চতুর্থ অধ্যায়
হিমালয় বললেন,
হে দেবী, তোমাকে আশ্রয় না করলে যদি জীবের মুক্তি অসম্ভব হয়, তাহলে আমাকে বলে দাও, কিভাবে তোমাকে আশ্রয় করতে হবে।।১।।
মা, মুক্তিপিপাসুরা তোমার কোন রূপটি ধ্যান করবে? যদি দেহের বন্ধন থেকে মুক্তি পেতে হয়, তাহলে তোমার প্রতিই যে পরাভক্তি রাখতে হবে।।২।।
পার্বতী বললেন,
এক হাজার মানুষের মধ্যে এক জন যদি সিদ্ধিলাভ করতে ইচ্ছুক হয়, তাহলে এমন এক হাজার সিদ্ধিলাভে ইচ্ছুক মানুষের মধ্যে এক জনই মাত্র আমার স্বরূপ জানতে পারে।।৩।।
বাবা, মুক্তিপিপাসুরা দেহের বন্ধন থেকে মুক্তিলাভের জন্য আমাকে সূক্ষ্ম, বাক্যের অতীত, নিষ্কলুষ, নির্গুণ, পরম জ্যোতির স্বরূপ, সর্বব্যাপী, একমাত্র কারণ, নির্বিকল্প, নিরালম্ব ও সচ্চিদানন্দ রূপে কল্পনা করবে।।৪।।
হে পর্বতরাজ, আমি সচ্চরিত্র ব্যক্তির সুমতি, পৃথিবীর পুণ্যগন্ধ গুণ, জলের রস ও চন্দ্রের প্রভা।।৫।।
আমি তপস্বীদের তপস্যা, আমি সূর্যের তেজ, আমি কামক্রোধ ইত্যাদি রহিত বলিগণের বল।।৬।।
হে রাজেন্দ্র পর্বতশ্রেষ্ঠ, সকল কাজের মধ্যে আমি পুণ্যকাজ, আমি ছন্দের মধ্যে সর্বোৎকৃষ্ট ছন্দ গায়ত্রী, আমি বীজমন্ত্রের মধ্যে ওঁকার, আবার আমিই সর্বভূতে ধর্ম-অবিরুদ্ধ কাম।।৭।।
এছাড়া সাত্ত্বিক, রাজসিক ও তামসিক–এই তিন প্রকার ভাব আমার থেকেই উৎপন্ন হয়েছে। তারা আমাতেই থেকে আমার অধীনস্থ আছে।।৮।।
হে পর্বতশ্রেষ্ঠ, আমি কখনই সেই ভাবসমূহের অধীনস্থ হই না। আমি সর্বপদার্থময় হয়েও অদ্বিতীয় ও অব্যয়–এই জানবে। কিন্তু আমার মায়ায় মুগ্ধ জীব আমাকে জানতে পারে না।।৯।।
যারা ভক্তি সহকারে আমার পূজা করে, তারাই এই মায়া থেকে উত্তীর্ণ হতে সমর্থ হয়, আমিই সৃষ্টির উদ্দেশ্যে ইচ্ছে করে স্ত্রী ও পুরুষ ভেদে আমার রূপ দুই প্রকারে কল্পিত করছি।।১০।।
শিবই সর্বশ্রেষ্ঠ পুরুষ এবং শিবানী পরমা শক্তি। শিব ও শক্তি একত্রে মিলে পূর্ণব্রহ্মরূপ হন। কিন্তু যোগীরা আমাকেই পরাৎপর শিবশক্তিরূপ ব্রহ্ম বলে থাকেন।।১১।।
আমিই ব্রহ্মরূপে এই চরাচর জগৎ সৃষ্টি করি এবং ইচ্ছার বশে মহারুদ্ররূপে তা সংহার করি।।১২।।
হে মহামতি, আমি বিষ্ণুরূপী পুরুষোত্তমরূপ ধারণ করে দুর্বৃত্তদের দমন করে এই সমস্ত জগৎ পালন করি।।১৩।।
হে মহামতি, আমিই মর্ত্যে এসে রাম প্রভৃতির রূপ ধরে দানবদের বধ করে পৃথিবী পালন করি।।১৪।।
বাবা, আমার শক্তিরূপই প্রধান বলে জেনো। কারণ, এই শক্তি বিনা পুরুষেরা কোনোরকম চেষ্টা বা কার্যকরণে সমর্থ হয় না।।১৫।।
হে রাজেন্দ্র, এই যে সব রূপ আর কালী প্রভৃতির রূপ–তা স্থূল বলে জেনো, আমার সূক্ষ্মরূপ কি, তা তোমার কাছে আগেই বলেছি।।১৬।।
হে পর্বতশ্রেষ্ঠ, আমার স্থূলরূপ চিন্তা না করলে, আমার সূক্ষ্মরূপ কোনোপ্রকারেই জানতে পারবে না, এবং তা না দেখলে মোক্ষলাভও হবে না।।১৭।।
সেই জন্য মুক্তিপিপাসু ব্যক্তিরা সর্বাগ্রে আমার স্থূলরূপ আশ্রয় করবে এবং ক্রিয়াযোগে তাঁকে বিধি অনুসারে পূজা করে ক্রমে ক্রমে আমার পরম অব্যয় সূক্ষ্মরূপ আলোচনা করবে।।১৮।।
হিমালয় বললেন,
মা, তোমার স্থূলরূপ অনেকগুলি। তার মধ্যে কোনটি আশ্রয় করে লোকে শীঘ্র মোক্ষলাভ করতে পারবে। আমাকে অনুগ্রহ করলে, হে মহাদেবী, তা আমার কাছে বর্ণনা করুন।।১৯।।
দেবী বললেন,
হে ভূধর, স্থূলরূপে আমি এই বিশ্বে ব্যাপ্ত হয়ে আছি, তার মধ্যে দৈবীমূর্তিই আশু মুক্তি প্রদান করে। সেই মূর্তিই আরাধ্যতমা।।২০।।
হে মহামতি, সেই দৈবীমূর্তিগুলির মধ্যে মুক্তিদায়িনী অনেক মহাবিদ্যা আছে, তুমি তাদের নাম শোনো।।২১।।
মহাকালী, তারা, ষোড়শী, ভুবনেশ্বরী, ভৈরবী, বগলা, ছিন্নমস্তা, ত্রিপুরসুন্দরী, ধূমাবতী ও মাতঙ্গী। এঁরা মানুষকে মোক্ষ প্রদান করেন। এঁদের প্রতি পরমাভক্তিসম্পন্ন মানুষ শীঘ্র মোক্ষপ্রাপ্ত হয়।।২২-২৩।।
বাবা, এই সকল মূর্তির একটিকে ক্রিয়াযোগে আশ্রয় করে আমার প্রতি মনোবুদ্ধি অর্পণ করলে আমাকেই পাওয়া যায়।।২৪।।
হে পর্বতাধিপ, যে মহাত্মাগণ আমাকে আশ্রয় করবেন, তাঁরা কখনই দুঃখময় অনিত্য পুনর্জন্ম লাভ করবেন না।।২৫।।
হে রাজা, যে যোগী একাগ্রমনে নিত্য সতত ভক্তিযোগে আমাকে স্মরণ করে, আমি তাকে মুক্তি প্রদান করি।।২৬।।
যে ব্যক্তি ভক্তির সঙ্গে আমাকে স্মরণ করতে করতে প্রাণত্যাগ করে, সংসারের দুঃখতরঙ্গ কখনই তাকে বাধা দিতে পারে না।।২৭।।
হে মহামতি, যারা ভক্তিভরে অনন্যমনে আমার পূজা করে, আমি নিত্য তাদের মুক্তি প্রদান করে থাকি।।২৮।।
হে মহারাজ, আমার শক্তিরূপ অনায়াসেই মুক্তি প্রদান করে, আপনি তা-ই আশ্রয় করে মোক্ষলাভে সমর্থ হন।।২৯।।
হে রাজেন্দ্র, যারা ভক্তি ও শ্রদ্ধাসহকারে অন্য দেবতাদেরও পূজা করে, তারা আমারই আরাধনা করে; এতে কোনো সংশয় নেই।।৩০।।
আমিই সর্বময়ী এবং আমিই সর্বযজ্ঞের ফলপ্রদাত্রী; কিন্তু যারা অন্য দেবতার ভক্ত, তাদের পক্ষে মুক্তি অতি দুর্লভ পদার্থ।।৩১।।
অতএব দেহবন্ধন থেকে মুক্তির জন্য আমারই শরণ নাও, তাহলে আমাকেই পাবে, তাতে আর কিঞ্চিত সন্দেহও নেই।।৩২।।
যাই কাজ করো, যাই খাও, যে হোমই করো, যা কিছুই দান করো–সব আমাকে সমর্পণ করলে কর্মবন্ধন থেকে মুক্তি পেতে পারবে।।৩৩।।
যে সব ভক্ত আমার পূজা করে, তারা আমাতেই অবস্থান করে এবং আমিও তাদের মধ্যেই অবস্থান করি। আমি তাদের কারোর অপ্রিয় নই, তাদের কেউই আমার অপ্রিয় নয়।।৩৪।।
কোনো পাপী যদি একমনে আমার পূজা করে, তাহলে সেও পাপমুক্ত হয়ে ভববন্ধন থেকে পরিত্রাণ পায়।।৩৫।।
হে পর্বতাধিপ, পাপী আমার পূজা করতে করতে ক্রমে ধর্মাত্মায় পরিণত হয়ে পরিত্রাণ লাভ করে। তাই আমার প্রতি ভক্তিপরায়ণ হলে মুক্তিলাভ নিশ্চিত।।৩৬।।
হে মহামতি, আপনি পরম ভক্তিভরে আমাতে আশ্রয় নিয়ে আমার প্রতি মন সমর্পণ করে আমার পূজা করুন। আমাকে নমস্কার করে আমার ধ্যান করুন। সংসারের দুঃখ আর আপনাকে বাধা দিতে পারবে না।।৩৭।।
চতুর্থ অধ্যায় সমাপ্ত।
পঞ্চম অধ্যায়
মহাদেব বললেন,
হে মুনি, এইভাবে পার্বতী যোগতত্ত্ব ব্যাখ্যা করলে পর্বতশ্রেষ্ঠ হিমালয় তা শুনে জীবন্মুক্ত হলেন।।১।।
মহেশ্বরী শৈলরাজকে যোগতত্ত্ব শুনিয়ে দুধের শিশুর মতো লীলাচ্ছলে মাতৃস্তন্য পান করতে লাগলেন।।২।।
পর্বতরাজ হিমালয়ের মহানন্দে এমন মহোৎসব করলেন যা, আগে কেউ দেখেওনি, শোনেওনি।।৩।।
পর্বতরাজ ষষ্ঠদিনে ষষ্ঠীপূজা করে দশম দিনে নিজের নামের সঙ্গে মেয়ের নাম রাখলেন পার্বতী।।৪।।
এইভাবে ত্রিভুবনে মা নিত্যা শ্রেষ্ঠা প্রকৃতি পার্বতী মেনকার গর্ভে জন্ম নিয়ে হিমালয়ের গৃহে অবস্থান করে পর্বতরাজকে উৎকৃষ্ট যোগতত্ত্ব ব্যাখ্যা করেছিলেন।।৫।।
হে মুনিশ্রেষ্ঠ নারদ, এই কথা যে পাঠ করে, তার মুক্তি সুলভ হয়। নিত্য মঙ্গলদাত্রী সর্বাণী তাঁর প্রতি পরিতুষ্টা হন এবং তাঁর সুদৃঢ়া ভক্তি উৎপন্ন হয়।।৬।।
অষ্টমী, নবমী ও চতুর্দশী তিথিতে ভক্তিসহকারে এই পার্বতীগীতা পাঠ করলে জীব মুক্তি পায়।।৭।।
শরৎকালে মহাষ্টমীতে উপবাস করে রাত জেগে যিনি এটি পাঠ করেন, তাঁর পুণ্যের কথা আর কি বলব।।৮।।
সেই দুর্গাভক্তিপরায়ণ সকল দেবতার বন্দনীয় হন এবং ইন্দ্র প্রভৃতি লোকপালগণ তাঁর বশবর্তী হয়ে থাকেন।।৯।।
সেই ব্যক্তি স্বয়ং মহেশ্বরীর প্রসাদে তাঁর স্বরূপত্ব লাভ করেন এবং তিনি যদি ব্রাহ্মণ-হত্যার পাপেও পাপী হন, তাহলেও তাঁর সব পাপ নষ্ট হয়ে যায়।।১০।।
তাঁর সর্বগুণসম্পন চিরজীবী রাজরাজেশ্বর পুত্রলাভ হয় এবং সমস্ত বিপদ দূর হয়ে নিত্য মঙ্গল লাভ হয়ে থাকে।।১১।।
অমাবস্যা তিথিতে ভক্তিসহকারে এই গীতা পাঠ করলে পাঠক সকল পাপ থেকে মুক্ত হয়ে দুর্গারই সমতুল্য হন।।১২।।
যিনি রাতে বেলগাছের তলায় বসে পাঠ করেন, এক বছরের মধ্যে দেবী তাঁকে দেখা দেন।।১৩।।
হে নারদ, তত্ত্বকথা শোনো, আর বেশি কি বলব, এই গীতাপাঠ তুল্য পুণ্য ধরাতলে নেই।।১৪।।
হে মুনিপ্রবর, তপস্যা ও যজ্ঞদানাদি করলে যে পুণ্যফল সঞ্চিত হয়, তার সংখ্যা হাতে গোনা; কিন্তু এই ভগবতী-গীতা পাঠের ফল অসংখ্য; সুতরাং তার সংখ্যা স্থির করা অসাধ্য।।১৫।।
ইতি শ্রীভগবতী-গীতা সমাপ্ত।
(উপেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের ‘গীতা-গ্রন্থাবলী’ গ্রন্থের অনুবাদ অবলম্বনে)
(আলোকচিত্র: অর্ণব দত্ত)