RSS

Monthly Archives: মে 2012

রাজস্থানি ভাষায় অনূদিত হল রবীন্দ্রনাথের গীতাঞ্জলি

বইপ্রকাশ অনুষ্ঠানে মুখ্যমন্ত্রী

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অমর কাব্যগ্রন্থ গীতাঞ্জলি অনূদিত হয়েছে ভারত ও বহির্ভারতের একাধিক ভাষায়। এই তালিকায় এবার সংযোজিত হল নতুন একটি নাম – রাজস্থানি। গত ১৬ মে, ২০১২ তারিখে কলকাতার ঐতিহাসিক টাউন হলে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাতে প্রকাশিত হল গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থের রাজস্থানি অনুবাদ অঞ্জলি গীতান রি। অনুবাদটি করেছেন বিশিষ্ট রাজস্থানি কবি ইকরাম রাজস্থানি।

অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন রাজ্যের অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র, নগরোন্নয়ন মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম, অভিনেতা প্রসেনজিৎ, শিল্পপতি হর্ষ নেওটিয়া প্রমুখ বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ। রবীন্দ্রসংগীত পরিবেশন করেন শিল্পী স্বাগতালক্ষ্মী দাশগুপ্ত।

মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই অনুষ্ঠানে রাজস্থান-বাংলার মৈত্রী সুদৃঢ় করার কথা বলেন। তিনি বলেন, “মানুষকে এক করা একটা মহৎ কাজ। এটি কবিকে সম্মান জানানো সঠিক উপায়।” রাজস্থানি ভাষায় কয়েকটি কথা বলে মুখ্যমন্ত্রী সবাইকে চমৎকৃতও করেন। অনুষ্ঠানের আয়োজক তথা প্রভা খৈতান ফাউন্ডেশনের কর্ণধার সন্দীপ ভুতোড়িয়া বলেন, “সারা দেশ রবীন্দ্রনাথের জন্মসার্ধশতবর্ষ পালন করছে। কিন্তু রাজস্থানের মানুষ ভাষাগত ব্যবধানের জন্য দীর্ঘকাল এই গ্রন্থ আস্বাদন করতে পারেননি। এই কাজ অনেক দিন আগেই হওয়া উচিত ছিল।” ফাউন্ডেশনের তরফ থেকে সনাতন দিন্দার আঁকা একটি রবীন্দ্র-প্রতিকৃতিও মুখ্যমন্ত্রীকে উপহার দেওয়া হয়। প্রসেনজিৎ বলেন, “ইকরাম রাজস্থানির কাব্য অনুবাদ বাংলা ও রাজস্থানের মধ্যে সাংস্কৃতিক সেতুবন্ধনের কাজ অনেক দূর এগিয়ে দেবে।”

 

ট্যাগ সমুহঃ

মাতৃতীর্থ জয়রামবাটী

যে গ্রামে জন্মিলা মাতাদেবী ঠাকুরানী।

পুণ্যময়ী লীলা-তীর্থ ধামে তারে গণি।।

শ্রীপ্রভুর পদরেণু বিকীর্ণ যেখানে।

বিধাতার সুদুর্লভ তপস্যা সাধনে।।

(শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণপুঁথি, অক্ষয়কুমার সেন)

নবদ্বীপধামে দেবী বিষ্ণুপ্রিয়া জয়রামবাটী এলে সারদা সাজিয়া,

জীর্ণ চীর বাসে নিজেরে ঢাকিয়া রাজলক্ষ্মী হ’লে যোগিনী।।

(মণীন্দ্রকুমার সরকার)

মাতৃমন্দিরে পূজিত মায়ের শ্বেতপাথরের মূর্তি

পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়া জেলার বিষ্ণুপুর মহকুমার অন্তঃপাতী জয়রামবাটী গ্রাম শ্রীশ্রীমা সারদা দেবীর পুণ্য জন্মস্থান। মা বলতেন–‘ওদের এখানে তিনরাত্রি বাস কত্তে বলো। এখানে তিনরাত্রি বাস কল্লে দেহ শুদ্ধ হয়ে যাবে, এটা শিবের পুরী কিনা।’ সত্যিসত্যিই মায়ের মন্দির নির্মাণের সময় ভিত খুঁড়তে গিয়ে পাওয়া গিয়েছিল একটি ছোটো কালো শিবলিঙ্গ। মাতৃমন্দিরের সিংহাসনে আজও সেটি পূজিত হয়।

জয়রামবাটী গ্রামের আদি নাম ছিল ‘তেঁতুলমুড়ি’। ‘জয়রামবাটী’ নাম কিভাবে এল, তা সঠিক জানা যায় না। মায়ের জীবনীকার স্বামী গম্ভীরানন্দ অনুমান করেন, সম্ভবত মায়ের পিতৃকুল মুখোপাধ্যায় বংশের কুলদেবতা রামচন্দ্র বা কোনো পুর্বপুরুষের নামে গ্রামের নতুন নামকরণ হয়েছিল। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের জন্মভূমি হুগলি জেলার কামারপুকুর গ্রাম থেকে জয়রামবাটীর দূরত্ব মাত্র সাড়ে তিন মাইল। ১৮৫৩ থেকে ১৮৫৯ সাল পর্যন্ত প্রায় ৬ বছর মা নিরবিচ্ছিন্নভাবে জয়রামবাটীতেই বাস করেছিলেন। বিয়ের পর কামারপুকুরের শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে মাঝে মাঝে থাকলেও ১৮৭২ সাল পর্যন্ত বেশিরভাগ সময় মা জয়রামবাটীতেই কাটান। এরপরও ১৮৯০ থেকে ১৯১৯ সাল পর্যন্ত জয়রামবাটীতেই বেশি ছিলেন তিনি।

শ্রীরামকৃষ্ণ একাধিকবার জয়রামবাটীতে এসেছিলেন। ঠাকুরের পার্ষদ ও মায়ের ভক্তশিষ্যদের মধ্যে কথামৃতকার শ্রীম, নাট্যাচার্য গিরিশচন্দ্র ঘোষ, স্বামী সারদানন্দ, স্বামী শিবানন্দ সহ অনেকেই জয়রামবাটী দর্শন করেছেন। স্বামী সারদানন্দই প্রথম জয়রামবাটীতে মাতৃমন্দির ও আশ্রয় স্থাপনে উদ্যোগী হন। তবে স্বামী বিবেকানন্দ এখানে এসেছিলেন কিনা, তা জানা যায় না।

Read the rest of this entry »

 

ট্যাগ সমুহঃ ,

যক্ষপ্রশ্ন (মহাভারত থেকে অনূদিত নির্বাচিত অংশ)

রচনা-পরিচিতি

বলা হয়, ‘যা নেই ভারতে, তা নেই ভারতে।’ অর্থাৎ মহাভারত-এ যা নেই, তা ভূভারতে নেই। হিন্দুদের দু-টি মহাকাব্যের অন্যতম হল মহাভারত। আঠারো পর্বে বিন্যস্ত এই মহাগ্রন্থ শুধুমাত্র বিশ্বের বৃহত্তম নীতিমূলক মহাকাব্যই নয়, বরং হিন্দুধর্মের বিশ্বকোষ-স্বরূপ। মহাকাব্যের মূল আলোচ্য বিষয় পাণ্ডব ও কৌরবদের পারিবারিক বিবাদের ইতিহাস। তা সত্ত্বেও হিন্দুধর্মের প্রতিটি আধ্যাত্মিক ও নীতিমূলক বিষয় এই বইতে আলোচিত হয়েছে।

এখানে অনূদিত ‘যক্ষপ্রশ্ন’ অংশটি মহাভারত-এর বনপর্ব-এর অন্তর্গত। এটি ছদ্মবেশী যমের সঙ্গে পাণ্ডবাগ্রজ যুধিষ্ঠিরের একটি কথোপকথন। যম যক্ষের রূপ ধরে এসে যুধিষ্ঠিরকে কতগুলি অদ্ভুত প্রশ্ন করেছিলেন। এই প্রশ্নের উত্তরে যুধিষ্ঠির খুব সংক্ষেপে ধর্মের কয়েকটি গূঢ় তত্ত্ব বর্ণনা করেন।

নির্বাচিত অংশ

যক্ষ বললেন–কিভাবে কোনো ব্যক্তি জ্ঞান অর্জন করতে পারে? কিভাবে সে মহৎ হতে পারে? কিভাবে সে দ্বিতীয় হতে পারে? এবং, হে রাজা, কিভাবে সে বুদ্ধিমান হতে পারে?

যুধিষ্ঠির বললেন–বেদ অধ্যয়ন করে একজন ব্যক্তি জ্ঞান অর্জন করতে পারে। সাধুসুলভ ব্রহ্মচর্য অবলম্বন করে সে মহৎ হতে পারে। সাহস অবলম্বন করে সে দ্বিতীয় হতে পারে। এবং গুরুজনের সেবা করে সে বুদ্ধিমান হতে পারে।

(শ্লোকসংখ্যা ৪৭-৪৮)

যক্ষ বললেন–ব্রাহ্মণদের দেবত্ব প্রতিষ্ঠিত হয় কিসে? ব্রাহ্মণের গুণ কী? ব্রাহ্মণদের মানুষ-সুলভ বৈশিষ্ট্য কী? এবং ব্রাহ্মণদের দোষ কী?

যুধিষ্ঠির বললেন–বেদ অধ্যয়ন ব্রাহ্মণদের মধ্যে দেবত্ব প্রতিষ্ঠা করে। ব্রহ্মচর্য ব্রাহ্মণের গুণ। নশ্বরতা ব্রাহ্মণের মানুষ-সুলভ বৈশিষ্ট্য। নিন্দাবাদ করা ব্রাহ্মণের দোষ।

(শ্লোকসংখ্যা ৪৯-৫০)

যক্ষ বললেন–কে পৃথিবীর চেয়েও ভারী? কে স্বর্গের চেয়েও উঁচু? কে বায়ুর চেয়েও দ্রুতগামী? ঘাসের চেয়েও সংখ্যায় বেশি কী?

যুধিষ্ঠির বললেন–মা পৃথিবীর চেয়েও ভারী। বাবা স্বর্গের চেয়েও উঁচু। মন বায়ুর চেয়েও দ্রুতগামী। দুশ্চিন্তা ঘাসের চেয়েও সংখ্যায় বেশি।

(শ্লোকসংখ্যা ৫৯-৬০)

Read the rest of this entry »

 

ট্যাগ সমুহঃ

জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি থেকে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়

———————————————-

বঙ্গভারতী পঁচিশে বৈশাখ স্মারক রচনা, ১৪১৯ (২০১২)

———————————————–

অর্ণব দত্ত

এই রচনার সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। লেখকের বিনা অনুমতিতে অন্যত্র প্রকাশ বেআইনি।

প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর

উত্তর কলকাতার পাদপ্রান্তে অবস্থিত জোড়াসাঁকো অঞ্চলের আদি নাম ছিল ‘মেছুয়াবাজার’। আড়াইশো বছর আগেকার এই মৎস্যজীবী-প্রধান অঞ্চল কালক্রমে কিভাবে হয়ে উঠল ‘বাংলার নবজাগরণের শিশুশয্যা’, সে এক দীর্ঘ ইতিহাস। ১৭৮৫ সালে কলকাতা শহরকে প্রথম যে ৩১টি থানায় ভাগ করা হয়েছিল, তার একটি ছিল এই জোড়াসাঁকো থানা। ক্রমে ক্রমে এই অঞ্চলে গড়ে ওঠে আদি ব্রাহ্মসমাজ, ভারতীয় নাট্যসমাজ, কলিকাতা হরিভক্তিপ্রদায়িনী সভা, মিনার্ভা লাইব্রেরি এবং কলকাতার প্রথম বেসরকারি স্কুল গৌরমোহন আঢ্যের ওরিয়েন্টাল সেমিনারি। জোড়াসাঁকোয় বসবাসকারী দু-টি পরিবারের সঙ্গে বাংলার নবজাগরণের নাম জড়িয়ে রয়েছে ওতোপ্রতোভাবে। একটি হল সিংহ পরিবার–যে পরিবারের সন্তান ছিলেন হুতোম পেঁচার নকশা-খ্যাত মহাভারত-অনুবাদক কালীপ্রসন্ন সিংহ। অপর পরিবারটি, বলাই বাহুল্য, বঙ্গদেশের সুবিখ্যাত ঠাকুর পরিবারের জোড়াসাঁকো শাখা। জোড়াসাঁকো থানা-গঠনের ঠিক এক বছর আগে ১৭৮৪ সালে প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের ঠাকুরদা নীলমণি ঠাকুর পাথুরিয়াঘাটার ঠাকুরদের সঙ্গে সব সম্পর্ক ছিন্ন করে চলে আসেন জোড়াসাঁকো অঞ্চলে। যে জমির উপর আজকের জোড়সাঁকো ঠাকুরবাড়ি তথা রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় দাঁড়িয়ে, সেই জমিটি নীলমণি ঠাকুর গৃহদেবতা লক্ষ্মীজনার্দন জিউয়ের নামে দেবোত্তর সম্পত্তি হিসেবে লাভ করেছিলেন কলকাতার বিশিষ্ট ধনী বৈষ্ণবচরণ শেঠের কাছ থেকে। এরপর অবস্থা আরও একটু স্বচ্ছল হলে নীলমণি সেই জমিতে বিরাট এক ইমারত তোলেন। জোড়াসাঁকো তখনও পর্যন্ত মেছুয়াবাজার নামেই পরিচিত ছিল। নীলমণি থেকে তাঁর নাতি দ্বারকানাথ পর্যন্ত জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি ছিল এক বিরাট জমিদারি ও ব্যবসাদারির কেন্দ্রস্থল। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের আমলে ব্রাহ্মধর্মের প্রসার বঙ্গ-সংস্কৃতির মুকুটে ঠাকুরবাড়ির এক নতুন পালক সংযোজন। তবে জমিদারি-কেন্দ্র থেকে ঠাকুরবাড়িকে যথাযথরূপে সাংস্কৃতিক পীঠস্থানে পরিণত করেছিলেন দেবেন্দ্রনাথের সন্তানসন্ততিগণ; যাঁদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাম। রবীন্দ্রনাথের জন্ম, কাব্যরচনা, সাহিত্যচর্চা, নাট্যাভিনয়, নোবেল-প্রাপ্তি, নাইটহুড-ত্যাগ, রাজনীতিদর্শন ও মহাপ্রয়াণের সঙ্গে এই বাড়ির নাম অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। রবীন্দ্রনাথ এবং তাঁর দাদা, বৌদি ও দিদিদের সুবাদে তৎকালীন ভারত ও বহির্ভারতের অনেক নামিদামি মানুষের পায়ের ধুলো পড়েছিল এই বাড়িতে। তাই বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় পাদে পশ্চিমবঙ্গ সরকার রবীন্দ্র-নামাঙ্কিত একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থাপনের জন্য বেছে নিয়েছিলেন এই বাড়িটিকেই। যার ফলস্রুতি, আজকের রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়।

রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের সূচনা

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর পর থেকেই ঠাকুর পরিবারের সদস্যরা একে একে জোড়াসাঁকোর বাস তুলে অন্যত্র চলে যান। বাড়ির দক্ষিণ-পূর্ব অংশের মালিকানা থেকে যায় গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের হাতে। কালক্রমে দেশভাগ ও স্বাধীনতা অর্জনের ডামাডোলে বাড়ির একটি বড়ো অংশই চলে যায় বহিরাগতদের হাতে। উনিশশো পঞ্চাশের দশকের গোড়ার দিকে রবীন্দ্রভারতী সোসাইটির তরফে সুরেন্দ্রনাথ মজুমদার পনেরো লক্ষ টাকা দিয়ে বাড়িটি কিনে নেন। পরে বাড়ির তদনীন্তন মালিক হাইকোর্টে মামলা করে আরও তিন লক্ষ টাকা দাবি আদায় করে। এর ফলে সুরেশচন্দ্র বেশ অর্থসংকটে পড়েন। তিনি পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কাছে সাহায্যের জন্য আবেদন জানান। এরপর পশ্চিমবঙ্গ সরকার ও রবীন্দ্রভারতী সোসাইটির মধ্যে একটি চুক্তি সাক্ষরিত হয়। সরকারি অনুদানের শর্ত হিসেবে ঠাকুরবাড়িতে সংগীত, নৃত্য ও নাটক শিক্ষার একটি আকাদেমি স্থাপনের প্রস্তাব রাখা হয়। এরপর ১৯৫৫ সালে স্থাপিত হয় পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য নৃত্য, নাটক, সংগীত ও চারুকলা আকাদেমি। উদয় শংকর, অহীন্দ্র চৌধুরী ও রমেশ বন্দ্যোপাধ্যায় যথাক্রমে নৃত্য, নাটক ও সংগীতের বিভাগীয় প্রধানের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। পরে অবশ্য উদয় শংকর তাঁর পদ থেকে পদত্যাগ করেছিলেন। ১৯৫৯ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকার আসন্ন রবীন্দ্র-জন্মশতবর্ষ উপলক্ষ্যে জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে রবীন্দ্রনাথের নামে একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের উদ্যোগ নেন। রবীন্দ্রভারতী সোসাইটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের পশ্চাতে সরকারের মূল উদ্দেশ্যটির সঙ্গে নিজেদের উদ্দেশ্যের সাদৃশ্য লক্ষ্য করে বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে মিশে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। কবি-পুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে আলোচনার পর পশ্চিমবঙ্গ সরকার সমগ্র ঠাকুরবাড়ির দখল নেন। বিচিত্রা ভবন থেকে সেই সময় বিশ্বভারতী গ্রন্থনবিভাগের কাজকর্ম চলত। বিশ্বভারতী বিচিত্রা ভবন খালি করে দেয়। জোড়াসাঁকোর পাশাপাশি বরানগর অঞ্চলে বি টি রোডের ধারে ১৮২০-এর দশকে নির্মিত মরকত কুঞ্জটিকেও বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি শিক্ষাপ্রাঙ্গনে পরিণত করা হয়। পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় পাস হওয়া রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় আইন রাষ্ট্রপতির সম্মতি পায় ১৯৬২ সালের ১০ জানুয়ারি। সেই বছরই পঁচিশে বৈশাখ যাত্রা শুরু হয় রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের।

Read the rest of this entry »

 

ট্যাগ সমুহঃ

উর্দুতে রবীন্দ্রসংগীত গাইছেন পাকিস্তানি পপ গায়ক

পাকিস্তানি পপ গায়ক নাজম শেরাজ

জনৈক পাকিস্তানি গায়কের কণ্ঠে উর্দুতে রবীন্দ্রসংগীত মন কেড়ে নিল পাকিস্তানবাসীর:

অগর মেরে গ়মকে ঘনেরে অন্ধেরে

তেরি রেহ্‌মতোঁ কে উজালোঁ সে চমকেঁ

চমকনে দে উনকো,

চমকনে দে মওলা

তুমহারি মহব্বত ভরিঁ এ নিগাহেঁ

আগর চশম্-এ-তর পার মেরি টিক রহি হ্যায়

তো আঁখো মেঁ আঁসু হি রহনে দে মওলা।

খুব চেনা চেনা লাগছে কী? বাংলা গানটি হল:

দুঃখের তিমিরে যদি জ্বলে তব মঙ্গল-আলোক

তবে তাই হোক ।।

মৃত্যু যদি কাছে আনে তোমার অমৃতময় লোক

তবে তাই হোক ।।

পুজার প্রদীপে তব জ্বলে যদি মম দীপ্ত শোক

তবে তাই হোক ।

অশ্রু-আঁখি-‘পরে যদি ফুটে ওঠে তব স্নেহচোখ

তবে তাই হোক ।।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

সারা ভারত যখন ভাসছে রবীন্দ্র সার্ধশতবর্ষ উদযাপনের জোয়ারে, তখন সীমান্তের ওপারে পাকিস্তানি পপ গায়ক নাজম শেরাজও বারোটি রবীন্দ্রগানের একটি অ্যালবাম প্রকাশ করলেন। বাংলা নয়, উর্দু অনুবাদে। শেরাজ পাকিস্তান, বাংলাদেশ ও ভারতে বেশ জনপ্রিয়। হিন্দি ছবি মার্ডারে তিনি ভিগি হোঁঠ নামে সেই বিখ্যাত গানটি গেয়েছিলেন। প্রায় এক বছর খেটেখুটে এই অ্যালবামটি বের করলেন শেরাজ। এই বছর মার্চে উর্দু অনুবাদে ১০০টি রবীন্দ্রকবিতার একটি সংকলন প্রকাশিত হয়েছে। অ্যালবামটি সেই প্রকল্পেরই অংশ।

রবীন্দ্রনাথের কবিতা অবশ্য আগেও উর্দুতে অনূদিত হয়েছে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য অনুবাদ ছিল ফিরাক গোরখপুরির অন্যবাদ। তিনি গীতাঞ্জলির কয়েকটি কবিতা অনুবাদ করেন। অনুবাদক নিয়াজ ফতেহপুরিও গীতাঞ্জলির কয়েকটি কবিতা অনুবাদ করেন। যেমন এটি:

আপনে কদমোঁ তলে

মুঝকো বিঝ জানে দো

ইক মুকাম্মাল খুশি কে লিয়ে

আপনে পাওঁ কি ধুল সে

সুর্খ হো জানে দো

মেরি পোষাক কো!

মূলগানটি বহুশ্রূত বাংলার লোকসুরের গান:

ওই      আসনতলের মাটির ‘পরে লুটিয়ে রব।

তোমার চরণ-ধুলায় ধুলায় ধূসর হব।

অ্যালবামের কভার

অ্যালবামটির নাম রাখা হয়েছে রোম্যান্সিং টেগোর। এই অ্যালবামের গানগুলি অনুবাদ করেছেন দিল্লিবাসী গীতিকার ইন্দিরা বর্মা ও কবি ড. রেহমান মুসাওয়ির। সংগীত আয়োজন করেছেন কলকাতার দেবজ্যোতি মিশ্র। শেরাজের সঙ্গে অ্যালবামে কণ্ঠ মিলিয়েছেন শুভা মুদগল ও কমলিনী মুখোপাধ্যায়।

লাহোরের সাপ্তাহিক দ্য ফ্রাইডে টাইমস পত্রিকায় রক্ষানন্দ জলিল এই অ্যালবামের সমালোচনায় লিখেছেন, “এই অনূদিত কবিতাগুলি কাব্যের অনিবর্চনীয় আনন্দ লাভে সহায়তা করে। অনুবাদগুলি মূল কবিতার মতোই সুশ্রাব্য হয়েছে। সংগীত পরিচালক রবীন্দ্রসংগীতের অনুরূপ সুরেই সংগীত আয়োজন করেছেন। এগুলি প্রথাগত উর্দু গজলের মতো করে গাওয়া হয়নি।”

তিনি আরও বলেছেন, উর্দু কবি ইকবাল বা ফৈজের মতো রবীন্দ্রনাথ ভারত-পাকিস্তান উভয়ের সম্পদ। উর্দুতে রবীন্দ্রনাথের অনুবাদ ও বাংলায় ফৈজের অনুবাদ তাই দুই দেশের সম্পর্কে মজবুত করবে।

শেরাজ বলেন, “রবীন্দ্রনাথ এমন একজন মানুষ যিনি জাতি হিসেবে ভারতকে সংস্কৃতি ক্ষেত্রে সমৃদ্ধ করে তুলেছেন। আমি তাঁর গান গাইছি। শ্রোতাদের সঙ্গে সুন্দর সম্পর্ক গড়ে তুলতে রবীন্দ্রনাথের জীবনী আমি সম্প্রতি পড়েছি। তিনি নিজেই একটি প্রতিষ্ঠান ছিলেন। বাংলা ভালবাসা, শান্তি ও আবেগে বিশ্বাস করে। আমি জানি না লোকের এই উর্দু অনুবাদ কেমন লাগবে। তবে এটুকু বলতে পারি, আমি মনপ্রাণ দিয়ে এতে কাজ করেছি।”

 

ট্যাগ সমুহঃ

গুজরাত ও রবীন্দ্রনাথ

মহাত্মা গান্ধী ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

সম্প্রতি গুজরাত সাহিত্য পরিষদ আয়োজিত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর উৎসবের দ্বিতীয় দিনে একটি আশ্চর্য তথ্য উঠে এল। রবীন্দ্রনাথের মেজদাদা সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিসত্ত্বাকে রবীন্দ্রনাথেরও আগে চিনেছিলেন গুজরাত ও আমেদাবাদবাসী। বিশিষ্ট  গুজরাতি কবি, প্রাবন্ধিক ও ঔপন্যাসিক প্রফুল্ল রাভাল এই দিন বলেন, “সত্যেন্দ্রনাথ ছিলেন আমেদাবাদে জেলা জজ। রবীন্দ্রনাথ মাঝে মাঝে তাঁর কাছে এসে থাকতেন। তবে স্থানীয় মাসিক পত্রিকা বসন্ত-এর সুবাদে সত্যেন্দ্রনাথের কবিতা রবীন্দ্রনাথের আগেই পড়ার সুযোগ পান আমেদাবাদবাসী।”

 

বসন্ত পত্রিকাটি চালাতেন আনন্দ শঙ্কর ধ্রুব। পত্রিকার প্রথম বর্ষের প্রথম সংখ্যায় প্রথম পৃষ্ঠাতেই ছিল সত্যেন্দ্রনাথের কবিতা। গুজরাতি ভাষায় তাঁর কবিতা অনুবাদ করেছিলেন কৃষ্ণ রাও ভোলানাথ। বসন্ত পত্রিকার একটি সংগ্রহ গুজরাত সাহিত্য পরিষদের গ্রন্থাগারে এখনও রাখা আছে এবং পাঠক তা পড়ারও সুযোগ পান।

 

রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে গুজরাতের সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে রাভাল বলেন, “১৯১৮ সালে রবীন্দ্রনাথের ডাকঘর নাটকটি গুজরাতিতে অনূদিত হয়। এটিই ছিল গুজরাতিতে অনূদিত প্রথম রবীন্দ্র-নাটক। পরের বছর ধ্রুব রবীন্দ্রনাথের মুকুট নাটকটিও অনুবাদ করেন।”

 

১৯১৩ সালে নোবেল-প্রাপ্তি রবীন্দ্রনাথকে এনে দিয়েছিল বিশ্বজোড়া খ্যাতি। তবে গুজরাতবাসী রবীন্দ্রনাথকে মনে রেখেছেন অন্য একটি বিশেষ কারণে। সেটি হল ১৯১৫ সালে মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের গভীর বন্ধুত্বের সম্পর্ক। রাভালের কথা থেকেই জানা যায়, ১৯১৫ থেকে ১৯৩০ পর্যন্ত সময়কালে গুজরাতের বহু যুবক শান্তিনিকেতনে গিয়ে কলা ও সাহিত্যের পাঠ নিয়েছিলেন। তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন প্রহ্লাদ পারেখ ও কৃষ্ণলাল সাধ্বানি। পারেখ কবিতা রচনায় দক্ষতা অর্জন করেন এবং সাধ্বানি কবিতা, ছোটোগল্প রচনা ও চিত্রকলা শিক্ষা করেন।

 

সূত্র: ডেইলি নিউজ অ্যান্ড অ্যানালাইসিস পত্রিকা, ৪ মে, ২০১২

 

ট্যাগ সমুহঃ

তামিল ভাষায় রবীন্দ্রনাথ

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

জানেন কি, রবীন্দ্রনাথের প্রায় ৮০ শতাংশ রচনা অনূদিত হয়েছে তামিল ভাষায়? হ্যাঁ, এই ভাবেই তামিল সংস্কৃতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ আসন দখল করে নিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

 

কবিগুরুর রচনার প্রথম তামিল অনুবাদ প্রকাশ করেছিল অ্যালাইন্স পাবলিশার্স। কবির জীবদ্দশাতেই তারা তাঁর রচনার তামিল অনুবাদ ছাপার স্বত্ব লাভ করে। রবীন্দ্র-রচনার তামিল অনুবাদের ক্ষেত্রে যে দু-জনের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য তাঁরা হলেন টি. এন. কুমারস্বামী ও টি. এন. সেনাপতি। এঁরা ছিলেন দুই ভাই। সরাসরি বাংলা থেকে তাঁরা কবির রচনা তামিলে অনুবাদ করেন। কুমারস্বামী নিজে ছিলেন একজন ঔপন্যাসিক ও ছোটোগল্পকার। তিনি নিজে বাংলা শিখে এই ভাষায় ব্যুৎপত্তি অর্জন করে। পরে তিনি তাঁর ছোটো ভাই সেনাপতিকেও বাংলা শেখান। তারপর অ্যালাইন্স পাবলিশার্সের হয়ে রবীন্দ্র-রচনার অনুবাদ শুরু করেন। কুমারস্বামীর পুত্র কে. অশ্বিন কুমার বলেন, “আমার বাবা ১৯৩০-এর দশকে বিশ্বভারতীতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা করে অনুবাদের প্রয়োজনীয় অনুমতি জোগাড় করে আনেন। অনুবাদের অধিকাংশ কাজ তাঁরই করা। তবে তাঁর ভাই সেনাপতিও কিছু অবদান রেখেছেন।” অ্যালাইন্স পাবলিশার্স ২৫ খণ্ডে তামিল রবীন্দ্র রচনাবলী প্রকাশ করেছিল। রবীন্দ্র জন্মসার্ধশতবর্ষ উপলক্ষ্যে তাঁরা সেই রচনাবলীর পুনর্মুদ্রণ করেছেন।

 

(বাঁদিক থেকে) টি. এন. কুমারস্বামী, টি. এন. সেনাপতি ও এ. শ্রীনিবাসরাঘবন

আরেক জন স্বনামধন্য তামিল রবীন্দ্র-অনুবাদক হলেন এ. শ্রীনিবাসরাঘবন। এই ইংরেজি সাহিত্যের এই খ্যাতনামা অধ্যাপক ১০০টি রবীন্দ্র-কবিতা তামিল ভাষায় অনুবাদ করেছিলেন। ২০০৫ সালে অধ্যাপক শ্রীনিবাসরাঘবনের জন্মশতবর্ষ উপলক্ষ্যে ছয় খণ্ডে তাঁর রচনাসমগ্র প্রকাশিত হয়। এই গ্রন্থমালার ষষ্ঠ খণ্ডটিতে শুধু রয়েছে তাঁর অনুবাদ করা রবীন্দ্রনাথের ১২০টি কবিতা। জন্মশতবর্ষ-উদযাপন কমিটির সদস্য তথা অল ইন্ডিয়া রেডিওর প্রাক্তন ডিরেক্টর বিজয় তিরুভেঙ্গাদাম বলেন, “শ্রীনিবাসরাঘবন কবিতাগুলি অনুবাদ করেছিলেন ইংরেজি অনুবাদ থেকে। তবে বাংলা ভাষার সৌন্দর্য ও ছন্দ রক্ষার জন্য তিনি কেন্দ্রীয় সামুদ্রিক মৎস্যচাষ গবেষণা প্রতিষ্ঠানের জীববিজ্ঞানী রবীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যের সাহায্য নিয়েছিলেন।”

 

করাইকুড়ির বাসিন্দা ভি. আর. এম. চেত্তিয়ারকে বলা হত ‘টেগোর-ভক্ত’। তিনি তীব্র অর্থসংকট সত্ত্বেও নিজের সমগ্র জীবন উৎসর্গ করেছিলেন তামিল ভাষায় রবীন্দ্রনাথের রচনা অনুবাদ ও প্রচারের কাজে। ১৯১৪ সালে তিরুচির সেন্ট জোসেফ কলেজে বন সম্পর্কে বক্তৃতা দিতে এসেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। সেখানেই চেত্তিয়ার প্রথম দেখেন তাঁকে। সেই সময় চেত্তিয়ারের বয়স ছিল অল্প। কবির কথা বিশেষ না বুঝলেও, কবির প্রতি গভীরভাবে আকৃষ্ট হন তিনি। এরপর ১৯২৯ সালে কবি যখন সাইগনে তখন কবিকে দ্বিতীয়বার দেখেন চেত্তিয়ার। কবির ভ্রমণের একটি বিস্তারিত বিবরণী তিনি প্রকাশ করেন “কবিতা মণ্ডলম” পত্রিকার ফেব্রুয়ারির শেষ সংখ্যায়। জানা যায়, চেত্তিয়ার একটি প্রকাশনাও চালাতেন শুধু রবীন্দ্র-রচনার অনুবাদ প্রকাশের জন্য। তবে অর্থসংকটের দরুন, বেশি দিন প্রকাশনার কাজ করে উঠতে পারেননি।

 

তথ্যসূত্র: দ্য হিন্দু পত্রিকা, ২ মে, ২০১২

 

ট্যাগ সমুহঃ

সিনেমা-শতবর্ষে সর্বোচ্চ সম্মানে ভূষিত সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়

সৌমিত্র এখন

৩ মে ২০১২। ভারতীয় সিনেমা পদার্পন করল শতবর্ষে। আর এই দিনই নতুন দিল্লির বিজ্ঞান ভবনে উপরাষ্ট্রপতি হামিদ আনসারি ৫৯তম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানে দেশের সর্বোচ্চ চলচ্চিত্র সম্মান দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার তুলে দিলেন বিশিষ্ট অভিনেতা ও আবৃত্তিশিল্পী সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের হাতে। সৌমিত্রবাবু অবশ্য প্রথম বাঙালি ফালকে-বিজেতা নন। তাঁর আগে এই সম্মানে ভূষিত হয়েছেন দেবিকা রানি, বি এন সরকার, পঙ্কজ কুমার মল্লিক, ধীরেন্দ্রনাথ গাঙ্গুলি, কানন দেবী, নীতিন বোস, রাইচাঁদ বড়াল, সত্যজিৎ রায়, হৃষিকেশ মুখোপাধ্যায়, মৃণাল সেন, তপন সিংহ ও মান্না দে। সেই হিসেবে সৌমিত্রবাবুই প্রথম পূর্ণ সময়ের বাঙালি পুরুষ অভিনেতা, যিনি এই সম্মানে ভূষিত হলেন। পুরস্কার গ্রহণের সময় সৌমিত্রবাবু বলেন:

এই মুহুর্তে কিছু বলার মতো মানসিক অবস্থা আমার নেই। সারা জীবন আমি সংশয়ে ছিলাম। হয়ত মনোরঞ্জনের এই ব্যবসা এ যুগের উপযোগী নয়। হয়তো আমার উচিত ছিল এ থেকে বেরিয়ে এসে মানুষের সেবা করা। কিন্তু এই পঞ্চাশ বছরে মানুষ আমাকে গ্রহণ করেছে, ভালবেসেছে। আমারও নিজেকে মনে হয়েছে তাদেরই একজন। আমার দৃষ্টিতে যা সুশিল্প, তা চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার শক্তি জোগানোর জন্য আমি তাদের ভালবাসি, সম্মান করি ও অভিবাদন জানাই।

১৯৩৫ সালের ১৯ জানুয়ারি পশ্চিমবঙ্গের নদিয়া জেলার কৃষ্ণনগরে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের জন্ম। তাঁর ছেলেবেলা কেটেছে কৃষ্ণনগর, হাওড়া ও কলকাতায়। সৌমিত্রবাবু কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্যে সাম্মানিক সহ স্নাতক ও পরে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। চলচ্চিত্র শিল্পে যোগ দেওয়ার আগে তিনি অল ইন্ডিয়া রেডিওতে কাজ করতেন।

১৯৫৯ সালে সত্যজিৎ রায়ে অপুর সংসার চলচ্চিত্রে অপুর চরিত্রে অভিনয়ের মাধ্যমে তাঁর চলচ্চিত্র জীবনের সূচনা। সত্যজিৎ রায় পরিচালিত ৩৪টি চলচ্চিত্রের মধ্যে ১৪টিতেই তিনি অভিনয় করেছিলেন। এজন্য তাঁকে বলা হয় ‘সত্যজিতের নায়ক’। আবার রবীন্দ্রনাথের কাহিনি অবলম্বনে নির্মিত অনেক কাহিনিচিত্রে সার্থক অভিনয় তাঁকে এনে দিয়েছিল ‘রবীন্দ্রনাথের নায়ক’ আখ্যা। মননশীল চলচ্চিত্রের পাশাপাশি মূলধারার চলচ্চিত্রেও তিনি ছিলেন জনপ্রিয় অভিনেতা। বাংলা গোয়েন্দা সাহিত্যের অমর সৃষ্টি ফেলুদার চরিত্রে তিনিই প্রথম রূপদান করেছিলেন।

সৌমিত্র তখন

সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় অভিনীত কয়েকটি উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্র হল: দেবী (১৯৬০), ক্ষুধিত পাষাণ (১৯৬০), ঝিন্দের বন্দী (১৯৬১), অভিযান (১৯৬২), অতল জলের আহ্বান (১৯৬২), সাত পাকে বাঁধা (১৯৬৩), চারুলতা (১৯৬৪), কিনু গোয়ালার গলি (১৯৬৪), আকাশ কুসুম (১৯৬৫), মণিহার (১৯৬৬), বাঘিনী (১৯৬৮), তিন ভুবনের পারে (১৯৬৯), অরণ্যের দিনরাত্রি (১৯৭০), স্ত্রী (১৯৭২), অশনি সংকেত (১৯৭৩), বসন্ত বিলাপ (১৯৭৩), সোনার কেল্লা (১৯৭৪), জয় বাবা ফেলুনাথ (১৯৭৮), দেবদাস (১৯৭৯), গণদেবতা (১৯৭৯), কোনি (১৯৮৬), আতঙ্ক (১৯৮৬), গণশত্রু (১৯৮৯), মহাপৃথিবী (১৯৯১), হুইলচেয়ার (১৯৯৪), অসুখ (১৯৯৯), পদক্ষেপ (২০০৬), ১৫ পার্ক এভিনিউ (২০০৬), বালিগঞ্জ কোর্ট  (২০০৭), অংশুমানের ছবি  (২০০৯), অপরাজিতা তুমি (২০১২) ইত্যাদি। কাজ করেছেন সত্যজিৎ রায়, তপন সিংহ, তরুণ মজুমদার, মৃণাল সেন, ঋতুপর্ণ ঘোষ প্রমুখ পরিচালকের সঙ্গে।

অভিনয়ের পাশাপাশি পেশাদার নাট্যমঞ্চেও সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় এক উল্লেখযোগ্য নাম। ১৯৬৩ সালে দেবনারায়ণ গুপ্তের পরিচালনায় তাপসী নাটকে তাঁর প্রথম পেশাদার নাট্যাভিনয়। এর পর অভিনয় করেছেন নামজীবন, রাজকুমার, ফেরা, নীলকণ্ঠ, ঘটক বিদায়, দর্পনে শরৎশশী, চন্দনপুরের চোর, ন্যায়মূর্তি, অন্ধযুগ, বিদেহী, টিকটিকি, প্রাণতপস্যা,  কুরবানি, আর একটা দিন, আরোহণ, আত্মকথা, হোমাপাখি, তৃতীয় অঙ্ক, অতএব ইত্যাদি নাটকে। এবছর তাঁর অভিনীত শেকসপিয়রের রাজা লিয়ার যথেষ্ট প্রশংসা কুড়িয়েছে।

১৯৭০-এর দশকে সৌমিত্রবাবু পদ্মশ্রী সম্মান প্রত্যাখ্যান করেন। তবে ২০০৪ সালে পদ্মভূষণ সম্মান গ্রহণ করেন। ২০০৮ সালে সুমন ঘোষের পদক্ষেপ ছবিতে অভিনয়ের জন্য শ্রেষ্ঠ অভিনেতা বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান। ফরাসি সরকার তাঁকে ফ্রান্সের সর্বোচ্চ কলা পুরস্কার ‘Officier des Arts et Metiers’ সম্মানে ভূষিত করেছে। লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্ট পুরস্কার দিয়েছে ইতালি সরকারও। ক্যাথেরিন বার্জে ফরাসি ভাষায় তাঁর উপর একটি তথ্যচিত্র নির্মাণ করেছেন।

 

ট্যাগ সমুহঃ