RSS

Monthly Archives: অক্টোবর 2012

পুরাণের অজানা লক্ষ্মী-কাহিনি

‘শ্রীশ্রীলক্ষ্মীদেবীর ব্রতকথা ও পাঁচালী’ নামক পাতলা চটি-বইটির দাপটে আমাদের এই বাংলায় লক্ষ্মী আপাদমস্তক লোকদেবী। লক্ষ্মীর বারব্রতই বলুন, কিংবা কোজাগরী বা দীপান্বিতা পূজাই বলুন, পৌরাণিক লক্ষ্মীর প্রবেশ যেন সেখানে আইন করে নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়েছে। একথা ঠিক যে, বিষ্ণু, শিব, দুর্গা প্রমুখ দেবদেবীদের দাপটে আমাদের পুরাণ শাস্ত্রগুলিকে লক্ষ্মী একটু ব্যাকফুটে চলে গিয়েছেন। কিন্তু তাই বলে ধনসম্পদের অধিষ্ঠাত্রী দেবীকে নিয়ে খুচরো গল্প পুরাণে কম ছড়িয়ে নেই। সমুদ্রমন্থনে লক্ষ্মীর উদ্ভবের গল্প অনেকের জানা। কিন্তু সেখানে লক্ষ্মী নীরব দর্শকমাত্র। সমুদ্র থেকে উঠেই নারায়ণের গলায় মালা দিয়ে বৈকুণ্ঠের গেরস্থালি সামলাতে শুরু করলেন। আর তারপরেই সেকালের পুরাণ শাস্ত্র থেকে আধুনিক হিন্দি সিরিয়ালে তাঁর কাজ হল নারায়ণের পা টিপে দেওয়া। সে গল্প বরং থাক। আসুন, লক্ষ্মীকে নিয়ে একটু অন্য ধরনের কয়েকটি গল্পের সন্ধান করা যাক।

উমার তপস্যা হিন্দু পুরাণের একটি জনপ্রিয় কাহিনি। সতী জন্মান্তরে হিমালয়ের ঘরে কন্যারূপে জন্ম নিয়ে শিবকে পতিরূপে পাওয়ার জন্য কঠোর তপস্যা করেছিলেন। স্কন্দপুরাণ থেকে জানা যায়, নারায়ণকে পেতে লক্ষ্মীও একই রকম তপস্যা করেছিলেন। ওই পুরাণের আবন্ত্য খণ্ডে আছে, লক্ষ্মী ঋষি ভৃগু ও তাঁর পত্নী খ্যাতির কন্যা। নরনারায়ণের বর্ণনা শুনে লক্ষ্মী তাঁর প্রেমে পড়ে যান। তাঁকে পতিরূপে পাওয়ার জন্য সাগরসীমায় গিয়ে তপস্যা শুরু করেন। এক হাজার বছর কঠোর তপস্যার পর ইন্দ্র ও অন্যান্য দেবতারা নারায়ণের ছদ্মবেশে এসে তাঁকে বর চাইতে বলেন। লক্ষ্মী বিশ্বরূপ দেখতে চান। দেবতাদের ছলনা ধরা পড়ে যায়। তাঁরা লজ্জিত হয়ে ফিরে যান। এই খবর পেয়ে নারায়ণ নিজে আসেন লক্ষ্মীর কাছে। তিনি লক্ষ্মীকে বর দিতে চাইলে লক্ষ্মী বলেন, “আপনি যদি সত্যিই নারায়ণ হন, তবে বিশ্বরূপ দর্শন করিয়ে আমার বিশ্বাস উৎপাদন করুন।” নারায়ণ তা-ই করে লক্ষ্মীর সংশয় দূর করেন। তারপর নারায়ণ তাঁকে বলেন, “ব্রহ্মচর্যই সব ধর্মের মূল ও সর্বোত্তম তপস্যা। যেহেতু তুমি ব্রহ্মচর্য অবলম্বন করে এখানে তপস্যা করেছো, সেহেতু আমিও ‘মূল শ্রীপতি’ নামে এখানে অবস্থান করব এবং তুমিও এখানে ব্রহ্মচর্য-স্বরূপা ‘ব্রাহ্মী মূলশ্রী’ নামে পরিচিত হবে।”

একটি আশ্চর্য লক্ষ্মী-উপাখ্যান পাওয়া যায় অদ্ভুত রামায়ণে। লক্ষ্মী একবার তাঁর সখীদের নিয়ে কৌশিক নামে এক বিষ্ণুভক্ত ব্রাহ্মণের বাড়ি গান শুনতে গিয়েছিলেন। সেখানে ব্রহ্মা ও অন্যান্য দেবতারাও গিয়েছিলেন গান শুনতে। কিন্তু তাঁরা যেতেই লক্ষ্মীর সহচরীরা তর্জন গর্জন করে তাঁদের দূরে সরে যেতে বলেন। দেবতারা লক্ষ্মীকে খুব সম্মান করতেন। তাঁরা কিছু না বলে সরে যান। শুধু নারদ এতে অপমান বোধ করেন। তিনি বুঝতে পারেন, লক্ষ্মীর সহচরীরা লক্ষ্মীর জ্ঞাতসারেই এই কাজ করেছে। তাই তিনি লক্ষ্মী-সহ সবাইকে রাক্ষসযোনিতে জন্মগ্রহণের অভিশাপ দেন। শাপের বর্ণনা শুনে লক্ষ্মী নারদের কাছে এক আশ্চর্য প্রার্থনা করেন। তিনি বলেন, যে রাক্ষসী স্বেচ্ছায় ঋষিদের রক্ত অল্প অল্প করে সঞ্চয় করে কলস পূর্ণ করবে, তিনি যেন তাঁরই গর্ভে জন্মগ্রহণ করেন। নারদ সেই প্রার্থনা মঞ্জুর করেন।

দেবীভাগবত পুরাণেও লক্ষ্মীকে নিয়ে এক আশ্চর্য কাহিনির সন্ধান মেলে। সূর্যের ছেলে রেবন্ত কোনো এক সময় উচ্চৈঃশ্রবা নামক ঘোড়ায় চড়ে বৈকুণ্ঠে বেড়াতে এসেছিলেন। উচ্চৈঃশ্রবা একে অশ্বরাজ, তায় লক্ষ্মীর মতোই সমুদ্রমন্থনের সময় উদ্ভুত। ঘোড়াটিকে লক্ষ্মী নিজের ভাইয়ের মতো দেখতেন। তাই উচ্চৈঃশ্রবা বৈকুণ্ঠে আসতেই তিনি স্বামীকে ছেড়ে ঘোড়ার আদরযত্ন নিয়ে পড়লেন। ঘোড়ার পিঠে বসে থাকা রেবন্তকে দেখে অবাক হলেন নারায়ণও। তিনি লক্ষ্মীকে জিজ্ঞাসা করলেন, “এই ছেলেটি কে?” লক্ষ্মী তখন ঘোড়ার আপ্যায়নে ব্যস্ত। কয়েকবার জিজ্ঞাসা করেও কথার উত্তর না পেয়ে লক্ষ্মীর উপর বেজায় খাপ্পা হয়ে উঠলেন নারায়ণ। স্ত্রীকে অভিশাপ দিয়ে বসলেন, “ঘোড়া নিয়ে এত আদিখ্যেতা যখন, তখন মর্ত্যে মাদীঘোড়া হয়ে জন্মাও গে!” যতই হোক, নারায়ণ লক্ষ্মীর স্বামী; লক্ষ্মীও নারায়ণের স্ত্রী। অভিশাপ শুনে লক্ষ্মীর খুব কষ্ট হল। নারায়ণকে জিজ্ঞাসা করলেন, কিভাবে তিনি শাপমুক্ত হয়ে আবার বৈকুণ্ঠে ফিরতে পারবেন। নারায়ণ বললেন, মর্ত্যে গিয়ে লক্ষ্মীর নারায়ণ-তুল্য এক ছেলে হবে। তারপরই লক্ষ্মী বৈকুণ্ঠে ফিরতে পারবেন। এরপর যথারীতি মর্ত্যে মাদী ঘোড়া হয়ে জন্মালেন লক্ষ্মী। মর্ত্যে গিয়ে তিনি শিবের তপস্যা করলেন। তপস্যায় তুষ্ট হয়ে শিব বর দিতে এলে লক্ষ্মী বললেন, তাঁর সন্তান যেন নারায়ণের ঔরসেই জন্মায়। শিবের পরামর্শে নারায়ণ হয়গ্রীব অবতার গ্রহণ করে ঘোটকীরূপিণী লক্ষ্মীকে বিয়ে করলেন। তাঁদের ছেলে হলে লক্ষ্মী শাপমুক্ত হয়ে বৈকুণ্ঠে ফিরে গেলেন।

এই দেবীভাগবত পুরাণেই লক্ষ্মীর চরিত্র বর্ণনা করতে গিয়ে বলা হয়েছে—তিনি পতিব্রতাদের মধ্যে প্রধান, সকল জীবের জীবন, স্বর্গে স্বর্গলক্ষ্মী, রাজগৃহে রাজলক্ষ্মী ও সাধারণ মর্ত্যবাসীর ঘরে গৃহলক্ষ্মী। তিনি বণিকদের কাছে বাণিজ্যলক্ষ্মী। আবার পাপীদের কলহ উৎপাদিনী। আমাদের বাংলার লক্ষ্মী ব্রতকথাগুলি পুরাণকথাকে আশ্রয় না করলেও, সেই সব উপকথার সারবস্তুর সঙ্গে এই পৌরাণিক বর্ণনার কী আশ্চর্য মিল দেখা যায়!

 
9 টি মন্তব্য

Posted by চালু করুন অক্টোবর 25, 2012 in পুরনো লেখা

 

ট্যাগ সমুহঃ

নবরাত্রি গোলু: দাক্ষিণাত্যের এক আশ্চর্য প্রথা

সুসজ্জিত নবরাত্রি গোলু।

নবরাত্রি উৎসবের সময় দক্ষিণ ভারতের চারটি রাজ্যে (তামিলনাড়ু, কেরল, অন্ধ্রপ্রদেশ ও কর্ণাটক) এবং শ্রীলঙ্কার তামিলদের মধ্যে একটি বিশেষ প্রথা পালিত হতে দেখা যায়। এটি হল “গোলু” বা “কোলু” প্রদর্শন। নানারকম পুতুল ও দেবমূর্তি একটি গ্যালারিতে সাজিয়ে প্রদর্শন করার নামই গোলু। গ্যালারির তাকগুলি সাধারণত ৭, ৯ বা ১১ বা কোনো বিজোড় সংখ্যায় থাকে। গোলুকে স্থানভেদে বোম্বে হাব্বা, বা বোম্মাই কোলু বা বোম্মালা কোলুভুও বলে। আমাদের বাংলার দুর্গাপূজায় নবপত্রিকা যেমন কৃষিসভ্যতার প্রতীক, দক্ষিণ ভারতীয় শারদ নবরাত্রির গোলুর সঙ্গেও কৃষিসভ্যতার সম্পর্ক খুব ঘনিষ্ঠ। কথিত আছে, আগেকার দিনে লোকে যাতে সেচখাল ও নদীখাতগুলি থেকে নিয়মিত পলি তুলে নেওয়ার অভ্যাস বজায় রাখতে পারে, তাই বিশেষ রকমের মাটির পুতুল দিয়ে গোলু সাজানোর উৎসবের প্রবর্তন করা হয়েছিল।

 

বাঙালি সমাজে যেমন দুর্গাপুজোয় ঠাকুর দেখতে যাওয়ার প্রথা আছে, দক্ষিণ ভারতেও আত্মীয়-অতিথিরা বাড়িতে বাড়িতে যান গোলু দর্শন করতে। এই সময় গোলু-দর্শনকারী কুমারী মেয়ে ও বিবাহিতা নারীদের হাতে প্রসাদ, কুমকুম আর একটা ছোটো উপহার-ভর্তি থলি তুলে দেওয়া হয়। সন্ধ্যাবেলা গোলুর সামনে “কোলাম” বা রঙিন আলপনার (রঙ্গোলি) মাঝে একটি ছোটো প্রদীপ জ্বেলে দেওয়া হয়। প্রদীপটিকে বলে “কুতুভিলাক্কু”। তারপর ভক্তিমূলক স্তবস্তোত্রাদি পাঠ করা হয়। পূজার পর দেবীর উদ্দেশ্যে ভোগ দেওয়া হয়।

 

গোলুতে নানারকম মূর্তি থাকে। বেশিরভাগ মূর্তিই পৌরাণিক দেবদেবীদের। নিয়ম হল, তার মধ্যে অন্তত একটি কাঠের পুতুল রাখা। সেই সঙ্গে একটি বালক ও একটি বালিকার পুতুলও থাকা চাই। এদের বলে “মারাপাচ্চি বোম্মাই”। মহানবমীর দিন দক্ষিণ ভারতীয়রা সরস্বতী পূজা করে। এই দিন তারা বাঙালিদের মতোই বইখাতা, বাদ্যযন্ত্র দেবীর পায়ের কাছে রেখে পুজো করে। পাশাপাশি, নানারকম যন্ত্রপাতি বা অস্ত্রশস্ত্র রেখে আয়ূধ পূজার প্রথাও আছে। এমনকি গাড়ি ভালো করে ধুয়ে ও সাজিয়ে সেগুলিকেও বিশেষভাবে পূজা করা হয়।

 

বিজয়াদশমীর দিনটি হিন্দুমাত্রেই পরম পবিত্র মনে করেন। এই দিন সব দেবশক্তির হাতে অশুভশক্তির চরম পরাজয় ঘটে। বিজয়াদশমীর দিন সন্ধ্যাবেলা গোলুর একটি পুতুলকে প্রতীকীভাবে ঘুম পাড়িয়ে দেওয়া হয়। আর কলসম বা ঘটটিকে উত্তর দিকে একটু সরিয়ে দিয়ে সেই বছরের গোলুর সমাপ্তি ঘোষণা করা হয়। গোলু উৎসব নির্বিঘ্নে শেষ করতে পারার জন্য বিশেষ প্রার্থনাও করা হয়। তারপর গোলুর পুতুল ও মূর্তিগুলিকে পরের বছরের জন্য তুলে রেখে দেওয়া হয়।

 

ট্যাগ সমুহঃ

হিন্দুশাস্ত্র: জ্ঞানকাণ্ড ও কর্মকাণ্ড

বিপিনবিহারী ঘোষাল সংকলিত হিন্দুশাস্ত্র: জ্ঞানকাণ্ড ও কর্মকাণ্ড (১৮৯৫) বই থেকে আধুনিক সরল বাংলা গদ্যে রূপান্তরিত।

আমাদের দেশের প্রাচীন ধর্মশাস্ত্রগুলিতে ধর্ম ও সাধনা সম্পর্কে যে বিভিন্ন রকম মত দেখতে পাওয়া যায়, প্রাচীন আর্য শাস্ত্রকারেরা সেগুলিকে দুটি প্রধান ভাগে ভাগ করেছিলেন এবং সেই সব বিভিন্ন রকম মত ও উপদেশগুলির মধ্যে যে একটা যোগ বা সম্বন্ধ আছে, তা-ও তাঁরা অনেক জায়গায় বলে গেছেন। যেমন—ভগবান শিব এক জায়গায় পার্বতীকে বলছেন,—

নানা তন্ত্রে পৃথক্‌ চেষ্টা ময়োক্তা গিরিনন্দিনি।

ঐক্যজ্ঞানং যদা দেবি তদা সিদ্ধিমবাপ্নুয়াৎ।।

মুণ্ডমালা তন্ত্র, ৬ পটল।

হে পার্বতী, আমি অধিকারী অনুসারে নানা তন্ত্রে নানা রকম সাধনা ও পূজা-উপাসনার বিধি দিয়েছি। সাধক যখন সেই সব নানা রকম ব্যবস্থার মধ্যেও ঐক্য দর্শন করে, তখন তার সিদ্ধিলাভ হয়।

প্রথমত, যাঁরা একটু বেশি জ্ঞান রাখেন ও চিন্তা করেন, যাঁদের বুদ্ধি সূক্ষ্ম তত্ত্বগুলি বুঝতে সক্ষম এবং যাগযজ্ঞ ইত্যাদি কর্মকাণ্ডের অনুষ্ঠানে যাঁদের পুরোপুরি শ্রদ্ধা বা তৃপ্তি জন্মায় না, তাঁদের জন্য শাস্ত্রকারেরা নিজের বিশ্বাস অনুযায়ী তত্ত্বজ্ঞান-স্বরূপ মহাসত্যগুলির উপদেশ দিয়েছেন। দ্বিতীয়ত, যাঁদের জ্ঞান তুলনামূলকভাবে অল্প বা যাঁরা এ সম্পর্কে ঠিকঠাক বিচার করতে পারেন না,[*] তাঁদেরও ধর্মপ্রবৃত্তি পরিতৃপ্ত করবার জন্য এবং ভবিষ্যতে তাদেরও তত্ত্বজ্ঞান লাভের উপযুক্ত করবার জন্য তাঁরা স্থূল ভাবের পূজা, উপাসনা বা অনুষ্ঠানপদ্ধতি লিপিবদ্ধ করে রেখেছেন।

প্রথমোক্ত সবল অধিকারী ব্যক্তিদের জন্য যে শাস্ত্রের উপদেশ দেওয়া হয়েছে, তার নাম জ্ঞানকাণ্ড; আর শেষোক্ত দুর্বল অধিকারীদের জন্য যে শাস্ত্র লেখা হয়েছে, তার নাম কর্মকাণ্ড।

কর্মকাণ্ডোজ্ঞানকাণ্ড ইতি ভেদোদ্বিধামতঃ।

ভবতি দ্বিবিধোভেদাজ্ঞানকাণ্ডস্য কর্মণঃ।।

শিব সংহিতা ১।২০

ভগবান শিব বললেন—

জ্ঞানকাণ্ড ও কর্মকাণ্ড ভেদে শাস্ত্রে দুই রকম মত দেখা যায়। জ্ঞানকাণ্ড ও কর্মকাণ্ড—এগুলি আবার দুটি দুটি করে ভাগে বিভক্ত।

বেদস্তাবৎ কাণ্ডদ্বয়াত্মকঃ।

তত্র পূর্বস্মিন্‌ কাণ্ডে নিত্যনৈমিত্তিককাম্যনিষিদ্ধরূপং

চতুর্বিধং কর্ম প্রতিপাদ্যং।

তৈত্তিরীয় সংহিতা ১৭১।১

সমগ্র বেদ দুই ভাগে বা দুই কাণ্ডে বিভক্ত। তার মধ্যে পূর্বকাণ্ডে নিত্য, নৈমিত্তিক, কাম্য ও নিষিদ্ধ এই চার রকমের কর্মের বিষয় বর্ণিত হয়েছে।

অত উত্তরকাণ্ড আরব্ধব্যঃ। আত্যন্তিকপুরুষার্থসিদ্ধিশ্চ দ্বিবিধা। সদ্যোমুক্তিঃ ক্রমমুক্তিশ্চেতি। তস্মাদুত্তরকাণ্ডে ব্রহ্মোপদেশ-ব্রহ্মোপাস্তিশ্চেত্যুভয়ং প্রতিপাদ্যতে।

তৈত্তিরীয় সংহিতা, প্রথম কাণ্ড, প্রথম প্রপাঠক, প্রথম অনুবাক্‌।

তারপর উত্তরকাণ্ডে সদ্যোমুক্তি ও ক্রমমুক্তি নামে দুই রকম আত্যন্তিক পুরুষার্থসিদ্ধির বিষয় নির্ণয় করা হয়েছে। এজন্য উত্তরকাণ্ডে ব্রহ্মবিষয়ক উপদেশ ও ব্রহ্মোপাসনা এই দুইটি বিষয় আলোচনা করা হয়।

দ্বাবিমাবথ পন্থানৌ যত্র বেদাঃ প্রতিষ্ঠিতাঃ।

প্রবৃত্তিলক্ষণো ধর্মো নিবৃত্তৌ চ বিভাষিতঃ।।

বাজসনেয় সংহিতার ভাষ্যে শঙ্করাচার্যের বাণী

বেদে দুই রকম ধর্ম প্রতিষ্ঠিত আছে। যথা—(১) প্রবৃত্তিলক্ষণ ধর্ম বা কর্মকাণ্ড, এবং (২) নিবৃত্তিলক্ষণ ধর্ম বা জ্ঞানকাণ্ড।

এই কর্মকাণ্ড ও জ্ঞানকাণ্ডের মধ্যে কর্মকাণ্ড বিনাশী, অর্থাৎ অনিত্য ফল দান করে এবং জ্ঞানকাণ্ড অবিনাশী, অর্থাৎ অনন্ত ফলদায়ী। যেমন, ব্যাসদেব শুকদেবকে বলেছেন—

কর্মবিদ্যাময়াবেতৌ ব্যাখ্যাস্যামি ক্ষরাক্ষরৌ।

মহাভারত, মোক্ষধর্ম পর্বাধ্যায় ৬৭।৩

নশ্বর কর্ম এবং অবিনশ্বর জ্ঞান-এই দুইয়ের বিষয় আমি তোমার কাছে বর্ণনা করছি।


[*] উন্নত ও গভীর বিষয়গুলি সর্বদা মনের মধ্যে বিচার করতে অভ্যাস করা বিশেষ প্রয়োজনীয়। মানুষের মধ্যে যাঁরা চিন্তাশীল নন, তাঁরা একরকম মানুষের মধ্যে গণ্যই নন, একথা আমাদের দেশের শাস্ত্রকারের বার বার বলে গিয়েছেন। যিনি চিন্তাশীল নন, তিনি হাজার রকম বিদ্যে শিখলেও জ্ঞানহীনদের মধ্যেই গণ্য হন।

টমাস কার্লাইল তাঁর এক চিঠিতে লিখেছেন—

“It is not books alone, or by books chiefly that a man becomes in all points a man.”

Treasury of Modern Biography, p. 293.

বিশিষ্ট আমেরিকান বুদ্ধিজীবী এমারসন বলেছেন—

“The man who thinks is the king; all else are journeymen.”

An Evening with Emerson.

by David Maerae, in The Americans at Home.

 

ট্যাগ সমুহঃ

দুর্গা-পরিবার

[পূর্ববর্তী পোস্টে কিশোরীলাল রায় রচিত দেবতত্ত্ব (১৮৮৫) গ্রন্থ থেকে দেবী দুর্গা, জগদ্ধাত্রী ও কালী—এই দেবীত্রয়ীর স্বরূপ বর্ণনা করা হয়েছে। এই পোস্টে ওই একই বই অবলম্বনে দেবী দুর্গার সঙ্গে পূজিত শিব, গণেশ, লক্ষ্মী, সরস্বতী ও কার্তিকের স্বরূপ বর্ণনা করা হল। এই লেখাটি মূল রচনার আধুনিক সরল বাংলা গদ্যে রূপান্তরণ।]

 

দুর্গা পরিবার

শিব

প্রলয়কর্তা অর্থে ঈশ্বরের নাম শিব। কিছুকাল না গেলে কোনো বস্তুর ধ্বংস অসম্ভব। তাই শিবকে কাল ও মহাকালও বলা হয়। যিনি সব কিছুর ধ্বংসকর্তা তাঁর আবার ধ্বংস কী? সুতরাং শিবের একটি বিশেষ নাম মৃত্যুঞ্জয়। বিশ্বকে ঈশ্বরের শরীর বলা হয়েছে। শিবোপাসকগণ মনে করেন ও সাধারণতও এই বিশ্বাস প্রবল দেখা যায় যে, মহাদেবের ললাটে ও মানুষের চোখের মতো তিনটি চোখ আছে। বাস্তবিক তা নয়। সূর্য, চাঁদ ও আগুনই মহাদেবের তিন চোখ, তাই তিনি ত্রিলোচন। যথা, শঙ্করাচার্য-কৃত অপবাদভঞ্জন স্তোত্রে “বন্দে সূর্যশশাঙ্ক বহ্নিনয়নং” ইত্যাদি। তিন চোখ তিন রকমের বলে মহাদেবের এক নাম বিরুপাক্ষ। জীর্ণদশায় প্রলয় ঘটে ও কালের বয়স অপরিমেয় বলে মহাদেবের মূর্তি বুড়ো মানুষের শরীরের মতো কল্পিত হয়েছে, তাঁকে প্রায় সর্বদা বৃদ্ধ বলে বর্ণনা কর হয়। চিতাভস্ম, শ্মশান ও নরমুণ্ড প্রভৃতি ধ্বংস বা মৃত্যুর স্মারক বলে ওই সবের দ্বারা তাঁকে দেখা হয়েছে। ধ্বংসকর্তা স্বয়ং মৃত্যুঞ্জয়, সুতরাং তাঁর মৃত্যুঞ্জয়ত্ব দেখানোর জন্য তিনি বিষধর সর্পজড়িত বলে বর্ণিত। মহাদেবরূপী কাল ও জড়জগৎরূপী প্রকৃতি সংযোগেই সব কিছুর উৎপত্তি হয়, সুতরাং মহাদেব ও দুর্গাকে জগতের পিতা ও মাতা বলা হয়েছে। কালিদাস বলেছেন “জগতঃ পিতরৌ বন্দে পার্বতী পরমেশ্বরৌ।” এই জন্য শিবলিঙ্গ ও গৌরীপট্টেরও কল্পনা। শবশিবারূঢ়া কালীমূর্তি, শক্তিহীন হলে শিবের যে অবস্থা ঘটে তা দেখানোর জন্য কল্পিত হয়েছে। কালী মহাদেবের শক্তি, সুতরাং শিবের দেহ থেকে শক্তি পৃথক হয়ে বেরিয়ে এলে শিব শক্তিহীন হয়ে শবের মতো পড়ে থাকেন। শঙ্করাচার্য আনন্দলহরীতে বলেছেন, “শিবঃ-শক্ত্যা-যুক্তো ভবতি শক্তঃ প্রভবিতুং। নচদেবং দেবোনখলু কুশলঃ স্পন্দিতুমপি।” অর্থাৎ, শিবের প্রভাব শক্তিযুক্ত থাকলেই; নয়তো তাঁহার নড়াচড়ার শক্তিও থাকে না। ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণের প্রকৃতি খণ্ডেও ওই কথা আছে। “শিবশক্তস্তয়া শক্ত্যাশবাকার স্তয়া বিনা।” অর্থাৎ, শিব শক্তিসহ থাকলেই শক্তিমান, নচেৎ শবাকার হন। মহাদেবকে বৃষবাহন বলার তাৎপর্য্য এই যে, কালের গতি বৃষভের গতির মতো ধীর অথচ নিশ্চিত। মেঘই মহাদেবের জটাজুট, সুতরাং শিবজটা থেকে গঙ্গার নির্গম হয় এর অর্থ এই যে, মেঘ থেকে জল নির্গত হয়। মহাদেবকে ভোলামহেশ্বর ও ধুস্তরফলাদি ভক্ষণকারী বলার তাৎপর্য এই যে, কালকে অনেক সময় মদবিহ্বল ব্যক্তির মতো কাজ করতে দেখা যায়। যেমন দুর্যোধনের রাজ্যভোগ ও যুধিষ্ঠিরের বনবাস প্রভৃতি। মহাদেব বৃদ্ধ কিন্তু উমা নিত্যযৌবনা, এর তাৎপর্য এই যে সময় একবার গেলে আর ফেরে না এবং তার বয়সেরও অন্ত নেই। কিন্তু পৃথিবী প্রতি বছর অভিনব বেশ ধারণ করে ও একবার বসন্ত শেষ হলেও তা বার বার আসতে থাকে।

 

কাল শূন্যের অনুরূপ ও আচ্ছাদনবিহীন বলে তাকে শ্বেতকায় ও দিগম্বর বলা হয়েছে। মহাদেবকে আদিদেব বলার তাৎপর্য এই যে, সবার আগেও কাল বিদ্যমান ছিল। সবই কালে ঘটছে। সুতরাং মহাদেব সর্বজ্ঞ, কালেই জ্ঞানলাভ হয়, সুতরাং তিনি জ্ঞানদাতা, এবং যশস্বী মহাত্মাদের কাল বাঁচিয়ে রাখে, সুতরাং তিনি ভক্তমুণ্ডমালী। মহাভারতে সুরথ সুধন্বার মুণ্ডগ্রহণ করার জন্য মহাদেবের যে আগ্রহ বর্ণিত হয়েছে, তাতে তাঁকে ভক্তমুণ্ডমালী শব্দের বাচ্য করে তুলেছে বলতে হবে।

 

অনন্ত বা শূন্যের বলরামরূপ কল্পনা করে কালের কল্পিতরূপ মহাদেবের সদৃশ করা হয়েছে। একটি মনোহরশায়ী গানেও বলা হয়েছে, “তার পর একজন বৃষভেতে আরোহণ, দাদা বলাইর মতন।” বাস্তবিক বলরাম ও মহাদেবের রূপে বিলক্ষণ সাদৃশ্য আছে। অনন্ত কাল অনন্ত আকাশের সদৃশ্যই বটে। শাস্ত্রে অনেক জায়গায় শিব ও দুর্গাকে পুরুষ ও প্রকৃতিও বলা হয়েছে।

 

রুদ্রের আট রকম শরীরের বর্ণনাও আছে। যথা— সূর্য, জল, পৃথিবী, অগ্নি, আকাশ, বায়ু, দীক্ষিত ব্রাহ্মণ ও চন্দ্র। দীক্ষিত ব্রাহ্মণের বদলে কোনো কোনো স্থলে জীব লেখা হয়েছে।

 

গণেশ

সিদ্ধির অধিষ্ঠাত্রী দেবতা অর্থে ঈশ্বরের নাম গণেশ। আগে সিদ্ধিকামনা করেই লোকে সব কাজে হাত লাগায়। সুতরাং সব দেবতার আগেই গণেশের পূজার নিয়ম হয়েছে। ইঁদুর নানা রকম বস্তু কেটে দেয়, সুতরাং বিঘ্নছেদনকারীর বাহন কল্পনা করতে ইঁদুরই সুসঙ্গত হয়। বিঘ্নস্বরূপ অন্ধকারের কাছে জ্যোতিস্বরূপ বলে গণেশের গায়ের রং সিঁদুরের মতো। হাতি যেমন শুঁড় দিয়ে জল তুলে ইচ্ছা মতো পান করে বা ফুঁ দিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দেয়, সেই রকম গণেশও ইচ্ছামতো বিঘ্নরাশি তুলে দূরে ফেলে দিতে পারেন। তাই তাঁকে গজানন (অর্থাৎ, যাঁর হাতির মতো মুখ) বলে বর্ণনা করা হয়েছে। সমস্ত সিদ্ধি তিনি নিজেতে সঞ্চিত করে রেখেছেন, তাই তাঁকে লম্বোদর বলে।

 

লক্ষ্মী

শোভা ও সম্পত্তির অধিষ্ঠাত্রী দেবতা এই অর্থে ঈশ্বরের নাম লক্ষ্মী। চন্দ্র খুবই সুন্দর, তাই চন্দ্রকে লক্ষ্মীর ভাই বলা হয়। সম্পত্তি কারো কাছে স্থির থাকে না, সুতরাং লক্ষ্মী চঞ্চলা। পদ্মবন অত্যন্ত সুন্দর জায়গা, তাই লক্ষ্মীর নাম পদ্মালয়া। শোভাতে কামের জন্ম হয়, তাই লক্ষ্মী কন্দর্প বা কামদেবের জননী বলে অভিহিত হয়েছেন।

 

সরস্বতী

বাক্যের সঙ্গে জ্ঞান সংশ্লিষ্ট। অতএব সরস্বতী কেবল শব্দের অধিষ্ঠাত্রী দেবতাই নন, জ্ঞানাধিষ্ঠাত্রী দেবতাও বটে। বেদ ছাড়া অন্যান্য বিদ্যা ও বাক্যের অধিপতি—এই অর্থে ঈশ্বরের নাম সরস্বতী। বেদের অধিপতি অর্থে তাঁর নাম সাবিত্রী (এই সাবিত্রী-সত্যবান কাহিনির পৌরাণিক চরিত্র নন)। সরস্বতীকে শ্বেতপদ্মে অধিষ্ঠিতা, শ্বেতবস্ত্র পরিহিতা, শ্বেতবর্ণা ও শ্বেতবীণাধরা বলার তাৎপর্য এই যে— বিদ্যা দিয়ে মনের অজ্ঞান-অন্ধকার দূর হয়, সুতরাং অজ্ঞান অন্ধকার-স্বরূপ, বিদ্যা আলোক স্বরূপ। এবং আলোক স্বরূপ প্রকাশে শ্বেতবর্ণের আবশ্যক। সরস্বতীর হাতে বই; কারণ বইই জ্ঞানের ভাণ্ডারস্বরূপ। অতএব দেখা যাচ্ছে যে নিরাকারা সরস্বতীর রূপ কল্পনা করতে হলে তাঁকে শ্বেতবর্ণ-বিশিষ্ট বলে কল্পনা করলেই প্রশংসনীয় রূপক হয়। ধর্মতত্ত্ব-এর কোনো লেখক যথার্থই বলেছেন যে, মাঘমাসে সরস্বতী পূজা বিহিত হওয়ার কারণ এই যে, এই সময়ে বসন্তের ছায়া পড়ে এবং বসন্তকালই সঙ্গীতবিলাসের সর্বোৎকৃষ্ট সময়। বাস্তবিক সঙ্গীতেশ্বরীর আরাধনা বসন্তের প্রারম্ভেই হওয়া উচিত। সরস্বতী যে শাস্ত্রকারগণের মতে ঈশ্বরের নামান্তর মাত্র; তা “বিশ্বরূপা বিশালাক্ষী” ইত্যাদি বাক্য আলোচনা করলেই বোঝা যাবে।

 

কার্তিক

কেবল সংগ্রামের অধিষ্ঠাত্রী দেবতা, এই অর্থে ঈশ্বরের নাম কার্তিক। যুদ্ধদেবের মতি তেজোময় হওয়া উচিত, সুতরাং কার্তিকেয়কে অগ্নির পুত্রও বলা হয়েছে। কৃত্তিকা নামক আগুনরঙা ছয়টি তারা, ঐ অগ্নির পুত্র বা মহাদেবের পুত্রকে পালন করেছিলেন, এই জন্য তাঁর নাম কার্তিকেয় বা ষড়ানন হয়েছে। অগ্নির মত তেজবিশিষ্ট দেবতার অগ্নিবর্ণা পালয়িত্রী কল্পনা করাই যুক্তিসঙ্গত। যোদ্ধা ও সুন্দরবর্ণ ময়ূরই কার্তিকের উপযুক্ত বাহন। যোদ্ধারা ভালভাবে রণসজ্জা করে ভাল একটা বাহনে চেপেই যুদ্ধক্ষেত্রে যান; সুতরাং যুদ্ধের অধিষ্ঠাত্রী দেবতা অর্থে ঈশ্বরের রূপ ও বাহনাদি কল্পনা করতে হলে, তাঁকে অতি সুন্দর পুরুষ ও সুন্দর বাহনে আরূঢ় বলেই বর্ণনা করতে হয়।

 

ট্যাগ সমুহঃ

দুর্গা-জগদ্ধাত্রী-কালী

[কিশোরীলাল রায় রচিত দেবতত্ত্ব (১৮৮৫) গ্রন্থ থেকে আধুনিক সরল বাংলা গদ্যে রূপান্তরিত।]

সপরিবার দুর্গা

মূল প্রকৃতিকে ঈশ্বরের সৃষ্টিশক্তি বা মায়াশক্তি বলে। আবার পঞ্চভূত ইত্যাদি জড় পদার্থের সমষ্টিকেও প্রকৃতি বলে। দুর্গা মূল প্রকৃতির এক অংশ। ব্রহ্মাণ্ডব্যাপী ও দুর্গতিনাশকারী—এই অর্থে ঈশ্বরের নাম দুর্গা। জড় পদার্থ জগৎ, পর্বত সবকিছু দিয়ে ধরা আছে; আর পর্বতের মধ্যে হিমালয় সবচেয়ে বড়ো—অতএব দুর্গাকে পার্বতী ও হিমালয়নন্দিনী বলে। গঙ্গাকেও হিমালয়নন্দিনী বলে, যেহেতু তা হিমালয় থেকে নিঃসৃত হয়েছে সাগর-অভিমুখে প্রবাহিত হয়েছে। এই জন্যই দুর্গাকে গঙ্গার সপত্নী বলে। কিন্তু মহাশক্তির অধিষ্ঠাত্রী দেবতা অর্থেই সচরাচর ঈশ্বরকে দুর্গা বলে বর্ণনা করা হয়েছে। দশ হাতই সেই অর্থে মহাশক্তির পরিচায়ক। পরাক্রমাধিষ্ঠাত্রী দেবতার সিংহই উপযুক্ত বাহন। দুর্জন বা অসুরেরাই জগতের দুর্গতির প্রধান কারণ, অতএব দুর্গা অসুরনাশিনী বলে বর্ণিত হয়েই একপ্রকারে দুর্গতিনাশিনী বলে বর্ণিত হয়েছেন। যখন নানা রকমের দুর্গতি আছে, তখন অন্য প্রকার দুর্গতিনাশিনী অর্থেও দুর্গাকে দুর্গা বলা যায়। শারদীয়া দুর্গাপ্রতিমার সঙ্গে সরস্বতী ও কার্তিক ইত্যাদি মূর্তিও দেখা যায়। এর তাৎপর্য এই যে, দুর্গতিনাশিনী মহাশক্তির থেকেই যখন যুদ্ধশক্তি উৎপন্ন হয়, তখন যুদ্ধদেবতা কার্তিককে দুর্গার ছেলে বলা যায়। যখন ওই মহাশক্তি থেকেই দুর্গতি ও বিঘ্ন বিনষ্ট হয়ে সিদ্ধি প্রাপ্ত হওয়া যায়, তখন সিদ্ধিদেবতা গণেশও দুর্গার সন্তান বলে পরিগণিত হতে পারে। একই রকম ভাবে বাকশক্তি ও জ্ঞানশক্তি দ্বারাও দুর্গতি দূর হয় বলে এবং তা মহাশক্তির এক অংশ বলে সেই শক্তির অধিষ্ঠাত্রী দেবতা সরস্বতীকেও দুর্গার সঙ্গে দেখা যায়। মহাশক্তির অংশ—তাই শোভা ও সম্পত্তির অধিষ্ঠাত্রী দেবতা লক্ষ্মীও দুর্গার পাশে বিরাজ করেন। মহাশক্তি বলে দুর্গাকে নিদ্রা, ক্ষুধা, লজ্জা, তুষ্টি, আগুনের দাহিকা শক্তি, সূর্যের তেজ, জলের শীতলতা, ব্রাহ্মণের ব্রহ্মণ্যশক্তি, ক্ষত্রিয়ের ক্ষত্রিয়শক্তি, তপস্বীর তপস্যাশক্তি, ক্ষমাবানের ক্ষমাশক্তি, পৃথিবীর ধারণ ও শস্য-উৎপাদন ক্ষমতা প্রভৃতি বলে স্তব করা হয়েছে ও হয়ে থাকে। যাঁরা শাস্ত্রতত্ত্ব বোঝেন না, তাঁরাই মাটির দুর্গাপ্রতিমাকে দুর্গা মনে করেন। কিন্তু জ্ঞানী ও শাস্ত্রজ্ঞ ব্যক্তি বুঝতে পারেন যে, ঈশ্বরকেই অবস্থা বিশেষে দুর্গা বলে বর্ণনা করা হয়েছে। যথা—”গণেশজননী দুর্গা রাধা লক্ষ্মী সরস্বতী। সাবিত্রী চ সৃষ্টিবিধৌ প্রকৃতিঃ পঞ্চমী স্মৃতা।” অর্থাৎ, মূল প্রকৃতিকে পাঁচ অংশে বিভক্ত করা হয়েছে। যথা—দুর্গা, রাধা, লক্ষ্মী, সরস্বতী, সাবিত্রী। দুর্গাতে তেজের অধিষ্ঠাত্রী দেবতা বলা হয়েছে। যথা—”তেজস্বরূপা পরমা তদধিষ্ঠাত্রী দেবতা।” হিন্দুশাস্ত্রের একটি প্রধান লক্ষণ এই যে, এতে ঈশ্বরের নাম নিয়ে অনেক প্রসঙ্গ আলোচনা করা হয়েছে। যেমন নারায়ণের সহস্র নাম, শত নাম, ষোড়শ নাম, অষ্ট নাম ইত্যাদি। এই রকম দুর্গারও সহস্র নাম বর্ণিত হয়েছে। ঈশ্বরের নাম নিয়ে এত প্রসঙ্গ করা হয়েছে যে, প্রায় প্রত্যেক ব্যাপারেই একটি পৃথক নাম নেওয়ার বিধি দেওয়া হয়েছে। যথা—”ঔষধে চিন্তয়েদ্বিষ্ণুং ভোজনে জনার্দনং। শয়নে পদ্মনাভঞ্চ বিবাহে চ প্রজাপতিং।।” ইত্যাদি। ভিন্ন ভিন্ন অঙ্গ রক্ষার জন্য ভিন্ন ভিন্ন নাম দেওয়া হয়েছে। যথা—”পায়ান্মধ্যং দিনে বিষ্ণু প্রাতর্নারায়ণ্যেবতু। মধুহাচাপারাহ্নে চ সায়ং রক্ষতু মাধবঃ।।” ইত্যাদি। ভিন্ন ভিন্ন স্থানে ভিন্ন ভিন্ন নামে ঈশ্বরের অধিষ্ঠান কথিত হয়েছে। যথা—মানসহ্রদে মৎস্য, হস্তিনাপুরে গোবিন্দ, কুরুক্ষেত্রে কুরুধ্বজ, হিমাচলে শূলবাহু, অবন্তিনগরে বিষ্ণু, বারাণসীতে কেশব, মর্ত্যলোকে অগস্ত্য, ভুবর্লোকে গরুড়, স্বর্গলোকে বিষ্ণু, জম্বুদ্বীপে চতুর্বাহু ইত্যাদি। শিব ও রাধিকারও সহস্র নাম কথিত হয়েছে। কিন্তু চৈতন্যদেবের সময়ে ঈশ্বরের নামের যে প্রকার অত্যধিক আলোচনা হয়েছে, এমন আর কোনো সময়েই হয়নি। এই বিষয়ে খ্রিস্টানদের সঙ্গে হিন্দুদের সম্পূর্ণ উল্টো রীতি দেখা যায়। খ্রিস্টধর্মে অনর্থক ঈশ্বরের নাম নেওয়া অপরাধ। কিন্তু হিন্দুদের মতে, অবহেলা করে নাম নেওয়াও মহাপুণ্যজনক। চৈতন্যদেবের সময়ে মহাভাগবত হরিদাস ঠাকুর প্রতিদিন তিন লক্ষ বার হরিনাম জপ করতেন। আজও অনেক হিন্দু রোজ শত শত বার ঈশ্বরের নাম জপ করে থাকেন। নাম জপের এত প্রাবল্য ভারতবর্ষ ছাড়া পৃথিবীর আর কোন দেশেই দেখা যায় না। এর একটি প্রধান কারণ এই যে, অন্যান্য জাতি অপেক্ষা ভারতীয়রা ঈশ্বরের দাস হওয়ার চেয়ে ঈশ্বরের প্রেমিক হতেই বেশি ভালবাসে।

দুর্গাকে প্রকৃতির অংশ বলে ও শাস্ত্রে অনেক জায়গায় তাঁকে স্বয়ং প্রকৃতি বলে বর্ণনা করা হয়েছে। পুরুষ ও প্রকৃতিকে কখনও কখনও কৃষ্ণ ও রাধা, কখনও কখনও শিব ও দুর্গা এবং কখনও কখনও লিঙ্গ ও যোনি বলা হয়েছে। যোনিপূজা বললে শাস্ত্র-না-জানা লোক তাকে যেভাবে গ্রহণ করে, দার্শনিক ও শাস্ত্রজ্ঞ ব্যক্তি কখনই তাকে সেভাবে গ্রহণ করে না। উক্তস্থলে সত্ব, রজঃ ও তমঃ এই তিন গুণের সমবায়ের নামই যোনি এবং ঐ ত্রিগুণের সাম্য অবস্থার নামই প্রকৃতি।

পুরুষের যে রকম দশাবতার বর্ণিত হয়েছে, তেমনই প্রকৃতিরও দশাবতারের (দশমহাবিদ্যা) বর্ণনা আছে। যথা—”কৃষ্ণরূপা কালিকাস্যাৎ রামরূপা চ তারিণী। বগলা কূর্মমূর্তিস্যান্মীনো ধূমাবতীভবেৎ।। ছিন্নমস্তা নৃসিংহর্স্যাদ্ববরাহশ্চৈব ভৈরবী। সুন্দরী যামোদগ্ন্যর্স্যাদ্বামনো ভুবনেশ্বরী।। কমলা বৌদ্ধরূপাস্যাৎ দুর্গাস্যাৎ কল্পিরূপিণী।” ইত্যাদি। ইতি শব্দকল্পদ্রুমধৃত মুণ্ডমালা তন্ত্র।

জগদ্ধাত্রী

ছান্দোগ্য উপনিষদে মহাশক্তি বিষয়ক একটি সুন্দর গল্প আছে। সেটি হল: এক সময় ইন্দ্র প্রভৃতি দেবতারা মোহে পড়ে নিজেদের ঈশ্বর ভাবতে শুরু করেছিলেন। তা দেখে ভগবান এক অনির্বচনীয় কোটিচন্দ্রসূর্যের জ্যোতিঃপুঞ্জের রূপে তাঁদের সামনে দেখা দিলেন। তিনি বায়ুকে জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি কে? বায়ু উত্তর দিলেন, আমি মাতরিশ্বা, আমি সক কিছু ওড়াতে পারি। জ্যোতিঃপুঞ্জ একটি ঘাস সামনে রেখে বললেন, এই ঘাসটুকু ওড়াও। বায়ু কোনোভাবেই তা ওড়াতে না পেরে লজ্জায় মাথা নিচু করে রইলেন। তারপর অগ্নি হাজির হলে তাঁর পরিচয় জানতে চাওয়া হল। অগ্নি উত্তর দিলেন, আমি অনল, আমি সব কিছু পোড়াতে পারি। জ্যোতিঃপুঙ্ক তাঁকে সেই ঘাসটি পোড়াতে বললে, অগ্নি তা পোড়াতে না পেরে লজ্জা পেয়ে গেলেন। কাত্যায়নী তন্ত্রের মতে, এই জ্যোতিঃপুঞ্জ পরে চতুর্ভূজা জগদ্ধাত্রীরূপে বিনয়াবনত দেবগণের সামনে কিছুক্ষণ প্রকাশিত থেকে অন্তর্হিতা হলেন। এই জগদ্ধাত্রীও দুর্গার রূপান্তর বিশেষ। শোভা, শক্তি ও জ্ঞানদাত্রীত্ব সূচনার্থে ইনি জ্যোতির্ময়ী বলে বর্ণিত হয়েছেন।

কালী

কালীকে দুর্গার ললাট থেকে উৎপন্না বলা হয়েছে। যথা—”দুর্গার ললাটে জাতা জলদবরণী।” কালী দুর্গার ললাট থেকে উৎপন্না হয়েছেন—এই বাক্যের তাৎপর্য যে, ললাটের সংকোচনেই ক্রোধভাব প্রকাশিত হয় বলে সদা ক্রোধান্বিতা; রণরঙ্গিনী করাল-বদনা কালীকে ললাট-সম্ভবা বলা হয়েছে। বাস্তবিক কালীও দুর্গার রূপান্তর বিশেষ। ক্রোধাবস্থাপন্না শক্তিকেই কালী বলা বয়েছে। ভয়ানক ভাবান্বিতা বিশ্বব্যাপিনী শক্তি—এই অর্থে ঈশ্বরের নাম কালী। এই জন্য কালীর বিবিধ প্রকার ভয়ানক মূর্তি কল্পিত হয়েছে। ধূমাবতী, ছিন্নমস্তা ও ভৈরবী—এ সবারই অতি ভয়ংকর মূর্তি। পাঠকদের জ্ঞাতার্থে একটি ধ্যান দেওয়া হল। দক্ষিণাকালীর ধ্যান—

করালবদনাং ঘোরাং মুক্তকেশীং চতুর্ভূজাম্। কালিকাং দক্ষিণাং দিব্যাং মুণ্ডমালাবিভূষিতাম্।। সদ্যশ্চিন্নশিরঃখড়্গবামাধোর্ধ্বকরাম্বুজাম্। অভয়ং বরদং চৈব দক্ষিণোর্ধ্বাধঃপাণিকাম্।। মহামেঘপ্রভাং শ্যামাং তথা চৈব দিগম্বরীম্। কর্ণাবসক্তমুণ্ডালীগলদ্রুধিরচর্চিতাম্।। কর্ণাবতংসতানীতশবযুগ্মভয়ানকম্। ঘোরদ্রংষ্টাং করালাস্যাং পীনোন্নতপয়োধরাম্।। শবানাং করসংঘাতৈঃ কৃতকাঞ্চীং হসন্মুখীম্। সৃক্কদ্বয়গলদ্রক্তধারাবিস্ফুরিতাননাম্।। ঘোররাবাং মহারৌদ্রীং শ্মশানালয়বাসিনীম্। বালার্কমণ্ডলাকারলোচনত্রিতয়ান্বিতাম্।।  দন্তুরাং দক্ষিণব্যাপিমুক্তালম্বিকচোচ্চয়াম্। শবরূপমহাদেবহৃদয়োপরি সংস্থিতাম্। শিবাভির্ঘোররাবাভিশ্চতুর্দিক্ষু সমান্বিতাম্। মহাকালেন চ সমং বিপরীতরতাতুরাম্।। সুখপ্রসন্নবদনং স্মেরাননসরোরুহম্। ছিন্নমস্তার ধ্যান আরও ভয়ংকর। বাস্তবিক কালীর মূর্তি, অস্ত্র, অনুচরী ডাকিনী ও যোগিনী এবং বাসস্থান ভূতশ্মশান সবই ভয়ানক ভাবের অবতার বিশেষ। কালী-সংক্রান্ত সব কিছুই যেমন ভয়ানক, তেমন আবার কৃষ্ণ সংক্রান্ত সব কিছুই আনন্দপ্রদ। কৃষ্ণের মূর্তি মনোহর। হাতে আনন্দজনক শব্দকর মুরলী। প্রিয়তমা আনন্দরূপিণী রাধিকা। মনোহর বেশধারিণী সখীগণের মধ্যে কেউ বীণা, কেউ বংশী, কেউ রবাব, কেউ মৃদঙ্গ, কেউ বা খঞ্জনী বাজাচ্ছেন। সংক্ষেপে বললে, তাঁরা নৃত্যগীতে মেতে থাকেন, নানা রকম বাদ্যযন্ত্র সুন্দর বাজাতে পারেন এবং সাদা, লাল, নীল, হলুদ প্রভৃতি নানা রঙের সুন্দর বস্ত্র পরে থাকেন। কালীর মূর্তি ও সংগ্রামকর্ম—দুইই ভয়ংকর। কৃষ্ণের মূর্তি ও নৃত্যগীতরূপ কাজ উভয়ই মনোহর। কালীর উপাসকেরা যেমন সব রকম ভয়ানক ভাবের একত্র সমাবেশ করতে যার-পর-নাই যত্নপরায়ন হয়েছেন, তেমন কৃষ্ণের উপাসকগণও আনন্দজনক ভাব সংগ্রহে, যিনি যেখান থেকে পেরেছেন, সেখান থেকে উপকরণ সঞ্চয় করে গেছেন। কালীর বাসস্থান ভয়ানক শ্মশান, কৃষ্ণের বাসস্থান মনোহর বৃন্দবন। কালীর হাতে ভয়ানক খড়্গ, কৃষ্ণের হাতে মনোহর বাঁশি। কালীর শরীর রক্তমাখা, কৃষ্ণের শরীর চন্দনমাখানো। কালী গম্ভীর গর্জন করেন, কৃষ্ণ মিষ্টি মিষ্টি কথা বলেন। কালী যুদ্ধে মেতে থাকেন, কৃষ্ণ নাচগান করেন। কালীর গলায় মুণ্ডমালা, কৃষ্ণের গলায় ফুলের হার। সংক্ষেপে বললে, কালীর ভয়ানক বেশ, কৃষ্ণের মূর্তি মনোহর। কালীর উপাসকরা নানারকম প্রাণী বলি দেয়, কৃষ্ণের উপাসনায় বলি নিষিদ্ধ। কালীপূজার কাল অমাবস্যা তিথি ও ঘনঘোর অন্ধকার রাত। মৃতদেহের উপর বসে, শ্মশানে তাঁর সাধনা করতে হয়। পূজার বাদ্যযন্ত্র ঢাক ও উপহারের ফুল টকটকে লাল রঙের জবা। তান্ত্রিকেরা আবার পঞ্চ-মকার দিয়ে ভয়ানক সাধনপ্রণালীর বিধানও দিয়েছেন। মদ্য, মাংস, মৎস্য, মুদ্রা ও মৈথুন—এই পঞ্চ-মকারের প্রায় প্রত্যেকই বাইরে থেকে দেখলে এক এক ভয়ানক সাধন-প্রণালী। বাইরে থেকে—এই কথা বলার তাৎপর্য এই যে, ওই পঞ্চ-মকারের আধ্যাত্মিক ভাব অত্যন্ত নির্মল ও উচ্চ। লোকনাথ বসু তাঁর হিন্দুধর্ম মর্ম নামক বইয়ে পঞ্চ-মকার সম্পর্কে আগমসারের যে এক অংশ উদ্ধৃত করেছেন, তার তাৎপর্য এই যে, ঐ স্থানে মদ্য বলতে পানীয় মদ বোঝায় না, তা ব্রহ্মরন্ধ্র থেকে ক্ষরিত অমৃতধারা বা ব্রহ্মানন্দ; মাংস মানে দেহের মাংস নয়, তা হল জিভের সংযম; মৎস্য বলতে মাছ বোঝায় না, তা হল শ্বাসনিরোধ (প্রাণায়ম); মুদ্রা মানে টাকাপয়সা নয়, বরং আত্মাতে যে পরমাত্মা মুদ্রিত হয়ে আছেন, সেই তত্ত্বজ্ঞান এবং মৈথুন বলতে যৌনসংগম বোঝায় না, তা হল জীবাত্মাতে পরমাত্মার বিরাজ।

শারদীয়া দুর্গাদেবীর কৃষ্ণানবম্যাদিবিহিত কল্পারম্ভ (১৪১৯ বঙ্গাব্দ) উপলক্ষ্যে প্রকাশিত বিশেষ রচনা।

 
4 টি মন্তব্য

Posted by চালু করুন অক্টোবর 9, 2012 in পুরনো লেখা

 

ট্যাগ সমুহঃ

সহজ চণ্ডীপাঠ বিধি

বাগবাজার সর্বজনীনের মণ্ডপে ২০১০ সালে আমার তোলা ছবি।

শ্রীশ্রীচণ্ডী বা দেবীমাহাত্ম্যম্ বা দুর্গাসপ্তশতী হিন্দু শাক্তদের প্রধান ধর্মগ্রন্থ। দুর্গাপূজা সহ একাধিক অনুষ্ঠানে চণ্ডীপাঠ অবশ্য করণীয়। কিন্তু ৭০০ শ্লোকবিশিষ্ট এই বিশাল গ্রন্থটি একবারে পাঠ করা অনেকের পক্ষেই সম্ভব নয়। প্রাচীন শাস্ত্রগুলিতে একদিনে একবার বসে পূর্ণাঙ্গ পাঠেরই বিধান দেওয়া হয়েছে। তবে এই বিধান সকাম পূজকের জন্য (মানে, যিনি বিশেষ কোনো ফলকামনায় চণ্ডীপাঠ করছেন)। যিনি নিষ্কাম দেবীভক্ত, তাঁর জন্য নিয়মের বাঁধন আলগা, একথা তন্ত্রে স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে। ভারতের নানা প্রান্তে নিষ্কাম দেবীভক্তেরা দেবীপ্রীতির জন্য কিভাবে চণ্ডী পারায়ণাদি করে থাকেন, তার নিয়মগুলি এখানে লিখছি। দেবীভক্তেরা নিজ নিজ সুবিধা মতো একটি পদ্ধতি বেছে নেবেন।

 

প্রথমে পঞ্চোপচার বা দশোপচারে শ্রীশ্রীচণ্ডীদেবীর পূজা করবেন। চণ্ডীপূজাবিধি বাজারে প্রচলিত চণ্ডীপুস্তকগুলিতে দেওয়া থাকে। অত নিয়ম না মানতে পারলে, একটি ঘটস্থাপন করে ঘরে যেমন করে ফুল-বেলপাতা-জল-বাতাসা দিয়ে পূজা করেন, তেমনি করবেন। বাকিটা চণ্ডীপাঠের মাধ্যমেই হয়ে যাবে।

 

চণ্ডীপাঠ ত্রি-অঙ্গ বা ষড়-অঙ্গ হতে পারে। একদিনে একেবারে বসে ষড়ঙ্গ চণ্ডীপাঠই বিধেয়। কিন্তু এক এক দিনে ভেঙে ভেঙে চণ্ডীপাঠ করলে ত্রি-অঙ্গ পাঠ করলেই চলবে।

 

ত্রি-অঙ্গ পাঠের সময় মূল পাঠের আগে প্রথমে বৈদিক দেবীসূক্তম্, অর্গলাস্তোত্রম, কীলকস্তব ও দেবীকবচ পাঠ করবেন। আপনার ঘরে মায়ের সিংহবাহিনী কোনো রূপের ছবি বা মূর্তি থাকলে দেবীবাহন মহাসিংহেরও ধ্যান করবেন। এরপর নবার্ণমন্ত্র জপ করে, তারপর মূল পাঠ করবেন। এই সব মন্ত্র ও স্তোত্র যেকোনো চণ্ডীগ্রন্থে পেয়ে যাবেন।

 

মূল পাঠ তিন প্রকারে করা যায়, ৩ দিনে, ৭ দিনে বা ৯ দিনে।

 

৩ দিনে চণ্ডীপাঠ করতে হলে মূল পাঠ নিম্নোক্ত রূপে ভেঙে নেবেন:

প্রথম দিন—প্রথম চরিত্র (অধ্যায় ১)

দ্বিতীয় দিন—মধ্যম চরিত্র (অধ্যায় ২, ৩, ৪)

তৃতীয় দিন—উত্তম চরিত্র (অধ্যায় ৫ থেকে ১৩)

 

৭ দিনে চণ্ডীপাঠ করতে হলে মূল পাঠ নিম্নোক্ত রূপে ভেঙে নেবেন:

প্রথম দিন—অধ্যায় ১

দ্বিতীয় দিন—অধ্যায় ২-৩

তৃতীয় দিন—অধ্যায় ৪

চতুর্থ দিন—অধ্যায় ৫-৮

পঞ্চম দিন—অধ্যায় ৯-১০

ষষ্ঠ দিন—অধ্যায় ১১

সপ্তম দিন—অধ্যায় ১২-১৩

 

৯ দিনে চণ্ডীপাঠ করতে হলে (এটি সাধারণত শারদ ও বাসন্তী নবরাত্রিতে করা হয়) মূল পাঠ নিম্নোক্ত রূপে ভেঙে নেবেন:

প্রতিপদ—অধ্যায় ১

দ্বিতীয়া— অধ্যায় ২, ৩, ৪

তৃতীয়া— অধ্যায় ৫, ৬

চতুর্থী—অধ্যায় ৭

পঞ্চমী— অধ্যায় ৮

ষষ্ঠী— অধ্যায় ৯, ১০

সপ্তমী— অধ্যায় ১১

মহাষ্টমী—অধ্যায় ১২

মহানবমী—অধ্যায় ১৩

বিজয়াদশমী—অপরাধক্ষমাস্তোত্রম্।

 

মহানবমীর দিন ত্রয়োদশ অধ্যায় পাঠের পরও অপরাধক্ষমাস্তোত্রম্ পড়তে পারেন। তারপর ইচ্ছা করলে রহস্যত্রয়ও পড়বেন।

 

ভাগে ভাগে চণ্ডীপাঠ করলে প্রতিদিন পাঠের পর কুঞ্জিকা স্তোত্র অবশ্য পাঠ করবেন। রামকৃষ্ণ মিশন উদ্বোধন কার্যালয় প্রকাশিত স্বামী জগদীশ্বরানন্দ অনূদিত ও সম্পাদিত শ্রীশ্রীচণ্ডী-তে (পুথি বা পকেট সাইজ নয়, মূল বইটি) কুঞ্জিকা স্তোত্রম্ দেওয়া আছে।

 

পুনরায় বলছি, এই সব নিয়ম নিষ্কাম দেবীভক্তদের জন্য, যাঁদের দেবীপ্রীতি ও ভক্তি ছাড়া আর কিছু কামনা নেই তাঁদের জন্য। যাঁরা বিশেষ ফলকামনায় চণ্ডীপাঠ করেন বা ঠাকুরদেবতাদের সঙ্গে ‘Give-and-Take’ সম্পর্ক রাখেন, তাঁরা বিধিমতে পূজা করে ষড়ঙ্গ চণ্ডীপাঠই করবেন, কোনোভাবেই অঙ্গহীন পূজাপাঠ করবেন না—তাঁদের জন্য নান্য পন্থা বিদ্যতে—অন্য পথ নেই।

 

ট্যাগ সমুহঃ , ,

জন কার্টার

জন কার্টার ছবির ফরাসি পোস্টার

পরিচালনা—অ্যান্ড্রু স্ট্যানটন

প্রযোজনা—জিম মরিস, কলিন উইলসন, লিন্ডসে কলিনস

চিত্রনাট্য—অ্যান্ড্রু স্ট্যানটন, মার্ক অ্যান্ড্রুজ, মাইকেল চ্যাবন (এডগার রাইস বারোর আ প্রিন্সেস অফ মার্স উপন্যাস অবলম্বনে)

অভিনয়—টাইলর কিচ, লিন কলিনস, সামান্থা মর্টন, মার্ক স্ট্রং এবং অন্যান্যরা

সংগীত—মাইকেল জিয়াচিনো

সিনেম্যাটোগ্রাফি—ড্যানিয়েল মিন্ডেল

মুক্তির তারিখ—৯ মার্চ, ২০১২ (যুক্তরাষ্ট্র)

দেশ—যুক্তরাষ্ট্র

ভাষা—ইংরেজি

বাজেট—২৫০-৩৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার

বক্স অফিস—২৮২,৭৭৮,১০০ মার্কিন ডলার

ছবির পোস্টারে দৃশ্যমান দানবদ্বয়

এই বছরই মুক্তি পেল অ্যান্ড্রু স্ট্যানটন পরিচালিত আমেরিকান কল্পবিজ্ঞান চলচ্চিত্র জন কার্টার। এডগার রাইস বারোর ‘বারসুম’ সিরিজের উপন্যাস আ প্রিন্সেস অফ মার্স অবলম্বনে তৈরি হয়েছে এই ছবি। জন কার্টারের প্রথম আন্তঃগ্রহ অভিযান এই ছবির বিষয়। নামভূমিকায় অভিনয় করেছেন টাইলর কিচ। ছবিটি নির্মিতও হয়েছে জন কার্টার চরিত্র সৃষ্টির শতবর্ষপুর্তি উপলক্ষ্যে। ওয়াল্ট ডিজনি পিকচার্স থেকে মুক্তি পেয়েছে এই ছবিটি।

 

ছবির ইংরেজি পোস্টার

প্লট

প্রাক্তন আমেরিকান সিভিল ওয়ার কনফেডারেট আর্মি ক্যাপ্টেন জন কার্টার (টাইলর কিচ)। তাঁর অকস্মাৎ মৃত্যুর পর শেষকৃত্যে যোগ দিতে এসেছে ভাগনে এডগার রাইস বারো (ডারিল সাবারা)। কার্টারের নির্দেশমতো তাঁর দেহ এমন একটা সমাধিসৌধের মধ্যে রাখা হয়েছে, যার চাবি শুধুমাত্র ভিতর থেকেই খোলা সম্ভব। এদিকে কার্টারের অ্যাটর্নি কার্টারের ব্যক্তিগত লেখাপত্র বারোকে পড়তে দিলেন। তিনি ভেবেছিলেন, বারো হয়তো এগুলি পড়ে কার্টারের মৃত্যুর কারণ কিছু আবিষ্কার করতে পারবে।

জন কার্টার: একটি আন্তঃগ্রহ প্রেমকাহিনি

এরপর ছবির দর্শক চলে যান অ্যারিজোনা টেরিটরিতে। সেখানে ইউনিয়ন কর্নেল পোয়েল (ব্রায়ান ক্যানস্টন) গ্রেফতার করছেন কার্টারকে। পোয়েল কার্টারের মিলিটারি ব্যাকগ্রাউন্ডের কথা জানতেন। তাই অ্যাপাকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে তাঁর সাহায্য প্রার্থনা করেন। যদিও যুদ্ধ চলাকালীন মার্শালদের সঙ্গে কার্টার পালিয়ে যান। তাঁর পিছনে ধাওয়া করে কার্টার ও পোয়েল দুজনেই এসে উপস্থিত হন একটি গুহায়। এই গুহাটিতেই সোনার খোঁজ করছিলেন কার্টার। এমন সময় সেখানে একজন থার্ন এসে হাজির হয়। কার্টার তাকে হত্যা করেন এবং তার মেডেলটির সাহায্যে নিজের অজ্ঞাতেই এসে হাজির হন বারসুম গ্রহে (মঙ্গলগ্রহ)। কার্টার পৃথিবীবাসী। তাই তার হাড়ের ঘনত্ব এই গ্রহের গড়পড়তা লোকের তুলনায় অন্যরকম। তার উপর এখানকার মাধ্যাকর্ষণ শক্তিও কম। সেই সুযোগে এখানে অনেক উঁচুতে লাফ মারা সহ বেশ কিছু অভাবনীয় কসরত খুব সহজেই আয়ত্ত করে ফেলেন কার্টার। কিন্তু সবুজ মঙ্গলগ্রহীয় থার্ক বাহিনী আর তাদের জেড্ডাক সম্রাট টারস টারকাস (উইলিয়াম ডিফো) তাঁকে বন্দী করতে সক্ষম হন।

নাসার গবেষণাকে গুলি মারুন। মঙ্গলগ্রহের জীবজন্তু এই রকমই হয়!

বারসুমে অন্যদিকে দুই মঙ্গলগ্রহীয় শহর হেলিয়াম ও জোডাঙ্গার মধ্যে এক হাজার বছর ধরে যুদ্ধ চলছে। জোডাঙ্গার জেড্ডাক স্যাব থ্যান (ডোমিনিক ওয়েস্ট) থার্নদের থেকে একটা বিশেষ অস্ত্র পেয়ে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব দিয়েছেন। কিন্তু যুদ্ধবিরতির বিনিময় শর্ত হল তিনি বিয়ে করবেন হেলিয়ামের রাজকন্যা ডেজাহ থোরিসকে (লিন কলিনস)। রাজকন্যা পালিয়ে যান। তাঁকে উদ্ধার করেন কার্টার। কার্টার, ডেজাহ আর টারকার মেয়ে সোলা (সামান্থা মরটন) কার্টারের পৃথিবীতে ফেরার রাস্তা খোঁজার জন্য একটি পবিত্র নদীর মোহনার দিকে যাত্রা করে। তারা নবম রশ্মি সম্পর্কে জানতে পারে। এই রশ্মির সাহায্যে এক অনন্ত শক্তিকে ব্যবহার করা যায়। যার ফলে বোঝা যায় ওই মেডেলটি কিভাবে কাজ করে। কিন্তু থার্ন দলপতি মাতাই শাং (মার্ক স্ট্রং) ও তার অনুগত ওয়ারহুনের সবুজ মানুষের দল তাদের উপর হামলা করে। কার্টার আবার বন্দী হন। ডেজাহের সঙ্গে তাঁকে ধরে নিয়ে যাওয়া হল। সোলা পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। মানসিকভাবে ভেঙে পড়া ডেজাহ অনিচ্ছাসত্ত্বেও স্যাব থানকে বিয়ে করতে রাজি হন। তারপর কার্টারকে তার মেডেলটি ফিরিয়ে দিয়ে পৃথিবীতে ফিরে যেতে বলেন। কার্টার কিন্তু থেকে যান। শাং তাঁকে বন্দী করেন। শাঙের মুখ থেকে কার্টার জানতে পারে থার্নদের উদ্দেশ্য হল, গ্রহে গ্রহে নিজেদের জনসংখ্যা বৃদ্ধি করা। কার্টার পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। তারপর সোলাকে নিয়ে নিয়ে থার্কদের কাছে গিয়ে তাদের সাহায্য চাইতে যান। কিন্তু গিয়ে দেখেন টাল হাজুস (টমাস হ্যাডেন চার্চ) টারকাকে সিংহাসন থেকে হঠিয়ে দিয়েছে। টারকা, কার্টার ও সোলাকে একটা বিরাট কলোসিয়ামে দুই ভয়ংকর বিশালাকায় জীবের সঙ্গে ছেড়ে দেওয়া হয় পরীক্ষা করার জন্য। তাদের পরাজিত করে ও হাজুসকে মেরে কার্টার থার্কদের নেতা হন।

মঙ্গলগ্রহীয় অধিবাসী। প্রশ্ন হল রাজকুমারীর চেহারা এই রকম হলে কী কার্টার তাকে বিয়ে করতেন?

থার্ক বাহিনী হেলিয়াম আক্রমণ করে জোডাঙ্গান বাহিনীকে পরাজিত করে স্যাব থ্যানকে হত্যা করে। ডেজাহকে বিয়ে করে কার্টার হেলিয়ামের রাজপুত্র ঘোষিত হন। কার্টার স্থির করেন, তিনি মঙ্গলগ্রহেই থেকে যাবেন। তাই মেডেলটি ফেলে দেন। সেই সুযোগে শাং তাকে পৃথিবীতে নির্বাসিত করে দেয়। এরপর দীর্ঘদিন ধরে কার্টার পৃথিবীতে থার্নদের অস্তিত্বের অনুসন্ধান চালিয়ে যান, যাতে তিনি তাদের মেডেল হস্তগত করতে পারেন। তারপরই হঠাৎ করে মারা যান কার্টার। মারা যাওয়ার আগে এক অদ্ভুত অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার ব্যবস্থা করে যান—যা দেখে মনে হয় যে, তিনি মেডেলটি খুঁজে পেয়েছেন। আর যেহেতু তিনি মঙ্গলগ্রহে ফিরে যাচ্ছেন, তাই তাঁর পার্থিব শরীরটাকে রেখে যাচ্ছেন কোমাচ্ছন্ন অবস্থায়—এমন একটা আভাসও দিয়ে যান। সেই জন্যই তিনি বারোকে নিজের রক্ষাকর্তা নিয়োগ করেন এবং তাকে সমাধিসৌধটি খোলার কৌশলটি কৌশলে শিখিয়ে দেন।

এরপরই দৃশ্যান্তর। আবার দর্শক ফিরে আসে চলতি সময়ে। বারো ছুটে আসছে কার্টারের সমাধিসৌধে। কিন্তু সমাধি খালি। এমন সময় তাকে অনুসরণ করে হাজির হয় একটা থার্ন। সে বারোকে খুন করতে যায়। কিন্তু সেই মুহুর্তে হাজির হন কার্টার। তিনি থার্নটাকে মেরে ফেলেন। তারপর বারোর কাছে সবকিছু খুলে বলেন তিনি। তিনি মোটেই মেডেলটি খুঁজে পাননি। শুধু জানতেন থার্নেরা তার উপর নজর রাখছে। তাই তিনি এই ফাঁদ পাতেন। তারপর কার্টার থার্নটার মেডেল তুলে নিয়ে ফিসফিস করে কী একটা যেন বলেন আর ট্রান্সপোর্টেড হয়ে যান বারসুমে।

শেষপাতে রইল বারোজের মূল বইয়ের একটি অলংকরণ।

 
2 টি মন্তব্য

Posted by চালু করুন অক্টোবর 5, 2012 in পুরনো লেখা

 

রাজা আলফ্রেডের কেকগুলি

প্রাচীন ইংরেজি লোককথা। জেমস বাল্ডউইনের ফিফটি ফেমাস স্টোরিজ রিটোল্ড বই থেকে অনূদিত।

© অর্ণব দত্ত

অনেক অনেক বছর আগে ইংল্যান্ডে আলফ্রেড নামে এক ভারি বুদ্ধিমান ও দয়ালু রাজা ছিলেন। দেশে তাঁর মতো মানুষ আর একটিও ছিল না। শুধু দেশে কেন, সারা দুনিয়াতেও ছিল না। তাই আজও তাঁকে সবাই মহান আলফ্রেড বলে ডাকে।

সে যুগে রাজাদের বড়ো সুখের জীবন ছিল না। দেশে যুদ্ধবিগ্রহ লেগেই থাকত। অবশ্য যুদ্ধে তাঁর মতো নেতাও বড়ো একটা দেখা যেত না। তাই রাজকাজ আর যুদ্ধবিগ্রহ নিয়ে আলফ্রেডের বেশ ব্যস্ত জীবন কাটছিল।

সে সময় ডেন নামে এক দুর্ধর্ষ ডাকাতে জাতি সাতসমুদ্দুর পেরিয়ে ইংরেজদের সঙ্গে লড়তে এসেছিল। তাদের সংখ্যা ছিল বেশি। গায়ের জোর আর সাহসও ছিল অনেক বেশি। শেষের বেশ কয়েকটা যুদ্ধে তারা হারের মুখ দেখেনি। এইভাবে চলতে থাকলে কিছুদিনের মধ্যেই তারা সারা দেশের মালিক হয়ে বসত।

দুদলের মধ্যে ঘোরতর যুদ্ধ হল। কিন্তু যুদ্ধের শেষে ইংরেজ বাহিনী ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল। যে যার প্রাণ নিয়ে যেদিকে পারল পালিয়ে গেল। রাজা আলফ্রেডও বন আর জলাজঙ্গল পেরিয়ে পালিয়ে গেলেন।

দিনের শেষে রাজা খুব ক্লান্ত ও ক্ষুধার্ত হয়ে এক কাটুরের কুটিরে এসে পৌঁছালেন। তাই কাঠুরের বউয়ের কাছ থেকে কিছু খাবার আর তাদের কুটিরে ঘুমানোর একটু জায়গা চাইলেন।

বউটি উনুনের উপর কিছু কেক সেঁকছিল। ছেঁড়া কাপড় পরা হতভাগ্য লোকটিকে দেখে তার ভারি দয়া হল। কিন্তু সে বুঝতেই পারল না যে ইনি আসলে রাজা।

কাঠুরের বউ বললে, “হ্যাঁ, অবশ্যই। কেকগুলো একটু দেখো, তাহলে রাতের খাবার পাবে। আমি যাই, গিয়ে দুধ দুইয়ে নিয়ে আসি। নজর রেখো কিন্তু, যাতে পুড়ে না যায়।”

রাজা আলফ্রেড কেকগুলোর উপরে নজর রাখতেই চাইছিলেন। কিন্তু তাঁর মন পড়ে ছিল অন্য দিকে। কিভাবে তিনি তাঁর বাহিনীকে আবার গড়ে তুলবেন? কিভাবে ওই দুর্ধর্ষ ডেনসদের পরাজিত করে দেশ থেকে তাড়িয়ে দেবেন? এই সব ভাবতে ভাবতে তিনিনিজের খিদের কথা ভুলে গেলেন, কেকের কথাও ভুলে গেলেন; এমনকি তিনি যে কাঠুরের কুটিরে আছেন সেটাও ভুলে গেলেন। তাঁর মন পরের দিনের জন্য পরিকল্পনা করতেই ব্যস্ত হয়ে পড়ল।

ইতিমধ্যে সেই বেঁটেখাটো চেহারার বউটি ফিরে এল। উনুনের উপর কেকগুলো থেকে তখন ধোঁয়া উঠছে। সেগুলো পুড়ে কালো ছাই হয়ে গেছে। দেখে তো বউটি রেগে আগুন হলেন!

সে চেঁচিয়ে বলল, “কুঁড়ের বাদশা কোথাকার! কী করেছো তুমি! খেতে চাও, কিন্তু কাজে মন দিতে পারো না?”

আমি শুনেছি, বউটি নাকি রাজাকে লাঠির বাড়িও মেরেছিল এক ঘা। তবে আমার মনে হয় না যে, সে অতটা বদমেজাজি ছিল।

এমন বকুনি খেয়ে রাজা নিশ্চয় মনে মনে হেসেছিলেন। খুব খিদেও পেয়েছিল তাঁর। তাই বউটির কথায় তিনি রাগ করতে পারলেন না। কেকগুলো যে সত্যিই পুড়ে গেছে।

আমি জানি না, সেরাতে রাজা আদৌ কিছু খেতে পেয়েছিলেন কিনা। বা কিছু না খেয়েই তাঁকে কাটাতে হয়েছিল কিনা? কিন্তু এটা জানা যায়, কিছুদিনের মধ্যেই তিনি আবার নিজের বাহিনী গড়ে তুলে এক সাংঘাতিক যুদ্ধ লড়ে ডেনদের হারিয়ে দিয়েছিলেন।

 
2 টি মন্তব্য

Posted by চালু করুন অক্টোবর 4, 2012 in পুরনো লেখা

 

দুর্গা নামের অচেনা দেবীরা

© অর্ণব দত্ত

কালীঘাট সহযাত্রীর দুর্গাপ্রতিমা–আকর্ণনয়না সাবেকি ধাঁচের দেবীমূর্তি। এ শিল্প পশ্চিমবঙ্গের সনাতন শিল্প।

দুর্গা—এই নামটি শুনলেই আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে একটা দেবীমূর্তি। তাঁর দশ হাতে দশ রকম অস্ত্র, এক পা সিংহের পিঠে, এক পা অসুরের কাঁধে। তাঁকে ঘিরে থাকেন গণেশ, লক্ষ্মী, সরস্বতী আর কার্তিক ঠাকুর। যাঁরা সেকেলে কেতায় ঠাকুর বানান, তাঁদের ঠাকুরের পিছনে চালচিত্রে আরও নানারকম ঠাকুরদেবতার ছবিও আঁকা থাকে। আর যাঁরা আধুনিক, তাঁরা প্রতিমার মাথার উপর একখানা ক্যালেন্ডারের শিবঠাকুর ঝুলিয়ে রাখেন। মোটামুটি এই মূর্তি বছর বছর দেখে আমরা অভ্যস্ত। তবে মাঝে মাঝে পুজো উদ্যোক্তারা একটু স্বাদবদলের জন্য বানান পঞ্চদুর্গা, নবদুর্গা, একাদশ দুর্গা, একান্ন দুর্গা ইত্যাদি। শাস্ত্রে কতরকম মাতৃমূর্তির কথা আছে। তার থেকেই সামর্থ্য অনুযায়ী কয়েকটা বেছে নিয়ে পঞ্চদুর্গা, নবদুর্গা ইত্যাদি বানানো। আমাদের ছেলেবেলায় দেখেছি, থিমপুজো শুরু হওয়ার আগে এই সব প্যান্ডেল নিয়ে ঠাকুর-দর্শনার্থীদের মধ্যে একটা বিশেষ আগ্রহ থাকত। এখনও আছে। মায়ের সনাতন মূর্তির আবেদন কখনও ম্লান হয় না ঠিকই, কিন্তু মানুষ এই সুযোগে অন্যান্য রূপগুলি দেখে চোখ জুড়িয়ে নিতেও ছাড়েন না।

শাস্ত্রে দুর্গার নয়টি নির্দিষ্ট মূর্তিকে ‘নবদুর্গা’ বলে। এঁরা হলেন—ব্রহ্মাণী, কৌমারী, বৈষ্ণবী, কৌমারী, নারসিংহী, বারাহী, ইন্দ্রাণী, চামুণ্ডা, কাত্যায়নী ও চণ্ডিকা। দুর্গাপূজার সময় দেবীদুর্গার আবরণদেবতা হিসেবে এঁদের পূজা করা হয়। আবার নবপত্রিকা (কলাবউ)-এর নয়টি গাছও নয় দেবীর প্রতীক। এঁরা হলেন—ব্রহ্মাণী (কলা), কালিকা (কচু), দুর্গা (হলুদ), জয়ন্তী (জায়ফল), শিবা (বেল), রক্তদন্তিকা (ডালিম), শোকরহিতা (অশোক), চামুণ্ডা (মান) ও লক্ষ্মী (ধান)। এঁরা পূজিত হন ‘ওঁ নবপত্রিকাবাসিন্যৈ নবদুর্গায়ৈ নমঃ’ মন্ত্রে।

তবে এঁরা ছাড়াও তন্ত্রে, পুরাণে আরও কয়েকজন দুর্গা-নামধারিণী দেবীর সন্ধান পাই। আবার দেবী দুর্গার অন্যান্য কয়েকটি রূপেরও দেখা পাওয়া যায়। আমরা সাধারণত দুর্গার যে মূর্তিটি শারদীয়া উৎসবে পূজা করি, সেই মূর্তিটির শাস্ত্রসম্মত নাম মহিষাসুরমর্দিনী-দুর্গা। স্মার্তমতে যাঁরা পঞ্চদেবতার পূজা করেন, তাঁরা জয়দুর্গার নাম ও ধ্যানমন্ত্রের সঙ্গে পরিচিত। এছাড়া আছেন মহিষমর্দিনী-দুর্গা, কাত্যায়নী-দুর্গা, নীলকণ্ঠী-দুর্গা, ক্ষেমঙ্করী-দুর্গা, হরসিদ্ধি-দুর্গা, রুদ্রাংশ-দুর্গা, বনদুর্গা, অগ্নিদুর্গা, বিন্ধ্যবাসিনী-দুর্গা, রিপুমারি-দুর্গা, অপরাজিতা-দুর্গা প্রমুখ দেবীগণ। এঁরা সবাই আগম-শাস্ত্রপ্রসিদ্ধ দেবী। এছাড়া তন্ত্রশাস্ত্রে দুর্গা-নাম্নী দেবীর যে ধ্যানমন্ত্র পাওয়া যায়, সেটিও আমাদের দেখা দশভুজা-মূর্তির মতো নয়।

মহিষাসুরমর্দিনী-দুর্গাকে নিয়ে আমাদের নতুন করে কিছুর বলার নেই। দুর্গাপূজায় প্রচলিত ‘জটাজুটসমাযুক্তা’ ইত্যাদি ধ্যানমন্ত্রের আধারে নির্মিত এই দেবীমূর্তি আমাদের সকলেরই পরম-পরিচিত। তবে বিষ্ণুধর্মোত্তর পুরাণ-এ মহিষাসুরমর্দিনীর একটু আলাদা রকমের বর্ণনা আমরা পাই। চণ্ডিকা নামে উল্লিখিত এই দুর্গার দশের জায়গায় কুড়িটি হাত। শ্রীশ্রীচণ্ডী-তে অষ্টাদশভূজা মহালক্ষ্মীর কথা আছে, এঁর হাত তাঁর থেকেও দুটি বেশি। ডান দিকের দশ হাতে থাকে শূল, খড়্গ, শঙ্খ, চক্র, বাণ, শক্তি, বজ্র, অভয়, ডমরু, ছাতা; আর বাঁদিকের দশ হাতে থাকে নাগপাশ, খেটক, পরশু, অঙ্কুশ, ধনুক, ঘণ্টা, পতাকা, গদা, আয়না ও মুগুর। বাকি সবই আমাদের চেনা মূর্তিটির মতো। দেবী কাত্যায়নী-দুর্গার মূর্তিটিও আমাদের দশভূজা-দুর্গার অনুরূপ। তবে আমাদের পরিচিত মহিষাসুরমর্দিনী ও তন্ত্রকথিত মহিষমর্দিনীর রূপে সামান্য ফারাক আছে। দেবী মহিষমর্দিনী অষ্টভুজা। এঁর ধ্যানে সিংহের উল্লেখ পাওয়া যায় না। দেবীকে মহিষের মাথার উপর বসে থাকতে দেখা যায়। হাতে থাকে শঙ্খ, চক্র, খড়্গ, খেটক, ধনুক, বাণ, শূল ও তর্জনীমুদ্রা। এর পূজার বিশেষ বৈশিষ্ট্য হল—শঙ্খপাত্রে অর্ঘ্যস্থাপনের উপর নিষেধাজ্ঞা; মৃৎপাত্রে এই কাজটি করতে হয়।

কুলাচারে পূজিতা দেবী জয়দুর্গার মূর্তিটি কিছুটা আমাদের পরিচিত জগদ্ধাত্রী মূর্তির মতো। শুধু দেবীর চার হাতে থাকে শঙ্খ, চক্র, খড়্গ ও ত্রিশূল এবং দেবীর গায়ের রং কালীর মতো কালো। কপালে থাকে অর্ধচন্দ্র। সিংহের পদতলে হাতি অনুপস্থিত। কেউ কেউ মনে করেন, জয়দুর্গা কালী ও দুর্গার সম্মিলিত মূর্তি।

Read the rest of this entry »

 

ট্যাগ সমুহঃ