RSS

Tag Archives: পুরনো লেখা

[সহজ ভাষায় উপনিষদ্] কেনোপনিষদ্

সামবেদীয়

কেনোপনিষদ্

বা

তলবকারোপনিষদ্

অনুবাদ © অর্ণব দত্ত

ওঁ

 Jagaddhatri-Naagyagnopabeetini

কে মনকে চালনে করে মনের দিকে নিয়ে যান? শরীরের প্রধান প্রাণকে কে নিযুক্ত করে তার কর্ম করিয়ে নেন? লোককে কে এই সব বাক্য উচ্চারণ করান? চোখ ও কানকে কোন দেবতাই বা নিজের নিজের কাজে যুক্ত রাখেন? ১ ।।

 

যিনি কানেরও কান, মনেরও মন, বাক্যেরু বাক্য; তিনিই প্রাণের প্রাণ, চোখের চোখ―এই জ্ঞান অর্জন করে ‘চোখ, কান ইত্যাদি আমার’―এই ধারণা জ্ঞানীগণ পরিত্যাগ করেন। তখন তাঁরা ইহলোকের উর্ধ্বে উঠে অমরত্ব অর্জন করেন ।। ২ ।।

 

ব্রহ্মকে চোখে দেখা যায় না। তাঁকে বাক্য দিয়ে বোঝানো যায় না। মন তাঁকে ধরতে পারে না। আমরা তাঁকে জানি না। কিভাবে তাঁর উপদেশ দিতে হয় তাও জানি না। জানা ও অজানা সকল বস্তুর মধ্যে তিনি শ্রেষ্ঠ অথব সবার থেকে আলাদা। যাঁরা ব্রহ্মতত্ত্ব ব্যাখ্যা করেছেন, তাঁদের কাছে শুনেছি― ৩ ।।

 

যিনি বাক্যের দ্বারা প্রকাশিত নন; বরং বাক্য যাঁর দ্বারা উচ্চারিত হয়, তাঁকেই তুমি ব্রহ্ম বলে জানো। লোকে এই যে সামান্য বস্তুর উপাসনা করে, এ ব্রহ্ম নয় ।। ৪ ।।

Read the rest of this entry »

 
2 টি মন্তব্য

Posted by চালু করুন জানুয়ারি 17, 2014 in পুরনো লেখা

 

ট্যাগ সমুহঃ

[সহজ ভাষায় উপনিষদ্] ঈশোপনিষদ্

শুক্লযজুর্বেদীয়

ঈশোপনিষদ্

বা

বাজসনেয় সংহিতোপনিষদ্

অনুবাদ © অর্ণব দত্ত

ওঁ

জগতে যা কিছু রয়েছে সবই পরব্রহ্মের দ্বারা আচ্ছাদিত―এই জেনে বিষয়বুদ্ধি ত্যাগ করবে। এই ত্যাগের দ্বারাই ব্রহ্মকে সম্ভোগ করবে; অন্যের ধনসম্পত্তিতে লোভ করবে না ।। ১ ।।

যার ব্রহ্মজ্ঞান হয়নি, সে কর্মের মাধ্যমে একশো বছর বেঁচে থাকতে চাইবে। হে মানব, এইরকম জীবনের ইচ্ছা থাকলে তোমার পক্ষে এমন কোনো পথ নেই, যা তোমাকে অশুভ কর্মের লিপ্ত হওয়া থেকে রক্ষা করতে পারে ।। ২ ।।

অজ্ঞানতার অন্ধকারে ঢাকা অনেক লোক আছে। যারা অবিদ্যার বশবর্তী হয়ে আত্মাকে অস্বীকার করে, তারাই মৃত্যুর পর সেই সব লোকে যায় ।। ৩ ।।

ব্রহ্ম এক। তিনি নিশ্চম হলেও মনের চেয়েও দ্রুতগামী। তিনিই সকলের আগে চলেন। ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে তাঁকে ধরা সম্ভব নয়। তিনি স্থির থেকেও অন্যান্য সচল বস্তুকে ছাড়িয়ে এগিয়ে যান। তিনি পরব্রহ্ম রূপে আছেন বলেই, বায়ু প্রাণীর দেহধারণের প্রচেষ্টাকে সফল করছেন ।। ৪ ।।

তিনি চলেও চলেন না। দূরে থেকেও কাছে থাকেন। তিনি সকলের অন্তরে আছেন, আবার সকলের বাইরেও আছেন ।। ৫ ।।

Read the rest of this entry »

 

ট্যাগ সমুহঃ

লক্ষ্মীনৃসিংহস্তোত্রম্

শ্রীমৎপয়োনিধিনিকেতন চক্রপাণে ভোগীন্দ্রভোগমণিরঞ্জিতপূণ্যমূর্তে।

যোগীশ শ্বাশত শরণ্য ভবাব্ধিপোত লক্ষ্মীনৃসিংহ মম দেহি করাবলম্বম্।।১।।

ব্রহ্মেন্দ্ররুদ্রমরুদর্ককীরিটকোটিসংঘট্টিতাঙ্ঘ্রিকমলামলকান্তিকান্ত।

লক্ষ্মীলসৎকুচসরোরুহরাজহংস লক্ষ্মীনৃসিংহ মম দেহি করাবলম্বম্‌।।২।।

সংসারঘোরগহনে চরতো ভূরারেভারোগ্রভীকরমৃগিপ্রবরার্দিতস্য।

আর্তস্য মৎসরনিদাঘনিপীড়িতস্য লক্ষ্মীনৃসিংহ মম দেহি করাবলম্বম্‌।।৩।।

সংসারকূপমতিঘোরমগাধমূলং সংপ্রাপ্য দুঃখশতসর্পসমাকূলস্য।

দীনস্য দেব করুণাপদমাগতস্য লক্ষ্মীনৃসিংহ মম দেহি করাবলম্বম্‌।।৪।।

সংসারসাগরবিশালকরালকালনক্রগ্রহগ্রসননিগ্রহবিগ্রহস্য।

ব্যগ্রস্যরাগরসনোর্মিনিপীড়িতস্য লক্ষ্মীনৃসিংহ মম দেহি করাবলম্বম্‌।।৫।।

সংসারবৃক্ষমঘবীজমনন্তকর্মশাখাশতং করণপত্রমনঙ্গপুষ্পম্‌।

আরুহ্য দুঃখফলিতং পততো দয়ালো লক্ষ্মীনৃসিংহ মম দেহি করাবলম্বম্‌।।৬।।

সংসারসর্পধনবক্ত্রভয়োগ্রতীব্রদংষ্ট্রাকরালবিষদগ্‌ধবিনষ্টমূর্তে।

নাগারিবাহন সুধাব্ধিনিবাস শৌরে লক্ষ্মীনৃসিংহ মম দেহি করাবলম্বম্‌।।৭।।

সংসারদাবদহনাতুরভীকরোরুজ্বালাবলীভিরতিদগ্‌ধতনুরুহস্য।

ত্বৎপাদপদ্মসরসীশরণাগতস্য লক্ষ্মীনৃসিংহ মম দেহি করাবলম্বম্‌।।৮।।

সংসারজালপতিতস্য জগন্নিবাস সর্বেন্দ্রিয়ার্থবড়িশার্থঝষোপমস্য।

প্রোৎখণ্ডিতপ্রচুরতালুকমস্তকস্য লক্ষ্মীনৃসিংহ মম দেহি করাবলম্বম্‌।।৯।।

সংসারভীকরকরীন্দ্রকলাভিঘাতনিষ্পিষতমর্মবপুষঃ সকলার্তিনাশ।

প্রাণপ্রয়াণভবভীতিসমাকুলস্য লক্ষ্মীনৃসিংহ মম দেহি করাবলম্বম্‌।।১০।।

অন্ধস্য মে হৃতবিবেকমহাধনস্য চোরৈঃ প্রভো বলিভিরিন্দ্রিয়নামধেয়ৈঃ।

মোহান্ধকূপকুহরে বিনিপাতিতস্য লক্ষ্মীনৃসিংহ মম দেহি করাবলম্বম্‌।।১১।।

লক্ষ্মীপতে কমলনাভ সুরেশ বিষ্ণো বৈকুণ্ঠ কৃষ্ণ মধুসূদন পুষ্করাক্ষ।

ব্রহ্মণ্য কেশব জনার্দন বাসুদেব দেবেশ দেহি কৃপণস্য করাবলম্বম্‌।।১২।।

লক্ষ্মীনৃসিংহচরণাব্জমধুব্রতেন স্তোত্রং কৃতং সুখকরং ভুবি শংকরেণ।।

যে তৎপথন্তি মনুজ হরিভক্তিযুক্তঃ লক্ষ্মীনৃসিংহ মম দেহি করাবলম্বম্‌।।১৩।।

ইতি শ্রীমৎপরমহংসপরিব্রাজকাচার্যশ্রীমচ্ছঙ্করাচ্চার্যবিরচিতং সংকষ্টনাশনং লক্ষ্মীনৃসিংহস্তোত্রং সম্পূর্ণম্‌।।

বঙ্গানুবাদ—

হে প্রভু, তুমি শ্রীপতি, ক্ষীরসমুদ্রনিবাসী, সুদর্শন-চক্রধারী, যোগীশ্বর; নাগরাজ অনন্তদেব তোমার মস্তকের মণিস্বরূপ; তুমি শরণাগতকে ভবসাগর পার করাও; হে লক্ষ্মীনৃসিংহ, তোমার করপদ্মস্পর্শে আমাকে ধন্য করো।। ১।।

ব্রহ্মা, ইন্দ্র, শিব, মরুৎগণ ও সূর্য তাঁদের কোটি মুকুট তোমার পায়ে অর্পণ করেন। তোমার পদযুগল লক্ষ্মীর পরম প্রিয়। তিনি (লক্ষ্মীদেবী) তোমার বক্ষপদ্মে রাজহংসীরূপে বিরাজ করেন। হে লক্ষ্মীনৃসিংহ, তোমার করপদ্মস্পর্শে আমাকে ধন্য করো।। ২।।

সংসারী মানুষ জন্মমৃত্যুর চক্রপথে দাবাগ্নিগ্রস্থ প্রাণীর মতো দগ্ধ হয়। শরীর দগ্ধ হওয়ার ভয়ে সে কাঁদে। দাবাগ্নিগ্রস্থ প্রাণী যেমন জলাশয়ে আশ্রয় খোঁকে, তেমনি সংসারদাবাগ্নিগ্রস্থ আশ্রয় নেয় তোমার পাদপদ্মরূপ জলাশয়ে। হে লক্ষ্মীনৃসিংহ, তোমার করপদ্মস্পর্শে আমাকে ধন্য করো।। ৩।।

এই বিশ্বচরাচরে আমি জন্মমৃত্যুর চক্রপাকে পড়েছি। মাছ যেমন করে টোপ গেলে, তেমনি করে কাম্যবস্তুর টোপ সাগ্রহে গিলেছি। মাছ ছটফট করলে তার মাথাটি যেমন কেটে নেওয়া হয়, তেমনি আমি আমার আত্মস্বরূপ বিস্মৃত হয়ে জাগতিক প্রবৃত্তির দ্বারা দণ্ডিত হচ্ছি। হে লক্ষ্মীনৃসিংহ, তোমার করপদ্মস্পর্শে আমাকে ধন্য করো।। ৪।।

জন্মমৃত্যুর করাল অতল কূপে পড়ে আমি সহস্রদুঃখরূপ সর্পের দ্বারা দংশিত হচ্ছি। এই পতিত অবস্থায়, হে প্রভু, তোমার কৃপায় আমি তোমার পাদপদ্ম আশ্রয় করেছি। হে লক্ষ্মীনৃসিংহ, তোমার করপদ্মস্পর্শে আমাকে ধন্য করো।। ৫।।

হস্তীর ন্যায় শক্তিশালী দৈত্যপতি হিরণ্যকশিপুকে তুমি দুই হাতে নিষ্পেষিত করে হত্যা করেছো। এইভাবেই তুমি ভয়াবহ জন্মমৃত্যুচক্রের সকল দুঃখ নাশ করো। যারা সংসারের তাপে দগ্ধ হয়, তাদের তুমি শেষ গতি। হে লক্ষ্মীনৃসিংহ, তোমার করপদ্মস্পর্শে আমাকে ধন্য করো।। ৬।।

জাগতিক সত্ত্বারূপ সর্পের শতসহস্র দন্তের আঘাতে আমি জর্জরিত। আমি যে শ্রীকৃষ্ণের চিরদাস, সেই সত্য এই করাল বিষ শরীরে ধারণ করে আমি বিস্মৃত হয়েছি। এই সর্পবিষের শ্রেষ্ঠ প্রতিষেধক হল অমৃত। হে শৌরী, তুমিই অমৃতসাগরের অধিবাসী, তোমার বাহন সর্পত্রাস গরুড়। হে লক্ষ্মীনৃসিংহ, তোমার করপদ্মস্পর্শে আমাকে ধন্য করো।। ৭।।

পাপচিন্তার বীজ থেকে জন্ম হয় সংসারবৃক্ষের। সকাম কর্মের প্রতিফল এর শাখাপ্রশাখা, ইন্দ্রিয়াদি এর পাতা এবং কামচেতনা এর পুষ্প। হে দয়াল, আমি এই বৃক্ষে আরোহণ করে শুধুই দুঃখময় ফল পেয়েছি। তাই এখন পতিত হয়েছি। হে লক্ষ্মীনৃসিংহ, তোমার করপদ্মস্পর্শে আমাকে ধন্য করো।। ৮।।

সংসারসাগরে সংসারবন্ধনরূপ শক্তিশালী তরঙ্গ আমাকে চূর্ণবিচূর্ণ করছে। কালকুম্ভীরের করাল চোয়ালে আমি আবদ্ধ হয়েছি। এই কুম্ভীর আমাকে বিদীর্ণ করে গ্রাস করছে। হে লক্ষ্মীনৃসিংহ, তোমার করপদ্মস্পর্শে আমাকে ধন্য করো।। ৯।।

জাগতিক মায়ারূপ ভয়াল হস্তীরাজ আমাকে আঘাত করছে। আমার শরীরের প্রধান অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সবই চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গিয়েছে। আমি যন্ত্রণায় বিদ্ধ হচ্ছি। আমার প্রাণসংশয় উপস্থিত। হে লক্ষ্মীনৃসিংহ, তোমার করপদ্মস্পর্শে আমাকে ধন্য করো।। ১০।।

ভেদবুদ্ধি আমাকে অন্ধ করেছে। ইন্দ্রিয়রূপ চোরে আমাকে চুরি করেছে। আমি অন্ধ হয়ে কামনার গভীর কূপে পতিত হয়েছি। হে লক্ষ্মীনৃসিংহ, তোমার করপদ্মস্পর্শে আমাকে ধন্য করো।। ১১।।

হে লক্ষ্মীপতি, পদ্মনাভ, সুরেশ্বর, পদ্মনয়ন বিষ্ণু। তুমিই বৈকুণ্ঠ, তুমিই কৃষ্ণ, তুমিই মধুসূদন। তুমিই ব্রহ্ম, তুমিই কেশব, তুমিই জনার্দন, তুমিই বাসুদেব। হে দেবেশ, তোমার করপদ্মস্পর্শে আমাকে ধন্য করো।। ১২।।

বিশ্বের মঙ্গলকারী এই স্তবটি লক্ষ্মীনৃসিংহপাদপদ্মে মধুপরূপী শঙ্করাচার্য কর্তৃক রচিত হল। যাঁরা হরিভক্তিসহকারে এই স্তবটি পাঠ করবেন, তাঁরা লক্ষ্মীনৃসিংহের পাদপদ্মে চিরতরে আশ্রয় পাবেন।। ১৩।।

স্তবপরিচয়:

লক্ষ্মীনৃসিংহস্তোত্র আদি শঙ্করাচার্যের রচনা। এটি লক্ষ্মীনৃসিংহ করাবলম্ব বা লক্ষ্মীনৃসিংহকরুণরসস্তোত্র নামেও পরিচিত। কথিত আছে, এক কাপালিক শঙ্করাচার্যকে বন্দী করে কালীর নিকট বলি দিতে গেলে, লক্ষ্মীনৃসিংহ তাঁকে উদ্ধার করেন, এরপর কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করে শঙ্কর এই স্তবটি রচনা করেন।

লক্ষ্মীনৃসিংহস্তোত্রটি দক্ষিণভারতে সুপ্রচলিত হলেও, বাংলায় এটি স্বল্পপরিচিত। তাই আমার নিত্যপূজিত ভগবান শ্রীশ্রীমহাবিষ্ণু লক্ষ্মীনৃসিংহ জীউ-র পাদপদ্মে এই অনুবাদ-অঞ্জলিটি প্রদান করলাম।

 
5 টি মন্তব্য

Posted by চালু করুন নভেম্বর 26, 2012 in পুরনো লেখা

 

ট্যাগ সমুহঃ

শিবপূজাপদ্ধতি

যাঁদের HTML সেভ করে রাখতে অসুবিধা হয়, তাঁরা এই পৃষ্ঠাটি সুন্দর করে সাজানো পিডিএফ ফাইলের আকারে ডাউনলোড করে রাখতে পারেন।

ডাউনলোড লিঙ্ক-

http://www.mediafire.com/view/?kad0pf125egasdn

শিবপূজার সাধারণ পদ্ধতি এখানে বর্ণিত হল। এই পদ্ধতি অনুসারে প্রতিদিন বা প্রতি সোমবার প্রতিষ্ঠিত শিবলিঙ্গ বা বাণেশ্বর শিবলিঙ্গে শিবের পূজা করতে পারেন। যাঁরা ‘সোমবার ব্রত’ করেন, তাঁরাও এই পদ্ধতি অনুসারে শিবপূজা করে ব্রতকথা পাঠ করতে পারেন। মনে রাখবেন, সাধারণ শিবলিঙ্গ ও বাণেশ্বর শিবলিঙ্গে পূজার মন্ত্র আলাদা। যাঁদের বাড়িতে বাণেশ্বর আছেন, তাঁরাই বাণেশ্বর মন্ত্রে শিবের পূজা করবেন। অন্যান্য ক্ষেত্রে সাধারণ শিবপূজার মন্ত্রেই পূজা করবেন। শিবরাত্রির দিন বিশেষভাবে পূজা করার নিয়ম আছে। সেই পদ্ধতি পরে দেওয়া হবে।

সকালে সূর্যোদয়ের তিন ঘণ্টার মধ্যে পূজা সেরে নেওয়াই উচিত। একান্ত অসমর্থ হলে খেয়াল রাখতে হবে যেন বেলা বারোটার মধ্যেই পূজা সেরে ফেলা যায়। তার পর সকালের পূজা করা উচিত নয়। শিশু, বৃদ্ধ ও অসুস্থ ব্যক্তি ছাড়া অন্যেরা কিছু না খেয়েই পূজা করবেন। সকালে স্নান ও আহ্নিক উপাসনা সেরে শিবপূজায় বসবেন। প্রথমে পূজার সামগ্রীগুলি একত্রিত করে গুছিয়ে নিন। প্রতিদিন শিবপূজা করলে অনেক সময় ফুল-বেলপাতা ইত্যাদি সংগ্রহ করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। সেক্ষেত্রে ওই সব উপাচারের নাম ও মন্ত্র উচ্চারণ করে সামান্যার্ঘ্য (জলশুদ্ধি) জল দিয়ে পূজা করলেই চলে। ধূপ ও প্রদীপ জ্বেলে নিন। শিব, শ্রীগুরু ও ইষ্টদেবতাকে প্রণাম করে তিন জনকে অভিন্ন চিন্তা করতে করতে যথাশক্তি দীক্ষামন্ত্র জপ করবেন। তারপর করজোড়ে এই মন্ত্রটি পাঠ করবেন—

ওঁ  সর্বমঙ্গলমাঙ্গল্যং বরেণ্যং বরদং শুভম্।

নারায়ণং নমস্কৃত্য সর্বকর্মাণি কারয়েৎ।।

আচমন

ডান হাতের তালু গোকর্ণাকৃতি করে মাষকলাই ডুবতে পারে এই পরিমাণ জল নিয়ে ‘ওঁ বিষ্ণু’ মন্ত্রটি পাঠ করে পান করুন। এইভাবে মোট তিন বার জলপান করে আচমন করার পর হাত জোড় করে এই মন্ত্রটি পাঠ করুন—

ওঁ তদ্বিষ্ণোঃ পরমং পদং সদা পশ্যন্তি সূরয়ঃ

দিবীব চক্ষুরাততম্।

ওঁ অপবিত্রঃ পবিত্রো বা সর্বাবস্থাং গতোঽপি বা।

যঃ স্মরেৎ পুণ্ডরীকাক্ষং স বাহ্যাভ্যন্তরঃ শুচিঃ।।

জলশুদ্ধি

তাম্রপাত্রে বা কোশায় গঙ্গাজল বা পরিষ্কার জল নিয়ে মধ্যমা দ্বারা সেই জল স্পর্শ করে এই মন্ত্রটি পাঠ করুন—

ওঁ  গঙ্গে চ যমুনে চৈব গোদাবরি সরস্বতি।

নর্মদে সিন্ধু-কাবেরি জলেঽস্মিন সন্নিধিং কুরু।

সূর্যমণ্ডল থেকে সকল তীর্থ সেই পার্শ্বস্থ জলে এসে উপস্থিত হয়েছেন এই চিন্তা করতে করতে সেই জলে একটি ফুল দিয়ে তীর্থপূজা করুন। তীর্থপূজার মন্ত্রটি হল—

ওঁ  এতে গন্ধপুষ্পে তীর্থেভ্যো নমঃ।

এরপর এই জল সামান্য কুশীতে নিয়ে পূজাদ্রব্যের উপর ও নিজের মাথায় ছিটিয়ে দিন।

আসনশুদ্ধি

যে আসনে বসেছেন, সেই আসনটিতে একটি ফুল দিয়ে হাত জোড় করে এই মন্ত্রটি পাঠ করুন—

ওঁ পৃথ্বি ত্বয়া ধৃতা লোকা দেবি ত্বং বিষ্ণুনা ধৃতা।

ত্বঞ্চ ধারায় মাং নিত্যং পবিত্রং কুরু চাসনম্।।

পুষ্পশুদ্ধি

পুষ্প স্পর্শ করে এই মন্ত্রটি পাঠ করুন—

ওঁ পুষ্পে পুষ্পে মহাপুষ্পে সুপুষ্পে পুষ্পসম্ভবে। পুষ্পাচয়াবকীর্ণে চ হুঁ ফট্ স্বাহা।

ভূতশুদ্ধি

হাত জোড় করে মনে মনে এই চারটি মন্ত্র পাঠ করুন—

ওঁ ভূতশৃঙ্গাটাচ্ছিরঃ সুষুম্নাপথেন জীবশিবং

পরমশিবপদে যোজয়ামি স্বাহা ।। ১ ।।

ওঁ যং লিঙ্গশরীরং শোষয় শোষয় স্বাহা ।। ২ ।।

ওঁ রং সংকোচশরীরং দহ দহ স্বাহা ।। ৩ ।।

ওঁ পরমশিব সুষুম্নাপথেন মূলশৃঙ্গাটমুল্লসোল্লস

জ্বল জ্বল প্রজ্জ্বল প্রজ্জ্বল সোঽহং হংসঃ স্বাহা ।। ৪ ।।

প্রাণায়ম

‘ওঁ’ বা গুরুপ্রদত্ত বীজমন্ত্রে (বাণেশ্বর শিবের ক্ষেত্রে ‘ঐঁ’ মন্ত্রে) চার বার ৪/১৬/৮ ক্রমে পূরক, কুম্ভক ও রেচক করে প্রাণায়ম করুন।

শ্রীগুর্বাদিপূজা

এরপর একটি একটি করে গন্ধপুষ্পদ্বারা শ্রীগুরু ও অন্যান্য দেবতাদের পূজা করুন। মন্ত্রগুলি হল—

ঐঁ এতে গন্ধপুষ্পে শ্রীগুরবে নমঃ।

ওঁ এতে গন্ধপুষ্পে গণেশাদিপঞ্চদেবতাভ্যো নমঃ।

ওঁ এতে গন্ধপুষ্পে আদিত্যাদিনবগ্রহেভ্যো নমঃ।

ওঁ এতে গন্ধপুষ্পে ইন্দ্রাদিদশদিকপালেভ্যো নমঃ।

ওঁ এতে গন্ধপুষ্পে কাল্যাদিদশমহাবিদ্যাভ্যো নমঃ।

ওঁ এতে গন্ধপুষ্পে মৎস্যাদিদশাবতারেভ্যো নমঃ।

ওঁ এতে গন্ধপুষ্পে মৎস্যাদিদশাবতারেভ্যো নমঃ।

ওঁ এতে গন্ধপুষ্পে সর্বেভ্যো দেবেভ্যো নমঃ।

ওঁ এতে গন্ধপুষ্পে সর্বাভ্যো দেবীভ্যো নমঃ।

ধ্যান

এরপর একটি ফুল নিয়ে (সম্ভব হলে কূর্মমুদ্রায় ফুলটি নেবেন) শিবের ধ্যান করবেন। শিবের সাধারণ ধ্যানমন্ত্র ও বাণেশ্বর ধ্যানমন্ত্র দুটি নিচে দেওয়া হল—

(সাধারণ ধ্যানমন্ত্র)—

ওঁ ধ্যায়েন্নিত্যং মহেশং রজতগিরিনিভং চারুচন্দ্রাবতংসং রত্নাকল্পোজ্জ্বলাঙ্গং পরশুমৃগবরাভীতিহস্তং প্রসন্নম্।

পদ্মাসীনং সমন্তাৎ স্তুতমমরগণৈর্ব্যাঘ্রকৃত্তিং বসানং বিশ্বাদ্যং বিশ্ববীজং নিখিলভয়হরং পঞ্চবক্ত্রং ত্রিনেত্রম্।।

(বাণেশ্বর শিবের ধ্যান)—

ঐঁ প্রমত্তং শক্তিসংযুক্তং বাণাখ্যঞ্চ মহাপ্রভাং।

কামবাণান্বিতং দেবং সংসারদহনক্ষমম্।।

শৃঙ্গারাদি-রসোল্লাসং বাণাখ্যং পরমেশ্বরম্।

এবং ধ্যাত্বা বাণলিঙ্গং যজেত্তং পরমং শিবম্।।

স্নান

এরপর শিবকে স্নান করাবেন। গঙ্গাজলে শুদ্ধজলে চন্দন মিশ্রিত করে ঘণ্টা বাজাতে বাজাতে শিবকে স্নান করাবেন এই মন্ত্রে শিবকে স্নান করাবেন—

ওঁ ত্র্যম্বকং যজামহে সুগন্ধিং পুষ্টিবর্ধনম্।

উর্বারুকমিব বন্ধনান্মৃত্যোর্মুক্ষীয় মাঽমৃতাৎ।।

ওঁ  তৎপুরুষায় বিদ্মহে মহাদেবায় ধীমহি

তন্নো রুদ্রঃ প্রচোদয়াৎ ওঁ।

বিঃ দ্রঃ সাধারণ শিবলিঙ্গ ও বাণেশ্বর—উভয়ক্ষেত্রেই স্নান মন্ত্র এক।

প্রধান পূজা

স্নানের পর আরেকবার আগের ধ্যানমন্ত্রটি পাঠ করে শিবের ধ্যান করবেন। তারপর মনে মনে উপচারগুলি শিবকে উৎসর্গ করে মানসপূজা করবেন। মানসপূজার পর একে একে উপচারগুলি বাহ্যিকভাবে শিবকে সমর্পণ করবেন।

(সাধারণ শিবলিঙ্গে দশোপচার পূজার মন্ত্র)—

ওঁ নমো শিবায় এতৎ পাদ্যং শিবায় নমঃ। (সামান্যার্ঘ্য জল একটু দিন)

ওঁ নমো শিবায় এষঃ অর্ঘ্যঃ শিবায় নমঃ। (আতপচাল ও দূর্বা একটি সচন্দন বেলপাতায় করে ফুল সহ দিন)

ওঁ নমো শিবায় ইদমাচমনীয়ং শিবায় নমঃ। (সামান্যার্ঘ্য জল একটু দিন)

ওঁ নমো শিবায় ইদং স্নানীয়ং শিবায় নমঃ। (সামান্যার্ঘ্য জল একটু দিন)

ওঁ নমো শিবায় এষ গন্ধঃ শিবায় নমঃ। (চন্দনের ফোঁটা দিন)

ওঁ নমো শিবায় ইদং সচন্দনপুষ্পং শিবায় নমঃ। (একটি চন্দনমাখানো ফুল দিন)

ওঁ নমো শিবায় ইদং সচন্দনবিল্বপত্রং শিবায় নমঃ। (একটি চন্দনমাখানো বেলপাতা দিন)

ওঁ নমো শিবায় এষ ধূপঃ শিবায় নমঃ। (ধূপটি শিবের সামনে তিনবার ঘুরিয়ে দেবতার বাঁদিকে, অর্থাৎ নিজের ডানদিকে রাখুন)

ওঁ নমো শিবায় এষ দীপঃ শিবায় নমঃ। (প্রদীপটি শিবের সামনে তিনবার ঘুরিয়ে দেবতার ডানদিকে, অর্থাৎ নিজের বাঁদিকে রাখুন)

ওঁ নমো শিবায় ইদং সোপকরণনৈবেদ্যং শিবায় নিবেদয়ামি।

(নৈবেদ্যের উপর অল্প সামান্যার্ঘ্য জল ছিটিয়ে দিন)

ওঁ নমো শিবায় ইদং পানার্থোদকং শিবায় নমঃ।

(পানীয় জলের উপর অল্প সামান্যার্ঘ্য জল ছিটিয়ে দিন)

ওঁ নমো শিবায় ইদং পুনরাচমনীয়ং শিবায় নমঃ।

(সামান্যার্ঘ্য জল একটু দিন)

ওঁ নমো শিবায় ইদং তাম্বুলং শিবায় নমঃ। (একটি পান দিন, অভাবে সামান্যার্ঘ্য জল একটু দিন।)

ওঁ নমো শিবায় ইদং মাল্যং শিবায় নমঃ। (মালা থাকলে মালাটি পরিয়ে দিন)

(বাণেশ্বর শিবলিঙ্গে দশোপচার পূজার মন্ত্র)—

বিঃ দ্রঃ উপচার দেওয়ার নিয়ম সাধারণ শিবলিঙ্গে পূজার অনুরূপ।

ঐঁ এতৎ পাদ্যং বাণেশ্বরশিবায় নমঃ।

ঐঁ এষঃ অর্ঘ্যঃ বাণেশ্বরশিবায় নমঃ।

ঐঁ ইদমাচমনীয়ং বাণেশ্বরশিবায় নমঃ।

ঐঁ ইদং স্নানীয়ং বাণেশ্বরশিবায় নমঃ।

ঐঁ এষ গন্ধঃ বাণেশ্বরশিবায় নমঃ।

ঐঁ ইদং সচন্দনপুষ্পং বাণেশ্বরশিবায় নমঃ।

ঐঁ ইদং সচন্দনবিল্বপত্রং বাণেশ্বরশিবায় নমঃ।

ঐঁ এষ ধূপঃ বাণেশ্বরশিবায় নমঃ।

ঐঁ এষ দীপঃ বাণেশ্বরশিবায় নমঃ।

ঐঁ ইদং সোপকরণনৈবেদ্যং বাণেশ্বরশিবায় নিবেদয়ামি।

ঐঁ ইদং পানার্থোদকং বাণেশ্বরশিবায় নমঃ।

ঐঁ ইদং পুনরাচমনীয়ং বাণেশ্বরশিবায় নমঃ।

ঐঁ ইদং তাম্বুলং বাণেশ্বরশিবায় নমঃ।

ঐঁ ইদং মাল্যং বাণেশ্বরশিবায় নমঃ।

পুষ্পাঞ্জলি

সচন্দন পুষ্প ও বেলপাতা নিয়ে এই মন্ত্রে এক, তিন অথবা পাঁচ বার অঞ্জলি দেবেন—

(সাধারণ পুষ্পাঞ্জলি)—

ওঁ নমো শিবায় এষ সচন্দনপুষ্পবিল্বপত্রাঞ্জলি নমো শিবায় নমঃ।

(বাণেশ্বর শিবের পুষ্পাঞ্জলি)—

ঐঁ এষ সচন্দনপুষ্পবিল্বপত্রাঞ্জলি বাণেশ্বরশিবায় নমঃ।

গৌরীপূজা

এইভাবে শিবপূজা শেষ করে শিবলিঙ্গের গৌরীপীঠ বা পিনেটে একটি ফুল দিয়ে এই মন্ত্রে গৌরীর পূজা করুন—

ওঁ হ্রীঁ এতে গন্ধপুষ্পে গৌর্যৈ নমঃ।

অষ্টমূর্তি পূজা

বাণেশ্বর শিবে অষ্টমূর্তির পূজা করতে হয় না। কিন্তু অন্যান্য শিবলিঙ্গের ক্ষেত্রে করতে হয়। একটি ফুল দিয়ে এই মন্ত্রে অষ্টমূর্তির পূজা করুন—

ওঁ  এতে গন্ধপুষ্পে অষ্টমূর্তিভ্যো নমঃ।

জপ ও জপসমর্পণ

এরপর ‘ওঁ নমঃ শিবায়’ বা দীক্ষামন্ত্র ১০৮ বার জপ করে এই মন্ত্রে এক গণ্ডুষ জল শিবের নিচের দিকের ডান হাতের উদ্দেশ্যে প্রদান করুন—

ওঁ গুহ্যাতিগুহ্যগোপ্তা ত্বং গৃহাণাস্মৎকৃতং জপম্।

সিদ্ধির্ভবতু মে দেব ত্বৎপ্রসাদান্মহেশ্বর।।

প্রণাম

এইবার এই মন্ত্রটি পড়ে সাষ্টাঙ্গে শিবকে প্রণাম করে পূজা সমাপ্ত করুন—

(সাধারণ শিবলিঙ্গের ক্ষেত্রে)—

ওঁ নমঃ শিবায় শান্তায় কারণত্রয়হেতবে।

নিবেদয়ামি চাত্মানং গতিস্তং পরমেশ্বরম্।।

(বাণেশ্বর শিবের ক্ষেত্রে)—

ওঁ বাণেশ্বরং নরকার্ণবতারণায়

জ্ঞানপ্রদায় করুণাময়সাগরায়।

কর্পূরকুন্দধবলেন্দুজটাধরায়

দারিদ্র্যদুঃখদহনায় নমঃ শিবায়।।

বিঃ দ্রঃ এটি সাধারণ নিয়ম। দীক্ষাগুরু বিশেষ নিয়ম কিছু বলে দিলে, সেই মতো পূজা করবেন। নতুবা এই নিয়মেই পূজা করা যেতে পারে।

—ইতি শিবপূজাপদ্ধতি সমাপ্ত—

 
7 টি মন্তব্য

Posted by চালু করুন নভেম্বর 19, 2012 in পুরনো লেখা

 

ট্যাগ সমুহঃ

ব্রাম স্টোকারের ১৬৫তম জন্মবার্ষিকীতে বঙ্গভারতীর বিশেষ শ্রদ্ধার্ঘ্য

আজ ৮ নভেম্বর, ২০১২। বিশিষ্ট ইংরেজ ভৌতিক সাহিত্য রচনাকার ব্রাম স্টোকারের ১৬৫তম জন্মবার্ষিকী। গত বছর তাঁর “ড্রাকুলার অতিথি” গল্পটি প্রকাশিত হয়েছিল ভূত চতুর্দশী উপলক্ষ্যে। সেই গল্পটি পরিমার্জিত পিডিএফ ই-বুকলেটের আকারে প্রকাশিত হল।

http://www.mediafire.com/view/?9o50ccy0mwgat20

 
4 টি মন্তব্য

Posted by চালু করুন নভেম্বর 8, 2012 in পুরনো লেখা

 

ট্যাগ সমুহঃ

রইল শনির দৃষ্টি

(এই রচনাটি পরশপাথর ই-পত্রিকায় ‘শনি-কথা’ নামে প্রকাশিত। এখানে সামান্য পরিমার্জনার পর পুনঃপ্রকাশিত হল।)

 

ভারতের জনপ্রিয় শিল্পকলায় শনিদেব।

৯-এ নবগ্রহ। আর নবগ্রহের মধ্যে আমাদের সবচেয়ে সুপরিচিত গ্রহটি হল শনি ওরফে শনৈশ্চর। ‘শনির দৃষ্টি’বা ‘শনির দশা’ কথাটা রাজ্যের যত অশুভ ও অমঙ্গলের সমার্থক শব্দ; এমনই শনির কুখ্যাতি! যাঁর দৃষ্টিতে গণেশের মতো জাঁদরেল দেবতার মুন্ডু উড়ে যেতে পারে, তাঁর কাছে মানুষ তো কোন ছাড়! আর তাই স্বর্গপাড়ার এই মস্তান-দেবতাটিকে তুষ্ট করতে ভারতের পথে-ঘাটে-ফুটপাথে কিংবা প্রতিষ্ঠিত মন্দিরে মন্দিরে প্রতি শনিবার বসে বারোয়ারি শনিপুজোর আসর; গ্রহবিপ্রেরা এই ‘মারণ’ দৃষ্টির কোপ থেকে মানুষকে বাঁচাতে দেন হরেক রকমের গ্রহশান্তির বিধান।

 

কিন্তু এই ভয়ংকর দেবতাটি সম্পর্কে আমরা জানি কতটুকুই বা? আসুন পুরাণের তালপাতার পুথি খুলে জেনে নিই আমাদের অতিপরিচিত শনিদেবকে ঘিরে দানা বাঁধা নানা গল্পকথা।

 

শনি সম্পর্কে সাধারণ মানুষের ধারণা যতই ভয়ভীতিমিশ্রিত হোক না কেন, মৎস্য পুরাণ কিন্তু শনিকে লোকহিতকর গ্রহের তালিকাতেই ফেলেছে। মৎস্য ও সৌর পুরাণের মতে, শনি বিবস্বান (সূর্য) ও ছায়ার পুত্র। আবার অগ্নি পুরাণের মতে, বিবস্বানের পত্নীর সংজ্ঞার গর্ভে শনির জন্ম। এদিকে মার্কণ্ডেয়, বায়ু, ব্রহ্মাণ্ড, বিষ্ণু ও কূর্ম পুরাণ মতে, শনি বা শনৈশ্চর অষ্টরুদ্রের প্রথম রুদ্রের পুত্র। তাঁর মায়ের নাম সুবর্চলা।

 

স্কন্দ পুরাণের আবন্ত্য খণ্ডে আছে, শনি ভূমিষ্ঠ হয়েছিলেন শিপ্রা ও ক্ষাতা নদীর সংযোগস্থলে। উক্ত পুরাণেই শনির জন্ম নিয়ে একটি চিত্তাকর্ষক কাহিনির অবতারণা করা হয়েছে: শনি জন্মগ্রহণ করেই ত্রিলোক আক্রমণ করে বসলেন এবং রোহিণীর পথ ভেদ করলেন। সারা ব্রহ্মাণ্ড শঙ্কিত হয়ে উঠল। ইন্দ্র প্রতিকার চাইতে ছুটলেন ব্রহ্মার কাছে। ব্রহ্মা সূর্যের কাছে গিয়ে শনিকে সংযত করতে বললেন। কিন্তু ততক্ষণে শনির দৃষ্টিপাতে সূর্যেরই পা-দুটি পুড়ে গিয়েছে। তিনি কিছুই করতে পারলেন না। তিনি ব্রহ্মাকেই উলটে শনিকে সংযত করার অনুরোধ করলেন। ব্রহ্মা গেলেন বিষ্ণুর কাছে। বিষ্ণুও নিজে কিছু করতে পারবেন না ভেবে ব্রহ্মাকে নিয়ে চললেন শিবের কাছে। শিব শনিকে ডেকে পাঠালেন। শনি বাধ্য ছেলের মতো মাথাটি নিচু করে এলেন শিবের কাছে। শিব শনিকে অত্যাচার করতে বারণ করলেন। তখন শনি শিবকে তাঁর জন্য খাদ্য, পানীয় ও বাসস্থানের নির্দেশ করতে বললেন। তখন শিবই ঠিক করে দিলেন—শনি মেষ ইত্যাদি রাশিতে তিরিশ মাস করে থেকে মানুষের পিছনে লাগবেন এবং এই করেই তাঁর হাড় জুড়াবে। অষ্টম, চতুর্থ, দ্বিতীয়, দ্বাদশ ও জন্মরাশিতে অবস্থান হলে তিনি সর্বদাই বিরুদ্ধ ভাবাপন্ন হবেন। কিন্তু তৃতীয়, ষষ্ঠ বা একাদশ স্থানে এলে তিনি মানুষের ভাল করবেন এবং তখন মানুষও তাঁকে পূজা করবে। পঞ্চম বা নবম স্থানে এলে তিনি উদাসীন থাকবেন। এও ঠিক হল, অন্যান্য গ্রহদের তুলনায় তিনি বেশি পূজা ও শ্রেষ্ঠতম স্থান পাবেন। পৃথিবীতে স্থির গতির জন্য তাঁর নাম হবে স্থাবর। আর রাশিতে মন্দ গতির জন্য তাঁর নাম হবে শনৈশ্চর। তাঁর গায়ের রং হবে হাতি বা মহাদেবের গলার রঙের মতো। তাঁর চোখ থাকবে নিচের দিকে। সন্তুষ্ট হলে তিনি লোককে দেবেন রাজ্য, অসন্তুষ্ট হলে লোকের প্রাণ নেবেন। শনির দৃষ্টি যার দিকেই পড়বে, তিনি দেবতাই হোন, বা দৈত্য, মানব, উপদেবতাই হোন, পুড়ে মরতে হবেই হবে। এই কথা বলে শিব শনিকে মহাকালবনে বাস করতে বললেন।

 

ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণের গণেশের জন্মকাহিনির সঙ্গে শনির যোগের কথা অনেকেই জানেন। তবু সেটার উল্লেখ না করলে এই রচনা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। উক্ত পুরাণ মতে, শনি আদৌ কুদৃষ্টি নিয়ে জন্মাননি; বরং স্ত্রীর অভিশাপই তাঁর কুদৃষ্টির কারণ। একদিন শনি ধ্যান করছিলেন, এমন সময় তাঁর স্ত্রী সুন্দর বেশভূষা করে এসে তাঁর কাছে সঙ্গম প্রার্থনা করলেন। ধ্যানমগ্ন শনি কিন্তু স্ত্রীর দিকে ফিরেও চাইলেন না। অতৃপ্তকাম শনিপত্নী তখন শনিকে অভিশাপ দিলেন, “আমার দিকে ফিরেও চাইলে না তুমি! যাও, অভিশাপ দিলুম, এরপর থেকে যার দিকেই চাইবে, সে-ই ভষ্ম হয়ে যাবে।” এরপর ঘটনাচক্রে গণেশের জন্ম হল। সকল দেবদেবীর সঙ্গে শনিও গেলেন গণেশকে দেখতে। কিন্তু স্ত্রীর অভিশাপের কথা স্মরণ করে তিনি গণেশের মুখের দিকে তাকালেন না। পার্বতী শনির এই অদ্ভুত আচরণের কারণ জিজ্ঞাসা করলে শনি অভিশাপের বৃত্তান্ত খুলে বলেন। কিন্তু পার্বতী সেকথা বিশ্বাস করলেন না। তিনি শনিকে পীড়াপীড়ি করতে শুরু করলেন। বারংবার অনুরোধের পর শনি শুধু আড়চোখে একবার গণেশের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। তাতেই গণেশের মুণ্ড দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।

 

কৃত্তিবাসী রামায়ণে রাজা দশরথের সঙ্গে শনির সাক্ষাৎকারের একটি বর্ণনা আছে। কৃত্তিবাস এই কাহিনিটি আহরণ করেছেন স্কন্দ পুরাণের নাগর ও প্রভাস খণ্ড থেকে—তবে একটু অন্যভাবে। উক্ত পুরাণের মতে, অযোধ্যার জ্যোতিষীগণ দশরথকে সাবধান করে বলেছিলেন, শনিগ্রহ শীঘ্রই রোহিণী ভেদ করবেন। আর তার ফলে বারো বছর ধরে রাজ্যে ভীষণ অনাবৃষ্টি হবে। এই কথা শুনে ইন্দ্রের দেওয়া দিব্য রথে চড়ে দশরথ তৎক্ষণাৎ শনির পিছন ছুটলেন। সূর্য ও চন্দ্রের পথ অতিক্রম করে একেবারে নক্ষত্রমণ্ডলে গিয়ে শনির সামনে উপস্থিত হয়ে রাজা বললেন, “তুমি রোহিণীর পথ পরিত্যাগ কর। না করলে, আমি তোমাকে বধ করব।” শনি দশরথের এই রকম সাহস দেখে অবাক হয়ে গেলেন। তিনি রাজার পরিচয় জানতে চাইলে দশরথ আত্মপরিচয় দিলেন। শুনে শনি বললেন, “আমি তোমার সাহস দেখে অত্যন্ত প্রীত হয়েছি। আমি যার দিকে তাকাই, সেই ভষ্ম হয়ে যায়। তবু তুমি প্রজাহিতের জন্য নিজের প্রাণ তুচ্ছ করে আমার কাছে এসেছো, এতে আমি আরও বেশি খুশি হয়েছি। যাও, আমি কথা দিলাম, রোহিণীর পথ আমি আর কোনোদিনও ভেদ করব না।” কৃত্তিবাসী রামায়ণে আছে, অনাবৃষ্টি শুরু হওয়ার পর দশরথ শনির কাছে গিয়েছিলেন।

 

নিজের সন্তানকে ভক্ষণ করছেন স্যাটার্ন।

এবার চলে যাই দেশান্তরের পুরাণে। আমরা হিন্দুরা যে গ্রহটিকে শনি নামে চিহ্নিত করেছি, পাশ্চাত্য জগতে সেই গ্রহটির নাম স্যাটার্ন (Saturn)। রোমান দেবতা। তবে রোমান পুরাণের অন্যান্য দেবতাদের মতো ইনিও গ্রিক পুরাণ থেকে আমদানিকৃত। গ্রিক পুরাণে স্যাটার্নের নাম ক্রোনাস। স্যাটার্নের নাম অনুসারে স্যাটারডে, যেমন শনির নামে শনিবার। এছাড়া শনি ও ক্রোনাস/স্যাটার্নের মধ্যে মিল অল্পই। কালিকা পুরাণে শনির ধ্যানমন্ত্রে আছে—

ইন্দ্রনীলনিভঃ শূলী বরদো গৃধ্রবাহনঃ।

পাশবাণাসনধরো ধ্যাতব্যোঽর্কসুতঃ।।

অর্থাৎ, “নীলকান্তমণির মতো গাত্রবর্ণবিশিষ্ট; শূল, বরমুদ্রা, পাশ ও ধনুর্বাণধারী; শকুনিবাহন সূর্যপুত্র শনিকে ধ্যান করি।” মহানির্বাণ তন্ত্রে আরও এক ধাপ উঠে বলা হয়েছে, শনি হলেন কানা ও খোঁড়া। বলাবাহুল্য, এই চেহারার সঙ্গে ক্রোনাস/স্যাটার্নের চেহারার মিল আদৌ নেই। তাঁর হাতে থাকে কাস্তে। গ্রিক পুরাণে ক্রোনাস হলেন দেবরাজ জিউসের পিতা। তিনি ব্রহ্মাণ্ডপিতা ইউরেনাসের পুত্র। পিতাকে সিংহাসন থেকে উৎখাত করে তিনি ব্রহ্মাণ্ডের অধীশ্বর হন। অত্যন্ত ক্ষমতালোভী ছিলেন। তাঁর ছেলেরা যাতে তাঁকে অনুসরণ করে সিংহাসনের দখল না নিতে পারে, সেজন্য তিনি নিজের ছেলেমেয়েদেরই ভক্ষণ করতেন। শেষে পুত্র জিউসের হাতে তাঁকে ক্ষমতা হারাতে হয় এবং তিনি কৃষিকর্মের দেবতা হয়ে থেকে যান। রোমান স্যাটার্নও কৃষিকাজ, মুক্তি ও সময়ের দেবতা। সেই হিসেবেও দেখা যায়, শনির মতো লোকপীড়নকারী চরিত্র এঁদের নয়।

 

সূর্যপুত্র শনি, বিজ্ঞানের আলোয়

শেষ পাতে, জ্যোতিষ থেকে চলে আসি জ্যোতির্বিজ্ঞানে। হিন্দুপুরাণের শনি যতই কুৎসিত এবং ক্ল্যাসিক্যাল পুরাণের স্যাটার্ন যতই নৃশংস হোন না কেন, আমাদের সৌরজগতের ষষ্ঠ গ্রহটি কিন্তু রূপে গুণে অসামান্য। তার কারণ, অবশ্যই এই গ্রহকে ঘিরে থাকা চাকতিগুলি; জ্যোতির্বিজ্ঞানের ভাষায় যাকে আমরা বলি ‘শনির বলয়’। তুষারকণা, খুচরো পাথর আর ধূলিকণায় সৃষ্ট মোট নয়টি পূর্ণ ও তিনটি অর্ধবলয় শনিকে সর্বদা ঘিরে থাকে। শনি দৈত্যাকার গ্রহ; এর গড় ব্যাস পৃথিবীর তুলনায় নয় গুণ বড়ো। এর অভ্যন্তরভাগে আছে লোহা, নিকেল এবং সিলিকন ও অক্সিজেন মিশ্রিত পাথর। তার উপর যথাক্রমে একটি গভীর ধাতব হাইড্রোজেন স্তর, একটি তরল হাইড্রোজেন ও তরল হিলিয়াম স্তর এবং সবশেষে বাইরে একটি গ্যাসীয় স্তরের আস্তরণ। আমাদের শনিদেবের গায়ের রং নীলকান্তমণির মতো (শ্রদ্ধেয় হংসনারায়ণ ভট্টাচার্যের মতে এই রং বিষ্ণুর থেকে ধার করা)। শনি গ্রহের রং কিন্তু হালকা হলুদ। এর কারণ শনির বায়ুমণ্ডলের উচ্চবর্তী স্তরে অবস্থিত অ্যামোনিয়া ক্রিস্টাল। শনির ধাতব হাইড্রোজেন স্তরে প্রবাহিত হয় এক ধরনের বিদ্যুত প্রবাহ। এই বিদ্যুৎ প্রবাহ থেকেই শনির গ্রহীয় চৌম্বক ক্ষেত্রের উদ্ভব ঘটেছে। এখনও পর্যন্ত শনির বাষট্টিটি চাঁদ আবিষ্কৃত হয়েছে এবং তার মধ্যে তিপ্পান্নটির সরকারিভাবে নামকরণ করা হয়েছে। অবশ্য এগুলি ছাড়াও শনির শতাধিক উপচাঁদ বা চন্দ্রাণু (Moonlets) আছে। সৌরজগতের দ্বিতীয় বৃহত্তম উপগ্রহ টাইটান শনির বৃহত্তম উপগ্রহ। এটি আকারে মঙ্গলের চেয়েও বড়ো এবং এটিই সৌরজগতের একমাত্র উপগ্রহ যার একটি সমৃদ্ধ বায়ুমণ্ডল আছে।

 

 

 

 

 

 
3 টি মন্তব্য

Posted by চালু করুন নভেম্বর 4, 2012 in পুরনো লেখা

 

ট্যাগ সমুহঃ

পুরাণের অজানা লক্ষ্মী-কাহিনি

‘শ্রীশ্রীলক্ষ্মীদেবীর ব্রতকথা ও পাঁচালী’ নামক পাতলা চটি-বইটির দাপটে আমাদের এই বাংলায় লক্ষ্মী আপাদমস্তক লোকদেবী। লক্ষ্মীর বারব্রতই বলুন, কিংবা কোজাগরী বা দীপান্বিতা পূজাই বলুন, পৌরাণিক লক্ষ্মীর প্রবেশ যেন সেখানে আইন করে নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়েছে। একথা ঠিক যে, বিষ্ণু, শিব, দুর্গা প্রমুখ দেবদেবীদের দাপটে আমাদের পুরাণ শাস্ত্রগুলিকে লক্ষ্মী একটু ব্যাকফুটে চলে গিয়েছেন। কিন্তু তাই বলে ধনসম্পদের অধিষ্ঠাত্রী দেবীকে নিয়ে খুচরো গল্প পুরাণে কম ছড়িয়ে নেই। সমুদ্রমন্থনে লক্ষ্মীর উদ্ভবের গল্প অনেকের জানা। কিন্তু সেখানে লক্ষ্মী নীরব দর্শকমাত্র। সমুদ্র থেকে উঠেই নারায়ণের গলায় মালা দিয়ে বৈকুণ্ঠের গেরস্থালি সামলাতে শুরু করলেন। আর তারপরেই সেকালের পুরাণ শাস্ত্র থেকে আধুনিক হিন্দি সিরিয়ালে তাঁর কাজ হল নারায়ণের পা টিপে দেওয়া। সে গল্প বরং থাক। আসুন, লক্ষ্মীকে নিয়ে একটু অন্য ধরনের কয়েকটি গল্পের সন্ধান করা যাক।

উমার তপস্যা হিন্দু পুরাণের একটি জনপ্রিয় কাহিনি। সতী জন্মান্তরে হিমালয়ের ঘরে কন্যারূপে জন্ম নিয়ে শিবকে পতিরূপে পাওয়ার জন্য কঠোর তপস্যা করেছিলেন। স্কন্দপুরাণ থেকে জানা যায়, নারায়ণকে পেতে লক্ষ্মীও একই রকম তপস্যা করেছিলেন। ওই পুরাণের আবন্ত্য খণ্ডে আছে, লক্ষ্মী ঋষি ভৃগু ও তাঁর পত্নী খ্যাতির কন্যা। নরনারায়ণের বর্ণনা শুনে লক্ষ্মী তাঁর প্রেমে পড়ে যান। তাঁকে পতিরূপে পাওয়ার জন্য সাগরসীমায় গিয়ে তপস্যা শুরু করেন। এক হাজার বছর কঠোর তপস্যার পর ইন্দ্র ও অন্যান্য দেবতারা নারায়ণের ছদ্মবেশে এসে তাঁকে বর চাইতে বলেন। লক্ষ্মী বিশ্বরূপ দেখতে চান। দেবতাদের ছলনা ধরা পড়ে যায়। তাঁরা লজ্জিত হয়ে ফিরে যান। এই খবর পেয়ে নারায়ণ নিজে আসেন লক্ষ্মীর কাছে। তিনি লক্ষ্মীকে বর দিতে চাইলে লক্ষ্মী বলেন, “আপনি যদি সত্যিই নারায়ণ হন, তবে বিশ্বরূপ দর্শন করিয়ে আমার বিশ্বাস উৎপাদন করুন।” নারায়ণ তা-ই করে লক্ষ্মীর সংশয় দূর করেন। তারপর নারায়ণ তাঁকে বলেন, “ব্রহ্মচর্যই সব ধর্মের মূল ও সর্বোত্তম তপস্যা। যেহেতু তুমি ব্রহ্মচর্য অবলম্বন করে এখানে তপস্যা করেছো, সেহেতু আমিও ‘মূল শ্রীপতি’ নামে এখানে অবস্থান করব এবং তুমিও এখানে ব্রহ্মচর্য-স্বরূপা ‘ব্রাহ্মী মূলশ্রী’ নামে পরিচিত হবে।”

একটি আশ্চর্য লক্ষ্মী-উপাখ্যান পাওয়া যায় অদ্ভুত রামায়ণে। লক্ষ্মী একবার তাঁর সখীদের নিয়ে কৌশিক নামে এক বিষ্ণুভক্ত ব্রাহ্মণের বাড়ি গান শুনতে গিয়েছিলেন। সেখানে ব্রহ্মা ও অন্যান্য দেবতারাও গিয়েছিলেন গান শুনতে। কিন্তু তাঁরা যেতেই লক্ষ্মীর সহচরীরা তর্জন গর্জন করে তাঁদের দূরে সরে যেতে বলেন। দেবতারা লক্ষ্মীকে খুব সম্মান করতেন। তাঁরা কিছু না বলে সরে যান। শুধু নারদ এতে অপমান বোধ করেন। তিনি বুঝতে পারেন, লক্ষ্মীর সহচরীরা লক্ষ্মীর জ্ঞাতসারেই এই কাজ করেছে। তাই তিনি লক্ষ্মী-সহ সবাইকে রাক্ষসযোনিতে জন্মগ্রহণের অভিশাপ দেন। শাপের বর্ণনা শুনে লক্ষ্মী নারদের কাছে এক আশ্চর্য প্রার্থনা করেন। তিনি বলেন, যে রাক্ষসী স্বেচ্ছায় ঋষিদের রক্ত অল্প অল্প করে সঞ্চয় করে কলস পূর্ণ করবে, তিনি যেন তাঁরই গর্ভে জন্মগ্রহণ করেন। নারদ সেই প্রার্থনা মঞ্জুর করেন।

দেবীভাগবত পুরাণেও লক্ষ্মীকে নিয়ে এক আশ্চর্য কাহিনির সন্ধান মেলে। সূর্যের ছেলে রেবন্ত কোনো এক সময় উচ্চৈঃশ্রবা নামক ঘোড়ায় চড়ে বৈকুণ্ঠে বেড়াতে এসেছিলেন। উচ্চৈঃশ্রবা একে অশ্বরাজ, তায় লক্ষ্মীর মতোই সমুদ্রমন্থনের সময় উদ্ভুত। ঘোড়াটিকে লক্ষ্মী নিজের ভাইয়ের মতো দেখতেন। তাই উচ্চৈঃশ্রবা বৈকুণ্ঠে আসতেই তিনি স্বামীকে ছেড়ে ঘোড়ার আদরযত্ন নিয়ে পড়লেন। ঘোড়ার পিঠে বসে থাকা রেবন্তকে দেখে অবাক হলেন নারায়ণও। তিনি লক্ষ্মীকে জিজ্ঞাসা করলেন, “এই ছেলেটি কে?” লক্ষ্মী তখন ঘোড়ার আপ্যায়নে ব্যস্ত। কয়েকবার জিজ্ঞাসা করেও কথার উত্তর না পেয়ে লক্ষ্মীর উপর বেজায় খাপ্পা হয়ে উঠলেন নারায়ণ। স্ত্রীকে অভিশাপ দিয়ে বসলেন, “ঘোড়া নিয়ে এত আদিখ্যেতা যখন, তখন মর্ত্যে মাদীঘোড়া হয়ে জন্মাও গে!” যতই হোক, নারায়ণ লক্ষ্মীর স্বামী; লক্ষ্মীও নারায়ণের স্ত্রী। অভিশাপ শুনে লক্ষ্মীর খুব কষ্ট হল। নারায়ণকে জিজ্ঞাসা করলেন, কিভাবে তিনি শাপমুক্ত হয়ে আবার বৈকুণ্ঠে ফিরতে পারবেন। নারায়ণ বললেন, মর্ত্যে গিয়ে লক্ষ্মীর নারায়ণ-তুল্য এক ছেলে হবে। তারপরই লক্ষ্মী বৈকুণ্ঠে ফিরতে পারবেন। এরপর যথারীতি মর্ত্যে মাদী ঘোড়া হয়ে জন্মালেন লক্ষ্মী। মর্ত্যে গিয়ে তিনি শিবের তপস্যা করলেন। তপস্যায় তুষ্ট হয়ে শিব বর দিতে এলে লক্ষ্মী বললেন, তাঁর সন্তান যেন নারায়ণের ঔরসেই জন্মায়। শিবের পরামর্শে নারায়ণ হয়গ্রীব অবতার গ্রহণ করে ঘোটকীরূপিণী লক্ষ্মীকে বিয়ে করলেন। তাঁদের ছেলে হলে লক্ষ্মী শাপমুক্ত হয়ে বৈকুণ্ঠে ফিরে গেলেন।

এই দেবীভাগবত পুরাণেই লক্ষ্মীর চরিত্র বর্ণনা করতে গিয়ে বলা হয়েছে—তিনি পতিব্রতাদের মধ্যে প্রধান, সকল জীবের জীবন, স্বর্গে স্বর্গলক্ষ্মী, রাজগৃহে রাজলক্ষ্মী ও সাধারণ মর্ত্যবাসীর ঘরে গৃহলক্ষ্মী। তিনি বণিকদের কাছে বাণিজ্যলক্ষ্মী। আবার পাপীদের কলহ উৎপাদিনী। আমাদের বাংলার লক্ষ্মী ব্রতকথাগুলি পুরাণকথাকে আশ্রয় না করলেও, সেই সব উপকথার সারবস্তুর সঙ্গে এই পৌরাণিক বর্ণনার কী আশ্চর্য মিল দেখা যায়!

 
9 টি মন্তব্য

Posted by চালু করুন অক্টোবর 25, 2012 in পুরনো লেখা

 

ট্যাগ সমুহঃ

নবরাত্রি গোলু: দাক্ষিণাত্যের এক আশ্চর্য প্রথা

সুসজ্জিত নবরাত্রি গোলু।

নবরাত্রি উৎসবের সময় দক্ষিণ ভারতের চারটি রাজ্যে (তামিলনাড়ু, কেরল, অন্ধ্রপ্রদেশ ও কর্ণাটক) এবং শ্রীলঙ্কার তামিলদের মধ্যে একটি বিশেষ প্রথা পালিত হতে দেখা যায়। এটি হল “গোলু” বা “কোলু” প্রদর্শন। নানারকম পুতুল ও দেবমূর্তি একটি গ্যালারিতে সাজিয়ে প্রদর্শন করার নামই গোলু। গ্যালারির তাকগুলি সাধারণত ৭, ৯ বা ১১ বা কোনো বিজোড় সংখ্যায় থাকে। গোলুকে স্থানভেদে বোম্বে হাব্বা, বা বোম্মাই কোলু বা বোম্মালা কোলুভুও বলে। আমাদের বাংলার দুর্গাপূজায় নবপত্রিকা যেমন কৃষিসভ্যতার প্রতীক, দক্ষিণ ভারতীয় শারদ নবরাত্রির গোলুর সঙ্গেও কৃষিসভ্যতার সম্পর্ক খুব ঘনিষ্ঠ। কথিত আছে, আগেকার দিনে লোকে যাতে সেচখাল ও নদীখাতগুলি থেকে নিয়মিত পলি তুলে নেওয়ার অভ্যাস বজায় রাখতে পারে, তাই বিশেষ রকমের মাটির পুতুল দিয়ে গোলু সাজানোর উৎসবের প্রবর্তন করা হয়েছিল।

 

বাঙালি সমাজে যেমন দুর্গাপুজোয় ঠাকুর দেখতে যাওয়ার প্রথা আছে, দক্ষিণ ভারতেও আত্মীয়-অতিথিরা বাড়িতে বাড়িতে যান গোলু দর্শন করতে। এই সময় গোলু-দর্শনকারী কুমারী মেয়ে ও বিবাহিতা নারীদের হাতে প্রসাদ, কুমকুম আর একটা ছোটো উপহার-ভর্তি থলি তুলে দেওয়া হয়। সন্ধ্যাবেলা গোলুর সামনে “কোলাম” বা রঙিন আলপনার (রঙ্গোলি) মাঝে একটি ছোটো প্রদীপ জ্বেলে দেওয়া হয়। প্রদীপটিকে বলে “কুতুভিলাক্কু”। তারপর ভক্তিমূলক স্তবস্তোত্রাদি পাঠ করা হয়। পূজার পর দেবীর উদ্দেশ্যে ভোগ দেওয়া হয়।

 

গোলুতে নানারকম মূর্তি থাকে। বেশিরভাগ মূর্তিই পৌরাণিক দেবদেবীদের। নিয়ম হল, তার মধ্যে অন্তত একটি কাঠের পুতুল রাখা। সেই সঙ্গে একটি বালক ও একটি বালিকার পুতুলও থাকা চাই। এদের বলে “মারাপাচ্চি বোম্মাই”। মহানবমীর দিন দক্ষিণ ভারতীয়রা সরস্বতী পূজা করে। এই দিন তারা বাঙালিদের মতোই বইখাতা, বাদ্যযন্ত্র দেবীর পায়ের কাছে রেখে পুজো করে। পাশাপাশি, নানারকম যন্ত্রপাতি বা অস্ত্রশস্ত্র রেখে আয়ূধ পূজার প্রথাও আছে। এমনকি গাড়ি ভালো করে ধুয়ে ও সাজিয়ে সেগুলিকেও বিশেষভাবে পূজা করা হয়।

 

বিজয়াদশমীর দিনটি হিন্দুমাত্রেই পরম পবিত্র মনে করেন। এই দিন সব দেবশক্তির হাতে অশুভশক্তির চরম পরাজয় ঘটে। বিজয়াদশমীর দিন সন্ধ্যাবেলা গোলুর একটি পুতুলকে প্রতীকীভাবে ঘুম পাড়িয়ে দেওয়া হয়। আর কলসম বা ঘটটিকে উত্তর দিকে একটু সরিয়ে দিয়ে সেই বছরের গোলুর সমাপ্তি ঘোষণা করা হয়। গোলু উৎসব নির্বিঘ্নে শেষ করতে পারার জন্য বিশেষ প্রার্থনাও করা হয়। তারপর গোলুর পুতুল ও মূর্তিগুলিকে পরের বছরের জন্য তুলে রেখে দেওয়া হয়।

 

ট্যাগ সমুহঃ

হিন্দুশাস্ত্র: জ্ঞানকাণ্ড ও কর্মকাণ্ড

বিপিনবিহারী ঘোষাল সংকলিত হিন্দুশাস্ত্র: জ্ঞানকাণ্ড ও কর্মকাণ্ড (১৮৯৫) বই থেকে আধুনিক সরল বাংলা গদ্যে রূপান্তরিত।

আমাদের দেশের প্রাচীন ধর্মশাস্ত্রগুলিতে ধর্ম ও সাধনা সম্পর্কে যে বিভিন্ন রকম মত দেখতে পাওয়া যায়, প্রাচীন আর্য শাস্ত্রকারেরা সেগুলিকে দুটি প্রধান ভাগে ভাগ করেছিলেন এবং সেই সব বিভিন্ন রকম মত ও উপদেশগুলির মধ্যে যে একটা যোগ বা সম্বন্ধ আছে, তা-ও তাঁরা অনেক জায়গায় বলে গেছেন। যেমন—ভগবান শিব এক জায়গায় পার্বতীকে বলছেন,—

নানা তন্ত্রে পৃথক্‌ চেষ্টা ময়োক্তা গিরিনন্দিনি।

ঐক্যজ্ঞানং যদা দেবি তদা সিদ্ধিমবাপ্নুয়াৎ।।

মুণ্ডমালা তন্ত্র, ৬ পটল।

হে পার্বতী, আমি অধিকারী অনুসারে নানা তন্ত্রে নানা রকম সাধনা ও পূজা-উপাসনার বিধি দিয়েছি। সাধক যখন সেই সব নানা রকম ব্যবস্থার মধ্যেও ঐক্য দর্শন করে, তখন তার সিদ্ধিলাভ হয়।

প্রথমত, যাঁরা একটু বেশি জ্ঞান রাখেন ও চিন্তা করেন, যাঁদের বুদ্ধি সূক্ষ্ম তত্ত্বগুলি বুঝতে সক্ষম এবং যাগযজ্ঞ ইত্যাদি কর্মকাণ্ডের অনুষ্ঠানে যাঁদের পুরোপুরি শ্রদ্ধা বা তৃপ্তি জন্মায় না, তাঁদের জন্য শাস্ত্রকারেরা নিজের বিশ্বাস অনুযায়ী তত্ত্বজ্ঞান-স্বরূপ মহাসত্যগুলির উপদেশ দিয়েছেন। দ্বিতীয়ত, যাঁদের জ্ঞান তুলনামূলকভাবে অল্প বা যাঁরা এ সম্পর্কে ঠিকঠাক বিচার করতে পারেন না,[*] তাঁদেরও ধর্মপ্রবৃত্তি পরিতৃপ্ত করবার জন্য এবং ভবিষ্যতে তাদেরও তত্ত্বজ্ঞান লাভের উপযুক্ত করবার জন্য তাঁরা স্থূল ভাবের পূজা, উপাসনা বা অনুষ্ঠানপদ্ধতি লিপিবদ্ধ করে রেখেছেন।

প্রথমোক্ত সবল অধিকারী ব্যক্তিদের জন্য যে শাস্ত্রের উপদেশ দেওয়া হয়েছে, তার নাম জ্ঞানকাণ্ড; আর শেষোক্ত দুর্বল অধিকারীদের জন্য যে শাস্ত্র লেখা হয়েছে, তার নাম কর্মকাণ্ড।

কর্মকাণ্ডোজ্ঞানকাণ্ড ইতি ভেদোদ্বিধামতঃ।

ভবতি দ্বিবিধোভেদাজ্ঞানকাণ্ডস্য কর্মণঃ।।

শিব সংহিতা ১।২০

ভগবান শিব বললেন—

জ্ঞানকাণ্ড ও কর্মকাণ্ড ভেদে শাস্ত্রে দুই রকম মত দেখা যায়। জ্ঞানকাণ্ড ও কর্মকাণ্ড—এগুলি আবার দুটি দুটি করে ভাগে বিভক্ত।

বেদস্তাবৎ কাণ্ডদ্বয়াত্মকঃ।

তত্র পূর্বস্মিন্‌ কাণ্ডে নিত্যনৈমিত্তিককাম্যনিষিদ্ধরূপং

চতুর্বিধং কর্ম প্রতিপাদ্যং।

তৈত্তিরীয় সংহিতা ১৭১।১

সমগ্র বেদ দুই ভাগে বা দুই কাণ্ডে বিভক্ত। তার মধ্যে পূর্বকাণ্ডে নিত্য, নৈমিত্তিক, কাম্য ও নিষিদ্ধ এই চার রকমের কর্মের বিষয় বর্ণিত হয়েছে।

অত উত্তরকাণ্ড আরব্ধব্যঃ। আত্যন্তিকপুরুষার্থসিদ্ধিশ্চ দ্বিবিধা। সদ্যোমুক্তিঃ ক্রমমুক্তিশ্চেতি। তস্মাদুত্তরকাণ্ডে ব্রহ্মোপদেশ-ব্রহ্মোপাস্তিশ্চেত্যুভয়ং প্রতিপাদ্যতে।

তৈত্তিরীয় সংহিতা, প্রথম কাণ্ড, প্রথম প্রপাঠক, প্রথম অনুবাক্‌।

তারপর উত্তরকাণ্ডে সদ্যোমুক্তি ও ক্রমমুক্তি নামে দুই রকম আত্যন্তিক পুরুষার্থসিদ্ধির বিষয় নির্ণয় করা হয়েছে। এজন্য উত্তরকাণ্ডে ব্রহ্মবিষয়ক উপদেশ ও ব্রহ্মোপাসনা এই দুইটি বিষয় আলোচনা করা হয়।

দ্বাবিমাবথ পন্থানৌ যত্র বেদাঃ প্রতিষ্ঠিতাঃ।

প্রবৃত্তিলক্ষণো ধর্মো নিবৃত্তৌ চ বিভাষিতঃ।।

বাজসনেয় সংহিতার ভাষ্যে শঙ্করাচার্যের বাণী

বেদে দুই রকম ধর্ম প্রতিষ্ঠিত আছে। যথা—(১) প্রবৃত্তিলক্ষণ ধর্ম বা কর্মকাণ্ড, এবং (২) নিবৃত্তিলক্ষণ ধর্ম বা জ্ঞানকাণ্ড।

এই কর্মকাণ্ড ও জ্ঞানকাণ্ডের মধ্যে কর্মকাণ্ড বিনাশী, অর্থাৎ অনিত্য ফল দান করে এবং জ্ঞানকাণ্ড অবিনাশী, অর্থাৎ অনন্ত ফলদায়ী। যেমন, ব্যাসদেব শুকদেবকে বলেছেন—

কর্মবিদ্যাময়াবেতৌ ব্যাখ্যাস্যামি ক্ষরাক্ষরৌ।

মহাভারত, মোক্ষধর্ম পর্বাধ্যায় ৬৭।৩

নশ্বর কর্ম এবং অবিনশ্বর জ্ঞান-এই দুইয়ের বিষয় আমি তোমার কাছে বর্ণনা করছি।


[*] উন্নত ও গভীর বিষয়গুলি সর্বদা মনের মধ্যে বিচার করতে অভ্যাস করা বিশেষ প্রয়োজনীয়। মানুষের মধ্যে যাঁরা চিন্তাশীল নন, তাঁরা একরকম মানুষের মধ্যে গণ্যই নন, একথা আমাদের দেশের শাস্ত্রকারের বার বার বলে গিয়েছেন। যিনি চিন্তাশীল নন, তিনি হাজার রকম বিদ্যে শিখলেও জ্ঞানহীনদের মধ্যেই গণ্য হন।

টমাস কার্লাইল তাঁর এক চিঠিতে লিখেছেন—

“It is not books alone, or by books chiefly that a man becomes in all points a man.”

Treasury of Modern Biography, p. 293.

বিশিষ্ট আমেরিকান বুদ্ধিজীবী এমারসন বলেছেন—

“The man who thinks is the king; all else are journeymen.”

An Evening with Emerson.

by David Maerae, in The Americans at Home.

 

ট্যাগ সমুহঃ

দুর্গা-পরিবার

[পূর্ববর্তী পোস্টে কিশোরীলাল রায় রচিত দেবতত্ত্ব (১৮৮৫) গ্রন্থ থেকে দেবী দুর্গা, জগদ্ধাত্রী ও কালী—এই দেবীত্রয়ীর স্বরূপ বর্ণনা করা হয়েছে। এই পোস্টে ওই একই বই অবলম্বনে দেবী দুর্গার সঙ্গে পূজিত শিব, গণেশ, লক্ষ্মী, সরস্বতী ও কার্তিকের স্বরূপ বর্ণনা করা হল। এই লেখাটি মূল রচনার আধুনিক সরল বাংলা গদ্যে রূপান্তরণ।]

 

দুর্গা পরিবার

শিব

প্রলয়কর্তা অর্থে ঈশ্বরের নাম শিব। কিছুকাল না গেলে কোনো বস্তুর ধ্বংস অসম্ভব। তাই শিবকে কাল ও মহাকালও বলা হয়। যিনি সব কিছুর ধ্বংসকর্তা তাঁর আবার ধ্বংস কী? সুতরাং শিবের একটি বিশেষ নাম মৃত্যুঞ্জয়। বিশ্বকে ঈশ্বরের শরীর বলা হয়েছে। শিবোপাসকগণ মনে করেন ও সাধারণতও এই বিশ্বাস প্রবল দেখা যায় যে, মহাদেবের ললাটে ও মানুষের চোখের মতো তিনটি চোখ আছে। বাস্তবিক তা নয়। সূর্য, চাঁদ ও আগুনই মহাদেবের তিন চোখ, তাই তিনি ত্রিলোচন। যথা, শঙ্করাচার্য-কৃত অপবাদভঞ্জন স্তোত্রে “বন্দে সূর্যশশাঙ্ক বহ্নিনয়নং” ইত্যাদি। তিন চোখ তিন রকমের বলে মহাদেবের এক নাম বিরুপাক্ষ। জীর্ণদশায় প্রলয় ঘটে ও কালের বয়স অপরিমেয় বলে মহাদেবের মূর্তি বুড়ো মানুষের শরীরের মতো কল্পিত হয়েছে, তাঁকে প্রায় সর্বদা বৃদ্ধ বলে বর্ণনা কর হয়। চিতাভস্ম, শ্মশান ও নরমুণ্ড প্রভৃতি ধ্বংস বা মৃত্যুর স্মারক বলে ওই সবের দ্বারা তাঁকে দেখা হয়েছে। ধ্বংসকর্তা স্বয়ং মৃত্যুঞ্জয়, সুতরাং তাঁর মৃত্যুঞ্জয়ত্ব দেখানোর জন্য তিনি বিষধর সর্পজড়িত বলে বর্ণিত। মহাদেবরূপী কাল ও জড়জগৎরূপী প্রকৃতি সংযোগেই সব কিছুর উৎপত্তি হয়, সুতরাং মহাদেব ও দুর্গাকে জগতের পিতা ও মাতা বলা হয়েছে। কালিদাস বলেছেন “জগতঃ পিতরৌ বন্দে পার্বতী পরমেশ্বরৌ।” এই জন্য শিবলিঙ্গ ও গৌরীপট্টেরও কল্পনা। শবশিবারূঢ়া কালীমূর্তি, শক্তিহীন হলে শিবের যে অবস্থা ঘটে তা দেখানোর জন্য কল্পিত হয়েছে। কালী মহাদেবের শক্তি, সুতরাং শিবের দেহ থেকে শক্তি পৃথক হয়ে বেরিয়ে এলে শিব শক্তিহীন হয়ে শবের মতো পড়ে থাকেন। শঙ্করাচার্য আনন্দলহরীতে বলেছেন, “শিবঃ-শক্ত্যা-যুক্তো ভবতি শক্তঃ প্রভবিতুং। নচদেবং দেবোনখলু কুশলঃ স্পন্দিতুমপি।” অর্থাৎ, শিবের প্রভাব শক্তিযুক্ত থাকলেই; নয়তো তাঁহার নড়াচড়ার শক্তিও থাকে না। ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণের প্রকৃতি খণ্ডেও ওই কথা আছে। “শিবশক্তস্তয়া শক্ত্যাশবাকার স্তয়া বিনা।” অর্থাৎ, শিব শক্তিসহ থাকলেই শক্তিমান, নচেৎ শবাকার হন। মহাদেবকে বৃষবাহন বলার তাৎপর্য্য এই যে, কালের গতি বৃষভের গতির মতো ধীর অথচ নিশ্চিত। মেঘই মহাদেবের জটাজুট, সুতরাং শিবজটা থেকে গঙ্গার নির্গম হয় এর অর্থ এই যে, মেঘ থেকে জল নির্গত হয়। মহাদেবকে ভোলামহেশ্বর ও ধুস্তরফলাদি ভক্ষণকারী বলার তাৎপর্য এই যে, কালকে অনেক সময় মদবিহ্বল ব্যক্তির মতো কাজ করতে দেখা যায়। যেমন দুর্যোধনের রাজ্যভোগ ও যুধিষ্ঠিরের বনবাস প্রভৃতি। মহাদেব বৃদ্ধ কিন্তু উমা নিত্যযৌবনা, এর তাৎপর্য এই যে সময় একবার গেলে আর ফেরে না এবং তার বয়সেরও অন্ত নেই। কিন্তু পৃথিবী প্রতি বছর অভিনব বেশ ধারণ করে ও একবার বসন্ত শেষ হলেও তা বার বার আসতে থাকে।

 

কাল শূন্যের অনুরূপ ও আচ্ছাদনবিহীন বলে তাকে শ্বেতকায় ও দিগম্বর বলা হয়েছে। মহাদেবকে আদিদেব বলার তাৎপর্য এই যে, সবার আগেও কাল বিদ্যমান ছিল। সবই কালে ঘটছে। সুতরাং মহাদেব সর্বজ্ঞ, কালেই জ্ঞানলাভ হয়, সুতরাং তিনি জ্ঞানদাতা, এবং যশস্বী মহাত্মাদের কাল বাঁচিয়ে রাখে, সুতরাং তিনি ভক্তমুণ্ডমালী। মহাভারতে সুরথ সুধন্বার মুণ্ডগ্রহণ করার জন্য মহাদেবের যে আগ্রহ বর্ণিত হয়েছে, তাতে তাঁকে ভক্তমুণ্ডমালী শব্দের বাচ্য করে তুলেছে বলতে হবে।

 

অনন্ত বা শূন্যের বলরামরূপ কল্পনা করে কালের কল্পিতরূপ মহাদেবের সদৃশ করা হয়েছে। একটি মনোহরশায়ী গানেও বলা হয়েছে, “তার পর একজন বৃষভেতে আরোহণ, দাদা বলাইর মতন।” বাস্তবিক বলরাম ও মহাদেবের রূপে বিলক্ষণ সাদৃশ্য আছে। অনন্ত কাল অনন্ত আকাশের সদৃশ্যই বটে। শাস্ত্রে অনেক জায়গায় শিব ও দুর্গাকে পুরুষ ও প্রকৃতিও বলা হয়েছে।

 

রুদ্রের আট রকম শরীরের বর্ণনাও আছে। যথা— সূর্য, জল, পৃথিবী, অগ্নি, আকাশ, বায়ু, দীক্ষিত ব্রাহ্মণ ও চন্দ্র। দীক্ষিত ব্রাহ্মণের বদলে কোনো কোনো স্থলে জীব লেখা হয়েছে।

 

গণেশ

সিদ্ধির অধিষ্ঠাত্রী দেবতা অর্থে ঈশ্বরের নাম গণেশ। আগে সিদ্ধিকামনা করেই লোকে সব কাজে হাত লাগায়। সুতরাং সব দেবতার আগেই গণেশের পূজার নিয়ম হয়েছে। ইঁদুর নানা রকম বস্তু কেটে দেয়, সুতরাং বিঘ্নছেদনকারীর বাহন কল্পনা করতে ইঁদুরই সুসঙ্গত হয়। বিঘ্নস্বরূপ অন্ধকারের কাছে জ্যোতিস্বরূপ বলে গণেশের গায়ের রং সিঁদুরের মতো। হাতি যেমন শুঁড় দিয়ে জল তুলে ইচ্ছা মতো পান করে বা ফুঁ দিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দেয়, সেই রকম গণেশও ইচ্ছামতো বিঘ্নরাশি তুলে দূরে ফেলে দিতে পারেন। তাই তাঁকে গজানন (অর্থাৎ, যাঁর হাতির মতো মুখ) বলে বর্ণনা করা হয়েছে। সমস্ত সিদ্ধি তিনি নিজেতে সঞ্চিত করে রেখেছেন, তাই তাঁকে লম্বোদর বলে।

 

লক্ষ্মী

শোভা ও সম্পত্তির অধিষ্ঠাত্রী দেবতা এই অর্থে ঈশ্বরের নাম লক্ষ্মী। চন্দ্র খুবই সুন্দর, তাই চন্দ্রকে লক্ষ্মীর ভাই বলা হয়। সম্পত্তি কারো কাছে স্থির থাকে না, সুতরাং লক্ষ্মী চঞ্চলা। পদ্মবন অত্যন্ত সুন্দর জায়গা, তাই লক্ষ্মীর নাম পদ্মালয়া। শোভাতে কামের জন্ম হয়, তাই লক্ষ্মী কন্দর্প বা কামদেবের জননী বলে অভিহিত হয়েছেন।

 

সরস্বতী

বাক্যের সঙ্গে জ্ঞান সংশ্লিষ্ট। অতএব সরস্বতী কেবল শব্দের অধিষ্ঠাত্রী দেবতাই নন, জ্ঞানাধিষ্ঠাত্রী দেবতাও বটে। বেদ ছাড়া অন্যান্য বিদ্যা ও বাক্যের অধিপতি—এই অর্থে ঈশ্বরের নাম সরস্বতী। বেদের অধিপতি অর্থে তাঁর নাম সাবিত্রী (এই সাবিত্রী-সত্যবান কাহিনির পৌরাণিক চরিত্র নন)। সরস্বতীকে শ্বেতপদ্মে অধিষ্ঠিতা, শ্বেতবস্ত্র পরিহিতা, শ্বেতবর্ণা ও শ্বেতবীণাধরা বলার তাৎপর্য এই যে— বিদ্যা দিয়ে মনের অজ্ঞান-অন্ধকার দূর হয়, সুতরাং অজ্ঞান অন্ধকার-স্বরূপ, বিদ্যা আলোক স্বরূপ। এবং আলোক স্বরূপ প্রকাশে শ্বেতবর্ণের আবশ্যক। সরস্বতীর হাতে বই; কারণ বইই জ্ঞানের ভাণ্ডারস্বরূপ। অতএব দেখা যাচ্ছে যে নিরাকারা সরস্বতীর রূপ কল্পনা করতে হলে তাঁকে শ্বেতবর্ণ-বিশিষ্ট বলে কল্পনা করলেই প্রশংসনীয় রূপক হয়। ধর্মতত্ত্ব-এর কোনো লেখক যথার্থই বলেছেন যে, মাঘমাসে সরস্বতী পূজা বিহিত হওয়ার কারণ এই যে, এই সময়ে বসন্তের ছায়া পড়ে এবং বসন্তকালই সঙ্গীতবিলাসের সর্বোৎকৃষ্ট সময়। বাস্তবিক সঙ্গীতেশ্বরীর আরাধনা বসন্তের প্রারম্ভেই হওয়া উচিত। সরস্বতী যে শাস্ত্রকারগণের মতে ঈশ্বরের নামান্তর মাত্র; তা “বিশ্বরূপা বিশালাক্ষী” ইত্যাদি বাক্য আলোচনা করলেই বোঝা যাবে।

 

কার্তিক

কেবল সংগ্রামের অধিষ্ঠাত্রী দেবতা, এই অর্থে ঈশ্বরের নাম কার্তিক। যুদ্ধদেবের মতি তেজোময় হওয়া উচিত, সুতরাং কার্তিকেয়কে অগ্নির পুত্রও বলা হয়েছে। কৃত্তিকা নামক আগুনরঙা ছয়টি তারা, ঐ অগ্নির পুত্র বা মহাদেবের পুত্রকে পালন করেছিলেন, এই জন্য তাঁর নাম কার্তিকেয় বা ষড়ানন হয়েছে। অগ্নির মত তেজবিশিষ্ট দেবতার অগ্নিবর্ণা পালয়িত্রী কল্পনা করাই যুক্তিসঙ্গত। যোদ্ধা ও সুন্দরবর্ণ ময়ূরই কার্তিকের উপযুক্ত বাহন। যোদ্ধারা ভালভাবে রণসজ্জা করে ভাল একটা বাহনে চেপেই যুদ্ধক্ষেত্রে যান; সুতরাং যুদ্ধের অধিষ্ঠাত্রী দেবতা অর্থে ঈশ্বরের রূপ ও বাহনাদি কল্পনা করতে হলে, তাঁকে অতি সুন্দর পুরুষ ও সুন্দর বাহনে আরূঢ় বলেই বর্ণনা করতে হয়।

 

ট্যাগ সমুহঃ

দুর্গা-জগদ্ধাত্রী-কালী

[কিশোরীলাল রায় রচিত দেবতত্ত্ব (১৮৮৫) গ্রন্থ থেকে আধুনিক সরল বাংলা গদ্যে রূপান্তরিত।]

সপরিবার দুর্গা

মূল প্রকৃতিকে ঈশ্বরের সৃষ্টিশক্তি বা মায়াশক্তি বলে। আবার পঞ্চভূত ইত্যাদি জড় পদার্থের সমষ্টিকেও প্রকৃতি বলে। দুর্গা মূল প্রকৃতির এক অংশ। ব্রহ্মাণ্ডব্যাপী ও দুর্গতিনাশকারী—এই অর্থে ঈশ্বরের নাম দুর্গা। জড় পদার্থ জগৎ, পর্বত সবকিছু দিয়ে ধরা আছে; আর পর্বতের মধ্যে হিমালয় সবচেয়ে বড়ো—অতএব দুর্গাকে পার্বতী ও হিমালয়নন্দিনী বলে। গঙ্গাকেও হিমালয়নন্দিনী বলে, যেহেতু তা হিমালয় থেকে নিঃসৃত হয়েছে সাগর-অভিমুখে প্রবাহিত হয়েছে। এই জন্যই দুর্গাকে গঙ্গার সপত্নী বলে। কিন্তু মহাশক্তির অধিষ্ঠাত্রী দেবতা অর্থেই সচরাচর ঈশ্বরকে দুর্গা বলে বর্ণনা করা হয়েছে। দশ হাতই সেই অর্থে মহাশক্তির পরিচায়ক। পরাক্রমাধিষ্ঠাত্রী দেবতার সিংহই উপযুক্ত বাহন। দুর্জন বা অসুরেরাই জগতের দুর্গতির প্রধান কারণ, অতএব দুর্গা অসুরনাশিনী বলে বর্ণিত হয়েই একপ্রকারে দুর্গতিনাশিনী বলে বর্ণিত হয়েছেন। যখন নানা রকমের দুর্গতি আছে, তখন অন্য প্রকার দুর্গতিনাশিনী অর্থেও দুর্গাকে দুর্গা বলা যায়। শারদীয়া দুর্গাপ্রতিমার সঙ্গে সরস্বতী ও কার্তিক ইত্যাদি মূর্তিও দেখা যায়। এর তাৎপর্য এই যে, দুর্গতিনাশিনী মহাশক্তির থেকেই যখন যুদ্ধশক্তি উৎপন্ন হয়, তখন যুদ্ধদেবতা কার্তিককে দুর্গার ছেলে বলা যায়। যখন ওই মহাশক্তি থেকেই দুর্গতি ও বিঘ্ন বিনষ্ট হয়ে সিদ্ধি প্রাপ্ত হওয়া যায়, তখন সিদ্ধিদেবতা গণেশও দুর্গার সন্তান বলে পরিগণিত হতে পারে। একই রকম ভাবে বাকশক্তি ও জ্ঞানশক্তি দ্বারাও দুর্গতি দূর হয় বলে এবং তা মহাশক্তির এক অংশ বলে সেই শক্তির অধিষ্ঠাত্রী দেবতা সরস্বতীকেও দুর্গার সঙ্গে দেখা যায়। মহাশক্তির অংশ—তাই শোভা ও সম্পত্তির অধিষ্ঠাত্রী দেবতা লক্ষ্মীও দুর্গার পাশে বিরাজ করেন। মহাশক্তি বলে দুর্গাকে নিদ্রা, ক্ষুধা, লজ্জা, তুষ্টি, আগুনের দাহিকা শক্তি, সূর্যের তেজ, জলের শীতলতা, ব্রাহ্মণের ব্রহ্মণ্যশক্তি, ক্ষত্রিয়ের ক্ষত্রিয়শক্তি, তপস্বীর তপস্যাশক্তি, ক্ষমাবানের ক্ষমাশক্তি, পৃথিবীর ধারণ ও শস্য-উৎপাদন ক্ষমতা প্রভৃতি বলে স্তব করা হয়েছে ও হয়ে থাকে। যাঁরা শাস্ত্রতত্ত্ব বোঝেন না, তাঁরাই মাটির দুর্গাপ্রতিমাকে দুর্গা মনে করেন। কিন্তু জ্ঞানী ও শাস্ত্রজ্ঞ ব্যক্তি বুঝতে পারেন যে, ঈশ্বরকেই অবস্থা বিশেষে দুর্গা বলে বর্ণনা করা হয়েছে। যথা—”গণেশজননী দুর্গা রাধা লক্ষ্মী সরস্বতী। সাবিত্রী চ সৃষ্টিবিধৌ প্রকৃতিঃ পঞ্চমী স্মৃতা।” অর্থাৎ, মূল প্রকৃতিকে পাঁচ অংশে বিভক্ত করা হয়েছে। যথা—দুর্গা, রাধা, লক্ষ্মী, সরস্বতী, সাবিত্রী। দুর্গাতে তেজের অধিষ্ঠাত্রী দেবতা বলা হয়েছে। যথা—”তেজস্বরূপা পরমা তদধিষ্ঠাত্রী দেবতা।” হিন্দুশাস্ত্রের একটি প্রধান লক্ষণ এই যে, এতে ঈশ্বরের নাম নিয়ে অনেক প্রসঙ্গ আলোচনা করা হয়েছে। যেমন নারায়ণের সহস্র নাম, শত নাম, ষোড়শ নাম, অষ্ট নাম ইত্যাদি। এই রকম দুর্গারও সহস্র নাম বর্ণিত হয়েছে। ঈশ্বরের নাম নিয়ে এত প্রসঙ্গ করা হয়েছে যে, প্রায় প্রত্যেক ব্যাপারেই একটি পৃথক নাম নেওয়ার বিধি দেওয়া হয়েছে। যথা—”ঔষধে চিন্তয়েদ্বিষ্ণুং ভোজনে জনার্দনং। শয়নে পদ্মনাভঞ্চ বিবাহে চ প্রজাপতিং।।” ইত্যাদি। ভিন্ন ভিন্ন অঙ্গ রক্ষার জন্য ভিন্ন ভিন্ন নাম দেওয়া হয়েছে। যথা—”পায়ান্মধ্যং দিনে বিষ্ণু প্রাতর্নারায়ণ্যেবতু। মধুহাচাপারাহ্নে চ সায়ং রক্ষতু মাধবঃ।।” ইত্যাদি। ভিন্ন ভিন্ন স্থানে ভিন্ন ভিন্ন নামে ঈশ্বরের অধিষ্ঠান কথিত হয়েছে। যথা—মানসহ্রদে মৎস্য, হস্তিনাপুরে গোবিন্দ, কুরুক্ষেত্রে কুরুধ্বজ, হিমাচলে শূলবাহু, অবন্তিনগরে বিষ্ণু, বারাণসীতে কেশব, মর্ত্যলোকে অগস্ত্য, ভুবর্লোকে গরুড়, স্বর্গলোকে বিষ্ণু, জম্বুদ্বীপে চতুর্বাহু ইত্যাদি। শিব ও রাধিকারও সহস্র নাম কথিত হয়েছে। কিন্তু চৈতন্যদেবের সময়ে ঈশ্বরের নামের যে প্রকার অত্যধিক আলোচনা হয়েছে, এমন আর কোনো সময়েই হয়নি। এই বিষয়ে খ্রিস্টানদের সঙ্গে হিন্দুদের সম্পূর্ণ উল্টো রীতি দেখা যায়। খ্রিস্টধর্মে অনর্থক ঈশ্বরের নাম নেওয়া অপরাধ। কিন্তু হিন্দুদের মতে, অবহেলা করে নাম নেওয়াও মহাপুণ্যজনক। চৈতন্যদেবের সময়ে মহাভাগবত হরিদাস ঠাকুর প্রতিদিন তিন লক্ষ বার হরিনাম জপ করতেন। আজও অনেক হিন্দু রোজ শত শত বার ঈশ্বরের নাম জপ করে থাকেন। নাম জপের এত প্রাবল্য ভারতবর্ষ ছাড়া পৃথিবীর আর কোন দেশেই দেখা যায় না। এর একটি প্রধান কারণ এই যে, অন্যান্য জাতি অপেক্ষা ভারতীয়রা ঈশ্বরের দাস হওয়ার চেয়ে ঈশ্বরের প্রেমিক হতেই বেশি ভালবাসে।

দুর্গাকে প্রকৃতির অংশ বলে ও শাস্ত্রে অনেক জায়গায় তাঁকে স্বয়ং প্রকৃতি বলে বর্ণনা করা হয়েছে। পুরুষ ও প্রকৃতিকে কখনও কখনও কৃষ্ণ ও রাধা, কখনও কখনও শিব ও দুর্গা এবং কখনও কখনও লিঙ্গ ও যোনি বলা হয়েছে। যোনিপূজা বললে শাস্ত্র-না-জানা লোক তাকে যেভাবে গ্রহণ করে, দার্শনিক ও শাস্ত্রজ্ঞ ব্যক্তি কখনই তাকে সেভাবে গ্রহণ করে না। উক্তস্থলে সত্ব, রজঃ ও তমঃ এই তিন গুণের সমবায়ের নামই যোনি এবং ঐ ত্রিগুণের সাম্য অবস্থার নামই প্রকৃতি।

পুরুষের যে রকম দশাবতার বর্ণিত হয়েছে, তেমনই প্রকৃতিরও দশাবতারের (দশমহাবিদ্যা) বর্ণনা আছে। যথা—”কৃষ্ণরূপা কালিকাস্যাৎ রামরূপা চ তারিণী। বগলা কূর্মমূর্তিস্যান্মীনো ধূমাবতীভবেৎ।। ছিন্নমস্তা নৃসিংহর্স্যাদ্ববরাহশ্চৈব ভৈরবী। সুন্দরী যামোদগ্ন্যর্স্যাদ্বামনো ভুবনেশ্বরী।। কমলা বৌদ্ধরূপাস্যাৎ দুর্গাস্যাৎ কল্পিরূপিণী।” ইত্যাদি। ইতি শব্দকল্পদ্রুমধৃত মুণ্ডমালা তন্ত্র।

জগদ্ধাত্রী

ছান্দোগ্য উপনিষদে মহাশক্তি বিষয়ক একটি সুন্দর গল্প আছে। সেটি হল: এক সময় ইন্দ্র প্রভৃতি দেবতারা মোহে পড়ে নিজেদের ঈশ্বর ভাবতে শুরু করেছিলেন। তা দেখে ভগবান এক অনির্বচনীয় কোটিচন্দ্রসূর্যের জ্যোতিঃপুঞ্জের রূপে তাঁদের সামনে দেখা দিলেন। তিনি বায়ুকে জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি কে? বায়ু উত্তর দিলেন, আমি মাতরিশ্বা, আমি সক কিছু ওড়াতে পারি। জ্যোতিঃপুঞ্জ একটি ঘাস সামনে রেখে বললেন, এই ঘাসটুকু ওড়াও। বায়ু কোনোভাবেই তা ওড়াতে না পেরে লজ্জায় মাথা নিচু করে রইলেন। তারপর অগ্নি হাজির হলে তাঁর পরিচয় জানতে চাওয়া হল। অগ্নি উত্তর দিলেন, আমি অনল, আমি সব কিছু পোড়াতে পারি। জ্যোতিঃপুঙ্ক তাঁকে সেই ঘাসটি পোড়াতে বললে, অগ্নি তা পোড়াতে না পেরে লজ্জা পেয়ে গেলেন। কাত্যায়নী তন্ত্রের মতে, এই জ্যোতিঃপুঞ্জ পরে চতুর্ভূজা জগদ্ধাত্রীরূপে বিনয়াবনত দেবগণের সামনে কিছুক্ষণ প্রকাশিত থেকে অন্তর্হিতা হলেন। এই জগদ্ধাত্রীও দুর্গার রূপান্তর বিশেষ। শোভা, শক্তি ও জ্ঞানদাত্রীত্ব সূচনার্থে ইনি জ্যোতির্ময়ী বলে বর্ণিত হয়েছেন।

কালী

কালীকে দুর্গার ললাট থেকে উৎপন্না বলা হয়েছে। যথা—”দুর্গার ললাটে জাতা জলদবরণী।” কালী দুর্গার ললাট থেকে উৎপন্না হয়েছেন—এই বাক্যের তাৎপর্য যে, ললাটের সংকোচনেই ক্রোধভাব প্রকাশিত হয় বলে সদা ক্রোধান্বিতা; রণরঙ্গিনী করাল-বদনা কালীকে ললাট-সম্ভবা বলা হয়েছে। বাস্তবিক কালীও দুর্গার রূপান্তর বিশেষ। ক্রোধাবস্থাপন্না শক্তিকেই কালী বলা বয়েছে। ভয়ানক ভাবান্বিতা বিশ্বব্যাপিনী শক্তি—এই অর্থে ঈশ্বরের নাম কালী। এই জন্য কালীর বিবিধ প্রকার ভয়ানক মূর্তি কল্পিত হয়েছে। ধূমাবতী, ছিন্নমস্তা ও ভৈরবী—এ সবারই অতি ভয়ংকর মূর্তি। পাঠকদের জ্ঞাতার্থে একটি ধ্যান দেওয়া হল। দক্ষিণাকালীর ধ্যান—

করালবদনাং ঘোরাং মুক্তকেশীং চতুর্ভূজাম্। কালিকাং দক্ষিণাং দিব্যাং মুণ্ডমালাবিভূষিতাম্।। সদ্যশ্চিন্নশিরঃখড়্গবামাধোর্ধ্বকরাম্বুজাম্। অভয়ং বরদং চৈব দক্ষিণোর্ধ্বাধঃপাণিকাম্।। মহামেঘপ্রভাং শ্যামাং তথা চৈব দিগম্বরীম্। কর্ণাবসক্তমুণ্ডালীগলদ্রুধিরচর্চিতাম্।। কর্ণাবতংসতানীতশবযুগ্মভয়ানকম্। ঘোরদ্রংষ্টাং করালাস্যাং পীনোন্নতপয়োধরাম্।। শবানাং করসংঘাতৈঃ কৃতকাঞ্চীং হসন্মুখীম্। সৃক্কদ্বয়গলদ্রক্তধারাবিস্ফুরিতাননাম্।। ঘোররাবাং মহারৌদ্রীং শ্মশানালয়বাসিনীম্। বালার্কমণ্ডলাকারলোচনত্রিতয়ান্বিতাম্।।  দন্তুরাং দক্ষিণব্যাপিমুক্তালম্বিকচোচ্চয়াম্। শবরূপমহাদেবহৃদয়োপরি সংস্থিতাম্। শিবাভির্ঘোররাবাভিশ্চতুর্দিক্ষু সমান্বিতাম্। মহাকালেন চ সমং বিপরীতরতাতুরাম্।। সুখপ্রসন্নবদনং স্মেরাননসরোরুহম্। ছিন্নমস্তার ধ্যান আরও ভয়ংকর। বাস্তবিক কালীর মূর্তি, অস্ত্র, অনুচরী ডাকিনী ও যোগিনী এবং বাসস্থান ভূতশ্মশান সবই ভয়ানক ভাবের অবতার বিশেষ। কালী-সংক্রান্ত সব কিছুই যেমন ভয়ানক, তেমন আবার কৃষ্ণ সংক্রান্ত সব কিছুই আনন্দপ্রদ। কৃষ্ণের মূর্তি মনোহর। হাতে আনন্দজনক শব্দকর মুরলী। প্রিয়তমা আনন্দরূপিণী রাধিকা। মনোহর বেশধারিণী সখীগণের মধ্যে কেউ বীণা, কেউ বংশী, কেউ রবাব, কেউ মৃদঙ্গ, কেউ বা খঞ্জনী বাজাচ্ছেন। সংক্ষেপে বললে, তাঁরা নৃত্যগীতে মেতে থাকেন, নানা রকম বাদ্যযন্ত্র সুন্দর বাজাতে পারেন এবং সাদা, লাল, নীল, হলুদ প্রভৃতি নানা রঙের সুন্দর বস্ত্র পরে থাকেন। কালীর মূর্তি ও সংগ্রামকর্ম—দুইই ভয়ংকর। কৃষ্ণের মূর্তি ও নৃত্যগীতরূপ কাজ উভয়ই মনোহর। কালীর উপাসকেরা যেমন সব রকম ভয়ানক ভাবের একত্র সমাবেশ করতে যার-পর-নাই যত্নপরায়ন হয়েছেন, তেমন কৃষ্ণের উপাসকগণও আনন্দজনক ভাব সংগ্রহে, যিনি যেখান থেকে পেরেছেন, সেখান থেকে উপকরণ সঞ্চয় করে গেছেন। কালীর বাসস্থান ভয়ানক শ্মশান, কৃষ্ণের বাসস্থান মনোহর বৃন্দবন। কালীর হাতে ভয়ানক খড়্গ, কৃষ্ণের হাতে মনোহর বাঁশি। কালীর শরীর রক্তমাখা, কৃষ্ণের শরীর চন্দনমাখানো। কালী গম্ভীর গর্জন করেন, কৃষ্ণ মিষ্টি মিষ্টি কথা বলেন। কালী যুদ্ধে মেতে থাকেন, কৃষ্ণ নাচগান করেন। কালীর গলায় মুণ্ডমালা, কৃষ্ণের গলায় ফুলের হার। সংক্ষেপে বললে, কালীর ভয়ানক বেশ, কৃষ্ণের মূর্তি মনোহর। কালীর উপাসকরা নানারকম প্রাণী বলি দেয়, কৃষ্ণের উপাসনায় বলি নিষিদ্ধ। কালীপূজার কাল অমাবস্যা তিথি ও ঘনঘোর অন্ধকার রাত। মৃতদেহের উপর বসে, শ্মশানে তাঁর সাধনা করতে হয়। পূজার বাদ্যযন্ত্র ঢাক ও উপহারের ফুল টকটকে লাল রঙের জবা। তান্ত্রিকেরা আবার পঞ্চ-মকার দিয়ে ভয়ানক সাধনপ্রণালীর বিধানও দিয়েছেন। মদ্য, মাংস, মৎস্য, মুদ্রা ও মৈথুন—এই পঞ্চ-মকারের প্রায় প্রত্যেকই বাইরে থেকে দেখলে এক এক ভয়ানক সাধন-প্রণালী। বাইরে থেকে—এই কথা বলার তাৎপর্য এই যে, ওই পঞ্চ-মকারের আধ্যাত্মিক ভাব অত্যন্ত নির্মল ও উচ্চ। লোকনাথ বসু তাঁর হিন্দুধর্ম মর্ম নামক বইয়ে পঞ্চ-মকার সম্পর্কে আগমসারের যে এক অংশ উদ্ধৃত করেছেন, তার তাৎপর্য এই যে, ঐ স্থানে মদ্য বলতে পানীয় মদ বোঝায় না, তা ব্রহ্মরন্ধ্র থেকে ক্ষরিত অমৃতধারা বা ব্রহ্মানন্দ; মাংস মানে দেহের মাংস নয়, তা হল জিভের সংযম; মৎস্য বলতে মাছ বোঝায় না, তা হল শ্বাসনিরোধ (প্রাণায়ম); মুদ্রা মানে টাকাপয়সা নয়, বরং আত্মাতে যে পরমাত্মা মুদ্রিত হয়ে আছেন, সেই তত্ত্বজ্ঞান এবং মৈথুন বলতে যৌনসংগম বোঝায় না, তা হল জীবাত্মাতে পরমাত্মার বিরাজ।

শারদীয়া দুর্গাদেবীর কৃষ্ণানবম্যাদিবিহিত কল্পারম্ভ (১৪১৯ বঙ্গাব্দ) উপলক্ষ্যে প্রকাশিত বিশেষ রচনা।

 
4 টি মন্তব্য

Posted by চালু করুন অক্টোবর 9, 2012 in পুরনো লেখা

 

ট্যাগ সমুহঃ

দুর্গা নামের অচেনা দেবীরা

© অর্ণব দত্ত

কালীঘাট সহযাত্রীর দুর্গাপ্রতিমা–আকর্ণনয়না সাবেকি ধাঁচের দেবীমূর্তি। এ শিল্প পশ্চিমবঙ্গের সনাতন শিল্প।

দুর্গা—এই নামটি শুনলেই আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে একটা দেবীমূর্তি। তাঁর দশ হাতে দশ রকম অস্ত্র, এক পা সিংহের পিঠে, এক পা অসুরের কাঁধে। তাঁকে ঘিরে থাকেন গণেশ, লক্ষ্মী, সরস্বতী আর কার্তিক ঠাকুর। যাঁরা সেকেলে কেতায় ঠাকুর বানান, তাঁদের ঠাকুরের পিছনে চালচিত্রে আরও নানারকম ঠাকুরদেবতার ছবিও আঁকা থাকে। আর যাঁরা আধুনিক, তাঁরা প্রতিমার মাথার উপর একখানা ক্যালেন্ডারের শিবঠাকুর ঝুলিয়ে রাখেন। মোটামুটি এই মূর্তি বছর বছর দেখে আমরা অভ্যস্ত। তবে মাঝে মাঝে পুজো উদ্যোক্তারা একটু স্বাদবদলের জন্য বানান পঞ্চদুর্গা, নবদুর্গা, একাদশ দুর্গা, একান্ন দুর্গা ইত্যাদি। শাস্ত্রে কতরকম মাতৃমূর্তির কথা আছে। তার থেকেই সামর্থ্য অনুযায়ী কয়েকটা বেছে নিয়ে পঞ্চদুর্গা, নবদুর্গা ইত্যাদি বানানো। আমাদের ছেলেবেলায় দেখেছি, থিমপুজো শুরু হওয়ার আগে এই সব প্যান্ডেল নিয়ে ঠাকুর-দর্শনার্থীদের মধ্যে একটা বিশেষ আগ্রহ থাকত। এখনও আছে। মায়ের সনাতন মূর্তির আবেদন কখনও ম্লান হয় না ঠিকই, কিন্তু মানুষ এই সুযোগে অন্যান্য রূপগুলি দেখে চোখ জুড়িয়ে নিতেও ছাড়েন না।

শাস্ত্রে দুর্গার নয়টি নির্দিষ্ট মূর্তিকে ‘নবদুর্গা’ বলে। এঁরা হলেন—ব্রহ্মাণী, কৌমারী, বৈষ্ণবী, কৌমারী, নারসিংহী, বারাহী, ইন্দ্রাণী, চামুণ্ডা, কাত্যায়নী ও চণ্ডিকা। দুর্গাপূজার সময় দেবীদুর্গার আবরণদেবতা হিসেবে এঁদের পূজা করা হয়। আবার নবপত্রিকা (কলাবউ)-এর নয়টি গাছও নয় দেবীর প্রতীক। এঁরা হলেন—ব্রহ্মাণী (কলা), কালিকা (কচু), দুর্গা (হলুদ), জয়ন্তী (জায়ফল), শিবা (বেল), রক্তদন্তিকা (ডালিম), শোকরহিতা (অশোক), চামুণ্ডা (মান) ও লক্ষ্মী (ধান)। এঁরা পূজিত হন ‘ওঁ নবপত্রিকাবাসিন্যৈ নবদুর্গায়ৈ নমঃ’ মন্ত্রে।

তবে এঁরা ছাড়াও তন্ত্রে, পুরাণে আরও কয়েকজন দুর্গা-নামধারিণী দেবীর সন্ধান পাই। আবার দেবী দুর্গার অন্যান্য কয়েকটি রূপেরও দেখা পাওয়া যায়। আমরা সাধারণত দুর্গার যে মূর্তিটি শারদীয়া উৎসবে পূজা করি, সেই মূর্তিটির শাস্ত্রসম্মত নাম মহিষাসুরমর্দিনী-দুর্গা। স্মার্তমতে যাঁরা পঞ্চদেবতার পূজা করেন, তাঁরা জয়দুর্গার নাম ও ধ্যানমন্ত্রের সঙ্গে পরিচিত। এছাড়া আছেন মহিষমর্দিনী-দুর্গা, কাত্যায়নী-দুর্গা, নীলকণ্ঠী-দুর্গা, ক্ষেমঙ্করী-দুর্গা, হরসিদ্ধি-দুর্গা, রুদ্রাংশ-দুর্গা, বনদুর্গা, অগ্নিদুর্গা, বিন্ধ্যবাসিনী-দুর্গা, রিপুমারি-দুর্গা, অপরাজিতা-দুর্গা প্রমুখ দেবীগণ। এঁরা সবাই আগম-শাস্ত্রপ্রসিদ্ধ দেবী। এছাড়া তন্ত্রশাস্ত্রে দুর্গা-নাম্নী দেবীর যে ধ্যানমন্ত্র পাওয়া যায়, সেটিও আমাদের দেখা দশভুজা-মূর্তির মতো নয়।

মহিষাসুরমর্দিনী-দুর্গাকে নিয়ে আমাদের নতুন করে কিছুর বলার নেই। দুর্গাপূজায় প্রচলিত ‘জটাজুটসমাযুক্তা’ ইত্যাদি ধ্যানমন্ত্রের আধারে নির্মিত এই দেবীমূর্তি আমাদের সকলেরই পরম-পরিচিত। তবে বিষ্ণুধর্মোত্তর পুরাণ-এ মহিষাসুরমর্দিনীর একটু আলাদা রকমের বর্ণনা আমরা পাই। চণ্ডিকা নামে উল্লিখিত এই দুর্গার দশের জায়গায় কুড়িটি হাত। শ্রীশ্রীচণ্ডী-তে অষ্টাদশভূজা মহালক্ষ্মীর কথা আছে, এঁর হাত তাঁর থেকেও দুটি বেশি। ডান দিকের দশ হাতে থাকে শূল, খড়্গ, শঙ্খ, চক্র, বাণ, শক্তি, বজ্র, অভয়, ডমরু, ছাতা; আর বাঁদিকের দশ হাতে থাকে নাগপাশ, খেটক, পরশু, অঙ্কুশ, ধনুক, ঘণ্টা, পতাকা, গদা, আয়না ও মুগুর। বাকি সবই আমাদের চেনা মূর্তিটির মতো। দেবী কাত্যায়নী-দুর্গার মূর্তিটিও আমাদের দশভূজা-দুর্গার অনুরূপ। তবে আমাদের পরিচিত মহিষাসুরমর্দিনী ও তন্ত্রকথিত মহিষমর্দিনীর রূপে সামান্য ফারাক আছে। দেবী মহিষমর্দিনী অষ্টভুজা। এঁর ধ্যানে সিংহের উল্লেখ পাওয়া যায় না। দেবীকে মহিষের মাথার উপর বসে থাকতে দেখা যায়। হাতে থাকে শঙ্খ, চক্র, খড়্গ, খেটক, ধনুক, বাণ, শূল ও তর্জনীমুদ্রা। এর পূজার বিশেষ বৈশিষ্ট্য হল—শঙ্খপাত্রে অর্ঘ্যস্থাপনের উপর নিষেধাজ্ঞা; মৃৎপাত্রে এই কাজটি করতে হয়।

কুলাচারে পূজিতা দেবী জয়দুর্গার মূর্তিটি কিছুটা আমাদের পরিচিত জগদ্ধাত্রী মূর্তির মতো। শুধু দেবীর চার হাতে থাকে শঙ্খ, চক্র, খড়্গ ও ত্রিশূল এবং দেবীর গায়ের রং কালীর মতো কালো। কপালে থাকে অর্ধচন্দ্র। সিংহের পদতলে হাতি অনুপস্থিত। কেউ কেউ মনে করেন, জয়দুর্গা কালী ও দুর্গার সম্মিলিত মূর্তি।

Read the rest of this entry »

 

ট্যাগ সমুহঃ

হেনরি জেমস (১৮৪৩-১৯১৬)

জীবন

তরুণ হেনরি জেমস

হেনরি জেমসের জন্ম নিউ ইয়র্কের এক ধনী ও সম্ভ্রান্ত আমেরিকান পরিবারে। শিক্ষা মূলত যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে। পরে ১৮৬২ সালে তিনি আইন পড়ার জন্য যোগ দেন হার্ভার্ডে। নিউ ইংল্যান্ড লেখকগোষ্ঠীর সদস্য জেমস রাসেল লোয়েল, এইচ. ডাবলিউ. লংফেলো, উইলিয়াম ডিন প্রমুখ ছিলেন তাঁর বন্ধুস্থানীয়। হাওয়েলের অ্যাটলান্টিক মান্থলি ও অন্যান্য কয়েকটি মার্কিন পত্রিকায় লেখালিখি করতে গিয়ে জেমসের সাহিত্যজীবনের সূত্রপাত হয়। ১৮৬০-এর দশকের শেষদিক থেকে পুরনো ইউরোপীয় সভ্যতা তাঁকে বিশেষভাবে আকর্ষণ করতে শুরু করে। এই সময় ইউরোপে তিনি দীর্ঘদিন কাটান। শেষে ১৮৭৫ সালে পাকাপাকিভাবে চলে আসেন লন্ডনে। ১৮৯৭ সাল পর্যন্ত জেমস লন্ডনেই ছিলেন। তারপর তিনি চলে যান রাইতে। সেখানেই বাকি জীবন কাটিয়ে দেন। ১৯১৫ সালে তিনি ব্রিটেনের নাগরিকত্ব লাভ করেছিলেন।

সাহিত্য

জেমস ছিলেন বহুমুখী প্রতিভাধর লেখক। উপন্যাস, ছোটোগল্প, ভ্রমণকাহিনি, সাহিত্য সমালোচনা, আত্মজীবনী—সব কিছুই সারাজীবন ধরে নিয়মিত লিখে গিয়েছেন। তাঁর প্রধান উপন্যাসগুলিকে তিনটি শ্রেণিতে ভাগ করা যায়। রোডেরিক হাডসন (১৮৭৫) থেকে শুরু করে যে চারটি উপন্যাস আমরা পাই, সেগুলি তাঁর পরিণত উপন্যাসগুলির তুলনায় অনেক সরল সাদাসিধে পদ্ধতিতে লেখা। এগুলির মধ্যে তিনি ধরেছেন পুরনো ইউরোপীয় সংস্কৃতি ও নব্য আমেরিকান সভ্যতার পার্থক্যের দিকটিকে। এই শ্রেণির অপর তিনটি উপন্যাসের নাম দ্য আমেরিকান (১৮৭৬-৭৭), দ্য ইউরোপিয়ানস (১৮৭৮) ও দ্য পোর্ট্রেট অফ আ লেডি (১৮৮১)। শেষোক্ত উপন্যাসটিকে তাঁর প্রথম জীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ রচনা বলা চলে। এই উপন্যাসের সূক্ষ্ম চরিত্র বিশ্লেষণ ও সযত্ন রচনাশৈলী জেমসকে তাঁর সাহিত্যজীবনের পরবর্তী স্তরে নিয়ে যেতে সাহায্য করেছিল। এরপর যে তিনটি উপন্যাস তিনি লেখেন, সেগুলি মূলত তাঁর ইংরেজ-চরিত্র অধ্যয়নের ফল। এগুলি হল: দ্য ট্র্যাজিক মিউজ (১৮৯০), দ্য স্পয়েলস অফ পয়েন্টন (১৮৯৭) ও দ্য অকার্ড এজ (১৮৯৯)। এগুলির মধ্যে দ্য স্পয়েলস অফ পয়েন্টন উপন্যাসটি তুলনামূলকভাবে ক্ষুদ্রাকার। এই উপন্যাসটি জেমসের রচনাশৈলীর বিবর্তনের অন্যতম প্রধান সাক্ষী। সাহিত্যজীবনের মধ্যগগনে তিনি রচনা করেন তিনটি উপন্যাস—দ্য উইংস অফ দ্য ডোভ (১৯০২), দ্য অ্যাম্বাস্যাডারস (১৯০৩) ও দ্য গোল্ডেন বাওল (১৯০৪)। এই তিন উপন্যাসে তিনি আবার ফিরে আসেন ইউরোপীয় ও আমেরিকান সংস্কৃতির বিরোধের জায়গাটিতে। তবে এখানে চরিত্রচিত্রণে তিনি অনেক সূক্ষ্ম এবং শিল্পসৃজনে এক দক্ষ রূপকার। তাই আধুনিক উপন্যাসের সারিতে এগুলির নাম উঠে আসে সবার আগে। তবে এই উপন্যাসগুলি রসাস্বাদনের জন্য পাঠকের গভীর মনোযোগ ও সচেতনতা দাবি করেছিল। তাই এগুলি কখনই খুব একটা জনপ্রিয়তা পায়নি। আমেরিকান জীবনধারা অধ্যয়ন করে জেমস দুটি অসামান্য বই লিখেছিলেন—ওয়াশিংটন স্কোয়ার (১৮৮১) ও দ্য বস্টনিয়ানস (১৮৮৬)। আরও দুটি বই তিনি সম্পূর্ণ করে যেতে পারেননি। তাঁর মৃত্যুর পর ১৯১৭ সালে দ্য সেন্স অফ দ্য পাস্টদ্য আইভরি টাওয়ার নামে প্রকাশিত হয় বইদুটি।

ছোটোগল্পেও হেনরি জেমস ছিলেন মুকুটহীন সম্রাট। তিনি প্রায় একশোটি ছোটোগল্প লিখেছিলেন, যার সূচনা হয়েছিল আমেরিকান পত্রপত্রিকার চাহিদা মেটানোর উদ্দেশ্যে। জীবনের মধ্যভাগ পর্যন্ত ছোটোগল্প লিখেছেন তিনি। তাঁর সবচেয়ে বিখ্যাত গল্প-সংকলন সম্ভবত দ্য টার্ন অফ দ্য স্ক্রিউ (১৮৯৮)। কিন্তু অতিপ্রাকৃতের প্রতি তাঁর আগ্রহ সবচেয়ে বেশি পরিস্ফুট হয় দ্য অল্টার অফ দ্য ডেড, দ্য বিস্ট ইন দ্য জাঙ্গল, দ্য বার্থ প্লেস, অ্যান্ড আদার টেলস (১৯০৯) গল্প-সংকলনে। অন্যান্য গল্পগুলি সংকলিত হয়েছে দ্য ম্যাডোনা অফ দ্য ফিউচার অ্যান্ড আদার টেলস (১৮৭৯), দ্য অ্যাসপার্ন পেপারস অ্যান্ড আদার স্টোরিজ (১৮৮৮), টারমিনেশনস (১৮৯৫) ও দ্য টু ম্যাজিকস (১৮৯৮) সংকলনগুলিতে।

তাঁর আত্মজৈবনিক রচনাবলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য— আ স্মল বয় অ্যান্ড আদারস (১৯১৩), নোটস অফ আ সন অ্যান্ড ব্রাদার (১৯১৪), এবং মরণোত্তর প্রকাশিত খণ্ড-রচনা টারমিনেশনস (১৯১৭)। (উল্লেখ্য, টারমিনেশন নামে জেমসের একটি গল্প-সংকলনও আছে, সেটি আলাদা বই।) ১৯২০ সালে প্রকাশিত হয় জেমসের পত্র সংকলন। এছাড়া নোটস অন নভেলিস্টস (১৯১৪), এবং প্রবন্ধ দ্য আর্ট অফ ফিকশন (১৮৮৪) তাঁর দুটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ রচনা। ১৯৪৭ সালে প্রকাশিত দ্য নোটবুক অফ হেনরি জেমস লেখককে জানার এক অতীত প্রয়োজনীয় বই।

দর্শন

হেনরি জেমস আধুনিক ঔপন্যাসিকদের মধ্যে প্রথম প্রজন্মের ব্যক্তিত্ব। তাঁর উপন্যাস এবং ভার্জিনিয়া উলফ, ক্যাথরিন ম্যানসফিল্ড, কনরাড প্রমুখের উপন্যাসের মধ্যে কিছু কিছু বিষয়ে ঐক্য দেখা যায়। উপন্যাস রচনা ছিল জেমসের দৃষ্টিতে এক শিল্প। তিনি উপন্যাসকে তাই বিচার করতেন শিল্পের দৃষ্টিকোণ থেকে, নৈতিকতার দৃষ্টিকোণ থেকে নয়। এই জন্যই নিজের উপন্যাসে উদ্দেশ্য ও বাস্তব জীবনের নিরপেক্ষ উপস্থাপনাকে তিনি অতিনাটকীয় রোম্যান্স বা ভাবপ্রবণতার আধিক্যের চেয়ে উচ্চ স্থানে বসিয়েছিলেন। বাইরের ঘটনার তুলনায় মানবমনের সূক্ষ্ম টানাপোড়েন তার উপন্যাসের কেন্দ্রস্থলে থাকত।

 
2 টি মন্তব্য

Posted by চালু করুন সেপ্টেম্বর 21, 2012 in পুরনো লেখা

 

ট্যাগ সমুহঃ

পূজারম্ভের পূর্বে আচমন কেন ও কিভাবে করে?

আচমন প্রসঙ্গে পূজ্যপাদ স্বামী প্রমেয়ানন্দজি মহারাজ লিখেছেন, “দেহ-মন শুদ্ধ না থাকলে আধ্যাত্মিক সাধনের যোগ্যতা হয় না। অন্যভাবে, দেহ-মন শুদ্ধ করে নিয়ে তবে সাধন-ভজনে প্রবৃত্ত হতে হয়। আচমনের মুখ্য উদ্দেশ্য দেহ-মন শুদ্ধ করা। বিষ্ণুস্মরণ দেহ-মনশুদ্ধির শ্রেষ্ঠ উপায়।… আবার আচমন পূজককে পূজার লক্ষ্য সর্বব্যাপক অখণ্ড-চৈতন্য পরমাত্মার দিকে অগ্রসর হওয়ার কথাও পরোক্ষভাবে স্মরণ করিয়ে দেয়।” (পূজাবিজ্ঞান, পৃ. ১৯) এই কারণে হিন্দুরা যে কোনো পবিত্র কাজ, তা সে পূজাই হোক বা অন্য কোনো ধর্মীয় অনুষ্ঠানই হোক, তা শুরু করার আগে আচমন করে থাকেন।

আচমনের দুটি অংশ। প্রথমটি মূল আচমন প্রক্রিয়া, দ্বিতীয়টি তার আনুষঙ্গিক বিষ্ণুস্মরণ। আচমন প্রক্রিয়াটি ওঁ-কারযুক্ত শুদ্ধ বিষ্ণুনাম উচ্চারণ-সহ কয়েকটি প্রতীকী ক্রিয়া। বিষ্ণুস্মরণের সময় আমরা সাধারণত যে মন্ত্রটি উচ্চারণ করি, সেটি হল—

ওঁ   তদ্বিষ্ণোঃ পরমং পদং সদা পশ্যন্তি সূরয়ঃ দিবীব চক্ষুরাততম্। ১

ওঁ   অপবিত্রঃ পবিত্রো বা সর্বাবস্থাং গতোঽপি বা।

যঃ স্মরেৎ পুণ্ডরীকাক্ষং স বাহ্যাভ্যন্তরঃ শুচিঃ।। ২

মন্ত্রটির বাংলা অর্থ—

আকাশের সূর্যের মতো সর্বত্র প্রকাশমান, বেদ ও অন্যান্য শাস্ত্রে প্রসিদ্ধ, পরম তত্ত্ব জ্ঞানীগণ সর্বদা দর্শন করেন। ১

বাহ্য শরীর ও শরীরের অভ্যন্তরে স্থিত মনের কোনো একটি বা দুটিই যদি অপবিত্র হয়, তবে পদ্মলোচন শ্রীবিষ্ণুকে স্মরণ করা মাত্রই বাহ্য ও অন্তরে শুদ্ধ হওয়া যায়। ২

মন্ত্রের তাৎপর্য উল্লেখ করে প্রমেয়ানন্দজি উপসংহারে লিখেছেন, “কর্মের (পূজা) সূচনায় সাধকও প্রার্থনা করছেন—জ্ঞাননেত্রে তিনি যেন বিষ্ণুকে দর্শন করতে পারেন, তাঁর স্বরূপ উপলব্ধি করতে পারেন ; কর্মের উদ্দেশ্য সাধনে তিনি যেন সক্ষম হন।” (তদেব)

কেউ কেউ বিষ্ণুস্মরণ মন্ত্রের সঙ্গে আরও দুটি পংক্তি জুড়ে দেন—

ওঁ   মাধবো মাধবো বাচি মাধবো মাধবো হৃদি।

স্মরন্তি সাধবঃ সর্বে সর্বকার্যেষু মাধব।।

মন্ত্রের অর্থ—

সাধুব্যক্তিদের বাক্যে মাধব (বিষ্ণু) ও হৃদয়ে মাধব। তাঁরা সকল কাজেই মাধবকে স্মরণ করে থাকেন।

আচমন পদ্ধতি

ডান হাতের তালু ‘গোকর্ণাকৃতি’ অর্থাৎ গোরুর কানের মতো করে একটি মাষকলাই ডুবতে পারে, এই পরিমাণ জল নিয়ে ‘ওঁ বিষ্ণু’ মন্ত্রে পান করতে হবে। এই রকমভাবে তিন বার জল পান করতে হয়। তারপর বুড়ো আঙুলের পিছন দিকটি দিয়ে ওষ্ঠ ও অধর ডান দিক থেকে বাঁদিকে দুবার মার্জনা করে সামান্য জলে হাত ধুয়ে নিতে হয়। এরপর ডান হাতের নির্দিষ্ট আঙুলের ডগা দিয়ে নিম্নলিখিত ক্রমে নির্দিষ্ট স্থানগুলি স্পর্শ করা হয়—

(১) তর্জনী+মধ্যমা+অনামিকা (একসঙ্গে)—ওষ্ঠ ও অধর।

(২) (হাত ধুতে হবে)
(৩) বুড়ো আঙুল+তর্জনী—ডান ও বাঁ নাক।

(৪) বুড়ো আঙুল+অনামিকা—ডান ও বাঁ চোখ; ডান ও বাঁ কান।

(৫) বুড়ো আঙুল+কড়ে আঙুল—নাভি

(৬) (আবার হাত ধুতে হবে)

(৭) করতল দ্বারা হৃদয় স্পর্শ করতে হবে

(৮) সবকটি আঙুলের ডগা দিয়ে মাথা, ডান ও বাঁ বাহুমূল স্পর্শ করতে হবে।

(দ্রঃ এই ক্রিয়াগুলি অভিজ্ঞ ব্যক্তিরাই করে থাকেন। এগুলি যাঁরা করতে অসমর্থ তাঁরা শুধু ‘ওঁ বিষ্ণু’ মন্ত্রে জলপান করেই আচমন করেন।)

এরপর হাতজোড় করে পূর্বোক্ত আচমন মন্ত্রটি পাঠ করতে হয়—

ওঁ   তদ্বিষ্ণোঃ পরমং পদং সদা পশ্যন্তি সূরয়ঃ দিবীব চক্ষুরাততম্।

ওঁ   অপবিত্রঃ পবিত্রো বা সর্বাবস্থাং গতোঽপি বা।

যঃ স্মরেৎ পুণ্ডরীকাক্ষং স বাহ্যাভ্যন্তরঃ শুচিঃ।।

মন্ত্রপাঠের সময় মনে মনে শ্রীবিষ্ণুকে স্মরণ করাও আবশ্যক। কারণ, মনে রাখতে হবে সংস্কৃত আমাদের মাতৃভাষা নয়, তাই সংস্কৃত মন্ত্র শুধু পাঠ করেই আমরা তার তাৎপর্য উপলব্ধি করতে পারি না, সেজন্য আমাদের মন্ত্রের অর্থ বিশেষভাবে স্মরণ করতে হয়।

নিত্যপূজায় উপরিউক্ত ক্রমেই আচমন করে। তবে বিশেষ পূজায় আচমনের পর কুশাঙ্গুরীয় ধারণ করে পাপস্খালনের জন্য নিম্নোক্ত মন্ত্রটিও পাঠ করতে হয়—

ওঁ   দেব তৎ প্রাকৃতং চিত্তং পাপাক্রান্তমভূন্মম।

তন্নিঃসারয় চিত্তান্মে পাপং হূঁ ফট চ তে নমঃ।

ওঁ   সূর্য সোমো যমঃ কালো মহাভূতানি পঞ্চ চ।

এতে শুভাশুভস্যেহ কর্মণো নব সাক্ষিণঃ।।

 
4 টি মন্তব্য

Posted by চালু করুন সেপ্টেম্বর 18, 2012 in পুরনো লেখা

 

ট্যাগ সমুহঃ

ব্রিটিশ ভারতে শিক্ষার ইতিহাস

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি সরকার ও পরে ব্রিটিশ রাজ সরকার ভারতবাসীর শিক্ষার মানোন্নয়নের দিকে বিশেষ গুরুত্ব দেননি। তাঁদের শিক্ষাব্যবস্থা চালু রাখার একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল কম-মাইনেতে ইংরেজি-শিক্ষিত কেরানির দল তৈরি করা।

১৭৮১ সালে ওয়ারেন হেস্টিংস কলকাতা মাদ্রাসা (অধুনা আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়) চালু করেন। ১৭৯১ সালে জোনাথান ডানকান বারাণসীতে একটি সংস্কৃত কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। ১৮০০ সালে লর্ড ওয়েলেসলি ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মচারীদের দেশীয় ভাষা ও আদবকায়দা শেখানোর উদ্দেশ্য নিয়ে কলকাতায় চালু করেন ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ।

১৮১৩ সালের চার্টার আইনে ভারতে শিক্ষাবিস্তারে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দায়িত্বের কথা প্রথম স্বীকার করা হয়। এই আইন মোতাবেক, ভারতীয়দের শিক্ষার মানোন্নয়নের জন্য বার্ষিক এক লক্ষ টাকা ধার্য করা হয়। এরপর ১৮১৭ সালে ডেভিড হিউম কলকাতা হিন্দু কলেজ (অধুনা প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়) স্থাপন করেন।

১৮৩৫ সালে ইংরেজি ভাষাকে ভারতের উচ্চশিক্ষার একমাত্র মাধ্যম হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ১৮৫৪ সালে প্রকাশিত হয় ‘উড’স ডেসপ্যাচ অন এডুকেশন’। চার্লস উডের এই ‘ডেসপ্যাচ’কেই ব্রিটিশ ভারতে শিক্ষার ম্যাগনা কার্টা আখ্যা দেওয়া হয়। তিনিই প্রথম প্রাথমিক স্তর থেকে উচ্চস্তর পর্যন্ত শিক্ষার একটি যুক্তিসঙ্গত পাঠক্রম নথি আকারে প্রকাশ করেন। এই নথিতে প্রাথমিক স্তরে, মাধ্যমিক স্তরে এবং উচ্চশিক্ষা স্তরে কিভাবে কি পড়ানো হয়ে তার বিভাগ করে দেন তিনি। উচ্চশিক্ষার মাধ্যম হিসাবে ইংরেজি এবং প্রাথমিক শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে স্থানীয় ভাষাকে গ্রহণ করা হয়। দেশীয় ভাষা শিক্ষা দেওয়ার জন্য প্রাথমিক বিদ্যালয়, ইঙ্গ-দেশীয় ভাষা মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও অনুমোদিত কলেজগুলি প্রতিষ্ঠিত হয়। বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলি সরকারি অনুদান পেতে শুরু করে। নারীশিক্ষার গুরুত্ব অনুধাবন করে ঘরোয়া পরিবেশে মেয়েদের শিক্ষা দেওয়ার প্রবণতা বৃদ্ধি পায়। শিক্ষক-প্রশিক্ষণের জন্যও উপযুক্ত প্রতিষ্ঠান স্থাপিত হয়। কারিগরি শিক্ষার গুরুত্বও স্বীকৃতি পায়। ১৮৫৭ সালে কলকাতা, বোম্বাই ও মাদ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়।

হান্টার কমিশন ১৮৮২-৮৩

ওয়ার্ডসের আবেদনের ভিত্তিতে লর্ড রিপন ভারত সরকারের শিক্ষানীতি পুনরালোচনার জন্য এক সদস্যের হান্টার কমিশন গঠন করেন। এই কমিশন জানায়, প্রাথমিক শিক্ষার প্রসার ও মানোন্নয়নে সরকারের গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। তাছাড়া মাধ্যমিক শিক্ষা, সাক্ষরতা ও বাণিজ্য শিক্ষার বিস্তারেও সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে হান্টার কমিশন। শুধু তাই নয়, হান্টার নারীশিক্ষা বিস্তার ও বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলির প্রতি বিশেষ গুরুত্ব আরোপের জন্যও সুপারিশ করেছিলেন। এরপর ১৮৮২ সালে পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয় ও ১৮৮৭ সালে এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়।

ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয় আইন, ১৯০৪

লর্ড কার্জনের আমলে ১৯০৪ সালের ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয় আইন পাস ও কার্যকর হয়। ১৯০১ সালে সিমলা শিক্ষা সম্মেলনের পর লর্ড কার্জন শিক্ষাক্ষেত্রে স্যার টমাস র্যালে কমিশন গঠন করেন। এই কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী এই আইন পাস হয়। উক্ত কমিশনে একজন ভারতীয় সদস্যও ছিলেন। তিনি গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায়। এই আইন চালু হওয়ার পর সরকার বিশ্ববিদ্যালয়ের ফেলোদের মনোনীত করার অধিকার পায়। বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার ব্যাপারে সরকারের ভেটো প্রয়োগের অধিকারও স্বীকৃত হয়। বেসরকারি কলেজগুলির উপর বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃত্ব শুরু হয়। ফেলোদের সদস্যসংখ্যা নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের এক্তিয়ার-এলাকা ও অনুমোদিত কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়গুলির মধ্যে বাঁটোয়ারা করে দেওয়ার জন্য গভর্নর-জেনারেল-ইন-কাউন্সিলকে ক্ষমতা দেওয়া হয়।

স্যাডলার কমিশন, ১৯১৭-১৯

১৯০৬ সালে দেশীয় রাজ্য বরোদায় রাজার আদেশ বলে প্রাথমিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক করে দেওয়া হয়। ১৯১৭ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজকর্ম পর্যালোচনার জন্য গঠিত হয় স্যাডলার কমিশন। এই কমিশনের দুজন ভারতীয় সদস্য ছিলেন স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় ও জিয়াউদ্দিন আহমেদ। ১৯১৯ সালে স্যাডলার কমিশন উচ্চশিক্ষার মানোন্নয়নের জন্য প্রস্তাব রাখেন। স্যাডলার কমিশন সুপারিশ করেন, ইন্টারমিডিয়েটের পর ৩ বছরের ডিগ্রি কোর্স রাখা উচিত, নারীশিক্ষায় আরও গুরুত্ব আরোপ করা উচিত, শিক্ষক-প্রশিক্ষণের সুযোগ আরও বৃদ্ধি করা উচিত, এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলির নিজস্ব ক্যাম্পাস থাকা উচিত এবং আবাসিক ও বোর্ডিং সুবিধাযুক্ত হওয়া উচিত।

হার্টোগ কমিশন, ১৯২৯

হার্টোগ কমিশন জাতীয় স্তরে প্রাথমিক শিক্ষার গুরুত্বের কথা বলে। এই কমিশন তহবিল সঞ্চয় ও উন্নয়ন নীতির উপর জোর দেয়। বিশ্ববিদ্যালয় ব্যবস্থাপনায় জোর দেওয়ার কথাও বলা হয়।

বুনিয়াদি শিক্ষাক্ষেত্রে ওয়ার্ধা পরিকল্পনা, ১৯৩৭

১৯৩৭ সালে মহাত্মা গান্ধী হরিজন পত্রিকায় একগুচ্ছ নিবন্ধ প্রকাশ করে শিক্ষাক্ষেত্রে একটি বিশেষ পরিকল্পনার প্রস্তাব দেন। এই পরিকল্পনা বুনিয়াদি শিক্ষা পরিকল্পনা বা ওয়ার্ধা স্কিম নামে পরিচিত। এই পরিকল্পনার মূল কথা ছিল কাজের মাধ্যমে শিক্ষা। জাকির হুসেন কমিটি এই পরিকল্পনার খুঁটিনাটি নিয়ে কাজ করেন এবং কয়েকটি কোর্সের জন্য পাঠক্রম তৈরি করেন। শুধু তাই নয়, শিক্ষক-প্রশিক্ষণ, পর্যালোচনা, পরীক্ষা ও শিক্ষাপ্রশাসন পরিচালনা সংক্রান্ত একগুচ্ছ প্রস্তাবও দেন।

সারজেন্ট পরিকল্পনা, ১৯৪৪

এই পরিকল্পনা ভারতে বুনিয়াদি শিক্ষার জন্য বিদ্যালয় ও উচ্চ বিদ্যালয় স্থাপনের উপর জোর দেয় এবং ৬-১১ বছর বয়সী ছেলেমেয়েদের জন্য সর্বজনীন অবৈতনিক শিক্ষাদানের কথা বলে। এই পরিকল্পনায় ৬ বছরের বিদ্যালয় পাঠক্রমের সুপারিশ করা হয়। উচ্চ বিদ্যালয়গুলিকে (১) আকাদেমিক ও কারিগরি ও (২) ভোকেশনাল—এই দুই ভাগে ভাগ করার কথা বলা হয়। এই পরিকল্পনাতেই ইন্টারমিডিয়েট স্তর অবলুপ্তির প্রস্তাব দেওয়া হয়। সারজেন্ট পরিকল্পনায় ৪০-বছরের শিক্ষা-সংস্কার পরিকল্পনার উপর জোর দেওয়া হয়। পরে খের কমিটি এই সংস্কার পরিকল্পনার সময়কাল কমিয়ে ১৬ বছর করে।

 
3 টি মন্তব্য

Posted by চালু করুন সেপ্টেম্বর 17, 2012 in পুরনো লেখা

 

ট্যাগ সমুহঃ

ই-বই: ইতিহাসের আগের ভারত

বঙ্গভারতী ব্লগে পূর্বপ্রকাশিত “প্রাগৈতিহাসিক ভারত” ও “সিন্ধুসভ্যতা” নিবন্ধদুটি নতুন আকারে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হল।

পিডিএফ আকারে বইটি ডাউনলোড করতে এখানে ক্লিক করুন:
http://www.mediafire.com/?23s61tbvx25cq3p

 

ট্যাগ সমুহঃ

জ্যোতির্বিজ্ঞানের তেরোটি বিশ্বকাঁপানো আবিষ্কার

গ্রহের গতি (খ্রিস্টপূর্ব ২০০০-৫০০ অব্দ)

প্রাচীন জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের এক হাজার বছরের পর্যবেক্ষণের ফলে জানা যায়, আকাশের তারাগুলির মধ্যে কয়েকটি নিজস্ব গতি আছে। এইগুলি এবং আমাদের পৃথিবী গ্রহ তারামণ্ডল থেকে পৃথক এক সৌরজগতের সদস্য।

 

কোপারনিকাস ও তাঁর সূর্যকেন্দ্রিক সৌরজগতের মডেল

পৃথিবীর গতি (১৫৪৩)

আগেকার মানুষের ধারণা ছিল, সৌরজগতের কেন্দ্রে রয়েছে পৃথিবী এবং তাকে কেন্দ্র করেই যাবতীয় গ্রহনক্ষত্র আবর্তিত হচ্ছে। কিন্তু নিকোলাস কোপারনিকাস এই ভ্রান্ত ধারণার অবসান ঘটিয়ে জানান যে, সৌরজগতের কেন্দ্রস্থলে রয়েছে সূর্য। তাকে কেন্দ্র করেই পৃথিবী ও অন্যান্য গ্রহগুলি ঘুরছে।

 

গ্রহগুলির উপবৃত্তাকার কক্ষপথ

গ্রহগুলির কক্ষপথ উপবৃত্তাকার (১৬০৫-১৬০৯)

গ্রহগুলির কক্ষপথ যে উপবৃত্তাকার তা গাণিতিক সূত্রের মাধ্যমে প্রথম যথাযথভাবে প্রমাণ করতে সক্ষম হন জোনান কেপলার।

Read the rest of this entry »

 

ট্যাগ সমুহঃ

বঙ্গভারতী পূজাপদ্ধতি গ্রন্থমালা-১: বৃহস্পতিবারবিহিত শ্রীশ্রীলক্ষ্মীপূজাপদ্ধতি (ব্রতকথা ও অন্যান্য জ্ঞাতব্য বিষয় সহ)

বাজারে ‘শ্রীশ্রীলক্ষ্মীদেবীর ব্রতকথা ও পাঁচালি’ নামাঙ্কিত অনেক বইই সুলভ। কিন্তু সেই সব অধিকাংশ বইই ত্রুটিপূর্ণ। তাছাড়া সাধারণ গৃহস্থ ভক্তের উপযোগী পূজাপদ্ধতি কোনো বইতেই দেওয়া থাকে না। সেই কথা মাথায় রেখে একটি পরিমার্জিত ব্রতকথা-সহ পূজাপদ্ধতির প্রকাশ আবশ্যক ছিল। এই পূজাপদ্ধতির একটি বৈশিষ্ট্য এই যে, এখানে মন্ত্রগুলির বাংলা অর্থ দিয়ে দেওয়া হয়েছে। মন্ত্রের অর্থজ্ঞান ছাড়া পূজা সম্পূর্ণ হয় না। আর যাঁরা দুরূহ সংস্কৃত ভাষা পাঠে অক্ষম হবেন, তাঁরা বাংলায় মন্ত্রার্থ দেখে মূল কথাটি আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে জগজ্জননীকে নিবেদন করতে পারবেন। লক্ষ্মীদেবীর একটি অতি-সংক্ষিপ্ত পরিচিতিও গ্রন্থাগ্রে সংযোজন করে দেওয়া হল। এতে লক্ষ্মীপূজা আমরা কেন করব, সেই সম্পর্কে একটি স্পষ্ট ধারণা জন্মাবে। ব্রতকথা ও বারোমাস্যা বাজারে প্রচলিত বারোমাস্যারই একটি সংশোধিত রূপ।

বইটি পেতে এই লিঙ্কে ক্লিক করুন।
http://www.mediafire.com/?muj3j3g77mrve5q

 
১ টি মন্তব্য

Posted by চালু করুন সেপ্টেম্বর 5, 2012 in পুরনো লেখা

 

ট্যাগ সমুহঃ

প্রতি বৃহস্পতিবার লক্ষ্মীপূজা করবেন কিভাবে?

মা লক্ষ্মী

বাংলার ঘরে ঘরে বৃহস্পতিবার হল সাপ্তাহিক লক্ষ্মী আরাধনার দিন। বাংলায় বৃহস্পতিবারকে বলা হয় লক্ষ্মীবার। এই দিন লক্ষ্মীপূজা করলে হৃদয়ে ও গৃহে চঞ্চলা লক্ষ্মী হন অচলা। কিন্তু আজকের কর্মব্যস্ত জীবনে শুদ্ধ আচারে অথচ সহজে লক্ষ্মীপূজা করবেন কিভাবে?

ফর্দ

বৃহস্পতিবারের লক্ষ্মীপূজার উপকরণ অতীব সামান্য। যেগুলি লাগে সেগুলি হল—সিঁদুর, ঘট ১টি, ধান সামান্য, মাটি সামান্য, আমপল্লব ১টি, ফুল ১টি, দুর্বা সামান্য, তুলসীপাতা ২টি, ফুল, কাঁঠালি কলা বা হরীতকী ১টি, চন্দন, ধূপ, দীপ, নৈবেদ্য, সামান্য আতপচাল ও জল। কোনো দ্রব্য সংগ্রহ করতে না পারলে, পূজার শেষে সেই দ্রব্যটির কথা মা লক্ষ্মীর কাছে উল্লেখ করে ক্ষমা চেয়ে নিলেই হবে।

কালীঘাটের পটচিত্রে লক্ষ্মীর এক বিরল মূর্তি।

লক্ষ্মী-পরিচয়

যে দেবতার পূজা করেন, সেই দেবতার পরিচয় আগে জেনে নিতে হয়। লক্ষ্মীকে আমরা টাকাপয়সার দেবী ভাবি, আসলে লক্ষ্মীর পরিচয় শুধু ওইটুকুতেই নয়। লক্ষ্মী শুধু ধনই দেন না, তিনি জ্ঞান ও সচ্চরিত্রও দান করেন। এককথায় লক্ষ্মীপূজা করলে, মানুষ সার্বিকভাবে সুন্দর ও চরিত্রবান হয়। স্বামী প্রমেয়ানন্দ বলেছেন, ‘কেবল টাকাকড়িই ধন নয়। চরিত্রধন মানুষের মহাধন। যার টাকাকড়ি নেই সে যেমন লক্ষ্মীহীন, যার চরিত্রধন নেই সে তেমনি লক্ষ্মীছাড়া। যাঁরা সাধক তাঁরা লক্ষ্মীর আরাধনা করেন মুক্তিধন লাভের জন্য।’ লক্ষ্মীর বাহন পেঁচা কেন? কেউ কেউ বলেন, এটি বিষ্ণুর বাহন গরুড়ের পরিবর্তিত রূপ। মা লক্ষ্মী আসলে তাঁর স্বামীর বাহনটিই ব্যবহার করেন। কিন্তু এই রূপ পেঁচার কেন? লক্ষ্মীর দেওয়া ধন যারা অপব্যবহার করে, তাদের কপালে লেখা আছে যমের দণ্ড—এই কথা ঘোষণা করে লক্ষ্মীর বাহন। তাই কথায় বলে, ‘লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু’। তাছাড়া ধনসম্পত্তি, সে টাকাকড়ি হোক বা সাধনধনই হোক, সদাজাগ্রত অবস্থায় রক্ষা করতে হয়। রাতে সবাই যখন ঘুমায়, তখন পেঁচা জেগে থাকে। পেঁচাই সেই ধনসম্পদ পাহারা দেয়।

লক্ষ্মী-পদচিহ্ন সহ সিংহাসনে উপবিষ্ট লক্ষ্মী।

জ্ঞাতব্য নিয়মকানুন

লক্ষ্মীপূজা বৃহস্পতিবার মাত্রেই করা যায়। তার জন্য তিথি নক্ষত্রের বিচার করতে হয় না। তাই যাঁরা প্রবাসী তাদের ভারতীয় বা বাংলাদেশী সময় মিলিয়ে পূজা না করলেও চলবে, যেদেশে যেমন বৃহস্পতিবার পড়বে, সেই দেশে তেমনই করবে। তাছাড়া শাস্ত্রে আছে, প্রবাসে নিয়মং নাস্তি। তাই প্রবাসী হলে রবিবার বা সাপ্তাহিক ছুটির দিনেও লক্ষ্মীপূজা করতে পারেন। সেক্ষেত্রে পূজার আগে মায়ের কাছে ক্ষমা চেয়ে বলে নেবেন, মা বৃহস্পতিবার পূজা করতে পারলাম না, আজ পূজা নাও। ভারত বা বাংলাদেশবাসী হলে বৃহস্পতিবারের পূজা বৃহস্পতিবারেই করবেন।

লক্ষ্মীপূজায় ঘণ্টা বাজাতে নেই। লক্ষ্মীকে তুলসীপাতা দিতে নেই। কিন্তু লক্ষ্মীপূজার পর একটি ফুল ও দুটি তুলসীপাতা দিয়ে নারায়ণকে পূজা করতে হয়। লক্ষ্মীপূজা সাধারণত সন্ধ্যাবেলা করে, তবে অনেকে সকালেও করে থাকেন। সকালে করলে সকাল ন-টার মধ্যে করে নেওয়াই ভাল। পূজার পর ব্রতকথা পাঠ করতে হয়। লক্ষ্মীপূজায় লোহা বা স্টিলের বাসনকোসন ব্যবহার করবেন না। লোহা দিয়ে অলক্ষ্মী পূজা হয়। তাই লোহা দেখলে লক্ষ্মী ত্যাগ করে যান।

Read the rest of this entry »

 
8 টি মন্তব্য

Posted by চালু করুন সেপ্টেম্বর 5, 2012 in পুরনো লেখা

 

ট্যাগ সমুহঃ

ভারতের বৃহত্তম দশটি জেলার মধ্যে চারটিই এখন পশ্চিমবঙ্গে

২০১১ সালের জনগণনার রিপোর্ট অনুযায়ী, ভারতের বৃহত্তম দশটি জেলার মধ্যে চারটি জেলাই পশ্চিমবঙ্গের। এগুলি হল—উত্তর চব্বিশ পরগনা, দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা, বর্ধমান ও মুর্শিদাবাদ। বৃহত্তম দশটি জেলার তালিকায় এদের স্থান যথাক্রমে দ্বিতীয়, ষষ্ঠ, সপ্তম ও নবম।

 

বর্তমানে ভারতের বৃহত্তম জেলা মহারাষ্ট্রের থানে। জনসংখ্যা ১.১১ কোটি। তারপরেই স্থান উত্তর চব্বিশ পরগনার। জনসংখ্যা ১.০১ কোটি। তৃতীয় স্থানে রয়েছে কর্ণাটকের বেঙ্গালুরু জেলা। জনসংখ্যা ৯৫.৮৯ লক্ষ।

 

চতুর্থ ও পঞ্চম স্থানে রয়েছে মহারাষ্ট্রেরই দুটি জেলা—পুনে ও মুম্বই শহরতলি। এই দুটি জেলার জনসংখ্যা যথাক্রমে ৯৪.২৭ ও ৯৩.৩২ লক্ষ।

 

ষষ্ঠ ও সপ্তম স্থানে আবার পশ্চিমবঙ্গের নাম—দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা ও বর্ধমান। জনসংখ্যা যথাক্রমে ৮১.৫৩ ও ৭৭.২৪ লক্ষ।

 

অষ্টম স্থানাধিকারী গুজরাতের আমেদাবাদ জেলার জনসংখ্যা ৭২.০৮ লক্ষ।

 

নবম স্থানে আছে পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলা। জনসংখ্যা ৭১.০২ লক্ষ।

 

এবং দশম স্থানাধিকারী রাজস্থানের জয়পুর জেলার জনসংখ্যা ৬৬.৬৪ লক্ষ।

 

উল্লেখ্য, পশ্চিমবঙ্গের উক্ত চারটি জেলার মধ্যে তিনটিই কিছুদিনের মধ্যে ভেঙে দেওয়া হবে। উত্তর চব্বিশ পরগনা ভেঙে তৈরি হবে বারাসত ও বসিরহাট জেলা। দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা ভেঙে হবে ডায়মন্ড হারবার ও বারুইপুর জেলা। এবং বর্ধমান ভেঙে হবে বর্ধমান গ্রামীণ ও বর্ধমান শিল্পাঞ্চল জেলা। মুর্শিদাবাদ ভেঙে দেওয়ার প্রস্তাবও সরকারের কাছে রাখা হয়েছে।

 
6 টি মন্তব্য

Posted by চালু করুন সেপ্টেম্বর 2, 2012 in পুরনো লেখা

 

ট্যাগ সমুহঃ