RSS

পুরাণের অজানা লক্ষ্মী-কাহিনি

25 অক্টো.

‘শ্রীশ্রীলক্ষ্মীদেবীর ব্রতকথা ও পাঁচালী’ নামক পাতলা চটি-বইটির দাপটে আমাদের এই বাংলায় লক্ষ্মী আপাদমস্তক লোকদেবী। লক্ষ্মীর বারব্রতই বলুন, কিংবা কোজাগরী বা দীপান্বিতা পূজাই বলুন, পৌরাণিক লক্ষ্মীর প্রবেশ যেন সেখানে আইন করে নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়েছে। একথা ঠিক যে, বিষ্ণু, শিব, দুর্গা প্রমুখ দেবদেবীদের দাপটে আমাদের পুরাণ শাস্ত্রগুলিকে লক্ষ্মী একটু ব্যাকফুটে চলে গিয়েছেন। কিন্তু তাই বলে ধনসম্পদের অধিষ্ঠাত্রী দেবীকে নিয়ে খুচরো গল্প পুরাণে কম ছড়িয়ে নেই। সমুদ্রমন্থনে লক্ষ্মীর উদ্ভবের গল্প অনেকের জানা। কিন্তু সেখানে লক্ষ্মী নীরব দর্শকমাত্র। সমুদ্র থেকে উঠেই নারায়ণের গলায় মালা দিয়ে বৈকুণ্ঠের গেরস্থালি সামলাতে শুরু করলেন। আর তারপরেই সেকালের পুরাণ শাস্ত্র থেকে আধুনিক হিন্দি সিরিয়ালে তাঁর কাজ হল নারায়ণের পা টিপে দেওয়া। সে গল্প বরং থাক। আসুন, লক্ষ্মীকে নিয়ে একটু অন্য ধরনের কয়েকটি গল্পের সন্ধান করা যাক।

উমার তপস্যা হিন্দু পুরাণের একটি জনপ্রিয় কাহিনি। সতী জন্মান্তরে হিমালয়ের ঘরে কন্যারূপে জন্ম নিয়ে শিবকে পতিরূপে পাওয়ার জন্য কঠোর তপস্যা করেছিলেন। স্কন্দপুরাণ থেকে জানা যায়, নারায়ণকে পেতে লক্ষ্মীও একই রকম তপস্যা করেছিলেন। ওই পুরাণের আবন্ত্য খণ্ডে আছে, লক্ষ্মী ঋষি ভৃগু ও তাঁর পত্নী খ্যাতির কন্যা। নরনারায়ণের বর্ণনা শুনে লক্ষ্মী তাঁর প্রেমে পড়ে যান। তাঁকে পতিরূপে পাওয়ার জন্য সাগরসীমায় গিয়ে তপস্যা শুরু করেন। এক হাজার বছর কঠোর তপস্যার পর ইন্দ্র ও অন্যান্য দেবতারা নারায়ণের ছদ্মবেশে এসে তাঁকে বর চাইতে বলেন। লক্ষ্মী বিশ্বরূপ দেখতে চান। দেবতাদের ছলনা ধরা পড়ে যায়। তাঁরা লজ্জিত হয়ে ফিরে যান। এই খবর পেয়ে নারায়ণ নিজে আসেন লক্ষ্মীর কাছে। তিনি লক্ষ্মীকে বর দিতে চাইলে লক্ষ্মী বলেন, “আপনি যদি সত্যিই নারায়ণ হন, তবে বিশ্বরূপ দর্শন করিয়ে আমার বিশ্বাস উৎপাদন করুন।” নারায়ণ তা-ই করে লক্ষ্মীর সংশয় দূর করেন। তারপর নারায়ণ তাঁকে বলেন, “ব্রহ্মচর্যই সব ধর্মের মূল ও সর্বোত্তম তপস্যা। যেহেতু তুমি ব্রহ্মচর্য অবলম্বন করে এখানে তপস্যা করেছো, সেহেতু আমিও ‘মূল শ্রীপতি’ নামে এখানে অবস্থান করব এবং তুমিও এখানে ব্রহ্মচর্য-স্বরূপা ‘ব্রাহ্মী মূলশ্রী’ নামে পরিচিত হবে।”

একটি আশ্চর্য লক্ষ্মী-উপাখ্যান পাওয়া যায় অদ্ভুত রামায়ণে। লক্ষ্মী একবার তাঁর সখীদের নিয়ে কৌশিক নামে এক বিষ্ণুভক্ত ব্রাহ্মণের বাড়ি গান শুনতে গিয়েছিলেন। সেখানে ব্রহ্মা ও অন্যান্য দেবতারাও গিয়েছিলেন গান শুনতে। কিন্তু তাঁরা যেতেই লক্ষ্মীর সহচরীরা তর্জন গর্জন করে তাঁদের দূরে সরে যেতে বলেন। দেবতারা লক্ষ্মীকে খুব সম্মান করতেন। তাঁরা কিছু না বলে সরে যান। শুধু নারদ এতে অপমান বোধ করেন। তিনি বুঝতে পারেন, লক্ষ্মীর সহচরীরা লক্ষ্মীর জ্ঞাতসারেই এই কাজ করেছে। তাই তিনি লক্ষ্মী-সহ সবাইকে রাক্ষসযোনিতে জন্মগ্রহণের অভিশাপ দেন। শাপের বর্ণনা শুনে লক্ষ্মী নারদের কাছে এক আশ্চর্য প্রার্থনা করেন। তিনি বলেন, যে রাক্ষসী স্বেচ্ছায় ঋষিদের রক্ত অল্প অল্প করে সঞ্চয় করে কলস পূর্ণ করবে, তিনি যেন তাঁরই গর্ভে জন্মগ্রহণ করেন। নারদ সেই প্রার্থনা মঞ্জুর করেন।

দেবীভাগবত পুরাণেও লক্ষ্মীকে নিয়ে এক আশ্চর্য কাহিনির সন্ধান মেলে। সূর্যের ছেলে রেবন্ত কোনো এক সময় উচ্চৈঃশ্রবা নামক ঘোড়ায় চড়ে বৈকুণ্ঠে বেড়াতে এসেছিলেন। উচ্চৈঃশ্রবা একে অশ্বরাজ, তায় লক্ষ্মীর মতোই সমুদ্রমন্থনের সময় উদ্ভুত। ঘোড়াটিকে লক্ষ্মী নিজের ভাইয়ের মতো দেখতেন। তাই উচ্চৈঃশ্রবা বৈকুণ্ঠে আসতেই তিনি স্বামীকে ছেড়ে ঘোড়ার আদরযত্ন নিয়ে পড়লেন। ঘোড়ার পিঠে বসে থাকা রেবন্তকে দেখে অবাক হলেন নারায়ণও। তিনি লক্ষ্মীকে জিজ্ঞাসা করলেন, “এই ছেলেটি কে?” লক্ষ্মী তখন ঘোড়ার আপ্যায়নে ব্যস্ত। কয়েকবার জিজ্ঞাসা করেও কথার উত্তর না পেয়ে লক্ষ্মীর উপর বেজায় খাপ্পা হয়ে উঠলেন নারায়ণ। স্ত্রীকে অভিশাপ দিয়ে বসলেন, “ঘোড়া নিয়ে এত আদিখ্যেতা যখন, তখন মর্ত্যে মাদীঘোড়া হয়ে জন্মাও গে!” যতই হোক, নারায়ণ লক্ষ্মীর স্বামী; লক্ষ্মীও নারায়ণের স্ত্রী। অভিশাপ শুনে লক্ষ্মীর খুব কষ্ট হল। নারায়ণকে জিজ্ঞাসা করলেন, কিভাবে তিনি শাপমুক্ত হয়ে আবার বৈকুণ্ঠে ফিরতে পারবেন। নারায়ণ বললেন, মর্ত্যে গিয়ে লক্ষ্মীর নারায়ণ-তুল্য এক ছেলে হবে। তারপরই লক্ষ্মী বৈকুণ্ঠে ফিরতে পারবেন। এরপর যথারীতি মর্ত্যে মাদী ঘোড়া হয়ে জন্মালেন লক্ষ্মী। মর্ত্যে গিয়ে তিনি শিবের তপস্যা করলেন। তপস্যায় তুষ্ট হয়ে শিব বর দিতে এলে লক্ষ্মী বললেন, তাঁর সন্তান যেন নারায়ণের ঔরসেই জন্মায়। শিবের পরামর্শে নারায়ণ হয়গ্রীব অবতার গ্রহণ করে ঘোটকীরূপিণী লক্ষ্মীকে বিয়ে করলেন। তাঁদের ছেলে হলে লক্ষ্মী শাপমুক্ত হয়ে বৈকুণ্ঠে ফিরে গেলেন।

এই দেবীভাগবত পুরাণেই লক্ষ্মীর চরিত্র বর্ণনা করতে গিয়ে বলা হয়েছে—তিনি পতিব্রতাদের মধ্যে প্রধান, সকল জীবের জীবন, স্বর্গে স্বর্গলক্ষ্মী, রাজগৃহে রাজলক্ষ্মী ও সাধারণ মর্ত্যবাসীর ঘরে গৃহলক্ষ্মী। তিনি বণিকদের কাছে বাণিজ্যলক্ষ্মী। আবার পাপীদের কলহ উৎপাদিনী। আমাদের বাংলার লক্ষ্মী ব্রতকথাগুলি পুরাণকথাকে আশ্রয় না করলেও, সেই সব উপকথার সারবস্তুর সঙ্গে এই পৌরাণিক বর্ণনার কী আশ্চর্য মিল দেখা যায়!

 
9 টি মন্তব্য

Posted by চালু করুন অক্টোবর 25, 2012 in পুরনো লেখা

 

ট্যাগ সমুহঃ

9 responses to “পুরাণের অজানা লক্ষ্মী-কাহিনি

  1. তমাল নাগ

    অক্টোবর 26, 2012 at 10:59 পুর্বাহ্ন

    দাদা পড়ে খুব ভাল লাগল, আপনি এইভাবে লিখে যান। 😀

     
    • অর্ণব দত্ত

      অক্টোবর 26, 2012 at 1:06 অপরাহ্ন

      এটা নিতান্ত সাধারণ একটা লেখা! এক জায়গায় তিনটে গল্প পেলাম। কোজাগরীর আগে পাঠকদের ভাল লাগতে পারে ভেবে লাগিয়ে দিলাম। পরে একটু ঘষামাজা করে দেবো।

       
  2. অর্ণব দত্ত

    অক্টোবর 27, 2012 at 11:53 পুর্বাহ্ন

    ঘোষণা: এই রচনাটি পরশপাথর ই-ম্যাগাজিনে “সতীলক্ষ্মীর লক্ষ্মীপুরাণ” শিরোনামে প্রকাশিত। উক্ত পত্রিকাতে লেখাটি আমার সম্মতিক্রমেই প্রকাশিত হয়েছে।

    http://www.parashpathor.com/%E0%A6%B8%E0%A6%A4%E0%A7%80%E0%A6%B2%E0%A6%95%E0%A7%8D%E0%A6%B7%E0%A7%8D%E0%A6%AE%E0%A7%80%E0%A6%B0-%E0%A6%B2%E0%A6%95%E0%A7%8D%E0%A6%B7%E0%A7%8D%E0%A6%AE%E0%A7%80%E0%A6%AA%E0%A7%81%E0%A6%B0%E0%A6%BE/

     
  3. Prabir Lahiri

    অক্টোবর 30, 2012 at 5:40 অপরাহ্ন

    Hindu Dhormer Prochar o prosar e apnar bhumika prosongshoniyo . Amar ekti group ache jaar naam পুরোহিত , eta facebook e ache . Ami apnake sei group e Join korar janyo anurodh Korchi . Sonaton sobhyota o songskriti rokkharthe amader haat prasastha karun .

     
    • অর্ণব দত্ত

      অক্টোবর 30, 2012 at 7:16 অপরাহ্ন

      আপনার সুন্দর মন্তব্যটির জন্য অনেক ধন্যবাদ। 🙂 আমি অবশ্য পুরোহিত নই। বাড়ির পুজোপাঠ করে থাকি এই যা।

       
  4. Susobhan Ray

    অক্টোবর 31, 2012 at 4:58 অপরাহ্ন

    Hindu Dhormo somporke prottek ta lekha osadharon …apnake osonkho dhonnobad erom ekti bhalo site amader upohar debar jonno … amar ekta abdar ache tomar kache jodi saraswati pujor podhoti niye kichu lekho jaate kore amra barite nijei korte paari khub bhalo hoi …

     
    • অর্ণব দত্ত

      অক্টোবর 31, 2012 at 5:07 অপরাহ্ন

      ধন্যবাদ, আপনার সুন্দর মন্তব্যটির জন্য। আমি এই মুহুর্তে কালীপূজার পদ্ধতিটি লিখে পোস্ট করছি। আগামী কয়েকটি পর্বে সেটি সম্পূর্ণ হবে। সরস্বতী পূজাপদ্ধতির কথা আমার মাথায় আছে। আমি সেটিও লিখে দেবো। 🙂

       
  5. Jhumpa Bhaskar Bose

    নভেম্বর 26, 2012 at 7:16 অপরাহ্ন

     
  6. Milon Chandra Sarker

    ফেব্রুয়ারি 27, 2015 at 5:02 অপরাহ্ন

    Hara Krishna!

     

Milon Chandra Sarker এর জন্য একটি উত্তর রাখুন জবাব বাতিল