RSS

হিন্দুশাস্ত্র: জ্ঞানকাণ্ড ও কর্মকাণ্ড

11 অক্টো.

বিপিনবিহারী ঘোষাল সংকলিত হিন্দুশাস্ত্র: জ্ঞানকাণ্ড ও কর্মকাণ্ড (১৮৯৫) বই থেকে আধুনিক সরল বাংলা গদ্যে রূপান্তরিত।

আমাদের দেশের প্রাচীন ধর্মশাস্ত্রগুলিতে ধর্ম ও সাধনা সম্পর্কে যে বিভিন্ন রকম মত দেখতে পাওয়া যায়, প্রাচীন আর্য শাস্ত্রকারেরা সেগুলিকে দুটি প্রধান ভাগে ভাগ করেছিলেন এবং সেই সব বিভিন্ন রকম মত ও উপদেশগুলির মধ্যে যে একটা যোগ বা সম্বন্ধ আছে, তা-ও তাঁরা অনেক জায়গায় বলে গেছেন। যেমন—ভগবান শিব এক জায়গায় পার্বতীকে বলছেন,—

নানা তন্ত্রে পৃথক্‌ চেষ্টা ময়োক্তা গিরিনন্দিনি।

ঐক্যজ্ঞানং যদা দেবি তদা সিদ্ধিমবাপ্নুয়াৎ।।

মুণ্ডমালা তন্ত্র, ৬ পটল।

হে পার্বতী, আমি অধিকারী অনুসারে নানা তন্ত্রে নানা রকম সাধনা ও পূজা-উপাসনার বিধি দিয়েছি। সাধক যখন সেই সব নানা রকম ব্যবস্থার মধ্যেও ঐক্য দর্শন করে, তখন তার সিদ্ধিলাভ হয়।

প্রথমত, যাঁরা একটু বেশি জ্ঞান রাখেন ও চিন্তা করেন, যাঁদের বুদ্ধি সূক্ষ্ম তত্ত্বগুলি বুঝতে সক্ষম এবং যাগযজ্ঞ ইত্যাদি কর্মকাণ্ডের অনুষ্ঠানে যাঁদের পুরোপুরি শ্রদ্ধা বা তৃপ্তি জন্মায় না, তাঁদের জন্য শাস্ত্রকারেরা নিজের বিশ্বাস অনুযায়ী তত্ত্বজ্ঞান-স্বরূপ মহাসত্যগুলির উপদেশ দিয়েছেন। দ্বিতীয়ত, যাঁদের জ্ঞান তুলনামূলকভাবে অল্প বা যাঁরা এ সম্পর্কে ঠিকঠাক বিচার করতে পারেন না,[*] তাঁদেরও ধর্মপ্রবৃত্তি পরিতৃপ্ত করবার জন্য এবং ভবিষ্যতে তাদেরও তত্ত্বজ্ঞান লাভের উপযুক্ত করবার জন্য তাঁরা স্থূল ভাবের পূজা, উপাসনা বা অনুষ্ঠানপদ্ধতি লিপিবদ্ধ করে রেখেছেন।

প্রথমোক্ত সবল অধিকারী ব্যক্তিদের জন্য যে শাস্ত্রের উপদেশ দেওয়া হয়েছে, তার নাম জ্ঞানকাণ্ড; আর শেষোক্ত দুর্বল অধিকারীদের জন্য যে শাস্ত্র লেখা হয়েছে, তার নাম কর্মকাণ্ড।

কর্মকাণ্ডোজ্ঞানকাণ্ড ইতি ভেদোদ্বিধামতঃ।

ভবতি দ্বিবিধোভেদাজ্ঞানকাণ্ডস্য কর্মণঃ।।

শিব সংহিতা ১।২০

ভগবান শিব বললেন—

জ্ঞানকাণ্ড ও কর্মকাণ্ড ভেদে শাস্ত্রে দুই রকম মত দেখা যায়। জ্ঞানকাণ্ড ও কর্মকাণ্ড—এগুলি আবার দুটি দুটি করে ভাগে বিভক্ত।

বেদস্তাবৎ কাণ্ডদ্বয়াত্মকঃ।

তত্র পূর্বস্মিন্‌ কাণ্ডে নিত্যনৈমিত্তিককাম্যনিষিদ্ধরূপং

চতুর্বিধং কর্ম প্রতিপাদ্যং।

তৈত্তিরীয় সংহিতা ১৭১।১

সমগ্র বেদ দুই ভাগে বা দুই কাণ্ডে বিভক্ত। তার মধ্যে পূর্বকাণ্ডে নিত্য, নৈমিত্তিক, কাম্য ও নিষিদ্ধ এই চার রকমের কর্মের বিষয় বর্ণিত হয়েছে।

অত উত্তরকাণ্ড আরব্ধব্যঃ। আত্যন্তিকপুরুষার্থসিদ্ধিশ্চ দ্বিবিধা। সদ্যোমুক্তিঃ ক্রমমুক্তিশ্চেতি। তস্মাদুত্তরকাণ্ডে ব্রহ্মোপদেশ-ব্রহ্মোপাস্তিশ্চেত্যুভয়ং প্রতিপাদ্যতে।

তৈত্তিরীয় সংহিতা, প্রথম কাণ্ড, প্রথম প্রপাঠক, প্রথম অনুবাক্‌।

তারপর উত্তরকাণ্ডে সদ্যোমুক্তি ও ক্রমমুক্তি নামে দুই রকম আত্যন্তিক পুরুষার্থসিদ্ধির বিষয় নির্ণয় করা হয়েছে। এজন্য উত্তরকাণ্ডে ব্রহ্মবিষয়ক উপদেশ ও ব্রহ্মোপাসনা এই দুইটি বিষয় আলোচনা করা হয়।

দ্বাবিমাবথ পন্থানৌ যত্র বেদাঃ প্রতিষ্ঠিতাঃ।

প্রবৃত্তিলক্ষণো ধর্মো নিবৃত্তৌ চ বিভাষিতঃ।।

বাজসনেয় সংহিতার ভাষ্যে শঙ্করাচার্যের বাণী

বেদে দুই রকম ধর্ম প্রতিষ্ঠিত আছে। যথা—(১) প্রবৃত্তিলক্ষণ ধর্ম বা কর্মকাণ্ড, এবং (২) নিবৃত্তিলক্ষণ ধর্ম বা জ্ঞানকাণ্ড।

এই কর্মকাণ্ড ও জ্ঞানকাণ্ডের মধ্যে কর্মকাণ্ড বিনাশী, অর্থাৎ অনিত্য ফল দান করে এবং জ্ঞানকাণ্ড অবিনাশী, অর্থাৎ অনন্ত ফলদায়ী। যেমন, ব্যাসদেব শুকদেবকে বলেছেন—

কর্মবিদ্যাময়াবেতৌ ব্যাখ্যাস্যামি ক্ষরাক্ষরৌ।

মহাভারত, মোক্ষধর্ম পর্বাধ্যায় ৬৭।৩

নশ্বর কর্ম এবং অবিনশ্বর জ্ঞান-এই দুইয়ের বিষয় আমি তোমার কাছে বর্ণনা করছি।


[*] উন্নত ও গভীর বিষয়গুলি সর্বদা মনের মধ্যে বিচার করতে অভ্যাস করা বিশেষ প্রয়োজনীয়। মানুষের মধ্যে যাঁরা চিন্তাশীল নন, তাঁরা একরকম মানুষের মধ্যে গণ্যই নন, একথা আমাদের দেশের শাস্ত্রকারের বার বার বলে গিয়েছেন। যিনি চিন্তাশীল নন, তিনি হাজার রকম বিদ্যে শিখলেও জ্ঞানহীনদের মধ্যেই গণ্য হন।

টমাস কার্লাইল তাঁর এক চিঠিতে লিখেছেন—

“It is not books alone, or by books chiefly that a man becomes in all points a man.”

Treasury of Modern Biography, p. 293.

বিশিষ্ট আমেরিকান বুদ্ধিজীবী এমারসন বলেছেন—

“The man who thinks is the king; all else are journeymen.”

An Evening with Emerson.

by David Maerae, in The Americans at Home.

 

ট্যাগ সমুহঃ

মন্তব্য করুন

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  পরিবর্তন )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  পরিবর্তন )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  পরিবর্তন )

Connecting to %s

 
%d bloggers like this: