[পূর্ববর্তী পোস্টে কিশোরীলাল রায় রচিত দেবতত্ত্ব (১৮৮৫) গ্রন্থ থেকে দেবী দুর্গা, জগদ্ধাত্রী ও কালী—এই দেবীত্রয়ীর স্বরূপ বর্ণনা করা হয়েছে। এই পোস্টে ওই একই বই অবলম্বনে দেবী দুর্গার সঙ্গে পূজিত শিব, গণেশ, লক্ষ্মী, সরস্বতী ও কার্তিকের স্বরূপ বর্ণনা করা হল। এই লেখাটি মূল রচনার আধুনিক সরল বাংলা গদ্যে রূপান্তরণ।]

দুর্গা পরিবার
শিব
প্রলয়কর্তা অর্থে ঈশ্বরের নাম শিব। কিছুকাল না গেলে কোনো বস্তুর ধ্বংস অসম্ভব। তাই শিবকে কাল ও মহাকালও বলা হয়। যিনি সব কিছুর ধ্বংসকর্তা তাঁর আবার ধ্বংস কী? সুতরাং শিবের একটি বিশেষ নাম মৃত্যুঞ্জয়। বিশ্বকে ঈশ্বরের শরীর বলা হয়েছে। শিবোপাসকগণ মনে করেন ও সাধারণতও এই বিশ্বাস প্রবল দেখা যায় যে, মহাদেবের ললাটে ও মানুষের চোখের মতো তিনটি চোখ আছে। বাস্তবিক তা নয়। সূর্য, চাঁদ ও আগুনই মহাদেবের তিন চোখ, তাই তিনি ত্রিলোচন। যথা, শঙ্করাচার্য-কৃত অপবাদভঞ্জন স্তোত্রে “বন্দে সূর্যশশাঙ্ক বহ্নিনয়নং” ইত্যাদি। তিন চোখ তিন রকমের বলে মহাদেবের এক নাম বিরুপাক্ষ। জীর্ণদশায় প্রলয় ঘটে ও কালের বয়স অপরিমেয় বলে মহাদেবের মূর্তি বুড়ো মানুষের শরীরের মতো কল্পিত হয়েছে, তাঁকে প্রায় সর্বদা বৃদ্ধ বলে বর্ণনা কর হয়। চিতাভস্ম, শ্মশান ও নরমুণ্ড প্রভৃতি ধ্বংস বা মৃত্যুর স্মারক বলে ওই সবের দ্বারা তাঁকে দেখা হয়েছে। ধ্বংসকর্তা স্বয়ং মৃত্যুঞ্জয়, সুতরাং তাঁর মৃত্যুঞ্জয়ত্ব দেখানোর জন্য তিনি বিষধর সর্পজড়িত বলে বর্ণিত। মহাদেবরূপী কাল ও জড়জগৎরূপী প্রকৃতি সংযোগেই সব কিছুর উৎপত্তি হয়, সুতরাং মহাদেব ও দুর্গাকে জগতের পিতা ও মাতা বলা হয়েছে। কালিদাস বলেছেন “জগতঃ পিতরৌ বন্দে পার্বতী পরমেশ্বরৌ।” এই জন্য শিবলিঙ্গ ও গৌরীপট্টেরও কল্পনা। শবশিবারূঢ়া কালীমূর্তি, শক্তিহীন হলে শিবের যে অবস্থা ঘটে তা দেখানোর জন্য কল্পিত হয়েছে। কালী মহাদেবের শক্তি, সুতরাং শিবের দেহ থেকে শক্তি পৃথক হয়ে বেরিয়ে এলে শিব শক্তিহীন হয়ে শবের মতো পড়ে থাকেন। শঙ্করাচার্য আনন্দলহরীতে বলেছেন, “শিবঃ-শক্ত্যা-যুক্তো ভবতি শক্তঃ প্রভবিতুং। নচদেবং দেবোনখলু কুশলঃ স্পন্দিতুমপি।” অর্থাৎ, শিবের প্রভাব শক্তিযুক্ত থাকলেই; নয়তো তাঁহার নড়াচড়ার শক্তিও থাকে না। ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণের প্রকৃতি খণ্ডেও ওই কথা আছে। “শিবশক্তস্তয়া শক্ত্যাশবাকার স্তয়া বিনা।” অর্থাৎ, শিব শক্তিসহ থাকলেই শক্তিমান, নচেৎ শবাকার হন। মহাদেবকে বৃষবাহন বলার তাৎপর্য্য এই যে, কালের গতি বৃষভের গতির মতো ধীর অথচ নিশ্চিত। মেঘই মহাদেবের জটাজুট, সুতরাং শিবজটা থেকে গঙ্গার নির্গম হয় এর অর্থ এই যে, মেঘ থেকে জল নির্গত হয়। মহাদেবকে ভোলামহেশ্বর ও ধুস্তরফলাদি ভক্ষণকারী বলার তাৎপর্য এই যে, কালকে অনেক সময় মদবিহ্বল ব্যক্তির মতো কাজ করতে দেখা যায়। যেমন দুর্যোধনের রাজ্যভোগ ও যুধিষ্ঠিরের বনবাস প্রভৃতি। মহাদেব বৃদ্ধ কিন্তু উমা নিত্যযৌবনা, এর তাৎপর্য এই যে সময় একবার গেলে আর ফেরে না এবং তার বয়সেরও অন্ত নেই। কিন্তু পৃথিবী প্রতি বছর অভিনব বেশ ধারণ করে ও একবার বসন্ত শেষ হলেও তা বার বার আসতে থাকে।
কাল শূন্যের অনুরূপ ও আচ্ছাদনবিহীন বলে তাকে শ্বেতকায় ও দিগম্বর বলা হয়েছে। মহাদেবকে আদিদেব বলার তাৎপর্য এই যে, সবার আগেও কাল বিদ্যমান ছিল। সবই কালে ঘটছে। সুতরাং মহাদেব সর্বজ্ঞ, কালেই জ্ঞানলাভ হয়, সুতরাং তিনি জ্ঞানদাতা, এবং যশস্বী মহাত্মাদের কাল বাঁচিয়ে রাখে, সুতরাং তিনি ভক্তমুণ্ডমালী। মহাভারতে সুরথ সুধন্বার মুণ্ডগ্রহণ করার জন্য মহাদেবের যে আগ্রহ বর্ণিত হয়েছে, তাতে তাঁকে ভক্তমুণ্ডমালী শব্দের বাচ্য করে তুলেছে বলতে হবে।
অনন্ত বা শূন্যের বলরামরূপ কল্পনা করে কালের কল্পিতরূপ মহাদেবের সদৃশ করা হয়েছে। একটি মনোহরশায়ী গানেও বলা হয়েছে, “তার পর একজন বৃষভেতে আরোহণ, দাদা বলাইর মতন।” বাস্তবিক বলরাম ও মহাদেবের রূপে বিলক্ষণ সাদৃশ্য আছে। অনন্ত কাল অনন্ত আকাশের সদৃশ্যই বটে। শাস্ত্রে অনেক জায়গায় শিব ও দুর্গাকে পুরুষ ও প্রকৃতিও বলা হয়েছে।
রুদ্রের আট রকম শরীরের বর্ণনাও আছে। যথা— সূর্য, জল, পৃথিবী, অগ্নি, আকাশ, বায়ু, দীক্ষিত ব্রাহ্মণ ও চন্দ্র। দীক্ষিত ব্রাহ্মণের বদলে কোনো কোনো স্থলে জীব লেখা হয়েছে।
গণেশ
সিদ্ধির অধিষ্ঠাত্রী দেবতা অর্থে ঈশ্বরের নাম গণেশ। আগে সিদ্ধিকামনা করেই লোকে সব কাজে হাত লাগায়। সুতরাং সব দেবতার আগেই গণেশের পূজার নিয়ম হয়েছে। ইঁদুর নানা রকম বস্তু কেটে দেয়, সুতরাং বিঘ্নছেদনকারীর বাহন কল্পনা করতে ইঁদুরই সুসঙ্গত হয়। বিঘ্নস্বরূপ অন্ধকারের কাছে জ্যোতিস্বরূপ বলে গণেশের গায়ের রং সিঁদুরের মতো। হাতি যেমন শুঁড় দিয়ে জল তুলে ইচ্ছা মতো পান করে বা ফুঁ দিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দেয়, সেই রকম গণেশও ইচ্ছামতো বিঘ্নরাশি তুলে দূরে ফেলে দিতে পারেন। তাই তাঁকে গজানন (অর্থাৎ, যাঁর হাতির মতো মুখ) বলে বর্ণনা করা হয়েছে। সমস্ত সিদ্ধি তিনি নিজেতে সঞ্চিত করে রেখেছেন, তাই তাঁকে লম্বোদর বলে।
লক্ষ্মী
শোভা ও সম্পত্তির অধিষ্ঠাত্রী দেবতা এই অর্থে ঈশ্বরের নাম লক্ষ্মী। চন্দ্র খুবই সুন্দর, তাই চন্দ্রকে লক্ষ্মীর ভাই বলা হয়। সম্পত্তি কারো কাছে স্থির থাকে না, সুতরাং লক্ষ্মী চঞ্চলা। পদ্মবন অত্যন্ত সুন্দর জায়গা, তাই লক্ষ্মীর নাম পদ্মালয়া। শোভাতে কামের জন্ম হয়, তাই লক্ষ্মী কন্দর্প বা কামদেবের জননী বলে অভিহিত হয়েছেন।
সরস্বতী
বাক্যের সঙ্গে জ্ঞান সংশ্লিষ্ট। অতএব সরস্বতী কেবল শব্দের অধিষ্ঠাত্রী দেবতাই নন, জ্ঞানাধিষ্ঠাত্রী দেবতাও বটে। বেদ ছাড়া অন্যান্য বিদ্যা ও বাক্যের অধিপতি—এই অর্থে ঈশ্বরের নাম সরস্বতী। বেদের অধিপতি অর্থে তাঁর নাম সাবিত্রী (এই সাবিত্রী-সত্যবান কাহিনির পৌরাণিক চরিত্র নন)। সরস্বতীকে শ্বেতপদ্মে অধিষ্ঠিতা, শ্বেতবস্ত্র পরিহিতা, শ্বেতবর্ণা ও শ্বেতবীণাধরা বলার তাৎপর্য এই যে— বিদ্যা দিয়ে মনের অজ্ঞান-অন্ধকার দূর হয়, সুতরাং অজ্ঞান অন্ধকার-স্বরূপ, বিদ্যা আলোক স্বরূপ। এবং আলোক স্বরূপ প্রকাশে শ্বেতবর্ণের আবশ্যক। সরস্বতীর হাতে বই; কারণ বইই জ্ঞানের ভাণ্ডারস্বরূপ। অতএব দেখা যাচ্ছে যে নিরাকারা সরস্বতীর রূপ কল্পনা করতে হলে তাঁকে শ্বেতবর্ণ-বিশিষ্ট বলে কল্পনা করলেই প্রশংসনীয় রূপক হয়। ধর্মতত্ত্ব-এর কোনো লেখক যথার্থই বলেছেন যে, মাঘমাসে সরস্বতী পূজা বিহিত হওয়ার কারণ এই যে, এই সময়ে বসন্তের ছায়া পড়ে এবং বসন্তকালই সঙ্গীতবিলাসের সর্বোৎকৃষ্ট সময়। বাস্তবিক সঙ্গীতেশ্বরীর আরাধনা বসন্তের প্রারম্ভেই হওয়া উচিত। সরস্বতী যে শাস্ত্রকারগণের মতে ঈশ্বরের নামান্তর মাত্র; তা “বিশ্বরূপা বিশালাক্ষী” ইত্যাদি বাক্য আলোচনা করলেই বোঝা যাবে।
কার্তিক
কেবল সংগ্রামের অধিষ্ঠাত্রী দেবতা, এই অর্থে ঈশ্বরের নাম কার্তিক। যুদ্ধদেবের মতি তেজোময় হওয়া উচিত, সুতরাং কার্তিকেয়কে অগ্নির পুত্রও বলা হয়েছে। কৃত্তিকা নামক আগুনরঙা ছয়টি তারা, ঐ অগ্নির পুত্র বা মহাদেবের পুত্রকে পালন করেছিলেন, এই জন্য তাঁর নাম কার্তিকেয় বা ষড়ানন হয়েছে। অগ্নির মত তেজবিশিষ্ট দেবতার অগ্নিবর্ণা পালয়িত্রী কল্পনা করাই যুক্তিসঙ্গত। যোদ্ধা ও সুন্দরবর্ণ ময়ূরই কার্তিকের উপযুক্ত বাহন। যোদ্ধারা ভালভাবে রণসজ্জা করে ভাল একটা বাহনে চেপেই যুদ্ধক্ষেত্রে যান; সুতরাং যুদ্ধের অধিষ্ঠাত্রী দেবতা অর্থে ঈশ্বরের রূপ ও বাহনাদি কল্পনা করতে হলে, তাঁকে অতি সুন্দর পুরুষ ও সুন্দর বাহনে আরূঢ় বলেই বর্ণনা করতে হয়।