© অর্ণব দত্ত

কালীঘাট সহযাত্রীর দুর্গাপ্রতিমা–আকর্ণনয়না সাবেকি ধাঁচের দেবীমূর্তি। এ শিল্প পশ্চিমবঙ্গের সনাতন শিল্প।
দুর্গা—এই নামটি শুনলেই আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে একটা দেবীমূর্তি। তাঁর দশ হাতে দশ রকম অস্ত্র, এক পা সিংহের পিঠে, এক পা অসুরের কাঁধে। তাঁকে ঘিরে থাকেন গণেশ, লক্ষ্মী, সরস্বতী আর কার্তিক ঠাকুর। যাঁরা সেকেলে কেতায় ঠাকুর বানান, তাঁদের ঠাকুরের পিছনে চালচিত্রে আরও নানারকম ঠাকুরদেবতার ছবিও আঁকা থাকে। আর যাঁরা আধুনিক, তাঁরা প্রতিমার মাথার উপর একখানা ক্যালেন্ডারের শিবঠাকুর ঝুলিয়ে রাখেন। মোটামুটি এই মূর্তি বছর বছর দেখে আমরা অভ্যস্ত। তবে মাঝে মাঝে পুজো উদ্যোক্তারা একটু স্বাদবদলের জন্য বানান পঞ্চদুর্গা, নবদুর্গা, একাদশ দুর্গা, একান্ন দুর্গা ইত্যাদি। শাস্ত্রে কতরকম মাতৃমূর্তির কথা আছে। তার থেকেই সামর্থ্য অনুযায়ী কয়েকটা বেছে নিয়ে পঞ্চদুর্গা, নবদুর্গা ইত্যাদি বানানো। আমাদের ছেলেবেলায় দেখেছি, থিমপুজো শুরু হওয়ার আগে এই সব প্যান্ডেল নিয়ে ঠাকুর-দর্শনার্থীদের মধ্যে একটা বিশেষ আগ্রহ থাকত। এখনও আছে। মায়ের সনাতন মূর্তির আবেদন কখনও ম্লান হয় না ঠিকই, কিন্তু মানুষ এই সুযোগে অন্যান্য রূপগুলি দেখে চোখ জুড়িয়ে নিতেও ছাড়েন না।
শাস্ত্রে দুর্গার নয়টি নির্দিষ্ট মূর্তিকে ‘নবদুর্গা’ বলে। এঁরা হলেন—ব্রহ্মাণী, কৌমারী, বৈষ্ণবী, কৌমারী, নারসিংহী, বারাহী, ইন্দ্রাণী, চামুণ্ডা, কাত্যায়নী ও চণ্ডিকা। দুর্গাপূজার সময় দেবীদুর্গার আবরণদেবতা হিসেবে এঁদের পূজা করা হয়। আবার নবপত্রিকা (কলাবউ)-এর নয়টি গাছও নয় দেবীর প্রতীক। এঁরা হলেন—ব্রহ্মাণী (কলা), কালিকা (কচু), দুর্গা (হলুদ), জয়ন্তী (জায়ফল), শিবা (বেল), রক্তদন্তিকা (ডালিম), শোকরহিতা (অশোক), চামুণ্ডা (মান) ও লক্ষ্মী (ধান)। এঁরা পূজিত হন ‘ওঁ নবপত্রিকাবাসিন্যৈ নবদুর্গায়ৈ নমঃ’ মন্ত্রে।
তবে এঁরা ছাড়াও তন্ত্রে, পুরাণে আরও কয়েকজন দুর্গা-নামধারিণী দেবীর সন্ধান পাই। আবার দেবী দুর্গার অন্যান্য কয়েকটি রূপেরও দেখা পাওয়া যায়। আমরা সাধারণত দুর্গার যে মূর্তিটি শারদীয়া উৎসবে পূজা করি, সেই মূর্তিটির শাস্ত্রসম্মত নাম মহিষাসুরমর্দিনী-দুর্গা। স্মার্তমতে যাঁরা পঞ্চদেবতার পূজা করেন, তাঁরা জয়দুর্গার নাম ও ধ্যানমন্ত্রের সঙ্গে পরিচিত। এছাড়া আছেন মহিষমর্দিনী-দুর্গা, কাত্যায়নী-দুর্গা, নীলকণ্ঠী-দুর্গা, ক্ষেমঙ্করী-দুর্গা, হরসিদ্ধি-দুর্গা, রুদ্রাংশ-দুর্গা, বনদুর্গা, অগ্নিদুর্গা, বিন্ধ্যবাসিনী-দুর্গা, রিপুমারি-দুর্গা, অপরাজিতা-দুর্গা প্রমুখ দেবীগণ। এঁরা সবাই আগম-শাস্ত্রপ্রসিদ্ধ দেবী। এছাড়া তন্ত্রশাস্ত্রে দুর্গা-নাম্নী দেবীর যে ধ্যানমন্ত্র পাওয়া যায়, সেটিও আমাদের দেখা দশভুজা-মূর্তির মতো নয়।
মহিষাসুরমর্দিনী-দুর্গাকে নিয়ে আমাদের নতুন করে কিছুর বলার নেই। দুর্গাপূজায় প্রচলিত ‘জটাজুটসমাযুক্তা’ ইত্যাদি ধ্যানমন্ত্রের আধারে নির্মিত এই দেবীমূর্তি আমাদের সকলেরই পরম-পরিচিত। তবে বিষ্ণুধর্মোত্তর পুরাণ-এ মহিষাসুরমর্দিনীর একটু আলাদা রকমের বর্ণনা আমরা পাই। চণ্ডিকা নামে উল্লিখিত এই দুর্গার দশের জায়গায় কুড়িটি হাত। শ্রীশ্রীচণ্ডী-তে অষ্টাদশভূজা মহালক্ষ্মীর কথা আছে, এঁর হাত তাঁর থেকেও দুটি বেশি। ডান দিকের দশ হাতে থাকে শূল, খড়্গ, শঙ্খ, চক্র, বাণ, শক্তি, বজ্র, অভয়, ডমরু, ছাতা; আর বাঁদিকের দশ হাতে থাকে নাগপাশ, খেটক, পরশু, অঙ্কুশ, ধনুক, ঘণ্টা, পতাকা, গদা, আয়না ও মুগুর। বাকি সবই আমাদের চেনা মূর্তিটির মতো। দেবী কাত্যায়নী-দুর্গার মূর্তিটিও আমাদের দশভূজা-দুর্গার অনুরূপ। তবে আমাদের পরিচিত মহিষাসুরমর্দিনী ও তন্ত্রকথিত মহিষমর্দিনীর রূপে সামান্য ফারাক আছে। দেবী মহিষমর্দিনী অষ্টভুজা। এঁর ধ্যানে সিংহের উল্লেখ পাওয়া যায় না। দেবীকে মহিষের মাথার উপর বসে থাকতে দেখা যায়। হাতে থাকে শঙ্খ, চক্র, খড়্গ, খেটক, ধনুক, বাণ, শূল ও তর্জনীমুদ্রা। এর পূজার বিশেষ বৈশিষ্ট্য হল—শঙ্খপাত্রে অর্ঘ্যস্থাপনের উপর নিষেধাজ্ঞা; মৃৎপাত্রে এই কাজটি করতে হয়।
কুলাচারে পূজিতা দেবী জয়দুর্গার মূর্তিটি কিছুটা আমাদের পরিচিত জগদ্ধাত্রী মূর্তির মতো। শুধু দেবীর চার হাতে থাকে শঙ্খ, চক্র, খড়্গ ও ত্রিশূল এবং দেবীর গায়ের রং কালীর মতো কালো। কপালে থাকে অর্ধচন্দ্র। সিংহের পদতলে হাতি অনুপস্থিত। কেউ কেউ মনে করেন, জয়দুর্গা কালী ও দুর্গার সম্মিলিত মূর্তি।
নীলকণ্ঠী, ক্ষেমঙ্করী ও হরসিদ্ধি—তিনজনই চতুর্ভূজা। সুখ ও সম্পদদাত্রী নীলকণ্ঠীর হাতে থাকে ত্রিশূল, খেটক, পানপাত্র ও বরদামুদ্রা। সুস্বাস্থ্যদাত্রী ক্ষেমঙ্করীর হাতে থাকে বরদামুদ্রা, ত্রিশূল, পদ্ম ও পানপাত্র। সিদ্ধিদাত্রী হরসিদ্ধির হাতে থাকে ডমরু, কমণ্ডলু, খড়্গ ও পানপাত্র।
দেবী রুদ্রাংশ-দুর্গাও চতুর্ভূজা। তবে তিনি দ্বিনয়না, কৃষ্ণবর্ণা ও লাল অলংকারে শোভিতা। তাঁর হাতে থাকে শূল, খড়্গ, শঙ্খ ও চক্র। দেবীর বাহন সিংহ ও দেবীর দুই পাশে থাকে চন্দ্র ও সূর্য। অনেকটাই জয়দুর্গার মতো এই দেবীর রূপ।
বনদুর্গার আট হাত। অস্ত্রশস্ত্র মহিষমর্দিনীর অনুরূপ। বিশেষ বৈশিষ্ট্য দেবীর গায়ের রঙে—তিনি ঘাসের মতো সবুজ।
অগ্নিদুর্গাও অষ্টভুজা। তাঁর আট হাতে থাকে খড়্গ, চক্র, খেটক, বাণ, পাশ, অঙ্কুশ, বরদা মুদ্রা ও তর্জনী মুদ্রা। দেবী সিংহবাহিনী, ভীষণা এবং কপালে অর্ধচন্দ্রধারিণী। দুই পাশে ঢাল-তলোয়ার ধরে থাকেন দেবীর দুই সহচরী।
বিন্ধ্যবাসিনী-দুর্গা পদ্মাসনা, ত্রিনয়না ও চতুর্ভূজা। তাঁর চার হাতে থাকে শঙ্খ, চক্র, বর ও অভয় মুদ্রা। তাঁরও কপালে অর্ধচন্দ্র। সালংকারা এই দেবীকে ঘিরে স্তব করেন ইন্দ্রাদি দেবতারা। দেবীর বাহন সিংহ পাশে দাঁড়িয়ে থাকে।
রিপুমারি-দুর্গা আবার দ্বিভূজা। তাঁর দুই হাতে থাকে ত্রিশূল ও তর্জনী মুদ্রা।
অপরাজিতা-দুর্গার পূজা বিজয়াদশমীর দিন বিসর্জনান্তে কুলাচার অনুসারে হয়ে থাকে। এই দেবী সিংহবাহিনী ও ত্রিনয়না। তাঁর চার হাতে থাকে পিণাক, বাণ, খড়্গ ও খেটক। তাঁর মাথায় জটাজুট ও অর্ধচন্দ্র; কোমরে বাসুকি নাগের বেল্ট।
তন্ত্রে দুর্গার যে দুটি রূপ বর্ণিত সেদুটি দেবী জগদ্ধাত্রীর রূপ। তার একটিতে অবশ্য সিংহের পায়ের তলায় হাতি থাকে না। অপর রূপটির মন্ত্র অনুসারে জগদ্ধাত্রী পূজা হয়। এছাড়াও কত বিচিত্র দেবী যে দুর্গা নামে বাংলার গ্রামে গ্রামে পূজা পান, তারও ইয়ত্তা নেই। চণ্ডীতে দেখি, শুম্ভাসুর দেবীর বিরুদ্ধে অভিযোগ এনে বলছে, অপরের শক্তিতে বলীয়ান হয়ে দেবী অসুরদের পরাজিত করেছেন; আর তক্ষুনি দুর্গা দেখিয়ে দিচ্ছেন, তিনি ছাড়া জগতে দ্বিতীয় কোনো দেবী নেই; আর সব দেবী-বিভূতি মিশে যাচ্ছে তাঁরই শরীরে। সেই রকম দুর্গার এই সব বিচিত্র রূপও সাধকভক্তের হৃদয়ে সেই এক ও অদ্বিতীয় আদ্যাশক্তি মহামায়ার রূপান্তরমাত্র।
তথ্যসূত্র—
- মহিষাসুরমর্দিনী-দুর্গা, স্বামী প্রজ্ঞানানন্দ, রামকৃষ্ণ বেদান্ত মঠ, কলকাতা।
- তন্ত্রসার, কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ, বসুমতী সাহিত্য মন্দির, কলকাতা।
- হিন্দুদের দেবদেবী, তৃতীয় খণ্ড, ফার্মা কেএলএম প্রাঃ লিঃ, কলকাতা।