
সৌরজগৎ
সূর্যের মাধ্যাকর্ষণ বলের টানে তাকে কেন্দ্র করে ঘুরছে অসংখ্য গ্রহ, গ্রহাণু, ধূমকেতু ইত্যাদি জ্যোতিষ্ক। এদের সবাইকে নিয়েই সূর্যের সংসার—সৌরজগৎ। এই নিবন্ধে সৌরজগতের বিভিন্ন সদস্যদের একটি সচিত্র সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দেওয়া হল।
সূর্য (Sun)

সূর্য
সূর্য সৌরজগতের কেন্দ্রীয় নক্ষত্র। সূর্যই পৃথিবীর নিকটতম নক্ষত্র। এটি একটি সাধারণ আকারের নক্ষত্র। এমন অনেক নক্ষত্র আছে যেগুলি সূর্যের চেয়েও বড়ো, বেশি ভারী, বেশি গরম এবং বেশি উজ্জ্বল। তবে সেগুলির চাইতে সূর্যই আমাদের বেশি কাছে বলে আমরা সূর্যকে অত বড়ো আর উজ্জ্বল দেখি। সূর্য পৃথিবী থেকে ১৪৯,৬০০,০০০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। আমাদের দ্বিতীয় নিকটতম নক্ষত্র হল আলফা সেন্টারি (Alpha Centauri)। পৃথিবী থেকে এর দূরত্ব ৪০,০০০,০০০,০০০,০০০ কিলোমিটারেরও বেশি। কিন্তু সূর্য পৃথিবী থেকে মাত্র ৮ আলোকমিনিট দূরে অবস্থিত। অর্থাৎ, সূর্যের আলো সূর্য থেকে পৃথিবীতে আসতে মাত্র ৮ মিনিট সময় লাগে। সূর্য থেকে যে তাপশক্তি ও আলোকশক্তি বিকিরিত হয়, তা-ই আমাদের পৃথিবীর প্রাণের উৎস। তাছাড়া, সূর্যের আলো বিকিরিত না হলে আমরা ধূমকেতু আর উল্কা ছাড়া সৌরজগতের আর কোনো জ্যোতিষ্ককেই দেখতে পেতাম না।
সূর্যের আবহমণ্ডলের একেবারে বাইরের দিকের অংশটিকে বলে করোনা (Corona)। ফটোস্ফিয়ার (Photosphere) হল সূর্যের ‘দৃশ্যমান’ উপরিতল। প্রত্যেক নক্ষত্রেরই একটি বৈশিষ্ট্য হল তার অ্যাবসর্পশন স্পেকট্রাম (Absorption Spectrum)। সূর্যের অ্যাবসর্পশন স্পেকট্রামের উৎস হল ফটোস্ফিয়ার। এটি তার উপরের আবহমণ্ডলীয় স্তরের চেয়ে গভীরতর। ফটোস্ফিয়ারের উপরে ও করোনার নিচের স্তরটির নাম ক্রোমোস্ফিয়ার (Chromosphere)। সূর্যের উপরিতলের স্তরগুলির যত গভীরে যাওয়া যায়, উপরের স্তরগুলির চাপে নিচের স্তরগুলির তাপমাত্রা, চাপ ও গভীরতা ততই বাড়তে থাকে। সূর্যের গোটা শরীরটাই গ্যাসীয়। এর মধ্যে হাইড্রোজেন গ্যাসের ভাগই সবচেয়ে বেশি—সূর্যের মোট ভরের ৭০ শতাংশ। অবশিষ্ট ২৮ শতাংশ হিলিয়াম এবং ২ শতাংশ লিথিয়াম, ইউরেনিয়াম ইত্যাদি ভারী উপাদান। হান্স বেথ (Hans Bethe) প্রমাণ করেছিলেন, সৌরশক্তির উৎপাদনের জন্য দায়ি সূর্যের নিয়ন্ত্রিত থার্মোনিউক্লিয়ার বিক্রিয়া।

হিন্দু সূর্যদেবতা
সাদা আলোয় সূর্যের যে আলোকচিত্র তোলা হয়েছে, তাতে সূর্যের গায়ে অসংখ্য কালো কালো ছোপ দেখা যায়। এগুলিকে বলে সৌরকলঙ্ক (Sunspots)। সূর্যের উজ্জ্বল উপরিতলের প্রেক্ষিতে এগুলিকে যে কালো দেখায় তার কারণ, এগুলির উত্তাপ তুলনামূলকভাবে কম (৪৫০০ কে)। সাধারণত সৌরকলঙ্কে দুটি স্পষ্ট অংশ দেখা যায়—এর অন্ধকার কেন্দ্রীয় অঞ্চলটিকে বলে আম্ব্রা (Umbra) এবং এর চারপাশের আলোকময় অংশটিকে বলে পেনুম্ব্রা (Penumbra)। সৌরকলঙ্কগুলি হল নিবিড় চৌম্বকক্ষেত্র। এগুলি নির্দিষ্ট চক্রের আকারে আবির্ভূত ও অন্তর্হিত হয়। এই চক্রকে বলে সৌরকলঙ্ক চক্র (Sunspot Cycle) বা সৌরচক্র (Solar Cycle)। এই চক্রের গড় সময়কাল প্রায় ১১ বছর। সৌরকলঙ্কগুলিকে প্রতিদিনই একটু একটু করে সরতে দেখা যায়। এর থেকে প্রমাণিত হয়েছে যে সূর্য নিজের অক্ষের উপর ২৫ দিনে এক পাক ঘোরে। মাঝে মাঝে সূর্যচাকতির উপর লাল H আলোর নিবিড়তা বেড়ে যায়। এই ঘটনাকে বলে সোলার ফ্লেয়ার (Solar Flare)। এই সময় সূর্য থেকে প্রচুর প্রোটন, ইলেকট্রন ও আলফা কণা নির্গত হয়, যা এক দিন পর পৃথিবীতে পৌঁছে বিশ্বময় চৌম্বক ঝড় তোলে এবং বেতার তরঙ্গ প্রচারে অসুবিধা সৃষ্টি করে। সূর্যের মধ্যে এই সব ঘটনা অবশ্য সৌরকলঙ্ক চক্রের সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলে। জানা গিয়েছে, গাছের বৃদ্ধিও সৌরকলঙ্ক দ্বারা প্রভাবিত হয়। এর ফলে গাছের ট্রাঙ্কের চাকাগুলির গভীরতার তারতম্য ঘটে।

রোমান সূর্যদেবতা অ্যাপোলো
গ্রহমণ্ডল (Planets)
যে সব জ্যোতিষ্ক সূর্য বা অন্য কোনো নক্ষত্রকে কেন্দ্র করে ঘোরে, এবং শুধুমাত্র নক্ষত্রের আলোতেই আলোকিত হয়, তাদের বলে গ্রহ। সৌরজগতে আকারের হিসেবে সূর্যের পরেই গ্রহগুলির স্থান। শুধুমাত্র কয়েকটি উপগ্রহের ব্যাস ক্ষুদ্রতম গ্রহ বুধের চেয়ে বেশি। গ্রহের সংখ্যা ৮। সূর্য থেকে দূরত্বের ক্রম অনুসারে এগুলির নাম হল—(১) বুধ, (২) শুক্র, (৩) পৃথিবী, (৪) মঙ্গল, (৫) বৃহস্পতি, (৬) শনি, (৭) ইউরেনাস এবং (৮) নেপচুন। শেষোক্ত চারটি গ্রহের আকার এতই বড়ো যে এগুলিকে দৈত্যাকার গ্রহ (Giant Planet) বলে। পৃথিবীর আকার গ্রহের গড় আকারের চেয়ে কিছু কম। এটি উক্ত দৈত্যাকার গ্রহগুলির চেয়ে অনেকটাই ছোটো। আগে প্লুটোকে গ্রহ বলে মনে করা হত, আধুনিক বৈজ্ঞানিকদের মতে প্লুটো পূর্ণাঙ্গ গ্রহ নয়, এটি বামন গ্রহ।

বেচারি প্লুটো: গ্রহতালিকা থেকে প্লুটোকে বাদ দেওয়ার পর অঙ্কিত একটি কার্টুন।
প্রতিটি গ্রহই একটি প্রকাণ্ড কক্ষপথে সূর্যের চারিদিকে ঘোরে। এই কক্ষপথগুলি প্রায় বৃত্তাকার। প্রত্যেক গ্রহের অক্ষ মোটামুটি একই সমতলে থাকে। শুধুমাত্র প্লুটোর অক্ষ পৃথিবীর চেয়ে ১৭ ডিগ্রি কোণে অবস্থান করে।
সূর্য থেকে গ্রহের দূরত্ব যত বাড়ে, গ্রহগুলির কক্ষপথও অত ছড়িয়ে পড়ে। আঠারো শতকে জার্মান জ্যোতির্বিদ জোহান এলার্ট বোড (Johann Elert Bode) ‘বোডের সূত্র’ নামে পরিচিত একটি সাধারণ বুড়ো আঙুলের নিয়মে সূর্য থেকে গ্রহগুলির দূরত্ব মাপার পদ্ধতি আবিষ্কার করেন। এই সূত্রের অবশ্য কোনো তাত্ত্বিক ভিত্তি ছিল না। তাই সবচেয়ে দূরে অবস্থিত গ্রহগুলির দূরত্ব এই সূত্রের দ্বারা মাপা সম্ভব হয়নি।
রাতের আকাশে চাঁদকে বাদ দিলে সবচেয়ে উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক হল শুক্র গ্রহ। এটি শেষ রাতে পূর্ব আকাশে অথবা সন্ধ্যায় পশ্চিম আকাশে দেখা যায়। ভোর ও সন্ধ্যায় দৃশ্যমান শুক্রের নামও তাই যথাক্রমে হয় শুকতারা ও সন্ধ্যাতারা। সূর্য-পরিক্রমার সঙ্গে সঙ্গে রাতের আকাশে গ্রহগুলির আপেক্ষিক অবস্থানেরও পরিবর্তন হয়।

পার্থিব গ্রহসমূহ
সূর্যের নিকটতম চারটি গ্রহের (বুধ, শুক্র, পৃথিবী ও মঙ্গল) গঠনতন্ত্র পৃথিবীর অনুরূপ। তাই এগুলিকে বলে পার্থিব গ্রহ (Terrestrial Planet)। এই গ্রহগুলির সাধারণ বৈশিষ্ট্য হল—মোটা পাথুরে ভূত্বক, লোহা ও ম্যাগনেশিয়াম সমৃদ্ধ আচ্ছাদন শিলা এবং গলিত ধাতু দ্বারা নির্মিত অভ্যন্তরভাগ। এই গ্রহগুলির উপগ্রহের সংখ্যা খুবই কম এবং এদের বায়ুমণ্ডল পাতলা।

বার্হস্পত্য গ্রহসমূহ
অন্যদিকে, মঙ্গলের পরবর্তী গ্রহগুলি পার্থিব গ্রহগুলির চেয়ে অনেক দূরে অবস্থিত। এগুলির আকার বৃহস্পতির মতো বলে এগুলিকে বার্হস্পত্য গ্রহ (Jovian Planet) বলে। এগুলির আকার গ্যাসীয়। এদের চারপাশে বলয় ও অনেকগুলি উপগ্রহ থাকে।
বুধ (Mercury)

বুধ গ্রহ
ব্যাস—৪,৮৬২ কিলোমিটার
সূর্য থেকে দূরত্ব—৫৮,০০০,০০০ কিলোমিটার
বার্ষিক গতি—৮৮দিন
আহ্নিক গতি—৫৯ দিন
উপগ্রহের সংখ্যা—০
সূর্যের নিকটতম গ্রহটির নাম বুধ। এটির আকার চাঁদের মতো। বুধ সূর্যের এত কাছে থাকে যে বেশির সময় সময়ই সূর্যের উজ্জ্বলতার মধ্যেই চাপা পড়ে থাকে। তবে মাঝেমাঝে সূর্যোদয়ের ঠিক আগে বা সূর্যাস্তের ঠিক পরেই বুধ আকাশে দৃশ্যমান হয়। এটি খুবই উজ্জ্বল একটি জ্যোতিষ্ক। সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে সকালে এবং মার্চ-এপ্রিল মাসে সন্ধ্যায় আকাশে বুধের উদয় ঘটে। বুধের অনেক বৈশিষ্ট্যই চাঁদের মতো। উভয়ের আকার ও ভর সমান। চাঁদের মতোই বুধের বায়ুমণ্ডলের অস্তিত্ব নেই এবং বুধের ভূত্বকও পাথুরে ও পর্বতময়।

হিন্দু দেবতা বুধ।

রোমান দেবতা মারকুরি, যাঁর নামে গ্রহের ইংরেজি নামকরণ।
শুক্র (Venus)

শুক্র গ্রহ
ব্যাস—১২,১৯০ কিলোমিটার
সূর্য থেকে গড় দূরত্ব—১০৮,০০০,০০০ কিলোমিটার
বার্ষিক গতি—২২৫দিন
আহ্নিক গতি—২৪৩ দিন (অন্যান্য গ্রহের যেদিকে আবর্তন তার বিপরীত দিকে)
উপগ্রহের সংখ্যা—০
শুক্র সূর্য থেকে দূরত্বের বিচারে দ্বিতীয় গ্রহ। এই গ্রহটিকেই শুকতারা বা সন্ধ্যাতারার রূপে আকাশে দেখা যায়। আমাদের খুবই পরিচিত এই গ্রহ। তবে সারা বছর এই গ্রহটিকে আকাশে দেখা যায় না। কারণ, সূর্যের কাছে থাকায় সূর্যের উজ্জ্বলতায় এই গ্রহ চাপা পড়ে থাকে। আগেই বলা হয়েছে, সূর্য ও চাঁদকে বাদ দিলে শুক্রই আকাশের সবচেয়ে উজ্জ্বল নক্ষত্র। আসলে সূর্যের বায়ুমণ্ডল সর্বদা মেঘাচ্ছন্ন থাকে। ফলে শুক্রের উপর পতিত সৌরালোকের তিন-চতুর্থাংশই প্রতিফলিত হয়ে যায় এবং শুক্রকে উজ্জ্বল দেখায়। শুক্র ও পৃথিবীর আকার সমান হলেও শুক্রের ভর পৃথিবীর তুলনায় ৪/৫ গুণ। শুক্রের কোনো উপগ্রহ নেই।

হিন্দু দেবতা শুক্র

রোমান দেবী ভেনাস
পৃথিবী (Earth)
ব্যাস—১২,৭২৫ কিলোমিটার
সূর্য থেকে গড় দূরত্ব—১৫০,০০০,০০০ কিলোমিটার
বার্ষিক গতি—৩৬৫দিন
আহ্নিক গতি—২৩.৯ ঘণ্টা
উপগ্রহের সংখ্যা—১

আমাদের পৃথিবী ও চাঁদ
তৃতীয় গ্রহ আমাদের পৃথিবী। সূর্যের আলো পৃথিবীর জল ও স্থলভাগে প্রতিফলিত হয় বলে মহাকাশ থেকে পৃথিবীকে নীল ও সবুজ দেখায়। পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল পাতলা। তবে পাতলা হলেও, তা পৃথিবীতে প্রাণ রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বায়ুমণ্ডল মহাশূন্যে ভাসমান নানা বস্তুর হাত থেকে পৃথিবীকে রক্ষা করে। বায়ুমণ্ডলের ওজন স্তর সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মী শোষণ করে নিয়ে জীবজগৎকে ওই রশ্মির ক্ষতিকর প্রভাবের হাত থেকে রক্ষা করে। তাছাড়া, বায়ুমণ্ডল হল পৃথিবীর প্রাকৃতিক গ্রিনহাউস। বায়ুমণ্ডল পৃথিবীর তাপমাত্রাকে জীবনধারণের উপযোগী অবস্থায় রাখতে সাহায্য করে। এই সব কারণেই সৌরজগতে শুধুমাত্র পৃথিবীই প্রাণের অনুকূল। পৃথিবীর আহ্নিক গতির জন্য দিনরাত্রি হয় এবং বার্ষিক গতির জন্য ঋতুপরিবর্তন হয়। পৃথিবীর একটিই উপগ্রহ—চাঁদ (Moon)।
মঙ্গল (Mars)

মঙ্গল গ্রহ
ব্যাস—৬,৭৮০ কিলোমিটার
সূর্য থেকে গড় দূরত্ব—২২৮,০০০,০০০ কিলোমিটার
বার্ষিক গতি—১.৯ বছর
আহ্নিক গতি—২৪.৬ ঘণ্টা
উপগ্রহের সংখ্যা—২
চতুর্থ গ্রহ মঙ্গল। এই গ্রহকে লাল দেখায় বলে এর নাম লাল গ্রহ। পৃথিবীর আকাশে বছরের বেশিরভাগ সময়ই মঙ্গল উপস্থিত থাকে। তবে যখন সূর্যের বিপরীত দিকে থাকে, তখনই এটিকে ভালভাবে পর্যবেক্ষণ করা যায়। মঙ্গলের ব্যাস পৃথিবীর ব্যাসের অর্ধেকের সামান্য বেশি। কিন্তু এর ভর পৃথিবীর তুলনায় এক-দশমাংশ মাত্র। মঙ্গলের বায়ুমণ্ডল পাতলা বলে পৃথিবী থেকে তা সহজেই দৃশ্যমান হয়। মঙ্গলের ভূপ্রকৃতি, সেখানে জলের অস্তিত্বের সম্ভাবনা নিয়ে বর্তমানে অনেক গবেষণা চলছে। মঙ্গল প্রথম গ্রহ যেখানে মানুষ মহাকাশযান পাঠাতে সক্ষম হয়েছে। মঙ্গলের দুটি উপগ্রহের নাম হল ফোবোস (Phobos) ও ডেমোস (Deimos)।

হিন্দু দেবতা মঙ্গল

রোমান দেবতা মার্স
বৃহস্পতি (Jupiter)

বৃহস্পতি গ্রহ
ব্যাস—১৪২,৮৬০ কিলোমিটার
সূর্য থেকে গড় দূরত্ব—৭৭৯,০০০,০০০ কিলোমিটার
বার্ষিক গতি—১১.৯ বছর
আহ্নিক গতি—৯.৮ ঘণ্টা
উপগ্রহের সংখ্যা—২৮
বৃহস্পতি সৌরজগতের সবচেয়ে বড়ো গ্রহ। বৃহস্পতির ভর অন্যান্য সকল গ্রহের সম্মিলিত ভরের চেয়েও বেশি। সূর্য থেকে প্রথম চারটি গ্রহের যে দূরত্ব তার প্রত্যেকটির যোগফলের চেয়েও বেশি বৃহস্পতি থেকে সূর্যের দূরত্ব। তাই পৃথিবী ও মঙ্গলের তুলনায় অনেক কম পরিমাণে সূর্যের তাপ ও আলো পায় বৃহস্পতি। তবুও শুক্র ও কখনও সখনও মঙ্গলকে বাদ দিলে বৃহস্পতিই পৃথিবীর আকাশে সবচেয়ে উজ্জ্বল গ্রহ। সূর্যের আলো বৃহস্পতির ঘন আবহমণ্ডলের উপর পড়ে বাইরে প্রতিফলিত হয়ে যায় বলেই একে এত উজ্জ্বল দেখায়। বৃহস্পতি গ্যাসীয় গ্রহ। মনে করা হয়, মূলত হাইড্রোজেন ও হিলিয়াম দিয়েই বৃহস্পতি গঠিত। এর বাইরের অঞ্চলে মিথেন গ্যাস পাওয়া যায়। স্ফটিকের আকারে অ্যামোনিয়াও আছে। ২০০২ সাল পর্যন্ত, বৃহস্পতির ২৮টি উপগ্রহ আবিষ্কৃত হয়েছে। এর বাইরে একটি আবছা বলয় দেখা যায়।

হিন্দু দেবতা বৃহস্পতি

রোমান দেবতা জুপিটার
শনি (Saturn)

শনি গ্রহ

হিন্দু দেবতা শনি
ব্যাস—১২০,০০০ কিলোমিটার
সূর্য থেকে গড় দূরত্ব—১,৪২৮,০০০,০০০ কিলোমিটার
বার্ষিক গতি—২৯.৫ বছর
আহ্নিক গতি—৯.৮ ঘণ্টা
উপগ্রহের সংখ্যা—৩০
প্রাচীন জ্যোতির্বিদগণ শনিকেই সবচেয়ে দূরের গ্রহ বলে জানতেন। সূর্য থেকে শনির দূরত্ব বৃহস্পতি ও সূর্যের দূরত্বের দ্বিগুণ। এর আকার, ভর ও গঠনতন্ত্র বৃহস্পতিরই অনুরূপ। শুধু বৃহস্পতির চেয়ে শনি বেশি ঠান্ডা। শনির বৈশিষ্ট্য হল এর সুন্দর বলয়টি। শনিকে ঘিরে তিনটি বলয় রয়েছে। খালি চোখে এই বলয়গুলি দেখা যায় না। এগুলিকে টেলিস্কোপের সাহায্যে দেখতে হয়। শনির ৩০টি উপগ্রহ আছে।

রোমান দেবতা স্যাটার্ন
ইউরেনাস (Uranus)

ইউরেনাস গ্রহ

রোমান আকাশ-দেবতা ইউরেনাস
ব্যাস—৫০,১০০ কিলোমিটার
সূর্য থেকে গড় দূরত্ব—২,৮৭৫,০০০,০০০ কিলোমিটার
বার্ষিক গতি—৮৪ বছর
আহ্নিক গতি—২৪ ঘণ্টা
উপগ্রহের সংখ্যা—১৪
টেলিস্কোপের সাহায্যে আবিষ্কৃত প্রথম গ্রহটি হল ইউরেনাস। ১৭৮১ সালে উইলিয়াম হার্কল (William Herchel) এই গ্রহটি আবিষ্কার করেন। এই গ্রহের ব্যাস পৃথিবীর চারগুণ। ইউরেনাসের আবহমণ্ডলে হাইড্রোজেন ও মিথেন গ্যাস চিহ্নিত করা হয়েছে। সূর্য থেকে এর দূরত্ব শনি ও সূর্যের দূরত্বের দ্বিগুণ। ইউরেনাসের ২১টি উপগ্রহ আবিষ্কৃত হয়েছে।
নেপচুন (Neptune)
ব্যাস—৪৮,৬০০ কিলোমিটার
সূর্য থেকে গড় দূরত্ব—৪,৫০০,০০০,০০০ কিলোমিটার
বার্ষিক গতি—১৬৪.৮ বছর
আহ্নিক গতি—১৬ ঘণ্টা
উপগ্রহের সংখ্যা—৮

নেপচুন গ্রহ
সূর্যের শেষ গ্রহ তথা টেলিস্কোপে আবিষ্কৃত দ্বিতীয় গ্রহটি হল নেপচুন। ১৮৪৬ সালে ফ্রান্সে ইউ জে লেভারিয়ার (U. J. Leverrier) ইউরেনাসের পরেও গ্রহ থাকার সম্ভাবনার কথা বলেন। তাঁর কথা অনুযায়ী জ্যোতির্বিদরা টেলিস্কোপের সাহায্যে ইউরেনাসের অবস্থান খুঁজে বের করেন। নেপচুনের উপগ্রহের সংখ্যা ৮।

রোমান দেবতা নেপচুন
গ্রহাণু (Asteroids)

সৌরজগতে গ্রহাণুপুঞ্জের অবস্থান
মঙ্গল ও বৃহস্পতির মাঝে অসংখ্য ছোটো ছোটো জ্যোতিষ্কের একটি কক্ষপথ দেখা যায়। এগুলি জমে-যাওয়া গ্যাসে ঢাকা পাথরের টুকরো। এদের বলে গ্রহাণু। সবচেয়ে বড়োটির নাম সেরেস (Ceres)। মোট ১০০০টি গ্রহাণু আবিষ্কৃত হয়েছে। মনে করা হয়, প্রায় ৫০,০০০ গ্রহাণুর অস্তিত্ব আছে। তবে এগুলির সম্মিলিত ভর পৃথিবীর তুলনায় কম।
গ্রহাণুর উৎপত্তির কারণ জানা যায় না। একটি তত্ত্ব অনুসারে, মঙ্গল ও বৃহস্পতির মাঝে আগে একটি বড়ো গ্রহ ছিল। সেটি কোনো অজ্ঞাত কারণে টুকরো টুকরো হয়ে গ্রহাণুতে পরিণত হয়েছে। কিন্তু বর্তমানে এই মত পরিত্যক্ত হয়েছে। মনে হয়, এখানে আগে কয়েকটি ছোটো গ্রহ ছিল। কোনো কারণে সেগুলির মধ্যে সংঘর্ষ হয় এবং সেগুলি টুকরো টুকরো হয়ে গ্রহাণুতে পরিণত হয়।
ধূমকেতু (Comets)

ধূমকেতু
ধূমকেতু হল গ্রহেরই মতো সৌরজগতের এক সূর্যপ্রদক্ষিণকারী সদস্য। তবে এরা গ্রহের মতো নিয়মিত কক্ষপথে সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে না। সাধারণত ধূমকেতুর তিনটি অংশ—নিউক্লিয়াস, কমা ও লেজ। গ্যাস ও ধূলাময় লেজটি সূর্যের কাছাকাছি এলে সৃষ্টি হয়। নিউক্লিয়াসটি হল কঠিন। মহাকাশপদার্থবিদদের মতে এটি এক কিলোমিটার আকারের নোংরা তুষারবল।
ধূমকেতু সূর্যের কাছাকাছি এলে সূর্যের তাপে তার পদার্থগুলি বাষ্পীভূত হয়ে কমায় পরিণত হয়। সূর্যের তাপবিকিরণ শক্তির প্রভাবে তা বের হয় লেজটি সৃষ্টি করে। সূর্যের আলোয় ধূমকেতুর গ্যাস ও ধূলা আলোকিত হয়ে দৃশ্যমান হয়। তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে ধূমকেতু সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মি শোষণ করে, পরে আলোক আকারে তা বিচ্ছুরিত করে।

হ্যালির ধূমকেতু
ধূমকেতু যখন সূর্যের দিকে যায় তখন তার লেজটি থাকে সূর্যের বিপরীত দিকে। ধূমকেতুর মাথা লেজের ডগাটির দূরত্ব যত বেশি হয়, লেজটি তত মোটা হয়। কারণ, এই সময় বেশি পরিমাণ গ্যাস ও ধূলা পিছনে ছড়িয়ে পড়ে। লেজটির আকার অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বাঁকা শিং-এর মতো হয়।
সূর্যের বিপরীত পথে যাত্রা শুরু করলেই, ধূমকেতুর লেজটি খসে যায়। এইভাবে প্রত্যেক পরিক্রমায় ধূমকেতুর ভর কমতে থাকে। তবে মহাশূন্যে ভ্রমণকালেও ধূমকেতু কিছু গ্যাস সংগ্রহ করে।
স্পেকট্রোগ্রাফে জানা গিয়েছে ধূমকেতুতে সিয়ানোজেন, কার্বন, কার্বন মনোক্সাইড, নাইট্রোজেন, হাইড্রক্সিল ও নাইট্রোজেন হাইড্রাইড প্রভৃতি গ্যাস থাকে।
১৬৮২ সালে বিজ্ঞানী হ্যালি একটি ধূমকেতু পর্যবেক্ষণ করে বলেন যে, ধূমকেতু মাধ্যাকর্ষণ সূত্র মেনে সূর্য প্রদক্ষিণ করে। ওই ধূমকেতুটি এখন হ্যালির ধূমকেতু নামে পরিচিত। হ্যালির পর থেকে অনেক ধূমকেতুরই কক্ষপথ আবিষ্কৃত হয়েছে। এঙ্কের ধূমকেতু (Enck’s Comet) সবচেয়ে কম সময়ে সূর্য প্রদক্ষিণ করে—৩.৩ বছরে। হ্যালির ধূমকেতু শেষ দেখা গিয়েছিল ১৯৮৫-৮৬ সালে। কোনো কোনো ধূমকেতুর সূর্য পরিক্রমা করতে ১০০, ২০০ বা ৫০০ বছরও লাগে।
উল্কা (Meteors)

উল্কাপাতের ফলে পৃথিবীর বুকে সৃষ্ট গর্ত
উল্কা মহাশূন্যে ভাসমান একপ্রকার জ্যোতিষ্ক। এগুলি পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ করে জ্বলে ওঠে। বড়ো বড়ো উল্কা পৃথিবীর মাটিতে আছড়েও পড়ে। উল্কা থেকে আমরা মহাশূন্যে প্রাপ্ত বিভিন্ন উপাদান সম্পর্কে জানতে পারি। এমনকি মহাশূন্য ও বিভিন্ন জ্যোতিষ্কের সৃষ্টিকালীন নানা তথ্যও উল্কাগুলি থেকে জানা যায়।
Indranil modak
সেপ্টেম্বর 6, 2012 at 9:01 অপরাহ্ন
আপনার পরিশ্রম সার্থক হয়েছে। পড়ে খুব ভালো লাগল। “LIKE” দিলাম।
অর্ণব দত্ত
সেপ্টেম্বর 8, 2012 at 12:55 অপরাহ্ন
অনেক ধন্যবাদ! 🙂
swaraj
জুন 15, 2013 at 9:02 পুর্বাহ্ন
thanks
shahadat hossen
এপ্রিল 9, 2015 at 3:07 অপরাহ্ন
খূব সুন্দর হল এগুলোপড়ে আমি কিছু জ্ঞান অর্জণ করতে পারলাম !! ধন্যবাদ !
bishan saha
ডিসেম্বর 19, 2017 at 1:03 অপরাহ্ন
thank’s from sufol roy