১৫৫০ সালে পর্তুগিজরা ভারতে প্রথম ছাপাখানা চালু করেছিল। ১৫৫৭ সালে পর্তুগিজ মিশনারিরাই ভারতে প্রথম ছাপা বই প্রকাশ করে। এরপর ১৬৮৪ সালে ইংরেজরা ছাপাখানা চালু করে। ১৭৮০ সালে জেমস অগাস্টাস হিকি প্রথম ভারতে খবরের কাগজ চালু করেন। কাগজটির নাম ছিল বেঙ্গল গেজেট। লোকমুখে তা পরিচিত ছিল হিকির গেজেট নামে। সরকারি নীতি ও গভর্নর-জেনারেলের সমালোচনা করে হিকির গেজেট সরকারের বিষ নজরে পড়ে। ফলে দু-বছরের মধ্যেই কাগজটি বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু শিগগিরিই এর দেখাদেখি আরও কয়েকটি কাগজ চালু হয়ে যায়।
গঙ্গাধর ভট্টাচার্য হলেন প্রথম ভারতীয় যিনি খবরের কাগজ চালু করেছিলেন। তাঁর বেঙ্গল গেজেট কাগজটিও ছিল ইংরেজিতে। দেশীয় ভাষায় প্রথম পত্রিকা চালু হয় ১৮১৬ সালে। ১৮২১ সালে মার্শম্যান চালু করেন দিগ্দর্শন নামে এক বাংলা মাসিক পত্রিকা। ১৮১৮ সালে রাজা রামমোহন রায় তাঁর সম্বাদ কৌমুদী কাগজটি চালু করেন। ১৮২১ সালে তিনি মিরাত-উল-আখবর নামে একটি ফারসি সাপ্তাহিক পত্রও চালু করেন।
১৭৯৯ সালে সেন্সরশিপ আইন চালু করে প্রথম বার সংবাদপত্রের অধিকার খর্ব করা হয়। এই আইনবলে কাগজের প্রতিটি সংখ্যায় মুদ্রক, সম্পাদক ও মালিকের নাম ছাপা এবং কাগজের বিষয়বস্তু ছাপার আগে সরকারি সচিবের কাছে পেশ করা বাধ্যতামূলক করা হয়। লর্ড ওয়েলেসলি ভারতে ফরাসি আক্রমণের ভয়ের অজুহাত দেখিয়ে এই আইন জারি করেন। ১৮০৭ সালে আইনটি পত্রপত্রিকা ও পুস্তকপুস্তিকার উপরও জারি হয়। লর্ড হেস্টিংস এই আইন বিলোপ করেন।
অস্থায়ী গভর্নর-জেনারেল জন অ্যাডাম লর্ড হেস্টিংসের নীতির বিরোধিতা করে, ১৮২৩ সালে পুনরায় নিয়ন্ত্রণমূলক আইন ফিরিয়ে আনেন। তাঁর আনা লাইসেন্সিং রেগুলেশন আইনের মূল বৈশিষ্ট্যগুলি হল:
(১) প্রত্যেক প্রকাশক ও মুদ্রকের সরকারি লাইসেন্স থাকা বাধ্যতামূলক করা হয়।
(২) সরকারকে যে কোনো লাইসেন্স বাতিল করে দেওয়ার ক্ষমতা দেওয়া হয়।
(৩) প্রতিটি লাইসেন্স-বিহীন প্রকাশনার জন্য দোষীকে ৪০০ টাকা পর্যন্ত জরিমানার ব্যবস্থা করা হয়।
এই রেগুলেশন-বলে অনেক খবরের কাগজ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। তার মধ্যে রাজা রামমোহনের ফারসি সাপ্তাহিকটিও ছিল।
গভর্নর-জেনারেল মেটকাফের আমলে (১৮৩৫-৩৬) লাইসেন্সিং রেগুলেশন বাতিল করে দেওয়া হয়, তাঁর মুক্ত প্রেসনীতির জন্য তাঁকে ‘ভারতীয় প্রেসের মুক্তিদাতা’ আখ্যা দেওয়া হয়। উল্লেখ্য, লর্ড ওয়েলেসলি, মিন্টো, অ্যাডাম, লিটন প্রমুখেরা ভারতীয় প্রেসের স্বাধীনতার বিরোধিতা করে এলেও, লর্ড হেস্টিংস, বেন্টিঙ্ক, মেটকাফ, ম্যাকাউলি ও রিপন ছিলেন প্রেসের স্বাধীনতার পক্ষে।
১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহের পর সরকার আবার লাইসেন্সিং আইন জারি করেন। আইনটির নাম ছিল ১৮৫৭ সালের পঞ্চদশ আইন (Act XV, 1857)। এই আইনবলে মেটকাফের নির্দেশিকা ফিরিয়ে নেওয়া হয় এবং লাইসেন্সিং রেগুলেশন ফিরিয়ে আনা হয়। পুরনো রেগুলেশনে উল্লিখিত ক্ষমতাগুলির পাশাপাশি এই আইনে সরকারকে সংবাদপত্র, বই বা যেকোনো ছাপা রচনার প্রকাশ বন্ধ করে দেওয়ার ক্ষমতাও দেওয়া হয়।
১৮৬৭ সালের প্রেস অ্যান্ড রেজিস্ট্রেশন অফ বুকস অ্যাক্ট জারি করে প্রতিটি বই ও সংবাদপত্রে মুদ্রক ও প্রকাশকের নাম ও মুদ্রণের স্থান ছাপা বাধ্যতামূলক করা হয়। পাশাপাশি বই প্রকাশের এক মাসের মধ্যে বইয়ের একটি কপি স্থানীয় সরকারের কাছে বিনামূল্যে সরবরাহ করার নির্দেশ দেওয়া হয়।
১৮৭৮ সালে লর্ড লিটন তাঁর কুখ্যাত দেশীয় সংবাদপত্র আইন বা ভার্নাকুলার প্রেস অ্যাক্ট জারি করেন। এই আইনবলে জেলার ম্যাজিস্ট্রেটদের এই মর্মে যেকোনো মুদ্রকের সঙ্গে বন্ড সাক্ষর করার অধিকার দেওয়া হয় যে, তাঁরা রাজদ্রোহ বা উসকানিমূলক কিছু ছাপবেন না। এই জন্য ম্যাজিস্ট্রেটকে নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ জমা রাখারও অধিকার দেওয়া হয়। এমনকি প্রেস বন্ধ করে দেওয়া বা প্রেসের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার অধিকারও তাঁকে দেওয়া হয়।
১৮৮২ সালে ইংল্যান্ডের লিবারেল সরকারের প্রতিনিধি লর্ড রিপন এই আইন প্রত্যাহার করে নেন।
১৯০৮ সালের সংবাদপত্র আইন বলে, ম্যাজিস্ট্রেটকে এমন ক্ষমতা দেওয়া হয়, যাতে তাঁরা হিংসায় উসকানি দেওয়া অভিযোগে প্রেস ও তার সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে নিতে পারেন। অবশ্য এই আইন বলে প্রেস বন্ধ করে দেওয়ার ১৫ দিনের মধ্যে প্রেস কর্তৃপক্ষকে হাইকোর্টে আপিল করার অনুমতি দেওয়া হয়।
১৯১০ সালের ভারতীয় প্রেস আইন বলে, স্থানীয় সরকারগুলিকে প্রেসের কাছ থেকে কমপক্ষে ৫০০ টাকা ও অনধিক ২০০০ টাকা জমা রাখার অধিকার দেওয়া হয় এবং বলা হয় কোনো প্রেস আপত্তিকর কিছু ছাপলে ওই টাকা বাজেয়াপ্ত করা হবে। নতুন রেজিস্ট্রেশনের ক্ষেত্রে কমপক্ষে ১০০০ টাকা ও অনধিক ১০,০০০ টাকা জমা রাখার নির্দেশও দেওয়া হয়। তবে ক্ষতিগ্রস্থ সংবাদপত্র প্রকাশ বন্ধ হয়ে যাওয়ার দু-মাসের মধ্যে হাইকোর্টের বিশেষ ট্রাইবুনালের কাছে আপিল জানাতে পারবে।
১৯২১ সালে সরকার ভাইসরয়ের কার্যনির্বাহী পরিষদের তদনীন্তন আইন-বিভাগীয় সদস্য স্যার তেজবাহাদুর সপ্রুর নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করেন। এই কমিটি প্রেস আইনগুলির কাজকর্ম খতিয়ে দেখে। কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী ১৯০৮ ও ১৯১০ সালের আইনদুটি প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়।
১৯৩০ সালে মহাত্মা গান্ধীর আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে সরকার নতুন করে প্রেস আইন জারি করে। ১৯১০ সালের আইনের ধারাগুলিকে নিয়ে চালু হয় ভারতীয় প্রেস (জরুরি ক্ষমতা) আইন। এই আইনবলে প্রাদেশিক সরকারগুলির হাতে প্রেসকে দমন করার অস্ত্র তুলে দেওয়া হয়।
১৯৩২ সালের এই আইনের ধারাগুলি ফৌজদারি অপরাধের ধারার আদলে সাজানো হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় প্রাক-সেন্সরশিপ ফিরিয়ে আনা হয় এবং সেটিকে ১৯৩১ সালের প্রেস এমারজেন্ট অ্যাক্ট ও অফিসিয়াল সিক্রেট অ্যাক্টের অধীনে আনা হয়। কংগ্রেস ও তার কার্যকলাপ নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়। নিষিদ্ধ হয়ে যায় জাতীয় চেতনার সঙ্গে সম্পৃক্ত কিছু ছাপাও। এরপর ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতার ঠিক আগে সংবাদপত্র-সংক্রান্ত আইনগুলি খতিয়ে দেখার জন্য একটি কমিটি গঠিত হয়।
pralaydutta
অগাষ্ট 25, 2016 at 5:19 অপরাহ্ন
GOOD