RSS

মাতৃতীর্থ জয়রামবাটী

11 মে

যে গ্রামে জন্মিলা মাতাদেবী ঠাকুরানী।

পুণ্যময়ী লীলা-তীর্থ ধামে তারে গণি।।

শ্রীপ্রভুর পদরেণু বিকীর্ণ যেখানে।

বিধাতার সুদুর্লভ তপস্যা সাধনে।।

(শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণপুঁথি, অক্ষয়কুমার সেন)

নবদ্বীপধামে দেবী বিষ্ণুপ্রিয়া জয়রামবাটী এলে সারদা সাজিয়া,

জীর্ণ চীর বাসে নিজেরে ঢাকিয়া রাজলক্ষ্মী হ’লে যোগিনী।।

(মণীন্দ্রকুমার সরকার)

মাতৃমন্দিরে পূজিত মায়ের শ্বেতপাথরের মূর্তি

পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়া জেলার বিষ্ণুপুর মহকুমার অন্তঃপাতী জয়রামবাটী গ্রাম শ্রীশ্রীমা সারদা দেবীর পুণ্য জন্মস্থান। মা বলতেন–‘ওদের এখানে তিনরাত্রি বাস কত্তে বলো। এখানে তিনরাত্রি বাস কল্লে দেহ শুদ্ধ হয়ে যাবে, এটা শিবের পুরী কিনা।’ সত্যিসত্যিই মায়ের মন্দির নির্মাণের সময় ভিত খুঁড়তে গিয়ে পাওয়া গিয়েছিল একটি ছোটো কালো শিবলিঙ্গ। মাতৃমন্দিরের সিংহাসনে আজও সেটি পূজিত হয়।

জয়রামবাটী গ্রামের আদি নাম ছিল ‘তেঁতুলমুড়ি’। ‘জয়রামবাটী’ নাম কিভাবে এল, তা সঠিক জানা যায় না। মায়ের জীবনীকার স্বামী গম্ভীরানন্দ অনুমান করেন, সম্ভবত মায়ের পিতৃকুল মুখোপাধ্যায় বংশের কুলদেবতা রামচন্দ্র বা কোনো পুর্বপুরুষের নামে গ্রামের নতুন নামকরণ হয়েছিল। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের জন্মভূমি হুগলি জেলার কামারপুকুর গ্রাম থেকে জয়রামবাটীর দূরত্ব মাত্র সাড়ে তিন মাইল। ১৮৫৩ থেকে ১৮৫৯ সাল পর্যন্ত প্রায় ৬ বছর মা নিরবিচ্ছিন্নভাবে জয়রামবাটীতেই বাস করেছিলেন। বিয়ের পর কামারপুকুরের শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে মাঝে মাঝে থাকলেও ১৮৭২ সাল পর্যন্ত বেশিরভাগ সময় মা জয়রামবাটীতেই কাটান। এরপরও ১৮৯০ থেকে ১৯১৯ সাল পর্যন্ত জয়রামবাটীতেই বেশি ছিলেন তিনি।

শ্রীরামকৃষ্ণ একাধিকবার জয়রামবাটীতে এসেছিলেন। ঠাকুরের পার্ষদ ও মায়ের ভক্তশিষ্যদের মধ্যে কথামৃতকার শ্রীম, নাট্যাচার্য গিরিশচন্দ্র ঘোষ, স্বামী সারদানন্দ, স্বামী শিবানন্দ সহ অনেকেই জয়রামবাটী দর্শন করেছেন। স্বামী সারদানন্দই প্রথম জয়রামবাটীতে মাতৃমন্দির ও আশ্রয় স্থাপনে উদ্যোগী হন। তবে স্বামী বিবেকানন্দ এখানে এসেছিলেন কিনা, তা জানা যায় না।

শ্রীশ্রীমাতৃমন্দির মঠ

 

শ্রীশ্রীমাতৃমন্দির মঠ জয়রামবাটীর প্রধান আকর্ষণ। স্বামী সারদানন্দ মঠে মায়ের মন্দির ও সম্পত্তি বেলুড়ের শ্রীরামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের ট্রাস্টি বোর্ডকে অর্পণ করে গিয়েছিলেন। মঠের ভিতর আছে মাতৃমন্দির, মায়ের পুরনো ও নতুন বাড়ি, পু্ণ্যপুকুর, অফিসঘর, পুস্তক বিক্রয়কেন্দ, সাধুদের বাসস্থান, রান্নাঘর, প্রসাদ বিতরণের ঘর, সুন্দরনারায়ণ ধর্মমন্দির ইত্যাদি। মঠে ঠাকুর, মা, স্বামীজি ও ঠাকুরের পারিষদবর্গের জন্মতিথি উৎসব, অক্ষয় তৃতীয়ায় মন্দির প্রতিষ্ঠা দিবস, জগদ্ধাত্রী পূজা, দুর্গাপূজা ও ফলহারিণী কালীপূজার অনুষ্ঠান মহাসমারোহে পালিত হয়।

মঠ ও মন্দির দর্শনের সময়

ভোর ৪টে থেকে বেলা ১১টা এবং বিকেল ৪টে থেকে রাত ৮টা (এপ্রিল-সেপ্টেম্বর)

ভোর সাড়ে ৪টে থাকে বেলা ১১টা এবং বিকেল সাড়ে ৩টে থেকে রাত ৮টা (অক্টোবর-মার্চ)

মাতৃমন্দির

 

মাতৃমন্দির

জয়রামবাটীর কেন্দ্রবিন্দু শ্রীশ্রীমাতৃমন্দির মঠ এবং শ্রীশ্রীমাতৃমন্দির মঠের কেন্দ্রস্থলটি হল মায়ের মন্দিরটি। মা স্বয়ং তাঁর জন্মস্থলটিকে বেলুড় মঠ কর্তৃপক্ষের হাতে দেবার ব্যবস্থা করে গিয়েছিলেন। মায়ের দেহরক্ষার বছর তিনেক বাদে ১৩৩০ বঙ্গাব্দের ৬ বৈশাখ (১৯২৩ সালের ১৯ এপ্রিল) শুভ অক্ষয় তৃতীয়া পবিত্র দিনে স্বামী সারদানন্দের প্রচেষ্টায় মায়ের জন্মস্থানে মাতৃমন্দিরটি উৎসর্গীকৃত হয়। এই খানেই মায়ের আদি বাড়িটি অবস্থিত ছিল ; নয় বছর বয়স পর্যন্ত তিনি এখানেই বাস করেন এবং এখানেই ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন।

প্রথমে গর্ভমন্দিরে একটি তৈলচিত্রে মায়ের পূজা হত। তৈলচিত্রটি ললিত চট্টোপাধ্যায় নামে মায়ের এক ভক্ত লন্ডন থেকে আঁকিয়ে এনেছিলেন। পরে ১৯৫৪ সালে মায়ের জন্মশতবর্ষ উপলক্ষ্যে বাসন্তী শুক্লাষষ্ঠীর দিন স্বামী শঙ্করানন্দ কর্তৃক একটি সুন্দর শ্বেতপাথরের মূর্তি প্রতিষ্ঠিত হয়। স্বামী ঋতানন্দ অনেক পরিশ্রম করে মূর্তিটি বারাণসী থেকে আনিয়েছিলেন। এর নির্মাতার নাম জানা যায় না। পুরনো তৈলচিত্রটি এখন বেলুড় মঠের শ্রীরামকৃষ্ণ সংগ্রহালয়ে রাখা আছে। মূর্তিপ্রতিষ্ঠার কিছুদিন পর মন্দিরটিও প্রসারিত করে বর্তমান প্রার্থনা কক্ষটি নির্মিত হয়।

মায়ের বেদির নিচের সিংহাসনে রয়েছে ঠাকুরের ছবি। মন্দিরের ভিতরে তাঁর পবিত্র দেহাবশেষও রক্ষিত আছে। মন্দিরটি ইঁটের তৈরি ; উচ্চতা ৪৫ ফুট। চারদিকে বারান্দা। মন্দিরের পিছনে শয়নরক্ষে রাখা আছে মায়ের আলতারঞ্জিত পদচিহ্ন, খাট, তোষক, লেপ ও বালিশ। মন্দিরের গম্বুজের উপরে বাংলায় ‘মা’ লেখা একটি ধাতব পতাকা দেখা যায়। এই ছোট্ট কথাটি দূরদূরান্ত থেকে আসা ভক্তদের স্মরণ করিয়ে দেয় মায়ের চিরন্তনী অভয়বাণী–‘আমি সতেরও মা, অসতেরও মা।… আমি রয়েছি, আমি মা থাকতে ভয় কি?’

মায়ের পুরনো বাড়ি

এই বাড়িতেই মা জীবনের অধিকাংশ সময় কাটান।

এটি মায়ের পিতৃদেব রামচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের আদি বাস্তুভিটা। এটি মাতৃমন্দিরের দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত। ১৯১৫ সাল পর্যন্ত প্রায় ৫২ বছর মা এই ঘরটিতে বাস করেছেন। এখানে অনেক ভক্ত তাঁর কাছে মন্ত্রদীক্ষা, ব্রহ্মচর্য ও সন্ন্যাসদীক্ষা পেয়েছিলেন।

মায়ের নতুন বাড়ি

মাতৃমন্দিরের দক্ষিণ-পূর্ব দিকে রয়েছে মায়ের নতুন বাড়ি। এখানে মা বাস করেছিলেন চার বছর—১৯১৫ সালের মে মাস থেকে ১৯২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত। জয়রামবাটীতে ভক্তদের ভিড় বেড়ে যাওয়ায় যখন পুরনো বাড়িতে থাকা অসুবিধা হতে লাগল, তখন স্বামী সারদানন্দ এই বাড়িটি তৈরি করে দেন। বাড়ির দলিল রেজিস্ট্রি হয়েছিল জগদ্ধাত্রীর নামে।

নতুন বাড়ির চার কোণে চারটি মাটির দেওয়াল ও খড়ের চাল-সহ ঘর তৈরি হয়। তার মধ্যে যে ঘরটিতে মা রাধুকে নিয়ে থাকতেন, সেটিই ঠাকুরঘর হিসেবে ব্যবহৃত হত। এই ঘরেও মা অনেক ভক্তকে মন্ত্রদীক্ষা, ব্রহ্মচর্য ও সন্ন্যাসদীক্ষা দেন। পাশের ঘরটি ব্যবহার করতেন মায়ের ভাইঝি নলিনী। নলিনীর ঘরের উল্টোদিকের ঘরটিতে মায়ের সময়ে জগদ্ধাত্রী পূজা ও অন্যসময় ভক্তদের বাসের জন্য নির্দিষ্ট ছিল। স্বামী সারদানন্দ প্রমুখেরা জয়রামবাটী এলে এঘরেই থাকতেন।

পুণ্যপুকুর

জয়রামবাটীতে মা

মাতৃমন্দিরের ঠিক সামনে তথা মায়ের নতুন বাড়ির পূর্বদিকের বিরাট পুকুরটি হল বিখ্যাত পুণ্যপুকুর। মা এই পুকুরের জল ব্যবহার করতেন। এটি মায়ের পরিবারের পারিবারিক সম্পত্তি ছিল। মাঝে জমিদারের হস্তগত হলেও এখন এটি শ্রীশ্রীমাতৃমন্দির মঠের সম্পত্তি।

জগদ্ধাত্রী পূজামণ্ডপ

মাতৃমন্দিরের দক্ষিণে মাটির দেওয়াল ও খড়ের চাল-যুক্ত এই মণ্ডপটিতেই মা জগদ্ধাত্রী পূজা শুরু করেছিলেন। প্রায় পঞ্চাশ বছর মা জগদ্ধাত্রী পূজা করেন। প্রতি বছর পূজার সময় তিনি অবশ্যই জয়রামবাটী আসতেন। মায়ের দেহরক্ষার পরও জগদ্ধাত্রী পূজায় ছেদ পড়েনি। আজও মাতৃমন্দিরে মহাসমারোহে জগদ্ধাত্রী পূজা আয়োজিত হয়।

গৃহদেবতার মন্দির

 

পুণ্যপুকুরের পশ্চিম পাড়ে একটি ছোটো বাড়ি রয়েছে। এটি আসলে মায়ের গৃহদেবতা সুন্দরনারায়ণ ধর্মঠাকুরের মন্দির। মায়ের পিতৃদেব রামচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের উর্ধ্বতন পঞ্চম পুরুষ খেলারাম মুখোপাধ্যায় বিষ্ণুপুরের রাজার থেকে ধর্মঠাকুরের সেবক হিসেবে দেবোত্তর জমি পেয়েছিলেন। মন্দিরের ভিতর সামনের দিকে কচ্ছপের আকৃতিবিশিষ্ট সুন্দরনারায়ণ ধর্মশিলার অধিষ্ঠান। এখানে ষষ্ঠী ও শীতলা দেবী এবং নারায়ণ শিলাও পূজিত হয়। অন্যান্য ঠাকুরদেবতার যে সব ছবি ও মূর্তি আজ আমরা দেখতে পাই সেগুলি পরবর্তীকালের সংযোজন।

মায়ের স্মৃতিবিজড়িত অন্যান্য স্থান

 

জয়রামবাটী ও তার আশেপাশে মায়ের স্মৃতিবিজড়িত আরও কয়েকটি স্থান রয়েছে। এগুলির কয়েকটি সম্পর্কে একে একে আলোচনা করা যাক।

ভানুপিসির বাড়ি

 

ভানুপিসি ছিলেন মায়ের ছেলেবেলার সঙ্গিনী। তিনিও ছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণের আশীর্বাদধন্যা। ঠাকুর তখন দক্ষিণেশ্বরে সাধনা করছেন। গাঁয়ে রটে গেল তিনি পাগল হয়ে গেছেন। অজ্ঞ গ্রামবাসীদের কূটকচালির হাত থেকে রেহাই পেতে মা সেই সময় প্রায়ই ভানুপিসির বাড়ি চলে যেতেন। মা যখন নেহাত শিশু, তখন থেকেই ভানুপিসি তাঁর মধ্যে দৈবী সত্ত্বা দেখতে পেতেন। শোনা যায়, তিনি মায়ের চতুর্ভূজা মূর্তিও দর্শন করেছিলেন।

ভানুপিসির বাড়িটি অবশ্য আজ আর নেই। শুধু স্থানটিই আজ আমরা দেখতে পাই। এটি মায়ের নতুন বাড়ির কাছে। এখন একটি শ্বেতপাথরের ফলকে ভানুপিসির চতুর্ভূজা মাতৃদর্শনের দৃশ্যটি খোদিত আছে।

সিংহবাহিনী মন্দির

 

জয়রামবাটীর গ্রামদেবতা সিংহবাহিনী। মন্দিরে রয়েছে তিনটি ছোটো অভিনব ঘটমূর্তি। মাঝের মূর্তিটি সিংহবাহিনী বা দুর্গার। তাঁর ডানদিকের মূর্তিটি চণ্ডী ও বাঁদিকের মূর্তিটি মহামায়ার। দু-জনেই মা সিংহবাহিনীর সহচরী। কিছুদূরে বাঁদিকে রয়েছেন সর্পদেবী মনসা।

সিংহবাহিনীর পুরনো মন্দিরটি ছিল খড়ের চালা। ১৯৭০-এর দশকে সেটি ভেঙে গেলে গোপাল মণ্ডল বর্তমান মন্দিরটি তৈরি করে দেন। মায়ের পিতৃবংশের বংশধর দেবীর সেবাপূজা করে থাকেন। দেবীর অন্নভোগ নিষিদ্ধ ; তাঁকে চিঁড়ে ফলমূল ও মিষ্টি দিয়ে পূজা করা হয়। দুর্গাপূজা, রাধাষ্টমী ও কালীপূজার দিন মহাসমারোহে পূজা হয়। শনি ও মঙ্গলবার ভক্তরা দুধ ও ছাগবলি দিয়ে পূজা দেন।

ভক্তরা বলেন, এই মন্দিরের মাটির রোগ সারিয়ে তোলার ক্ষমতা আছে। তাঁরা এই মাটি প্রসাদ হিসেবেও সংগ্রহ করে নিয়ে যান। মায়ের জীবনেও অনেক ঘটনা ঘটেছে, যা থেকে প্রমাণিত হয় যে, মা সিংহবাহিনী খুব জাগ্রতা দেবী।

যাত্রাসিদ্ধিরায় মন্দির

মাতৃমন্দিরের পশ্চিম প্রান্তে মায়ের ঘাটের সামনে ঘোষবংশের কুলদেবতা যাত্রাসিদ্ধিরায় ধর্মঠাকুরের পূর্বমুখী আটচালা ছোটো মন্দির। গ্রামবাসীদের ধারণা ছিল, মন্দিরে প্রতিষ্ঠিত কচ্ছপাকৃতি শিলাটি নারায়ণের কুর্মাবতারের প্রতীক। তাই যাত্রাসিদ্ধিরায় নারায়ণের প্রতীক হিসেবেই পূজিত হন। মন্দিরটির প্রতিষ্ঠাকাল জানা যায় না। তবে আগেকার দিনে জয়রামবাটী থেকে যখন কেউ বাইরে যাত্রা করতেন, তখন তিনি এই মন্দিরে পূজা দিয়ে বেরোতেন। যাত্রায় সিদ্ধি প্রদান করেন এই দেবতা ; তাই তাঁর নাম যাত্রাসিদ্ধিরায়। মা-ও জয়রামবাটী থেকে কোথাও যাওয়ার আগে এই মন্দিরে পূজা দিয়ে বেরোতেন।

বাঁড়ুজ্জ্যেপুকুর

জয়রামবাটীর দক্ষিণপূর্বকোণে এখনকার বড়ো রাস্তার ধারে বাড়ুজ্জ্যেপুকুর বা তালপুকুর। এই পুকুরটিতে মা মাঝে মাঝে স্নান করতে আসতেন। এই পুকুরের জলেই তিনি রান্নাবান্না করতেন। মায়ের সন্তানরা যখন মায়ের সঙ্গে কিছুদিন কাটিয়ে বাড়ি ফেরার জন্য যাত্রা করতেন, মা তখন বাঁড়ুজ্জ্যেপুকুর পর্যন্ত এগিয়ে আসতেন তাঁদের বিদায় জানানোর জন্য। জানা যায়, ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ জয়রামবাটী এলে বাঁড়ুজ্জ্যেপুকুরের ধারে আপনমনে পদচারণা করতেন।

মায়ের ঘাট

 

বাল্যকালে মা একটি দিঘির পাড়ে ঘাস কাটতে যেতেন গোরুদের খাওয়ানোর জন্য। এই দিঘিটিই এখন মায়ের দিঘি নামে পরিচিত। আর এই দিঘির ঘাটটিকে বলে মায়ের ঘাট। মায়ের ঘাট আজকের জয়রামবাটীর বাসস্টপের নাম।

আমোদর নদ

আমোদর আসলে জয়রামবাটীর পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া একটি ছোটো খাল। মা এই খালটিকে বলতেন ‘আমার গঙ্গা’। আমোদরে মা স্নান করতে আসতেন। এর পাড়ে একটা শ্মশানও আছে। মায়ের ঘাট থেকে কিছুদূরে গেলে একটা আমলকি গাছ দেখা যাবে। এখানে বহু আগে একটি আমলকি গাছ ছিল। তারই স্মৃতিতে বর্তমান আমলকি গাছটি পোঁতা হয়েছে। শ্রীরামকৃষ্ণ বলতেন, ‘আমলকি গাছের তলায় বসে ধ্যান করলে, সব মনোস্কামনা পূর্ণ হয়।’ যোগিন মা, গোলাপ মা, গৌরী মা প্রমুখ ঠাকুরের সব শিষ্যা এবং স্বামী সারদানন্দ সহ একাধিক সন্ন্যাসী এখানে জপধ্যান করতে আসতেন।

কোয়ালপাড়া রামকৃষ্ণ যোগাশ্রম

 

জয়রামবাটী থেকে তিন মাইল উত্তরে কোয়ালপাড়া। মায়ের জীবনের সঙ্গে এই আশ্রমের যোগ নিবিড়। রেলপথ হওয়ার পর মা জয়রামবাটী থেকে বিষ্ণুপুর হয়ে কলকাতা আসতেন। বিষ্ণুপুরে আসার পথে কোয়ালপাড়া আশ্রমে বিশ্রাম করতেন। ১৯০৯ সাল থেকে ১৯১৯ সালের পর্যন্ত মা যতবার বিষ্ণুপুর এসেছেন, ততবারই কোয়ালপাড়ায় বিশ্রাম করেছেন। দু-বার দীর্ঘসময়ের জন্য মা এখানে বাসও করেছিলেন। কোয়ালপাড়াকে মা বলতেন, ‘আমার বৈঠকখানা।’

১৩১৬ বঙ্গাব্দে কোয়ালপাড়ার ভক্ত কেদারনাথ দত্ত (সন্ন্যাসজীবনে নাম স্বামী কেশবানন্দ) কোয়ালপাড়া রামকৃষ্ণ যোগাশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন। কোয়ালপাড়া আশ্রমটির একটি কারণে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। মা কয়েকটি স্থানে নিজের ছবি প্রতিষ্ঠা করে পূজা করেছিলেন। কোয়ালপাড়া তার মধ্যে একটি। ১৯১১ সালের নভেম্বর মাসে এখানে ঠাকুরের সঙ্গে নিজের ছবি প্রতিষ্ঠা করে মা পূজা করেন। ছবিদু-টি হাতে নিয়ে, মাথায় ঠেকিয়ে, বেদিতে রেখে, তাতে ফুল দেন মা।

জগদম্বা আশ্রম

 

কোয়ালপাড়া আশ্রমের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন মায়ের শিষ্য কেদার ; যিনি পরে পরিচিত হন স্বামী কেশবানন্দ নামে। তাঁর মা জগদম্বাও ছিলেন মায়ের ভক্ত। জগদম্বা দেবীর বাড়িটিকে বলা হয় জগদম্বা আশ্রম। এখানে মা মাঝে মাঝে রাধুকে নিয়ে থাকতে আসতেন। এটি কোয়ালপাড়া আশ্রম থেকে কিছুটা দূরে অবস্থিত।

তেলোভেলোর মাঠ

হুগলি জেলার আরামবাগ শহর ছাড়িয়ে কিছুদূরে গেলে পড়ে তেলোভেলোর মাঠ। এই মাঠেই এক সন্ধ্যায় এক ডাকাত দম্পতির সাক্ষাৎ পেয়েছিলেন মা। মাতৃসংস্পর্শে কিভাবে সেই দুর্ধর্ষ ডাকাতেরও মন গলেছিল ; সে গল্প আমরা সবাই জানি। ঠিক যে স্থানে মায়ের সঙ্গে তাঁর ডাকাতবাবার সাক্ষাৎ হয়েছিল, সেই স্থানটিতে এখন মায়ের একটি মন্দির স্থাপন করা হয়েছে। মন্দিরের পাশের ঘরটিতে ডাকাতবাবার একটি লাইফ-সাইজ মূর্তিও রয়েছে। সেটিও পূজিত হয়। মায়ের মন্দিরের কিছুদূরেই রয়েছে একটি কালীমন্দির ; ইনি ডাকাতকালী নামে পরিচিতা।

মাতৃমন্দিরের উৎসব অনুষ্ঠান

মাতৃমন্দিরের দুর্গাপ্রতিমা

  • পয়লা বৈশাখ—বাংলা বছরের প্রথম দিন মাতৃমন্দিরে বর্ষবরণ অনুষ্ঠান হয়। এদিন সকলের কল্যাণ কামনায়  পূজা ও হোম হয়ে থাকে।
  • অক্ষয় তৃতীয়া—মাতৃমন্দিরের প্রতিষ্ঠাদিবস। এদিন মন্দিরে বিশেষ পূজা, চণ্ডীপাঠ, ভোগারতি, নরনারায়ণ সেবা ও সন্ধ্যারতির পর নাটক আয়োজিত হয়।
  • ফলহারিণী কালীপূজা—বৈশাখী অমাবস্যা তিথিতে মাতৃমন্দিরে মায়ের মূর্তিতেই ফলহারিণী কালীপূজা হয়ে থাকে। পূজার দিন সকালে সিংহবাহিনী মন্দিরে ছাগবলি হয়। বলির অগ্রভাগ ঠাকুর ও সিংহবাহিনীকে নিবেদন করে বাকি অংশ কালীপূজার জন্য রান্না করা হয়।
  • জামাইষষ্ঠী—জয়রামবাটীর জামাই শ্রীরামকৃষ্ণকে এইদিন দু-তিন রকমের মাছ ও দই-মিষ্টি ভোগ দেওয়া হয়।
  • গঙ্গাপূজা—জ্যৈষ্ঠ মাসের শুক্লা দশমীতে মাতৃমন্দিরে পঞ্চোপচারে দশহরা গঙ্গাপূজা করা হয়।
  • রথযাত্রা—সুসজ্জিত রথে জগন্নাথ-বলরাম-সুভদ্রা সহ ঠাকুর ও মায়ের ছবি স্থাপন করে গ্রাম প্রদক্ষিণ করা হয়।
  • গুরুপূর্ণিমা—আষাঢ় মাসের পূর্ণিমা তিথিতে মঠে ব্যাসদেব এবং ঠাকুর ও মায়ের বিশেষ পূজা হয়।
  • জন্মাষ্টমী—সন্ধ্যারতির পর বালগোপালের বিশেষ পূজা, শ্যামনাম সংকীর্তন ও ভাগবতপাঠ হয়।
  • দুর্গাপূজা—সারা পশ্চিমবঙ্গের মতো জয়রামবাটীর সবচেয়ে বড়ো উৎসব। এই উপলক্ষ্যে মাতৃমন্দিরে মেলা বসে। দরিদ্রনারায়ণ সেবা হয়।
  • কোজাগরী লক্ষ্মীপূজা—মায়ের মূর্তিতেই ষোড়োশপচারে পূজা, ভোগ, আরতি ও হোম হয়।
  • কালীপূজা—রাত্রিকালীন ভোগের পর নাটমন্দিরে অনুষ্ঠিত হয়।
  • জগদ্ধাত্রী পূজা—মা স্বয়ং এই পূজা শুরু করে গিয়েছিলেন। তিন দিন ধরে পূজা হয়। প্রথম দিন ষোড়োশপচারে, পরের দু-দিন সাধারণভাবে পূজা হয়। দেবীর দু-পাশে জয়া-বিজয়া ও নারদও পূজিত হন। বিরাট মেলা বসে। দরিদ্রনারায়ণ সেবা হয়।
  • শ্রীশ্রীমায়ের আবির্ভাবতিথি—অগ্রহায়ণ কৃষ্ণা সপ্তমী তিথিতে মায়ের জন্মতিথি উপলক্ষ্যে মাতৃমন্দিরের গর্ভমন্দিরে বিশেষ পূজা ও হোম হয়।
  • সরস্বতী পূজা—এটিও নাটমন্দিরে হয়ে থাকে।
  • শিবরাত্রি—সন্ধ্যার পর নাটমন্দিরে মহিলারা শিবরাত্রি ব্রত পালন করেন।
  • দোলপূর্ণিমা—এই দিন নাটমন্দিরে শ্রীচৈতন্য ও রাধাকৃষ্ণের যুগলমূর্তির পূজা ও আবির প্রদান করা হয়। নামসংকীর্তনও হয়।

এছাড়া রাধাষ্টমী, বিশ্বকর্মা পূজা, জাতীয় যুব দিবস, পৌষপার্বন, ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের আবির্ভাবতিথি, রামনবমী, বুদ্ধপূর্ণিমা, বড়দিন, শঙ্করাচার্য জয়ন্তী, ও ঠাকুরের ষোলোজন ত্যাগী পার্ষদের জন্মতিথিও জয়রামবাটী মঠে মহাসমারোহে পালিত হয়।

মাতৃতীর্থ জয়রামবাটী পরিক্রমা আমরা এখানেই শেষ করি মায়ের অভয়বাণী স্মরণ করে:

দেখ, স্বপ্নে যেন দেখলুম, জয়রামবাটী, কোয়ালপাড়া ও কামারপুকুর সব এক হয়ে গেছে।… এখানে অত সব (জপধ্যান) করতে হবে না। এখানে এসে খাবে দাবে আর আনন্দ করবে। বিধিরও সাধ্য নেই আমার ছেলেদের রসাতলে ফেলে।… এখানে যারা আসবে, তাদের শেষ জন্ম।

সহায়ক গ্রন্থ-

১। বেলুড় মঠ পিলগ্রিমেজ (ইংরেজি), স্বামী আশুতোষানন্দ, শ্রীরামকৃষ্ণ মঠ, চেন্নাই।

২। শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ-সারদার কামারপুকুর-জয়রামবাটী, দুর্গাপদ চট্টোপাধ্যায়, শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ-সারদা গবেষণা কেন্দ্র, বেঙ্গাই, হুগলি।

ছবিগুলি ইন্টারনেট-সূত্রে পাওয়া ; এখানে কেবল ছবিগুলির লিঙ্ক-ই ব্যবহৃত হয়েছে এবং তা করা হয়েছে সম্পূর্ণ অবাণিজ্যিকভাবে।

 

ট্যাগ সমুহঃ ,

One response to “মাতৃতীর্থ জয়রামবাটী

  1. Mousumi Bhattacharjee

    অক্টোবর 29, 2017 at 12:41 অপরাহ্ন

    অসাধারণ লাগলো। জয় মা

     

মন্তব্য করুন

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  পরিবর্তন )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  পরিবর্তন )

Connecting to %s

 
%d bloggers like this: