৩ মে ২০১২। ভারতীয় সিনেমা পদার্পন করল শতবর্ষে। আর এই দিনই নতুন দিল্লির বিজ্ঞান ভবনে উপরাষ্ট্রপতি হামিদ আনসারি ৫৯তম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানে দেশের সর্বোচ্চ চলচ্চিত্র সম্মান দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার তুলে দিলেন বিশিষ্ট অভিনেতা ও আবৃত্তিশিল্পী সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের হাতে। সৌমিত্রবাবু অবশ্য প্রথম বাঙালি ফালকে-বিজেতা নন। তাঁর আগে এই সম্মানে ভূষিত হয়েছেন দেবিকা রানি, বি এন সরকার, পঙ্কজ কুমার মল্লিক, ধীরেন্দ্রনাথ গাঙ্গুলি, কানন দেবী, নীতিন বোস, রাইচাঁদ বড়াল, সত্যজিৎ রায়, হৃষিকেশ মুখোপাধ্যায়, মৃণাল সেন, তপন সিংহ ও মান্না দে। সেই হিসেবে সৌমিত্রবাবুই প্রথম পূর্ণ সময়ের বাঙালি পুরুষ অভিনেতা, যিনি এই সম্মানে ভূষিত হলেন। পুরস্কার গ্রহণের সময় সৌমিত্রবাবু বলেন:
এই মুহুর্তে কিছু বলার মতো মানসিক অবস্থা আমার নেই। সারা জীবন আমি সংশয়ে ছিলাম। হয়ত মনোরঞ্জনের এই ব্যবসা এ যুগের উপযোগী নয়। হয়তো আমার উচিত ছিল এ থেকে বেরিয়ে এসে মানুষের সেবা করা। কিন্তু এই পঞ্চাশ বছরে মানুষ আমাকে গ্রহণ করেছে, ভালবেসেছে। আমারও নিজেকে মনে হয়েছে তাদেরই একজন। আমার দৃষ্টিতে যা সুশিল্প, তা চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার শক্তি জোগানোর জন্য আমি তাদের ভালবাসি, সম্মান করি ও অভিবাদন জানাই।
১৯৩৫ সালের ১৯ জানুয়ারি পশ্চিমবঙ্গের নদিয়া জেলার কৃষ্ণনগরে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের জন্ম। তাঁর ছেলেবেলা কেটেছে কৃষ্ণনগর, হাওড়া ও কলকাতায়। সৌমিত্রবাবু কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্যে সাম্মানিক সহ স্নাতক ও পরে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। চলচ্চিত্র শিল্পে যোগ দেওয়ার আগে তিনি অল ইন্ডিয়া রেডিওতে কাজ করতেন।
১৯৫৯ সালে সত্যজিৎ রায়ে অপুর সংসার চলচ্চিত্রে অপুর চরিত্রে অভিনয়ের মাধ্যমে তাঁর চলচ্চিত্র জীবনের সূচনা। সত্যজিৎ রায় পরিচালিত ৩৪টি চলচ্চিত্রের মধ্যে ১৪টিতেই তিনি অভিনয় করেছিলেন। এজন্য তাঁকে বলা হয় ‘সত্যজিতের নায়ক’। আবার রবীন্দ্রনাথের কাহিনি অবলম্বনে নির্মিত অনেক কাহিনিচিত্রে সার্থক অভিনয় তাঁকে এনে দিয়েছিল ‘রবীন্দ্রনাথের নায়ক’ আখ্যা। মননশীল চলচ্চিত্রের পাশাপাশি মূলধারার চলচ্চিত্রেও তিনি ছিলেন জনপ্রিয় অভিনেতা। বাংলা গোয়েন্দা সাহিত্যের অমর সৃষ্টি ফেলুদার চরিত্রে তিনিই প্রথম রূপদান করেছিলেন।

সৌমিত্র তখন
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় অভিনীত কয়েকটি উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্র হল: দেবী (১৯৬০), ক্ষুধিত পাষাণ (১৯৬০), ঝিন্দের বন্দী (১৯৬১), অভিযান (১৯৬২), অতল জলের আহ্বান (১৯৬২), সাত পাকে বাঁধা (১৯৬৩), চারুলতা (১৯৬৪), কিনু গোয়ালার গলি (১৯৬৪), আকাশ কুসুম (১৯৬৫), মণিহার (১৯৬৬), বাঘিনী (১৯৬৮), তিন ভুবনের পারে (১৯৬৯), অরণ্যের দিনরাত্রি (১৯৭০), স্ত্রী (১৯৭২), অশনি সংকেত (১৯৭৩), বসন্ত বিলাপ (১৯৭৩), সোনার কেল্লা (১৯৭৪), জয় বাবা ফেলুনাথ (১৯৭৮), দেবদাস (১৯৭৯), গণদেবতা (১৯৭৯), কোনি (১৯৮৬), আতঙ্ক (১৯৮৬), গণশত্রু (১৯৮৯), মহাপৃথিবী (১৯৯১), হুইলচেয়ার (১৯৯৪), অসুখ (১৯৯৯), পদক্ষেপ (২০০৬), ১৫ পার্ক এভিনিউ (২০০৬), বালিগঞ্জ কোর্ট (২০০৭), অংশুমানের ছবি (২০০৯), অপরাজিতা তুমি (২০১২) ইত্যাদি। কাজ করেছেন সত্যজিৎ রায়, তপন সিংহ, তরুণ মজুমদার, মৃণাল সেন, ঋতুপর্ণ ঘোষ প্রমুখ পরিচালকের সঙ্গে।
অভিনয়ের পাশাপাশি পেশাদার নাট্যমঞ্চেও সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় এক উল্লেখযোগ্য নাম। ১৯৬৩ সালে দেবনারায়ণ গুপ্তের পরিচালনায় তাপসী নাটকে তাঁর প্রথম পেশাদার নাট্যাভিনয়। এর পর অভিনয় করেছেন নামজীবন, রাজকুমার, ফেরা, নীলকণ্ঠ, ঘটক বিদায়, দর্পনে শরৎশশী, চন্দনপুরের চোর, ন্যায়মূর্তি, অন্ধযুগ, বিদেহী, টিকটিকি, প্রাণতপস্যা, কুরবানি, আর একটা দিন, আরোহণ, আত্মকথা, হোমাপাখি, তৃতীয় অঙ্ক, অতএব ইত্যাদি নাটকে। এবছর তাঁর অভিনীত শেকসপিয়রের রাজা লিয়ার যথেষ্ট প্রশংসা কুড়িয়েছে।
১৯৭০-এর দশকে সৌমিত্রবাবু পদ্মশ্রী সম্মান প্রত্যাখ্যান করেন। তবে ২০০৪ সালে পদ্মভূষণ সম্মান গ্রহণ করেন। ২০০৮ সালে সুমন ঘোষের পদক্ষেপ ছবিতে অভিনয়ের জন্য শ্রেষ্ঠ অভিনেতা বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান। ফরাসি সরকার তাঁকে ফ্রান্সের সর্বোচ্চ কলা পুরস্কার ‘Officier des Arts et Metiers’ সম্মানে ভূষিত করেছে। লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্ট পুরস্কার দিয়েছে ইতালি সরকারও। ক্যাথেরিন বার্জে ফরাসি ভাষায় তাঁর উপর একটি তথ্যচিত্র নির্মাণ করেছেন।