RSS

প্রবাল দ্বীপ :: রবার্ট মাইকেল ব্যালেন্টাইন : অর্ণব দত্ত অনূদিত :: ৩

10 ফেব্রু.

এই উপন্যাসটির অনুবাদ-স্বত্ব অনুবাদক কর্তৃক সংরক্ষিত। অনুবাদকের অনুমতি ও নাম-উল্লেখ ছাড়া তা কোনো উপায়ে অন্যত্র প্রকাশ নিষিদ্ধ।

প্রবাল দ্বীপ : প্রশান্ত মহাসাগরের গল্প
রবার্ট মাইকেল ব্যালেন্টাইন
অনুবাদ।। অর্ণব দত্ত

তৃতীয় অধ্যায়।

প্রবাল দ্বীপ—তীরে পৌঁছোনোর পর আমাদের অনুসন্ধান ও তার ফল—আমরা সিদ্ধান্ত করলুম যে দ্বীপটি জনহীন

অজ্ঞান অবস্থা থেকে জ্ঞান ফেরার সময়টায় যে অদ্ভুত একটা রোমাঞ্চকর অনুভূতি হয়েছিল, সেটা লিখে বর্ণনা করা যাবে না। কেমন একটা স্বপ্নালু, হতচকিত চৈতন্যের ভাব; আধো-ঘুমন্ত আধো-জাগরিত অবস্থা; সেই সঙ্গে কেমন একটা উদ্বেগের ভাবও ছিল, যদিও সেটা নিতান্ত খারাপ বোধ হচ্ছিল না। আস্তে আস্তে আমার জ্ঞান ফিরে এল। পিটারকিনের গলা শুনলুম। সে শুধোচ্ছিল, এখন একটু ভাল লাগছে কিনা। আমার মনে হচ্ছিল, আমি যেন বেশি ঘুমিয়ে ফেলেছি, তাই শাস্তি দিয়ে এখুনি আমাকে তুলে দেওয়া হবে মাস্তুলের চুড়োয়। তড়াক করে উঠতে যাব, কিন্তু তার আগেই চিন্তাটা যেন মাথা থেকে দূর হয়ে গেল। মনে হল, আমি যেন অসুস্থ। সেই মুহুর্তে একটা মিষ্টি হাওয়া আমার গালে এসে ঠেকল। মনে হল যেন আমি আমার বাড়িতে। বাবার কটেজের বাগানে সুন্দর সুন্দর ফুল আর মায়ের নিজের হাতে তৈরি করা সুগন্ধী হানি-সাকল লতার মাঝে শুয়ে আছি। কিন্তু ঢেউয়ের গর্জন সেই সব সুন্দর চিন্তাগুলিকে খেদিয়ে দিল। সমুদ্রে ফিরে গেলুম। সেই ডলফিন আর উড়ুক্কু মাছ দেখা, ঝোড়ো কেপ হর্ন পেরিয়ে আসা জাহাজ। আস্তে আস্তে ঢেউয়ের গর্জন জোরালো আর স্পষ্টতর হয়ে উঠল। মনে হল, নিজের দেশ থেকে বহু বহু দূরে কোথায় আমার জাহাজ ভেঙে পড়েছে। ধীরে ধীরে চোখ খুললুম। দেখলুম আমার সঙ্গী জ্যাক-দাদা ভারি উদ্বিগ্ন হয়ে আমার মুখের দিকে চেয়ে রয়েছে।

জ্যাক-দাদা আস্তে আস্তে জিজ্ঞাসা করল, “কথা বল্‌, ভাই রালফ, এখন একটু ভালো লাগছে?”

আমি হেসে চোখে মেলে চাইলুম। বললুম, “ভালো। কেন, জ্যাক-দাদা? আমি তো ভালোই আছি।”

পিটারকিন চোখে জল নিয়ে হেসে বলল, “তাহলে ওরকম ভাবখানা করেছিলে কেন? আমরা কী ভয় পেয়ে গেছিলুম!” বেচারি ভেবেছিল, আমি বুঝি মরতে বসেছি।

তারপর আধ-বসা হয়ে উঠে বসলুম। কপালে হাত দিতেই বুঝলুম অনেকটা কেটেছে। বেশ অনেকটা রক্ত বেরিয়েছে।

জ্যাক-দাদা আমাকে শুইয়ে দিয়ে বলল, “আরে আরে, করিস্‌ কি রালফ, শুয়ে পড়্‌, সোনা, তুই এখনও পুরো সেরে উঠিসনি। নে, এই জলে গলাটা ভিজিয়ে নে। বেশ ঠান্ডা আর স্বচ্ছ জল। কাছেই একটা ঝোরা থেকে পেলুম।” আমি একটা কথা বলতে যাচ্ছিলুম। কিন্তু জ্যাক-দাদা আমাকে চুপ করিয়ে দিল। বলল, “সব বলব। কিন্তু পুরো সেরে না উঠে তুই একটা কথাও বলবি না।”

এতক্ষণে পিটারকিনের দুশ্চিন্তা দূর হল। সে উঠে গিয়ে আমার গায়ে যাতে ঠান্ডা হাওয়া না লাগে সেজন্য চারদিকে ভাঙা ডালপালার ছাউনি খাড়া করতে লাগল। যদিও তার দরকার ছিল না। আমার পাশে পাথরের চাঁইগুলোই হাওয়া আটকানোর ক্ষেত্রে যথেষ্ট ছিল। পিটারকিন বলল, “ওকে চুপ করে থাকতে দিও না, জ্যাক-দাদা। ওকে কথা বলতে দাও। ঘণ্টার পর ঘণ্টা তো মিশরের মমির মতো থম মেরে সাদা শক্ত হয়ে পড়ে ছিল। এখন ওর গলাটা শুনেও ভালো লাগছে। এরকম ছেলে দেখিনি, রাফল-দাদা। সব সময় দুষ্টুমি! আমার গলা টিপে মারতে গিয়েছিলে! তুমি সত্যিই খুব খুব দুষ্টু!”

পিটারকিন বকর-বকর করতে লাগল। আমিও একটু চাঙ্গা বোধ করলুম। আস্তে আস্তে আমার অবস্থাটা বুঝতে পারলুম। “আমি তোর গলা টিপে মারতে গিয়েছিলাম মানে?” আমি পিটারকিনকে জিজ্ঞাসা করলাম।

“মানে? ইংরিজি বোঝো না? নাকি ফরাসি করে বললে ভালো বুঝবে? মনে নেই—”

তাকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে বললুম, “না, আমার কিচ্ছু মনে নেই। সেই যে আমরা জলে পড়ে গেলুম, তারপর আর কিছুই মনে নেই।”

জ্যাক-দাদা ভারি উদ্বিগ্ন হয়ে আমার মুখের দিকে চেয়ে রয়েছে।

জ্যাক-দাদা বললে, “পিটারকিন, তুই থামবি! আজেবাজে বকে তুই রালফকে উত্তেজিত করে তুলছিস্‌। আমি সব বলছি। তোর মনে আছে, জাহাজডুবির পর আমরা তিন জন জাহাজের আগাটা ধরে সমুদ্রে ভাসছিলাম। এমন সময় আমি দেখলাম, একটা দাঁড় এসে তোর মাথায় আঘাত করল। তোর ভুরুর কাছটা কেটে গেল। তোর তখন ঠিক হুঁশ ছিল না। তাই বোধহয় পিটারকিনের গলাটা জাপটে ধরে ছিলি, যদিও কি করছিলি সে সম্পর্কে তোর ঠিক ধারণা ছিল না। এই অবস্থাতে তুই প্রাণ বাঁচানোর জন্য একটা টেলিস্কোপ ধরলি আর সেটা পুরে দিলি পিটারকিনের মুখে—”

পিটারকিন মাঝপথে বাধা দিয়ে বলল, “আমার মুখে পুরে দিল মানে! বলো, আমার গলার মধ্যে ঠেসে দিল। এখনও আমার গলার ভিতরে একটা স্পষ্ট পিতলের চাকতির দাগ রয়ে গেছে!”

জ্যাক-দাদা বলল, “আচ্ছা আচ্ছা, তা-ই। তারপর রালফ, তুই তো ওকে ধরে রইলি। আমার ভয় হল ওর দমটা না বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু দেখলাম ও দাঁড়টা খুব ভালোভাবে ধরে আছে। তাই আমি একটু কসরত করে তোদের তীরের দিকে ঠেলতে ঠেলতে নিয়ে এলুম। কপাল ভাল যে, বিশেষ ঝক্কি ছাড়াই আমরা পৌঁছে গেলুম। প্রবালপ্রাচীরের ভিতরের জল আসলে খুব শান্ত ছিল।”

আমি উদ্বেগভরে জিজ্ঞাসা করলাম, “কিন্তু ক্যাপ্টেন আর মাল্লাদের কী হল?”

জ্যাক-দাদা মাথা নাড়ল।

“তবে কি ওরা হারিয়ে গেছে?”

“না, আশা করি ওরা হারায়নি। তবে আমার মনে হয় না ওদের বাঁচার আশা আছে। আমরা এই যে দ্বীপটায় এসে পড়েছি, এরই লেজের কাছটায় ধাক্কা খেয়েছে জাহাজটা। সমুদ্রে নৌকা নামানো হয়েছিল। সেটা না উল্টোলেও তাতে অনেকটা জল ঢুকে গিয়েছিল। সবাই ওটাতেই উঠেছিল। কিন্তু ওরা দাঁড় ফেলবার আগেই ঝোড়ো হাওয়া তাদের দ্বীপ থেকে উল্টোদিকে নিয়ে চলে গেল। আমি তীরে নামার পর ওদের এদিকে আসার চেষ্টা করতে দেখেছিলুম, কিন্তু আটটা দাঁড়ের মধ্যে তখন মাত্র এক জোড়াই টিকে ছিল। আর সেটাও যথেষ্ট ছিল না। হাওয়া তাদের তীর থেকে দূরে নিয়ে চলল। তারপর ওরা পালের মতো একটা কিছু টাঙাবার চেষ্টা করল। মনে হল জিনিসটা কম্বল। তবে নৌকাটার পক্ষে ওটা খুব ছোটো। আধ ঘণ্টা পরে তারা দৃষ্টির আড়ালে চলে গেল।”

আমার খুব দুঃখ হল শুনে। নিচু গলায় বলে উঠলাম, “আহা বেচারারা!”

জ্যাক-দাদা একটু খুশি গলায় বলল, “কিন্তু ওদের কথা যত ভাবছি, ততই আশা দেখতে পাচ্ছি। দ্যাখ্‌ রালফ, আমি দক্ষিণ সমুদ্র দ্বীপপুঞ্জ সম্পর্কে অনেক পড়াশোনা করেছি। আমি জানি, এখানে সমুদ্রের বুকে হাজার হাজার দ্বীপ ছড়িয়ে আছে। আমার মনে হয়, ওরাও এইরকমই কোনো দ্বীপে গিয়ে পড়েছে।”

পিটারকিন আগ্রহভরে বলে উঠল, “আমি নিশ্চিত তা-ই হয়েছে। কিন্তু জ্যাক-দাদা, ভাঙা জাহাজটার কি হল? আমি যখন রালফ-দাদার দেখভাল করছিলুম, তখন দেখলুম তুমি পাথর বেয়ে উঠছ। কি দেখলে? জাহাজটা কি ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে?”

জ্যাক-দাদা উত্তর দিলে, “না, ভেঙে টুকরো টুকরো হয়নি বটে, তবে ডুবে গেছে। বললাম না, জাহাজটা এই দ্বীপের লেজের দিকটায় ধাক্কা খেয়েছিল। তাতে ওটা ফুটো হয়ে গিয়েছিল। তারপর ঢেউ এসে ওটাকে বাতাসের দিকে খানিকটা নিয়ে গেল। নৌকার বেচারিরা জাহাজটায় ফেরার খুব চেষ্টা করছিল। কিন্তু ওরা জাহাজে পৌঁছানোর আগেই জাহাজটা ডুবে গেল। জাহাজটা পুরোপুরি ডুবে যাওয়ার পরই দেখতে পেলুম ওরা দ্বীপে পৌঁছানোর চেষ্টা করছে।”

জ্যাক-দাদার কথা শেষ হলে পরে অনেকক্ষণ কেউ কোনো কথা বলল না। আমার মনে কোনো সন্দেহ ছিল না যে, প্রত্যেকের মনের মধ্যে তখন অত্যাশ্চর্য এক ভাবনা পাক খাচ্ছে। আমার নিজের চিন্তাগুলি যে খুব যথার্থ ছিল তা বলতে পারি না। আমি জানতুম যে, আমরা এখন একটা দ্বীপে। জ্যাক-দাদা তাই বলেছিল। সেই দ্বীপে জনমানব আছে কিনা জানতুম না। থাকলে ভয়ের ব্যাপার ছিল। দক্ষিণ সমুদ্র দ্বীপপুঞ্জের লোকেদের কথা যা শুনেছি, তাতে তারা আমাদের জ্যান্ত রোস্ট করে খেলেও আশ্চর্য হওয়ার কিছু থাকবে না। আবার দ্বীপটা জনমানবহীন হলেও আমাদের কপালে অনাহারে মৃত্যু লেখা আছে। আমি ভাবলুম, “আহা, জাহাজটা যদি শুধু পাথরে ধাক্কাই খেত, তাহলে আমাদের কিছু সুবিধে হত, অন্তত জাহাজ থেকে কিছু রসদ জোগাড় করে আনতে পারতুম। একটা মাথা গোঁজার ছাউনি তৈরির যন্ত্রপাতিটাতি, কিন্তু কী আর করা যাবে—হায়! হায়! আমরা হারিয়েই গেছি!” চরম হতাশার মধ্যে শেষ কথাটুকু জোরেই উচ্চারণ করে ফেললুম।

জ্যাক-দাদার মুখে একটা আন্তরিক হাসি দেখলাম। সে উচ্ছ্বসিত হয়ে বলল, “হারিয়ে গেছি! রালফ? না, বল্, বেঁচে গেছি। তুই ভুল পথে চিন্তা করছিস্, তাই ভুল সিদ্ধান্ত নিচ্ছিস্।”

পিটারকিন বলল, “আমি কি সিদ্ধান্ত করেছি, শুনবে? আমি ঠিক করে ফেলেছি যে এটাই আমাদের রাজধানী,—প্রথম শ্রেণির,— এর চেয়ে ভালো আর কিছুই হয় না। তিন জন প্রাণোচ্ছ্বল তরুণের আর কী চাই! এই দ্বীপটা পুরো আমাদের। আমরা রাজার নামে এই দ্বীপটার দখল নেবো। আমরা গিয়ে এর কালো অধিবাসীদের সেবা নেবো। স্বাভাবিকভাবেই আমরাই সব গুরু বিষয়গুলো দেখাশোনা করব। যেমন সাদা মানুষেরা বর্বরের দেশে গিয়ে করে থাকে। জ্যাক-দাদা, তুমি হলে রাজা। রালফ-দাদা প্রধানমন্ত্রী হবে। আর আমি হব—”

জ্যাক-দাদা মাঝপথে বলে দিল, “রাজসভার ভাঁড়!”

পিটারকিন বললে, “না, আমার কোনো উপাধি থাকবে না। আমি শুধু সরকারের কোনো গুরুত্বপূর্ণ পদ নেবো। আসলে কি জানো তো, জ্যাক-দাদা। আমার কোনো কাজ না করেই প্রচুর মাইনে নিতে খুব ভাল লাগে।”

“কিন্তু এখানে কোনো মানুষ না থাকলে কী করবি?”

“তাহলে একটা সুন্দর বাড়ি বানাবো। তার চারপাশে একটা সুন্দর বাগান করব। সেখানে সুন্দর সুন্দর সব বিষুবীয় ফুল ফুটবে। আমরা জমি চাষ করব, বীজ পুঁতবো, ফসল ফলাবো, খাবো, ঘুমাবো আর সুখে থাকব।”

পিটারকিন সব-কিছু নিয়ে রসিকতা শুরু করলে, জ্যাক-দাদা গম্ভীর হয়ে বলল, “হাসির কথা নয়! আমাদের অবস্থা সুবিধের নয়! এখানে মানুষ না থাকলে, আমাদের বুনো জন্তুদের মতো বাস করতে হবে! কারণ, আমাদের কাছে একটা ছুরি পর্যন্ত নেই!”

পিটারকিন বলল, “হ্যাঁ, তা আছে।” এই বলে সে তার পকেট হাতড়ে একটা ছোটো পকেটছুরি বের করল। তার একখানা ব্লেড, সেটাও আবার ভাঙা।

জ্যাক-দাদা উঠে বসে বলল, “নেই মামার চেয়ে কানা মামা ভাল। আমরা কথা বলে সময় নষ্ট করছি। বরং কিছু কাজ করা দরকার। মনে হচ্ছে, তুই এখন হাঁটতে পারবি, রালফ। আমাদের পকেটে যা যা আছে তা বের করে ফেলি। তারপর ওই পাহাড়ের মাথায় উঠে দেখা যাবে আমরা কিরকম দ্বীপে এসে পড়েছি। কারণ, ভালো হোক বা মন্দ, এখন কিছুদিন এখানেই থাকতে হবে বলে মনে হচ্ছে।”

 

মন্তব্য করুন

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  পরিবর্তন )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  পরিবর্তন )

Connecting to %s

 
%d bloggers like this: