এই উপন্যাসটির অনুবাদ-স্বত্ব অনুবাদক কর্তৃক সংরক্ষিত। অনুবাদকের অনুমতি ও নাম-উল্লেখ ছাড়া তা কোনো উপায়ে অন্যত্র প্রকাশ নিষিদ্ধ।
প্রবাল দ্বীপ : প্রশান্ত মহাসাগরের গল্প
রবার্ট মাইকেল ব্যালেন্টাইন
অনুবাদ।। অর্ণব দত্ত
দ্বিতীয় অধ্যায়।
যাত্রারম্ভ—সমুদ্র—আমার সঙ্গীরা—সমুদ্রে দেখা কয়েকটি আশ্চর্য দৃশ্যের বর্ণনা—ভয়াল ঝড় ও ভয়ংকর জাহাজডুবি
এক সুন্দর রৌদ্রজ্জ্বল উষ্ণ দিনে আমাদের জাহাজ মৃদুমন্দ বাতাসে পাল তুলে দক্ষিণ সমুদ্রের পথে পাড়ি জমাল। নোঙর তুলতে তুলতে মাল্লার দল মহানন্দে একসঙ্গে গান জুড়ে দিল। সে গান শুনে আমার যে কি ভাল লাগল। ক্যাপ্টেন চিৎকার করলেন। লোকেরা তাঁর হুকুম তামিল করতে ছুটল। বিশাল জাহাজটা বাতাসে ভর করে ভেসে চলতে লাগল। দেখতে দেখতে তটরেখাটা আমার দৃষ্টিপথ থেকে মুছে গেল। সেদিকে তাকিয়ে পুরো ব্যাপারটাকে একটা সুন্দর স্বপ্ন মনে হতে লাগল।
ডেকের উপর নোঙর তুলে শক্ত করে দড়ি দিয়ে সেটা বেঁধে ফেলা হল। আমার অল্পদিনের নাবিক-জীবনে যে কটা জিনিস দেখেছিলাম, তার মধ্যে এই ঘটনাটাই আমার প্রথম আলাদা রকমের কিছু মনে হল। যেন আমরা চিরকালের মতো মাটির পৃথিবী বিদায় নিলাম। যেন ওই নোঙরগুলোর আর কোনো প্রয়োজনই রইল না।
নোঙরগুলোকে সব গুছিয়ে রেখে সেগুলোর গায়ে হাত বুলোতে বুলোতে এক চওড়া কাঁধওয়ালা মাল্লা বলল, “নাও সোনামনি, এই বেলা ঘুমিয়ে পড়ো। এখন বেশ কিছুদিন আর তোমাকে কাদা ঘাঁটতে হবে না!”
ঠিক তা-ই হয়েছিল। নোঙরটাকে তারপর বেশ কিছুদিন “কাদা ঘাঁটতে” হয়নি। শেষে যখন ঘাঁটল, একেবারে শেষবারের মতো ঘাঁটল।
জাহাজে অনেকগুলি ছেলে ছিল। তার মধ্যে দুটিকে আমার বিশেষ ভাল লাগত। তাদের একজন জ্যাক মার্টিন। লম্বা-চওড়া চেহারা, চওড়া কাঁধ, সুদর্শন ও সুরসিক। বয়স আঠারো। মুখে একটা দৃঢ়তার ভাব। ছেলেটি সুশিক্ষিত, বুদ্ধিমান ও সহৃদয়। কাজের সময় সিংহের মতো তেজ, কিন্তু অন্য সময় ভারি চুপচাপ। জ্যাককে সবাই ভালবাসত। তবে তার প্রতি আমার একটু বিশেষ টান ছিল। আমার অপর সঙ্গীটির নাম ছিল পিটারকিন গে। ছোটোখাটো চেহারা, চটপটে, আমুদে আর ভারি দুষ্টু। বয়স প্রায় চোদ্দো। পিটারকিন দুষ্টুমি করত বটে, কিন্তু কারো ক্ষতি করত না। তাইতো সে অত ভালোবাসা পেত।
যেদিন প্রথম জাহাজে এলুম, সেদিন আমার কাঁধে চাপড় মেরে জ্যাক মার্টিন বলেছিল, “এই যে খোকা! নিচে আয়, তোকে তোর বার্থটা দেখিয়ে দিই। তুই আর আমি হলুম মেসমেট। তোর চেহারাটা আমার বেশ লেগেছে। আমার মনে হয় তুই আর আমি খুব ভালো বন্ধু হব।”
জ্যাক ঠিকই বলেছিল। সে, আমি আর পিটারকিন পরে এত ভালো বন্ধু হয়েছিলাম যে, ঝোড়ো সমুদ্রের ঢেউ আমাদের তিনজনকে একসঙ্গে ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছিল।
আমাদের সমুদ্রযাত্রার প্রথম অংশ সম্পর্কে অল্প দু-চার কথা বলব। মোটামুটি ভাল ও খারাপ দুই রকম আবহাওয়ার মধ্যে দিয়েই আমাদের জাহাজ ভেসে চলল। সমুদ্রে অনেক অদ্ভুত মাছের খেলা দেখলুম। একদিন উড়ুক্কু মাছের একটা ঝাঁককে জল থেকে লাফিয়ে উঠে বাতাসে খানিকটা উড়ে যেতে দেখলুম। ভারি মজা লাগল। দেখলাম, ডলফিনের দল তাদের খাবার আশায় তাড়া করেছে। ভয় পেয়ে একটা উড়ুক্কু মাছে উড়ে এসে পড়ল জাহাজের ডেকে। পড়েই ছটফট করতে লাগল। তাদের পাখনাগুলো যতখানি লম্বা ততখানি চওড়া নয়। তাই একবারে বেশি দূর উড়ে যেতে পারে না। পাখির মতো আকাশে লাফ মেরে আকাশে উড়তেও পারে না। শুধু সমুদ্রের জলের সমান্তরালে লাফিয়ে চলে। জাহাজে উড়ে এসে পড়া মাছটাকে আমি আর জ্যাক মিলে খেলুম। বেশ খেতে ছিল।
আমেরিকার দক্ষিণতম স্থান কেপ হর্নে পৌঁছুলাম। সেখানে খুব ঠান্ডা। তার উপর ঝোড়ো হাওয়া বইছিল। মাল্লারা সেখানকার ভয়ংকর প্রবল বাতাস আর সেই ভয়াল অন্তরীপের অন্যান্য বিপদের গল্প বলতে লাগল।
একজন বলল, “আমি যত অন্তরীপ পেরিয়েছি, তার মধ্যে কেপ হর্নই সবচে’ ভয়াল। আমাকে দু-দুবার এই জায়গা পেরোতে হয়েছিল। দু-বারই মনে হচ্ছিল, এই বুঝি হাওয়া জাহাজখানাকে উড়িয়ে নিয়ে গেল!”
অপর জন বলল, “আমি একবারই গেছিলুম। সেসময় জাহাজের পালটাল সব ছিঁড়ে একসা কাণ্ড। দড়িফড়িগুলো তো সব জমে গেল। কোনো কাজে লাগল না। সেবার ডুবতে ডুবতে স্রেফ কপাল জোরে বেঁচে ফিরেছি।”
তৃতীয় জন বললে, “আমি পাঁচ-পাঁচবার গেছি। যতবারই গেছি আগের বারে চেয়েও মারাত্মক হাওয়া পেয়েছি। উফ্ কী হাওয়া রে বাপ্!”
পিটারকিন ভেংচি কেটে বলল, “আমি সেখানে শূন্যবার গেছিলুম। আর গিয়েই উলটে পড়েছিলুম!”
আমরা অবশ্য অন্তরীপ পেরোনোর সময় কোনোরকম খারাপ আবহাওয়ার সম্মুখীন হলাম না। তারপর বেশ কয়েক সপ্তাহ বাদে প্রশান্ত মহাসাগরে পৌঁছে উষ্ণ বিষুবীয় বাতাসের স্পর্শ পেলুম। আমাদের জাহাজ চলল এগিয়ে। কখনও দুরন্ত হাওয়ায় তরতরিয়ে ছুটল। অন্য সময় শান্ত স্রোতে ভাসতে ভাসতে চলল। সমুদ্রের মাছ ধরতুম। মাল্লারা অবশ্যি সমুদ্রের জীবজন্তু নিয়ে বেশি মাথা ঘামাত না। আমার কিন্তু ওগুলোকে বেশ লাগত।
শেষকালে এসে পড়লুম প্রশান্ত মহাসাগরের প্রবাল দ্বীপপুঞ্জে। সেই বিস্ময় কোনোদিন ভুলব না। একটা দ্বীপ পেরিয়ে যাওয়ার সময় অবাক হয়ে চেয়ে দেখলুম ধবধবে সাদা উজ্জ্বল সৈকত আর সবুজ সবুজ তাল গাছ। সূর্যের আলোয় কি সুন্দর লাগছিল সেই দৃশ্য। আমাদের তিন জনেরই ভারি ইচ্ছে ছিল সেখানে একবার নামার। ভেবেছিলুম ওখানে যেতে পারলেই আনন্দের সিংহদ্বার খুলে যাবে! তবে আমাদের ইচ্ছে যে এত তাড়াতাড়ি পূর্ণ হবে, সেটাই ভাবতে পারিনি।
বিষুবীয় অঞ্চলে পৌঁছানোর পরই একদিন রাতে ঝড় আছড়ে পড়ল আমাদের জাহাজটার উপর। ঝোড়ো হাওয়ার প্রথম ধাক্কাতেই আমাদের দুটো মাস্তুল উড়ে গেল। রইল শুধু সামনেরটা। তবে সেটা যথেষ্ট ছিল না, আমরা সেখানে পাল খাটানোর সাহস পেলুম না। পাঁচ দিন ধরে চলল সেই ভয়ংকর ঝড়। একটা ছোটো নৌকা ছাড়া ডেক থেকে আর সব কিছু উড়ে গেল। স্টিয়ারসম্যান হুইলটাকে আঁকড়ে ধরে ছিল। নইলে সে-ও উড়ে যেত আর আমরাও ভেসে যেতুম। ক্যাপ্টেন বললেন, উত্তাল স্রোতে দুলতে দুলতে আমরা যে কোথায় এসে পড়েছি, তা তিনি হদিস করতে পারছেন না। প্রশান্ত মহাসাগরে বিপজ্জনক সব প্রবাল প্রাচীর রয়েছে। ভয় হল সেই প্রাচীরের জায়গাতেই বোধহয় এসে পড়েছি। ষষ্ঠ দিন ঝোড়ো সকালের আলো ফুটলে দূরে একটা জমি চোখে পড়ল। প্রবাল প্রাচীর ঘেরা একটা দ্বীপ। তার গায়ে আছড়ে পড়ছে ক্রুদ্ধ ঢেউ। প্রাচীরের ভিতরের জল অবশ্য শান্ত। একটা ছোট্ট সরু খাঁড়ি পথের মাধ্যমেই সেই শান্ত জলে যাওয়া চলে। আমরা সেই খাঁড়ির দিকেই এগুতে গেলুম, কিন্তু মাঝপথে প্রচণ্ড একটা ঢেউ আমাদের জাহাজের উপর আছড়ে পড়ে হালটাকে একেবারে ভেঙে টুকরো টুকরো করে দিয়ে আমাদের হাওয়া আর স্রোতের দয়ায় ভাসিয়ে দিয়ে চলে গেল।
ক্যাপ্টেন সবাইকে বললেন, “ছেলেরা, তৈরি হও! নৌকা নামাও, আমরা আধ ঘণ্টার মধ্যে ওই পাথরে গিয়ে উঠব।”
লোকেরা চুপচাপ হুকুম তামিল করল। তারাও জানত, ছোটো নৌকায় চড়ে এই উত্তাল সমুদ্রে চলা যায় না।
কোয়ার্টার-ডেকে দাঁড়িয়ে গম্ভীর গলায় জ্যাক মার্টিন আমাকে আর পিটারকিনকে বলল, “ছেলেরা আয়! আয় আয়! আমরা তিন জন একসঙ্গে থাকব। দ্যাখ, ওইটুকু নৌকায় চড়ে অতগুলো লোক তীরে পৌঁছুতে পারবে না। নির্ঘাৎ উল্টোবে। আমার মনে হয় বড়ো দাঁড়টা ধরে থাকাই থাকাই ভালো। আমি টেলিস্কোপ দিয়ে দেখেছি, জাহাজটা ওই প্রবাল প্রাচীরে গিয়ে ধাক্কা খাবে। তারপরই ঢেউ ভেঙে পড়ছে শান্ত জলে। যদি দাঁড়টা ধরে থাকতে পারি, তাহলে আমরা হয়ত তীরে গিয়ে উঠব। কি বলিস্ তোরা? আসবি?”
জ্যাক সবসময়েই আমাদের অনুপ্রেরণা জোগাত। তার কথায় আমরা খুশি হয়ে উঠলুম। যদিও তার গলায় বিষন্নতার আভাস পেয়ে আমার ভারি দুঃখ হল। তবে তার একটা ছোট্ট আশা ছিল। তাছাড়া প্রাচীরের গায়ে ক্রুদ্ধ ঢেউয়ের ধাক্কা দেখে আমারও মনে হয়েছিল, মরতে আর বেশি দেরি নেই। আমার মনটে চুপসে গেল। কিন্তু সেই সময়ই মায়ের কথা মনে পড়ল। বিদায় জানানোর সময় মা বলেছিল, “রালফ, সোনা আমার, বিপদের সময় সময় তোমার প্রভু ও ত্রাণকর্তা যিশু খ্রিস্টকে স্মরণ করবে। একমাত্র তাঁর সাহায্যে ও ইচ্ছাতেই তোমার শরীর ও আত্মা রক্ষা পেতে পারে।” সেই কথা মনে পড়তে মনে একটু সাহস জাগল।
জাহাজটা পাথরের খুব কাছে এসে পড়েছিল। লোকেরা নৌকায় চড়তে তৈরি হল। ক্যাপ্টেন তাদের হুকুম দিচ্ছিলেন। এমন সময় একটা রাক্ষুসে ঢেউ ছুটে এল। আমরা তিন জনায় জাহাজের আগার দিকে ছুটলাম বড়ো দাঁড়টাকে ধরার জন্য। সেখানে পৌঁছতে না পৌঁছতেই ঢেউটা আছড়ে পড়ল ডেকে। সঙ্গে সঙ্গে সামনের মাস্তুলটা ভেঙে পড়ল ডেকের উপর। জাহাজটা কাত হয়ে নৌকা আর লোকজন নিয়ে উলটে গেল। আমাদের দাঁড়টাও উল্টোতে যাচ্ছিল। জ্যাক একটা কুড়ুল নিয়ে সেটাকে কাটতে গেল। কিন্তু পারল না। সেটা দাঁড়ে গেঁথে গেল। অবশ্য আর একটা ঢেউ দিতেই দাঁড়টা ভেঙে বেরিয়ে গেল। আমরা সেটা আঁকড়ে ধরলুম। তারপরই উত্তাল সমুদ্রে ভাসতে ভাসতে চললুম। শেষ দৃশ্য যেটা দেখলুম মনে আছে, জাহাজটা লোকজন সমেত ফেনিল সমুদ্রের জলে ওলটপালট খেতে লাগল। তারপরই অজ্ঞান হয়ে গেলুম।
জ্ঞান ফিরতে দেখি, আমি নরম ঘাসের উপর শুয়ে আছি। মাথার উপর পাথরের ছায়া। আমার কপাল ফেটে রক্ত পড়ছিল। তাই পিটারকিন আমার পাশে হাঁটু গেড়ে বসে আস্তে আস্তে আমার রগটা জল দিয়ে ধুয়ে ধুয়ে রক্ত বন্ধ করার চেষ্টা করছে।