এই উপন্যাসটির অনুবাদ-স্বত্ব অনুবাদক কর্তৃক সংরক্ষিত। অনুবাদকের অনুমতি ও নাম-উল্লেখ ছাড়া তা কোনো উপায়ে অন্যত্র প্রকাশ নিষিদ্ধ।
প্রবাল দ্বীপ : প্রশান্ত মহাসাগরের গল্প
রবার্ট মাইকেল ব্যালেন্টাইন
অনুবাদ।। অর্ণব দত্ত
প্রথম অধ্যায়।
সূত্রপাত–আমার প্রথম জীবন ও চরিত্র–আমার অ্যাডভেঞ্চার-পিপাসা ও বিদেশভ্রমণের ইচ্ছা
ঘুরে বেড়ানোর নেশা আমার চিরকালের। ঘুরে বেড়ানোতেই আমার মনের আনন্দ। ঘুরে বেড়িয়েই আমার বেঁচে থাকা। ছেলেবেলায়, কৈশোরে, এমনকি পরিণত বয়সেও আমি ছিলুম ভবঘুরে। শুধু আমার স্বদেশের বনে পাহাড়চূড়ায় আর পাহাড়ি উপত্যকার পথেই ঘুরে বেড়াতুম না, বরং পরম আগ্রহে চষে বেড়াতুম বিপুলা এ পৃথিবীর নানা প্রান্তর।
বিরাট আটলান্টিক মহাসাগরের ফেনিল বুকে জন্ম আমার। সেদিন রাতে ঝড়ে উত্তাল হয়ে উঠেছিল কালো রাত্রি। আমার বাবা ছিলেন ক্যাপ্টেন। ঠাকুরদা ছিলেন ক্যাপ্টেন। ঠাকুরদার বাবাও ছিলেন নাবিক। তাঁর বাবা কি ছিলেন ঠিক জানি না। তবে মা বলতেন, তিনি ছিলেন মিডশিপম্যান (প্রশিক্ষণরত তরুণ নৌ-অফিসারদের সাময়িক পদ)। তাঁর দাদামশাই আবার রয়্যাল নেভির অ্যাডমিরাল ছিলেন। এইভাবে যতদূর জানতে পারি, সমুদ্দুরের সঙ্গে আমার প্রায় সব পূর্বপুরুষেরই ছিল খুব ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। আমার পিতৃকুল-মাতৃকুল দুয়ের সম্পর্কেই এই কথা খাটে। বাবা দীর্ঘ সমুদ্রযাত্রায় বের হলে, মা-ও বাবার সঙ্গে যেতেন। তাই জীবনের বেশিরভাগ সময়টা তাঁর জলেই কেটেছিল।
তাই মনে হয়, আমার এই ভবঘুরে স্বভাবটা উত্তরাধিকার সূত্রেই পেয়েছিলুম। আমার জন্মের কিছুকাল পরেই আমার বৃদ্ধ বাবা নাবিক জীবন থেকে অবসর নিয়ে ইংল্যান্ডের পশ্চিম উপকূলে একটা জেলে-গ্রামে ছোটো কটেজ কিনলেন। যে সমুদ্র জীবনভর ছিল তাঁর ঘরবাড়ি, সেই সমুদ্রের উপকূলে জীবনসন্ধ্যাটি কাটানোর জন্য থিতু হলেন। আর তার অল্প কিছুদিন পরেই আমার ভিতরের ভবঘুরে স্বভাবটা জেগে উঠল। আমার শিশু পা-দুটির শক্তিসঞ্চয়ে কিছুদিন সময় লাগল। কিছুকাল হামাগুড়ি দিয়ে যখন বিতৃষ্ণা জন্মাল, তখন অনেক চেষ্টা করলুম উঠে দাঁড়িয়ে মানুষের মতো হাঁটতে। কিন্তু হাঁটতে পারতুম না। পড়ে যেতুম। একদিন মায়ের অনুপস্থিতির সুযোগে আরেকবার চেষ্টা করলুম। সেদিন দরজা অবধি যেতে পেরেছিলুম। তারপরই কটেজের বাইরে জলকাদার গর্তে উলটে পড়লুম। কিন্তু সেদিন কী আনন্দ! আমার বেশ মনে আছে, একদল হাঁসের প্যাঁকপ্যাঁকানির মাঝে আমাকে কাদাজলে হাত-পা ছুঁড়তে দেখে মা কী ভয়টাই না পেয়েছিল! সঙ্গে সঙ্গে পরম যত্নে আমাকে তুলে নিয়ে গিয়ে আমার নোংরা কাপড় ছাড়িয়ে দিয়ে আমার কাদামাখা ছোট্ট শরীরটা ভালো করে ধুইয়ে দিয়েছিলেন। তারপর থেকে আমার ঘুরে-বেড়ানোটা একটু বেড়েই গেল। যত বয়স বাড়ল, গন্তব্যের দূরত্বও বাড়তে লাগল। শেষে কাছেদূরে সব জায়গাতেই যেতে লাগলাম। সে সমুদ্রের ধারেই হোক, বা আমাদের বাসার চারদিকের বনেই হোক। শেষকালে বাবা আমাকে উপকূলের পণ্যবাহী একটা নৌকায় শিক্ষানবিশের কাজে লাগিয়ে দিলেন, তবে শান্তি পেলুম।
কয়েকবছর আনন্দের সঙ্গে বন্দরের জাহাজগুলোতে চড়ে ঘুরে বেড়ালুম আমার স্বদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের সমুদ্রে। আমার খ্রিস্টান নামটি ছিল রালফ। আমার বন্ধুরা আমার ঘুরে বেড়ানোর তীব্র আকাঙ্ক্ষা দেখে তার সঙ্গে জুড়ে দিয়েছিল ‘রোভার’ বা ভবঘুরে কথাটা। রোভার আমার আসল নাম নয়। কিন্তু এমন যথার্থ নাম আমি আর পাইনি। তাই পাঠকের কাছে রালফ রোভার বা ভবঘুরে রালফ নামে নিজের পরিচয় না দেওয়ার কোনো কারণই দেখি না আমি। আমার জাহাজি বন্ধুরা ছিল দয়ালু সহৃদয় লোক। আমার সঙ্গে তাদের সম্পর্কও ছিল খুব ভালো। আমাকে নিয়ে তারা প্রায়ই ঠাট্টা-তামাশা করত, তবে সেটা আমাকে আঘাত দেওয়ার জন্য নয় অবশ্য। আমি একবার আড়ি পেতে তাদের বলতে শুনেছিলুম যে, রালফ রোভার একটি ‘আশ্চর্য সেকেলে মানসিকতার ছোকরা।’ অস্বীকার করব না, এই কথাটা শুনে আমিই খুব অবাক হয়েছিলুম। অনেকক্ষণ ভেবেছিলুম কথাটা নিয়ে। আমার মধ্যে সেকেলে মানসিকতাটার আছেটা কী! একথা সত্যি যে আমি খুব চুপচাপ থাকতুম, কথা বলার না থাকলে কথা বলতুম না। তার উপর আমার বন্ধুদের রসিকতার মানে বুঝতে পারতুম না, এমনকি তারা বুঝিয়ে দিলেও বুঝতুম না। এহেন নির্বুদ্ধিতার জন্য খুব দুঃখ হত। ব্যাপারটা যাতে প্রকাশ না হয়ে পড়ে, তাই হাসার চেষ্টা করতুম বটে, কিন্তু লক্ষ্য করতুম আমার হাসিটা ঠিক তাদের হাসির মতো বুদ্ধিদীপ্ত হচ্ছে না। কোনটা কেন হয়, তা জানার আগ্রহ আমার মধ্যে প্রবল ছিল। মনে মনে সেসব কথা ভাবতে ভাবতে হারিয়ে যেতুম। কিন্তু এসবের মধ্যেই এমন কিছু অস্বাভাবিকতা আমার চোখে পড়ত না, যাতে করে আমার বন্ধুদের আমাকে ‘সেকেলে মানসিকতার ছোকরা’ বলার কোনো কারণ লুকিয়ে থাকতে পারে।
উপকূলীয় বাণিজ্যের কাজে যুক্ত থাকার সময় আমার সঙ্গে এমন সব নাবিকের আলাপ হয়েছিল, যাঁরা পৃথিবীর প্রায় সব গোলার্ধেই ঘুরেছিলেন। বিদেশের মাটিতে তাঁদের আশ্চর্য অ্যাডভেঞ্চারের গল্প শুনে আমার মনও যে উতলা হত, সেকথা অস্বীকার করব না — কত ভয়ংকর ঝড়ের কবল থেকে বেঁচে ফিরে, কত বিপদকে তুচ্ছ করে, জলে স্থলে কত রকম আশ্চর্য জীবের সম্মুখীন হয়ে, কত কৌতুহলকর দেশ আর অদ্ভুত মানুষের সংস্পর্শে এসেছিলেন তাঁরা। সেই সব গল্প তাঁদের কাছে শুনতুম। তবে সবচেয়ে ভাল লাগত দক্ষিণ সমুদ্রের (বিষুবরেখার দক্ষিণের সমুদ্রভাগ, বিশেষত দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগর) প্রবাল দ্বীপের গল্প শুনতে। তাঁদের কাছেই শুনেছিলাম, ছোটো ছোটো প্রবাল কীট কিভাবে হাজার হাজার সুন্দর উর্বর দ্বীপ গড়ে তুলেছে সেই অঞ্চলে। সেখানে সারা বছরই গ্রীষ্মকাল। সারাবছরই সেখানকার গাছে মিষ্টি মিষ্টি সব ফল ধরে থাকে। আবহাওয়াও সেখানে চমৎকার। তবে সেখানকার লোকগুলো সব বুনো রক্তপিপাসু বর্বর জাতি। শুধুমাত্র যেসব দ্বীপের অধিবাসীরা আমাদের ত্রাণকর্তা প্রভু যিশু খ্রিস্টের সুসমাচার গ্রহণ করেছিল, সেখানকার কথা আলাদা। এই সব রোমাঞ্চকর গল্প শোনার প্রভাব পড়েছিল আমার মনে। তাই পনেরো বছর বয়স হতেই ঠিক করে ফেললুম দক্ষিণ সমুদ্রে সমুদ্রাযাত্রায় যাব।
আমার বাবা-মা প্রথমে আমাকে যেতে দিতে মোটেই রাজি ছিলেন না। কিন্তু আমি বাবাকে বললুম যে, সারা জীবন উপকূলীয় বাণিজ্য নিয়ে পড়ে থাকলে বড়ো ক্যাপ্টেন হব কী করে? বাবা বুঝলেন, কথাটা ঠিক। তাই আর আপত্তি করলেন না। বাবা সম্মতি দিলেন দেখে মা-ও সম্মতি না দিয়ে পারল না। যাওয়ার সময় বললেন, “কিন্তু বাবা রালফ, আমাদের বয়স হচ্ছে, হয়ত আর বেশিদিন বাঁচব না। তাই তাড়াতাড়ি ফিরে এসো কিন্তু।”
বাবা-মায়ের থেকে শেষ বিদায় কিভাবে নিয়ে এলুম, তার অনুপুঙ্খ বিবরণ নিয়ে পাঠকে ভারাক্রান্ত করব না। শুধু এটুকু বললেই যথেষ্ট হবে যে, আমার বাবা আমাকে তাঁর এক পুরনো মেস-মেট (জাহাজের একই মেসের নাবিকবন্ধু) জনৈক মার্চেন্ট ক্যাপ্টেনের অধীনে জুটিয়ে দিলেন। তিনি দক্ষিণ সমুদ্রে যাচ্ছিলেন তাঁর নিজের অ্যারো নামের জাহাজটি নিয়ে। আমার মা আশীর্বাদ করে আমাকে একটি ছোট্ট বাইবেল দিয়ে শেষ অনুরোধ করলেন, আমি যেন মনে করে রোজ বাইবেলের একটি অধ্যায় পড়ি ও প্রার্থনা করি। আমি সজল নয়নে কথা দিলুম, অবশ্যই তা করব।
তারপর অ্যারো জাহাজে চেপে বসলুম আর তারপরই সেই সুন্দর বিশাল জাহাজটা যাত্রা শুরু করল প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপপুঞ্জের দিকে।
© Arnab Dutta 2012
Jhumpa Bhaskar Bose
নভেম্বর 24, 2012 at 9:35 অপরাহ্ন
https://www.facebook.com/groups/229439667136259/permalink/388727091207515/