RSS

ভগিনী নিবেদিতার প্রবন্ধ ‘নব্য হিন্দুধর্ম’

01 জানু.

নব্য হিন্দুধর্ম

ভগিনী নিবেদিতা

[১৯১০ সালের ১৯ মার্চ ‘কর্মযোগিন’ পত্রিকায় এই নিবন্ধটি ‘দ্য নিউ হিন্দুইজম’ নামে প্রকাশিত হয়। পরে এটি নিবেদিতার সিভিল আইডিয়াল অ্যান্ড ইন্ডিয়ান ন্যাশনালিটি বইতে (দ্য কমপ্লিট ওয়ার্কস অফ সিস্টার নিবেদিতা, চতুর্থ খণ্ড, অদ্বৈত আশ্রম প্রকাশিত) অন্তর্ভুক্ত হয়। হিন্দুধর্ম-বিষয়ে নিবেদিতার গভীর অধ্যয়ন, তীক্ষ্ণ অন্তর্দৃষ্টি ও উচ্চাকাঙ্ক্ষার নিদর্শন এই নিবন্ধটি।]

ভগিনী নিবেদিতা

আমাদের রাজনৈতিক ইতিহাসের প্রতিটি যুগ হিন্দু ধর্মচর্চার ক্ষেত্রে এক একটি নবযুগের সূচনা করে থাকে। যেসব ধ্যানধারণা জন্মলগ্ন থেকে আমাদের ঘিরে আছে, সেগুলি ভূতাত্ত্বিক শিলাস্তরের মতো একটির পর একটি সঞ্চিত; তার প্রতিটি স্তরই নিজ নিজ জন্মকালীন চিহ্নগুলি বহন করছে। বর্তমান কালের জ্বলন্ত সমস্যাগুলিও সেই রকম আমাদের ধর্ম, চিন্তাভাবনা ও রীতিনীতির উপর নিজের সুস্পষ্ট ছাপ রেখে যাচ্ছে। বোঝাই যায়, যা নতুন তা যদি সব বাধা অতিক্রম করে টিকে থাকতে চায়, তবে তাকে পুরনোর অবশেষ দিয়ে নিজেকে গড়তে হবে, বাইরে থেকে আমদানি-করা উপাদানে কাজ হবে না। আর এই জন্যই আমরা বুঝতে পারি না, আমাদের এই যুগ নব্য হিন্দুধর্মের যুগ। এই হিন্দুধর্ম সনাতন হিন্দুধর্মই, শুধু তা একটি নতুন কণ্ঠ আর এক নতুন প্রয়োগবিধি খুঁজে নিয়েছে। বিবেকানন্দের মহতী বাণী শুনলে মনে হয়, এই কথাগুলি তো আমরা ছেলেবেলায় ঠাকুরদা-ঠাকুরমার মুখেই শুনেছি; মনেই হয় না যে, আসলে তিনি হিন্দুধর্ম সম্পর্কে অনভিজ্ঞ একদল ভিনদেশী শ্রোতামণ্ডলীর সামনে এই কথাগুলি উচ্চারণ করেছিলেন। এই যে আমাদের ধর্ম আজ সারা বিশ্বের সামনে দাঁড়িয়ে নিজের ন্যায্য পাওনাটি দাবি করছে;—পৃথিবীর শেষতম প্রান্তটিতে গিয়েও নিজের আত্মাটিকে খুঁজে নিতে চাইছে;—এই ঘটনাই তো বিপ্লব; এমন এক বিপ্লব, যাকে অস্বীকার করার কথা কেউ স্বপ্নেও ভাবতে পারছে না; সারা বিশ্ব স্বীকার করে নিচ্ছে তার অস্তিত্ব। আবার, সত্য বিপ্লব স্বেচ্ছায় থামে না। তা অনেকটা ঢিল মারার পর জলে ওঠে প্রথম তরঙ্গটির মতো, এই তরঙ্গ থেকে একের পর এক তরঙ্গবৃত্তের সৃষ্টি হয়। সেই রকম প্রতিটি বিপ্লবও সংশ্লিষ্ট সমাজে এক ছন্দোময় পরিবর্তনের সূচনা করে। সেই পরিবর্তন অব্যাহত থাকে, আসে দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্তরের পরিবর্তন। শেষে যুগান্তকালে পরবর্তী যুগের শক্তি-পরমাণুগুলি তাদের গ্রাস করে যুগ-পরম্পরায় নতুন শক্তিতে উজ্জীবিত করে তোলে।

জাতীয় ভাবের কোনো আন্দোলনের পিছনে একটি দার্শনিক ভাব থাকা চাই। এমন ভাব, যা নতুন বলে মনে হলেও আসলে হবে মানুষের কাছে এখন যা কিছু পরিচিত, তারই এক প্রবল শক্তিসমষ্টি ও তার পুনঃসৃজিত রূপ। সগর্বে সানন্দে এরই মধ্যে জাতি খুঁজে পাবে তার নিজস্ব জাতীয় মেধাটিকে। প্রত্যেকেই জানবে যে, সে ও তার পূর্বপুরুষেরা এই জাতীয় সম্পদের বিনির্মাণ, বিকাশ ও সংরক্ষণের কাজে নিযুক্ত। সকলের মধ্যে আত্মনির্ভরতার রোমাঞ্চ সঞ্চারিত হবে। তাদের পায়ের তলার মাটি হবে শক্ত, তাদের মাথা হবে উঁচু, প্রথমবারের জন্য তারা তাদের অন্তরে আলোড়ন-সৃষ্টিকারী মহাশক্তিটিকে অনুভব করবে।

আমাদের ধর্মগ্রন্থগুলির মধ্যে গীতা বিগত অন্তত দেড় হাজার বছর ধরে জাতীয় ধর্মগ্রন্থের মর্যাদা পেয়ে আসছে। নবাবিষ্কৃতের মতো আজও গীতা আমাদের জাতীয় পুনরুত্থানের সুসমাচার। কিন্তু গীতার এই নবীনতা আমাদের দৃষ্টির বিভ্রম বই আর কিছুই না। দৈববশে তা আমাদের চোখে ঠেকছে আজ। বিশ্বের অন্যান্য ধর্মগ্রন্থগুলির সঙ্গে তুলনা করলে তবেই গীতার পরিপূর্ণতা আমাদের দৃষ্টিগোচর হবে। কেবল তখনই আমরা বুঝতে পারব যে, সত্যিই গীতার বিকল্প নেই। যে পৃষ্ঠা থেকেই এই বই আমরা পড়া শুরু করি না কেন, সেইখানেই দেখব এ কেবল সেই সর্বভূতে পরিব্যপ্ত মহাসত্ত্বা, সেই বহুর মধ্যে স্পন্দিত একের কথাই বলছে। এই বৃহৎ, রহস্যময় অনন্ত, যাকে নামে প্রকাশ করা যায় না, যাকে পরিমাপ এমনকি স্পর্শও করা যায় না, এ-ই সকল রহস্যের সমাধান, সকল প্রকার মুক্তির প্রদাতা। অন্যান্য ধর্মবিশ্বাস কয়েকটি অসম্পূর্ণ অভিজ্ঞতা ও লক্ষণমূলক আবেগের কথা বলে মাত্র। একমাত্র গীতাই সর্বব্যাপী পরম সত্যের সন্ধান দেয়। আশ্চর্য কী, মাত্র ছ-মাস গীতা পড়েই আমেরিকান এমারসন লিখে ফেলতে পেরেছিলেন তাঁর জীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ রচনা ‘ওভার-সোল’-সংক্রান্ত প্রবন্ধটি। ধর্মক্ষেত্রের এই মহান কীর্তিটির মতো অন্যান্য সব ক্ষেত্রে আমাদের জাতীয় শিক্ষিত সমাজ যদি এক একটি মহৎ কীর্তি স্থাপন করতে সক্ষম হয়, তাহলে ভারতের মননশক্তি কোথায় উন্নীত হতে পারবে, ভাবা যায়? “আমাদের সঙ্গে যিনি আছেন, তিনি আমাদের বিরুদ্ধে দণ্ডায়মান সকল শক্তির চেয়েও শক্তিশালী।”

আধুনিক যুগ ও তার সমস্যাগুলি কেবলমাত্র ধর্মীয় দর্শনের উপরেই অনপনেয় ছাপ রেখে যায়, তা নয়; বরং প্রথা-আচার ও আনুষ্ঠানিক জীবনের উপরেও গভীর প্রভাব বিস্তার করে। নিঃসন্দেহে বলা চলে, হিন্দু ধর্মানুষ্ঠানের এখন ভারি প্রয়োজন যৌথ ও সংঘবদ্ধভাবে গণতান্ত্রিক ভাবপ্রকাশের কয়েকটি মাধ্যমের। হাওড়া পুলের পাশে গাছতলায় প্রতিদিন রাতে যে ছোটো অনুষ্ঠানটি হয়, তা জনপ্রিয়; তার কারণ, নিজের অবচেতনে তা পূর্বোক্ত উদ্দেশ্যটিই সাধিত করছে। বাংলায় চৈতন্যের সাফল্যের একটি প্রধান কারণ হল, আনন্দনৃত্য ও গীতবাদ্য সহযোগে তাঁর সংকীর্তন মানুষকে আত্মঘোষণা করার একটি সুযোগ এনে দিয়েছিল। নিঃসন্দেহে এও বলা চলে, ব্রাহ্মসমাজের সংঘবদ্ধ উপাসনাই তার জনপ্রিয়তার মূল ভিত্তি।

সমন্বয়ের আদর্শে নির্মিত ধর্মক্ষেত্র বেলুড় মঠ

খ্রিস্টান গির্জার প্রতিটি অংশই হিন্দু মন্দিরের অনুরূপ। যা প্রমাণ করে, খ্রিস্টীয় স্থাপত্যের উৎসভূমি আদতে প্রাচ্যদেশ। কিন্তু সহযোগিতা ও সমন্বয়ের ক্ষেত্রে খ্রিস্টানদের জাতীয় প্রতিভার পরিচয় পাওয়া যায় তাদের উপাসনা পদ্ধতির মধ্যে। সেখানে নাটমন্দির বা কয়্যারের অবস্থান গর্ভগৃহ বা মূল মন্দিরের ঠিক সামনে এবং মানুষের বসার জায়গাটি কয়্যার বা নাটমন্দিরের সম্মুখভাগে–সবকিছুই একই ছাদের তলায়। গির্জা-ভবনটি কয়্যারের কাছে সরু হয়ে আসে, যাতে গর্ভগৃহটি পৃথক থাকতে পারে এবং সব মানুষই তার সামনে দাঁড়াতে পারে। এই ব্যবস্থার ফলস্রুতি – যেখান থেকেই দেখা হোক না কেন, ভবনের প্রান্তভাগ এসে মেশে পূজাবেদিতে এবং মানুষ যত দূরেই দাঁড়াক না কেন, তারা প্রতিটি উপাসনা সভার অবিচ্ছেদ্য ও মূল অংশ হয়ে উঠতে পারে।

আমাদের আজ আশু প্রয়োজন মানুষকে গুরুত্বপূর্ণ ও অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ করে একটি বিশেষ উপাসনা পদ্ধতি গড়ে তোলা। সংঘবদ্ধ উপাসনায় প্রত্যেকের অংশগ্রহণের স্বীকৃতি থাকবে। এজন্য আমাদের পুরনো রীতিগুলি অনুপুঙ্খভাবে পরীক্ষা করে দেখতে হবে। প্রাচীন কালে, যে যুগে পুরোহিত শ্রেণি ধর্মানুষ্ঠানের আধার ও সঞ্চালক হয়ে ওঠেনি, সেই যুগে প্রচলিত ধর্মানুষ্ঠানের জটিল অর্থগুলিকে পুনঃস্থাপনের চেষ্টা করতে হবে। নিঃসন্দেহে বলা যায়, এক সময় এই নতুন ধারা আমাদের ধর্মীয় স্থাপত্যকলাকেও প্রভাবিত করতে শুরু করবে। এই মুহুর্তে আমাদের সামনে এর কোনো ফলাফল নেই, আছে শুধুই প্রচেষ্টা। আমাদের ভাবতে হবে, যুক্তির অবতারণা করতে পারছি কিনা। পারিবারিক অনুষ্ঠানে যেমন বাবা, মা, শাশুড়ি, ননদ, মেয়ে ও অন্যান্যদের নির্দিষ্ট কাজ বেঁধে দেওয়া হয়, আমাদের ভবিষ্যতের জাতীয় ও গণ-অনুষ্ঠানগুলিতেও তেমনি প্রত্যেককে নির্দিষ্ট কাজে বেঁধে দিতে হবে। কলকাতা শহরে আমরা ‘সার্ভিস অফ সিভিল প্রেইজে’র মতো নগর-পরিক্রমার কথা ভাবতে পারি। অবশ্য শহরের সর্বস্তরের প্রতিনিধিত্ব ছাড়া তা সম্ভব নয়। নির্দিষ্ট কোনো স্থানে পবিত্রতার মহাগ্নি প্রজ্বলিত করতে হবে। ভবানীপুর, এন্টালি, বড়োবাজার ও অন্যান্য অংশের মানুষ স্থানীয় ধর্মনেতাদের নেতৃত্বে পৃথক পৃথক স্তবক গাইতে গাইতে এক বিশেষ পৌর-সংগীতে যোগ দেবে; শেষে প্রত্যেকে মিলবে ঐকতানে। এর চেয়ে মহত্তর আর কিছুই হবে না।

বেলুড় মঠে রামকৃষ্ণ জয়ন্তী উপলক্ষ্যে শোভাযাত্রা

প্রারম্ভিক স্তরে শোভাযাত্রার রূপে প্রদক্ষিণ এবং ধর্মানুষ্ঠানের উদ্দেশ্য সাধনের জন্য এই শোভাযাত্রার গুরুত্ব অনস্বীকার্য। আলোকমালা, পতাকা, শঙ্খ, ঘণ্টা, ভেরি, ফুল-পাতা বহন ও গঙ্গাজল সিঞ্চনের মাধ্যমে পালিত হবে সেই অনুষ্ঠান। ভারত শোভাযাত্রার দেশ। এই সব রীতিনীতি প্রতিষ্ঠা করতে খুব অসুবিধা হবে না। এসব রীতিনীতির মধ্যে নতুন ও অদৃষ্টপূর্ব কিছু গুরুত্ব আছে। হিন্দু বিবাহের সুন্দর অনুষ্ঠানটিও এই প্রসঙ্গে তাৎপর্যপূর্ণ। শাস্ত্রপাঠ ও পুরোহিতের উচ্চারিত বাক্যের প্রত্যুত্তরে পর্যায়ক্রমে দুই পূজারি দলের প্রশ্নোত্তরের আকারে গীত যুগ্ম প্রার্থনাসংগীত গণতান্ত্রিক উপাসনা পদ্ধতির এক আকর্ষণীয় উদাহরণ। যজমান-আয়োজিত প্রার্থনা-নাটক এক সম্প্রদায়গত চেতনার জন্ম দেয়। এই সব অনুষ্ঠানে ভারতের মাটি, জল ও পতাকাই হোক সর্বোচ্চ প্রতীক। এই সব অনুষ্ঠানের সারল্য ও করুণ রসই সকলের হৃদয় অধিকার করবে। ভবিষ্যতে এ নিয়ে আলোচনার সুযোগ আর হবে না। আমরা তাই আমাদের পাঠকবর্গের দৃষ্টি আকর্ষণ করে এই বিষয়ে ভাবনাচিন্তা করার অনুরোধ জানাই।

(অনুবাদ: অর্ণব দত্ত)

 

ট্যাগ সমুহঃ

মন্তব্য করুন

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  পরিবর্তন )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  পরিবর্তন )

Connecting to %s

 
%d bloggers like this: