RSS

ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন (১৮৫৭-১৯৪৭): একটি সংক্ষিপ্ত ইতিহাস :: পর্ব ২

27 ডিসে.

বঙ্গভঙ্গ (১৯০৫)

 

১৮৯৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর ভারতের নতুন ভাইসরয় নিযুক্ত হলেন লর্ড কার্জন। ১৯০৫ সালের ১৬ অক্টোবর তিনি একটি রাজকীয় ঘোষণাবলে সুবৃহৎ বঙ্গপ্রদেশ দ্বিখণ্ডিত করলেন। গঠিত হল পূর্ববঙ্গ ও আসাম প্রদেশ। ব্রিটিশ সরকারের বক্তব্য ছিল, এর মাধ্যমে অনুন্নত পূর্ববঙ্গের উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে। কিন্তু বঙ্গভঙ্গের প্রকৃত উদ্দেশ্য ছিল সেযুগের ভারতের সবচেয়ে অগ্রসর প্রদেশটিকে দ্বিখণ্ডিত করে ‘ডিভাইড ও রুল’ পদ্ধতিতে ঔপনিবেশিক শাসন কায়েম রাখা। তাছাড়া হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে সাম্প্রদায়িক বিভাজন সৃষ্টিও ছিল ব্রিটিশদের উদ্দেশ্য। তাই ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বঙ্গভঙ্গের বিরোধিতা করে।

 

স্বদেশি আন্দোলন (১৯০৫)

বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলন ধীরে ধীরে স্বদেশি আন্দোলনের রূপ ধারণ করল। বিংশ শতাব্দীর সূচনায় এই আন্দোলনের মাধ্যমেই জাতীয়তাবাদী স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রকৃত সূচনা।

১৯০৫ সালের বারাণসী অধিবেশনে গোপালকৃষ্ণ গোখেলের সভাপতিত্বে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস বাংলায় স্বদেশি ও বয়কট আন্দোলনকে সমর্থন জানায়। অন্যদিকে বালগঙ্গাধর তিলক, বিপিনচন্দ্র পাল, লালা লাজপৎ রাই, অরবিন্দ ঘোষ প্রমুখ চরমপন্থী নেতৃবর্গ শুধুমাত্র বাংলায় ব্রিটিশ পণ্য বয়কটের মধ্যে আন্দোলনকে সীমিত না রেখে, সারা দেশ জুড়ে গণ-আন্দোলন গড়ে তোলার স্বপক্ষে মত প্রকাশ করেন।

 

১৯০৫ সালের ৭ অগস্ট কলকাতার টাউন হলে বয়কট প্রস্তাব গৃহীত হয়। সেই সঙ্গে শুরু হয় দেশীয় শিল্প পুনরুজ্জীবনের প্রয়াসও। বয়কটের আগুন জ্বলে উঠল বাংলার সব কটি প্রধান শহরে। দেশের ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প নবজীবন লাভ করল। স্থাপিত হল একাধিক জাতীয় ব্যাংক ও বিমা কোম্পানি। জাতীয়তাবাদের অনুপ্রেরণায় নতুন গতি পেল জাতীয়তাবাদী সাহিত্যও।

 

স্বদেশি ও বিদেশি পণ্য বয়কট আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ল সারা দেশে। লোকমান্য তিলক আন্দোলন শুরু করলেন বোম্বাই ও পুনায়। অজিত সিং ও লালা লাজপৎ রাই জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে নিয়ে গেলেন পাঞ্জাব ও উত্তর ভারতের অন্যান্য অঞ্চলে। সৈয়দ হায়দর রাজা আন্দোলন শুরু করলেন দিল্লিতে। রাওয়ালপিন্ডি, কাংড়া, জম্মু, মুলতান ও হরিদ্বারেও তীব্র আন্দোলন শুরু হল। চিদম্বরম পিল্লাই মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সিতে আন্দোলন শুরু করলেন। বিপিনচন্দ্র পাল মাদ্রাজে গিয়ে জ্বালাময়ী বক্তৃতার মাধ্যমে তাঁর আন্দোলনকে প্রেরণা জোগালেন।

 

মুসলিম লিগ (১৯০৬)

১৯০৬ সালে আগা খান, ঢাকার নবাব সালিমুল্লাহ্ ও নবাব মহসিন-উল-মুলকের নেতৃত্বে গঠিত হল মুসলিম লিগ। লিগ বঙ্গভঙ্গ সমর্থন করে স্বদেশি আন্দোলনের তীব্র বিরোধিতা করল। শুধু তাই নয়, তাঁরা মুসলিমদের স্বার্থরক্ষার জন্য বিশেষ রক্ষাকবচ চাইলেন এবং মুসলিমদের জন্য পৃথক নির্বাচনী ব্যবস্থা দাবি করলেন। এর মাধ্যমে হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যে সাম্প্রদায়িক ভেদ বৃদ্ধি পেল।

 

স্বরাজ

১৯০৬ সালে জাতীয় কংগ্রেসের কলকাতা অধিবেশনে দাদাভাই নওরোজি ঘোষণা করলেন, ভারতবাসীর আন্দোলনের চরম লক্ষ্যটি হল ‘স্বরাজ’। সভাপতির ভাষণে নওরোজি বললেন, জাতীয় কংগ্রেসের উদ্দেশ্য হল ‘যুক্তরাজ্যে যেরকম স্বশাসন রয়েছে, সেই রকম স্বশাসন বা স্বরাজ।’ কিন্তু আন্দোলনের কর্মপদ্ধতি নিয়ে কংগ্রেসের নরমপন্থী ও চরমপন্থী দলের মতভেদ চরমে উঠল অতিশীঘ্রই।

 

সুরাত কংগ্রেস (১৯০৭)

১৯০৭ সালে জাতীয় কংগ্রেসের সুরাত অধিবেশনে কংগ্রেস চরমপন্থী ও নরমপন্থী নামে পরিচিত দুটি গোষ্ঠীতে ভেঙে যায়। চরমপন্থী দলের নেতৃত্ব দেন তিলক, লাজপৎ রাই, বিপিনচন্দ্র পাল প্রমুখেরা এবং নরমপন্থীদের নেতৃত্ব দেন গোখেল। উভয় গোষ্ঠীর প্রতিনিধিদের হৈ-হট্টগোলে সুরাট কংগ্রেস বানচাল হয়ে যায়।

 

সুরাটের ঘটনার আকস্মিকতায় চরমপন্থী নেতারা কিছুটা হতচকিত হয়ে গিয়েছিলেন। তাঁরা রাসবিহারী ঘোষের নেতৃত্বাধীন কংগ্রেস কর্মসমিতির দিকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে চান। কিন্তু কংগ্রেস তাঁদের সহযোগিতা নিতে অস্বীকার করে। সরকার সব পরিস্থিতি বিবেচনা করে চরমপন্থীদের বিরুদ্ধে ব্যাপক দমননীতি অবলম্বন করে। তিলককে গ্রেফতার করে ছয় বছরের জন্য মান্দালয় জেলে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। অরবিন্দ ঘোষ ঘটনাচক্রে রাজনীতি ছেড়ে আধ্যাত্মিক জীবনের সন্ধানে পন্ডিচেরি চলে যান। বিপিনচন্দ্র পালও সাময়িকভাবে রাজনীতি ত্যাগ করেন। লাজপৎ রাই ব্রিটেনে চলে যান। এর ফলে চরমপন্থীরা নেতার অভাব অনুভব করতে থাকেন। অবশেষে ১৯০৮ সালে চরমপন্থী আন্দোলন স্তব্ধ হয়ে যায়।

 

মর্লে-মিন্টো সংস্কার (১৯০৯)

১৯০৯ সালে লর্ড মিন্টো ভারতের গভর্নর-জেনারেল পদে থাকার সময় যে প্রশাসনিক সংস্কার কার্যকর হয়, তাকে মর্লে-মিন্টো সংস্কার বলা হয়। এই সংস্কারের মাধ্যমে নরমপন্থীদের জন্য সাংবিধানিক সুযোগসুবিধা ও মুসলিমদের জন্য পৃথক নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হয়। এর মাধ্যমে সরকার একাধারে কংগ্রেসের মধ্যে নরমপন্থী-চরমপন্থী বিরোধ এবং সামাজিক স্তরে হিন্দু-মুসলিম বিরোধকে ইন্ধন জোগায়। যদিও ভারতীয় নেতৃবর্গ এই সংস্কারে সন্তুষ্ট হতে পারলেন না। ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ হয় এবং ভারতের রাজধানী কলকাতা থেকে দিল্লিতে স্থানান্তরিত হয়।

 

হোমরুল আন্দোলন (১৯১৫-১৬)

আইরিশ বিদ্রোহের অনুপ্রেরণায় ১৯১৬ সালের সেপ্টেম্বরে ড. অ্যানি বেসান্ত ভারতে শুরু করলেন হোমরুল আন্দোলন। শীঘ্রই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ল সারা দেশে। হোমরুল লিগের শাখা স্থাপিত হল সব প্রদেশে। বালগঙ্গাধর তিলক সর্বান্তকরণে হোমরুল আন্দোলনকে সমর্থন করলেন। শুধু তাই নয়, মুসলিম লিগকেও আন্দোলন সমর্থনে এগিয়ে আসার আহ্বান জানালেন।

 

লখনউ চুক্তি (১৯১৬)

হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের পথে একটি বড়ো সাফল্য ছিল ১৯১৬ সালের লখনউ চুক্তি। ব্রিটেন তুরস্কের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হলে ভারতীয় মুসলমানদের মধ্যে ব্রিটিশ-বিরোধী চেতনা জেগে ওঠে। এর ফলে কংগ্রেস ও মুসলিম লিগের ঐক্যের পথ মসৃণ হয়ে যায়। উভয় দলই ১৯১৬ সালে লখনউতে অধিবেশনের আয়োজন করে। এখানেই বিখ্যাত লখনউ চুক্তিটি সাক্ষরিত হয়। কংগ্রেস পৃথক নির্বাচনী ব্যবস্থা মেনে নেয়। উভয় দলই ডোমিনিয়ন মর্যাদার জন্য একযোগে দাবি উত্থাপন করে। হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের ফলে সরকারকে অনমনীয় মনোভাব ত্যাগ করতে হয়। ১৯১৬ সালেই ব্রিটিশ সরকার নতুন নীতি ঘোষণা করে জানিয়ে দেয়, আইনসভায় ভারতীয়দের সুযোগসুবিধা বৃদ্ধি করা হবে এবং ধাপে ধাপে স্থানীয় স্বায়ত্ত্বশাসনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

 

অগস্ট ঘোষণাপত্র (১৯১৭)

এই ঘোষণাপত্রে জানিয়ে দেওয়া হয়, ভারতের শাসনভার ধীরে ধীরে ভারতের জনগণের হাতে তুলে দেওয়া হবে। এই ঘোষণাপত্র ছিল লখনউ চুক্তির ফলস্রুতি।

 

গান্ধীযুগের সূচনা (১৯১৮)

১৯১৮ সালে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের ইতিহাসে গান্ধীযুগের সূচনা হয়। ভারতীয় রাজনীতিতে মহাত্মা গান্ধীর কর্তৃত্ব চলেছিল ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে এই যুগটিই ছিল সবচেয়ে ঘটনাবহুল সময়। মহাত্মা গান্ধী এই সময় এক যোগ্য নেতার পরিচয় দিয়েছিলেন। ভারতের মাটি থেকে ব্রিটিশদের উৎখাত করতে তাঁর অহিংস সত্যাগ্রহ আন্দোলন যথেষ্টই ফলপ্রসূ হয়েছিল।

 

রাওলাট আইন (১৯১৯)

১৯১৮ সালে ভাইসরয় লর্ড চেমসফোর্ডের আমলে সরকার বিচারপতি রাওলাটের নেতৃত্বে একটি রাজদ্রোহ কমিটি গঠন করে। এই কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী রাজদ্রোহ দমনে সরকার একাধিক পদক্ষেপ নেয়। ১৯১৯ সালের রাওলাট আইন সরকারকে নির্বিচারে আটক ও বিনা বিচারে বন্দী রাখার অধিকার দেয়। এই আইনে ভারতের সর্বস্তরের মানুষ বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। এমনকি আইন পাস হওয়ার আগেই এর বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রদর্শনী শুরু হয়ে যায়।

 

গান্ধীজি এই আইনের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করেন। ১৯১৯ সালের ৬ এপ্রিল তিনি সত্যাগ্রহের ডাক দেন। ৮ এপ্রিল তাঁকে কারারুদ্ধ করা হয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও দিল্লি, আমেদাবাদ ও পাঞ্জাবে বিক্ষোভ ঘনীভূত হয়ে ওঠে।

 

ক্রমশ…

 

ট্যাগ সমুহঃ

মন্তব্য করুন

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  পরিবর্তন )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  পরিবর্তন )

Connecting to %s

 
%d bloggers like this: