
তোমার এই ছেলে হয় বিশ্বের শ্রেষ্ঠ নরপতি হবে, নতুবা মানুষের দুঃখে কাতর হয়ে সংসার ত্যাগ করবে এবং সম্প্রদায়ের গুরু হবে।
মূল রচনা: ভগিনী নিবেদিতা
অনেক দূরে ভারতের উত্তরে প্রাচীন রাজধানী কপিলাবস্তু। আজ থেকে পঁচিশ শতাব্দী আগে সেখানে একদিন শহর ও রাজপ্রাসাদ মুখরিত হল আনন্দ-কোলাহলে। জন্ম নিলেন শিশু রাজকুমার গৌতম। ভৃত্যেরা সংবাদ নিয়ে এল। চিরাচরিত প্রথা অনুযায়ী রাজা তাঁদের বহুমূল্য পুরস্কার দিয়ে পুরস্কৃত করলেন। অন্যান্য কাজ যারা করেছিল, সে যতই ছোটো কাজ হোক না কেন, তারা সবাই পুরস্কার পেল। তারপর রাজা এসে বসলেন অন্দরমহলে। একদল প্রাজ্ঞ ব্যক্তি তাঁদের তালপাতার পুথিপত্র আর আশ্চর্য সব যন্ত্রপাতি নিয়ে বসলেন গণনা করতে। রাজা উদ্বেগভরে অপেক্ষা করতে লাগলেন।
তাঁরা কী করছিলেন, জানো? সে এক ভারি মজার কাজ! তাঁরা ছোট্ট ছেলেটির জন্মনক্ষত্রের অবস্থান হিসেব করে তা থেকে তার ভবিষ্যৎ জীবনের কাহিনি পাঠ করছিলেন! শুনলে আশ্চর্য হবে, কিন্তু এই ছিল ভারতের সেকালের প্রথা। আজও লোকে এই প্রথা মেনে চলে। এই নক্ষত্র ধরে ভবিষ্যৎ জানাকে বলে মানুষের কোষ্ঠীবিচার। আমি এমন হিন্দুকেও চিনি যাঁর কাছে তাঁর তেরশো বছর আগেকার পূর্বপুরুষেরও কোষ্ঠী আছে!
কপিলাবস্তুর প্রাজ্ঞ মানুষেরা অনেকক্ষণ ধরে শিশু রাজপুত্রের কোষ্ঠীবিচার করলেন। কারণ, তাঁরা তার মধ্যে এমন সব অত্যাশ্চর্য ঘটনার সমাবেশ দেখেছিলেন যে, ঘোষণার আগে কোনো ভুলচুক রয়ে গেল কিনা, তা ভাল করে মিলিয়ে দেখে নিতে চাইছিলেন। তারপর তাঁরা এসে দাঁড়ালেন রাজার সম্মুখে।
রাজা উদ্বেগভরে জিজ্ঞাসা করলেন, “ছেলেটি বাঁচবে তো?”
জ্যোতিষীদের মধ্যে সবচেয়ে প্রবীণ যিনি, তিনি বললেন, “বাঁচবে, মহারাজ।”
রাজা বললেন, “তবে আর ভাবনা কী!” তিনি কথঞ্চিত নিশ্চিন্ত হলেন। প্রাজ্ঞ মানুষটি বলতে লাগলেন, “ছেলেটি বাঁচবে বটে, কিন্তু কোষ্ঠী সঠিক হলে, আজ থেকে ঠিক সাত দিনের মাথায় তার মা মহারানি মায়া দেহ রাখবেন। এছাড়াও, মহারাজ, এমন চিহ্ন দেখছি যে, তোমার এই ছেলে হয় বিশ্বের শ্রেষ্ঠ নরপতি হবে, নতুবা মানুষের দুঃখে কাতর হয়ে সংসার ত্যাগ করবে এবং সম্প্রদায়ের গুরু হবে।”
“মহারানি দেহ রাখবেন–ছেলেটি শ্রেষ্ঠ নরপতি হবে–অথবা সম্প্রদায়ের গুরু হবে–” এই কথাগুলি বারংবার রাজার কানে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হতে লাগল। তিনি একাকী বসে ভাবতে লাগলেন। শেষ কথাটি তাঁর বুকে সবচেয়ে বেশি বাজল। ‘সম্প্রদায়ের গুরু’ মানে তো ভিক্ষুক! তাঁর কাছে সম্প্রদায়ের গুরু যা ভিক্ষুকও তা। রাজা ভয়ে কেঁপে উঠলেন। কিন্তু দাঁড়াও। ওঁরা তো বললেন, ‘মানুষের দুঃখে কাতর হয়ে সংসার ত্যাগ করবে’। রাজপুত্রের জনক তখন বললেন, “আমার পুত্রকে আমি মানুষের দুঃখের কথা কিছুতেই জানতে দেবো না।” রাজা ভাবলেন, এই ভাবে তিনি পুত্রের বিশ্বজয়ী হওয়া সুনিশ্চিত করবেন।
প্রাজ্ঞ মানুষটির কথা ফলে গেল। সাত দিনের মাথায় মহারানি মায়া দেহত্যাগ করলেন। শেষের দিনগুলিতে তাঁর কত সেবাযত্ন করা হল। কিন্তু কিছুতেই কিছু হল না। শেষে পূর্বকথিত সেই দিনটিতে এক সুখী শিশুকন্যার মতো ঘুমিয়ে পড়লেন তিনি। সে ঘুম আর ভাঙল না।
সেই শোকের দিন জ্যোতিষীদের কথা ওভাবে ফলে যেতে দেখে বিশেষ উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলেন রাজা শুদ্ধোধন। তিনি পুত্রকে ভিক্ষাবৃত্তির নিয়তি থেকে রক্ষা করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হলেন। ভাবলেন, তা হলেই সে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ধনী ও শক্তিশালী সম্রাট হতে পারবে।
ছেলেটি বড়ো হতে লাগল। তাকে দেখেই বোঝা যেত, এক আশ্চর্য ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করে আছে তার জন্য। ভারি উজ্জ্বল প্রাণোচ্ছ্বল ছিল সে। লেখাপড়া ও খেলাধূলায় ছিল তুখোড়। প্রথম দর্শনেই মানুষকে সে এত ভালবেসে ফেলত যে, যে-ই তার সংস্পর্শে আসুক না কেন, তার গুণে মুগ্ধ না হয়ে পারত না। আর এজন্য তার কোনো শত্রুও ছিল না। সবাই বলত, তার দয়ার শরীর। একবার এক ডানা-ভাঙা পাখিকে কত শুশ্রুষা করে সে জীবনদান করেছিল। তার বন্ধুবান্ধব কপিলাবস্তুর অভিজাত বংশের ছেলেদের মতো তীরধনুক নিয়ে অবলা পশুপাখিদের প্রাণ বধ করে তিনি কোনো আনন্দ পেতেন না। এসব করাকে তিনি আদৌ পুরুষোচিত কাজ মনে করতেন না। বলতেন, এ যেত ছোটো ভাইটির দুঃখযন্ত্রণায় আনন্দিত হওয়া! তিনি জানতেন, কাউকে তীরে বিঁধলে তার কেমন যন্ত্রণা হয়। তবে আর কোনো দুঃখের কথা তাঁর জানা ছিল না। তিনি বাস করতেন রাজপ্রাসাদে। প্রাসাদ ঘিরে ছিল একটি উদ্যান। উদ্যানের পরেই ছিল এক উপবন। রাজধানীর উত্তরে বহু যোজন পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল সেই উপবন। তার বাইরে রাজপুত্র কোনোদিন যায়নি। সেখানেই সে অশ্বারোহণ ও ধনুর্বিদ্যা অভ্যাস করত। ঘুরে বেড়াত ঘণ্টার পর ঘণ্টা। ভাবত। আর দেখত স্বপ্ন। সেখানে কোনো দুঃখ ছিল না। কেউ উচ্চস্বরে দুঃখের কথা বলতও না। রাজ্যের মধ্যে সে ছিল এক উপরাজ্য। তার বাইরে আর যাওয়া হয়নি তার। ‘মানুষের দুঃখে কাতর’ – কথাটি শুদ্ধোধনের প্রায়ই মনে পড়ত। তাই তিনি সদা সচেষ্ট থাকতেন, পুত্র যেন দুঃখের কথা কিছুই না জানতে পারে। সবাইকে তিনি দুঃখের কথা কইতে বারণ করে দিয়েছিলেন। তাই রাজকুমারও আর দুঃখের অস্তিত্বের কথা জানতে পারল না।
(অনুবাদ: অর্ণব দত্ত)
(ক্রমশ)
স্মৃতিলেখা চক্রবর্ত্তী
জানুয়ারি 3, 2012 at 3:39 অপরাহ্ন
এর পরের অংশ -টা কই???
অর্ণব দত্ত
জানুয়ারি 3, 2012 at 4:47 অপরাহ্ন
পর পর পোস্ট করা যাচ্ছে না বলে দুঃখিত। লেখার নিচে “ট্যাগ” নামে লিঙ্কটি ধরে খুঁজুন। দ্বিতীয় অংশ পেয়ে যাবেন। দ্বিতীয় অংশ অবধিই আছে। তৃতীয় ও চতুর্থ অংশ পরে পোস্ট করব (মোট চার অংশে লেখাটা শেষ হবে)।
Indranil modak
সেপ্টেম্বর 13, 2012 at 2:56 পুর্বাহ্ন
আমি কোন “ট্যাগ” নামে লিঙ্ক খুঁজে পেলাম না। বাকিটা অমীমাংসিতই রইল। তবে লেখাটা বেশ ভালো।
অর্ণব দত্ত
সেপ্টেম্বর 13, 2012 at 6:20 পুর্বাহ্ন
ট্যাগ লিঙ্ক কিসের জন্য খুঁজছেন?