সুরাট অধিবেশন (১৯০৭)
বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলন চলাকালীনই কংগ্রেসের নরমপন্থী ও চরমপন্থী গোষ্ঠীর মতাদর্শগত বিরোধ চরমে ওঠে। ১৯০৫ সালের বারাণসী অধিবেশনে গোপালকৃষ্ণ গোখেলের সভাপতিত্বে অল্পের জন্য কংগ্রেস বিভাজিত হওয়ার হাত থেকে বেঁচে যায়। তাতে অবশ্য নরমপন্থী ও চরমপন্থীদের প্রকাশ্য বাকবিতণ্ডা ও মতবিরোধ থেমে থাকেনি। আগেই বলা হয়েছে, চরমপন্থীরা আন্দোলনকে বাংলার বাইরেও ছড়িয়ে দিতে এবং তাকে শুধুমাত্র বয়কটের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে সর্বতোমুখী বিরোধিতার অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে চাইছিলেন। এসবের তীব্র বিরোধী ছিলেন নরমপন্থীরা। ১৯০৬ সালের কলকাতা অধিবেশনে সভাপতি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দুই গোষ্ঠীর মধ্যে সংঘাতের উপক্রম হয়। সেযাত্রা সর্বজনশ্রদ্ধেয় ভারতের ‘গ্র্যান্ড ওল্ড ম্যান’ দাদাভাই নওরোজিকে সভাপতি করে শেষরক্ষা করা হয়। নরমপন্থী ও চরমপন্থী গোষ্ঠীর মধ্যে মতৈক্য ঘটানোর লক্ষ্যে দাদাভাই নওরোজি ঘোষণা করেন যে, ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের লক্ষ্য ‘যুক্তরাজ্য বা তার উপনিবেশগুলিতে যেরকম স্বায়ত্বশাসিত সরকার বা স্বরাজ দেখা যায়, সেই রকম সরকারব্যবস্থা অর্জন’। সেই সঙ্গে কংগ্রেস স্বায়ত্ত্বশাসিত সরকার, বয়কট, স্বরাজ ও জাতীয় শিক্ষা সংক্রান্ত চারটি আপোষমূলক প্রস্তাবও গ্রহণ করে।
১৯০৭ সালের ২৬ ডিসেম্বর সুরাট শহরে তাপ্তি নদীর তীরে বসে কংগ্রেসের অধিবেশন। গুজব রটে যায়, নরমপন্থীর কলকাতা অধিবেশনের প্রস্তাব চারটি অকার্যকর করে দেওয়ার পরিকল্পনা করছেন। এতে চরমপন্থীদের ক্রোধে ঘৃতাহুতি পড়ে। অন্যদিকে, অধিবেশন শুরুর আগের তিন দিন সুরাটে বিভিন্ন জনসভায় চরমপন্থীরা নরমপন্থীদের নিয়ে যে ঠাট্টাতামাশা করেছিলেন, তাতে বেজায় চটেছিলেন নরমপন্থীরাও। ফলত, এক বিক্ষুব্ধ বাতাবরণে কংগ্রেস প্রতিনিধিরা মিলিত হলেন। চরমপন্থীরা সভাপতি পদে রাসবিহারী ঘোষের নির্বাচনের বিরোধিতা করলেন। ফলে চিৎকার-চ্যাঁচামেচি ও চেয়ার ছোঁড়াছুড়ির মধ্যে দিয়ে অধিবেশন ভন্ডুল হয়ে গেল। ১৯০৭ সালের সুরাত অধিবেশনে কংগ্রেসের নরমপন্থী ও চরমপন্থীরা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলেন।
এর পরই সরকার চরমপন্থীদের বিরুদ্ধে ব্যাপক দমনমূলক ব্যবস্থা নিল। লোকমান্য তিলককে ছয় বছরের জন্য মান্দালয় জেলে পাঠিয়ে দেওয়া হল। অরবিন্দ ঘোষ ঘটনাচক্রে রাজনীতি পরিত্যাগ করে আধ্যাত্মিক জীবনের সন্ধানে পন্ডিচেরি চলে গেলেন। বিপিনচন্দ্র পালও সাময়িকভাবে রাজনীতি থেকে সরে এলেন। লাজপৎ রাই ব্রিটেনে চলে গেলেন। চরমপন্থীদের তুষ্ট করতে সরকার ১৯০৯ সালের ভারতীয় কাউন্সিল আইন পাস করলেন। এই আইনই মর্লে-মিন্টো সংস্কার নামে পরিচিত।
মর্লে-মিন্টো সংস্কার (১৯০৯)
১৯০৫ সালে লর্ড মিন্টো ভাইসরয় নিযুক্ত হয়ে ভারতে আসার পরই জন মর্লে নামে জনৈক উদারপন্থী ভারতসচিব নিযুক্ত হন। দু-জনেই সিদ্ধান্ত নিলেন, যেহেতু ভারতবাসীর স্বায়ত্ত্বশাসনের দাবি আর ঠেকিয়ে রাখা যাবে না, সেহেতু তাদের কিছুটা স্বায়ত্ত্বশাসন দিয়ে দেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ। এই মর্মে তাঁরা দু-জনে মিলে আইনবিভাগীয় সংস্কারের একটি রূপরেখা তৈরি করলেন। ১৯০৯ সালে এই সংস্কার প্রস্তাবই ভারতীয় কাউন্সিল আইন, ১৯০৯-এর আকারে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে পাস হয়ে গেল।
মর্লে-মিন্টো সংস্কার বলে কেন্দ্রীয় আইনসভার সদস্য সংখ্যা ১৬ থেকে বাড়িয়ে ৬০ করা হয়। প্রাদেশিক আইনসভাগুলির সদস্যসংখ্যাও বৃদ্ধি করা হয়; বাংলা, বোম্বাই ও মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সির সদস্য সংখ্যা হয় ৫০, অন্যান্য ক্ষেত্রে ৩০। কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক উভয় স্তরেই আইনসভাগুলির সদস্যদের চারটি শ্রেণিতে ভাগ করা হল। যথা: (১) এক্স-অফিসিও সদস্য, (২) সরকার-মনোনীত সদস্য, (৩) বেসরকারি মনোনীত সদস্য ও (৪) নির্বাচিত সদস্য। মুসলিমদের জন্য পৃথক নির্বাচনী ব্যবস্থা ঘোষণা করা হল। কেন্দ্রীয় স্তরে সরকারি ও প্রাদেশিক স্তরে বেসরকারি মনোনীত সদস্যদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা রক্ষা করা হল। সদস্যদের বাজেট আলোচনা, সংশোধনী প্রস্তাব দান ও নির্দিষ্ট কিছু ক্ষেত্রে ভোট দেওয়ার অধিকার স্বীকৃত হল। ভারত সচিবের কাউন্সিলে দু-জন ভারতীয় সদস্য নেওয়া হল। গভর্নর-জেনারেলকে তাঁর কার্যনির্বাহী কাউন্সিলে একজন ভারতীয় সদস্য নেওয়ার অধিকার দেওয়া হল।
বলাবাহুল্য, ভারতে গণতান্ত্রিক পরিবেশ সৃষ্টির উদ্দেশ্যে এই সংস্কার গৃহীত হয়নি। এর প্রকৃত উদ্দেশ্য ছিল জাতীয়তাবাদীদের বিভ্রান্ত করে বিভক্ত করে দেওয়া। চরমপন্থী আন্দোলনকে সরকার অঙ্কুরে বিনষ্ট করতে চেয়েছিল। তাদের উদ্দেশ্য আপাত দৃষ্টিতে সফল হলেও, বাস্তব চিত্রটা একটু অন্যরকম ছিল। চরমপন্থীরা ভারতবাসীর সামনে ভারতীয় জাতিসত্ত্বা ও দেশপ্রেমের জ্বলন্ত আদর্শ স্থাপন করে তাদের মধ্যে সাহস, আত্মবিশ্বাস ও আত্মত্যাগের স্পৃহা জাগিয়ে তুলতে সক্ষম হন। আর ব্রিটিশ-বিরোধী বয়কট আন্দোলনের ফলে স্বদেশি শিল্পের যে জোয়ার এসেছিল, তা ঔপনিবেশিকতার জাঁতাকলে মুখ-থুবড়ে-পড়া ভারতীয় অর্থনীতিকে যে নতুন দিগন্তের সন্ধান দিয়েছিল, তা বলাই বাহুল্য।
সমাপ্ত