স্বদেশি আন্দোলন
বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলনকেই স্বদেশি আন্দোলনের বীজ বলা চলে। এই আন্দোলনের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা হয় ১৯০৫ সালের ৭ অগস্ট কলকাতার টাউন হলে। এই ঐতিহাসিক সম্মেলনেই পাস হয় বয়কট প্রস্তাব। ১৯০৫ সালে সঞ্জীবনী পত্রিকায় কৃষ্ণকমল মিত্র প্রথম বয়কটের প্রস্তাব রাখেন। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের বারাণসী অধিবেশনে সভাপতি গোপালকৃষ্ণ গোখেল বাংলায় স্বদেশি ও বয়কট আন্দোলনকে সমর্থন করেন।
বাংলার নেতারা অনুভব করলেন, শুধুমাত্র বিক্ষোভ প্রদর্শন, জনসভা বা প্রস্তাব পাস করাই যথেষ্ট নয়, বরং আরো গুরুতর কিছু করতে হবে। মানুষকে ব্রিটিশ পণ্য বয়কট করে স্বদেশে উৎপাদিত জিনিস ব্যবহারে উৎসাহিত করা হতে লাগল। সারা বাংলা জুড়ে জনসমাবেশ করে স্বদেশির শপথ গ্রহণ করা হল। এমনকি রোগীরাও বিদেশি ওষুধ গ্রহণে অস্বীকার করল। সবাই বিদেশি কাপড় ও বিলিতি শৌখিন জিনিসপত্র পোড়াতে লাগল। স্বদেশি আন্দোলন ব্যাপক সাফল্য পেল।
স্বদেশি আন্দোলনের আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল, দেশবাসীকে আত্মশক্তিতে বলীয়ান হতে শেখানো। এই আত্মশক্তির সঙ্গে জুড়ে ছিল জাতির গৌরববোধ, সম্মান ও আত্মবিশ্বাস। স্বদেশির হাওয়া লাগল অর্থনীতির পালেও। অনেক দেশি কাপড়কল, সাবান ও দেশলাই কারখানা, জাতীয় ব্যাংক ও বীমা কোম্পানি স্থাপিত হল। এমনই কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ছিল আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের বেঙ্গল কেমিক্যাল, বঙ্গলক্ষ্মী কটন মিল, ক্যালকাটা পটারিজ ইত্যাদি। স্বদেশি আন্দোলনে বড় ভূমিকা নিয়েছিলেন ছাত্ররাও। তাঁরা বিদেশি পণ্যের দোকানের সামনে পিকেটিং শুরু করলেন। স্থাপিত হল জাতীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান – বেঙ্গল টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউট, জাতীয় শিক্ষা পরিষদ, ন্যাশনাল কলেজ (এর অধ্যক্ষ ছিলেন অরবিন্দ ঘোষ স্বয়ং)।
আগেই বলেছি, স্বদেশি আন্দোলন নরমপন্থী নেতাদের হাত ধরে শুরু হলেও আস্তে আস্তে আন্দোলনের রাশ চলে গিয়েছিল চরমপন্থীদের হাতে। আসলে চরমপন্থীরা স্বদেশি আন্দোলনকে ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন বাংলার বাইরেও। আর তাতেই তীব্র আপত্তি ছিল নরমপন্থীদের। তাছাড়া চরমপন্থীদের কাছে স্বদেশি ছিল বিদেশি সরকারের সার্বিক বিরোধিতা। নরমপন্থীরা শুধু বিদেশি পণ্য বয়কটের মধ্যেই আন্দোলনকে সীমাবদ্ধ করে রাখতে চেয়েছিলেন।
ব্রিটিশ সরকার অবশ্য স্বদেশি আন্দোলনকে দমন করতে কোনো কসুর করেনি। জনসভা লণ্ডভণ্ড করা থেকে শুরু করে নেতাদের ভীতিপ্রদর্শন সবই চলত। জনতার পিছনে গোর্খা সৈন্য লেলিয়ে দেওয়া হত। বিশেষ করে, পূর্ববঙ্গের বরিশালে অমানবিক দমননীতি আশ্রয় করা হয়েছিল। নতুন প্রদেশের লেফটানেন্ট-গর্ভনর হিন্দুদের ৩-৪ প্রজন্মের জন্য সরকারি চাকরি থেকে বঞ্চিত করার হুমকি দিয়েছিলেন। বিলিতি চিনিতে তৈরি মিষ্টি ফেলে দেওয়ার জন্য ছাত্রদের জেলে পুরে দেওয়া হতে লাগল। গোর্খা সৈন্যদের আদেশ করা হল মানুষের ‘বন্দেমাতরম্’ শ্লোগান দেওয়া বা গান গাওয়া বন্ধ করে দেওয়ার জন্য। যেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনকারীদের সমর্থন করে, তাদের অনুদান বন্ধ করে দেওয়া হয়। এমনকি শিক্ষক-অধ্যাপকদের বিরুদ্ধেও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হতে থাকে। ব্রিটিশ সরকার ‘বিভাজন ও শাসন’ (Divide and Rule) নীতি অবলম্বন করে। ১৯০৯ সালে মর্লে-মিন্টো সংস্কারের মাধ্যমে যে ভারতীয় কাউন্সিল আইন চালু হয়, তাতে নরমপন্থীদের সামান্য কিছু সাংবিধানিক সুযোগসুবিধা প্রদান করা হয়। এভাবে নরমপন্থী ও চরমপন্থীদের মধ্যে বিভাজনরেখা খাড়া করতে সক্ষম হয় সরকার। ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ করা হয়। পশ্চিম ও পূর্ববঙ্গকে এক করে দিয়ে বিহার ও ওড়িশাকে বাংলা থেকে পৃথক করা হয়। সেই সঙ্গে ভারতের রাজধানী কলকাতা থেকে দিল্লিতে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়।
ক্রমশ…