উনিশশো পাঁচের বঙ্গভঙ্গ
১৯০৫ সালের ২০ জুলাই লর্ড কার্জন আদেশ জারি করে বাংলাকে দুটি প্রদেশে ভাঙলেন। পূর্বে ৩.১ কোটি জনসংখ্যা নিয়ে গঠিত হল পূর্ববঙ্গ ও আসাম প্রদেশ। অবশিষ্ট বঙ্গপ্রদেশের জনসংখ্যা হল ৫.৪ কোটি। এদের মধ্যে ১.৮ কোটি বাঙালি এবং ৩.৬ কোটি বিহারি ও ওড়িয়া।
আসুন দেখে নিই, সরকারি বয়ানে এই বঙ্গভঙ্গের কী উদ্দেশ্য দেখানো হয়েছিল:
(১) যুক্তবাংলা একটি বিরাট প্রদেশ। সুতরাং প্রশাসনিক চাপ হালকা করতে বঙ্গভঙ্গ অপরিহার্য।
(২) পশ্চাদপদ আসাম রাজ্যের উন্নতি ত্বরান্বিত করা। আসামকে তাই চিফ কমিশনার-শাসিত প্রদেশ করা হয়েছিল।
(৩) ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ওড়িয়া-ভাষাভাষীদের একই প্রশাসনিক ছাতার তলায় আনা।
যদিও বঙ্গভঙ্গের আসল উদ্দেশ্য ছিল, রাজনৈতিকভাবে অগ্রসর বাংলাকে দ্বিখণ্ডিত করে বাংলাভাষী হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে বিভেদের বীজ রোপণ করা। আর তাই আসাম, বিহার ও ওড়িশাকে পৃথক পৃথক প্রদেশের মর্যাদা না দিয়ে বঙ্গভঙ্গ ঘটিয়ে ৭.৮ বাঙালি জনতাকে ভাগ-বাঁটোয়ারা করে দেওয়া হল অন্যান্য ভাষাভাষীদের সঙ্গে।
ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস ও অন্যান্য জাতীয়তাবাদী নেতারা বঙ্গভঙ্গের তীব্র বিরোধিতা করলেন। বাঙালির মধ্যে ধর্মের বিভাজন রেখা (পশ্চিমবঙ্গে হিন্দুরা এবং পূর্ববঙ্গে মুসলমানরা সংখ্যাগুরু ছিল) খাড়া করার ব্রিটিশ চক্রান্তটি তাঁরা উপলব্ধি করেছিলেন। তাছাড়া নবগঠিত বঙ্গপ্রদেশে (পশ্চিমবঙ্গ) বাঙালিদের সংখ্যা ছিল ১.৮ কোটি; এবং বিহারীদের সংখ্যা ছিল ২ কোটি; সেই সঙ্গে ছিল সংখ্যালঘু ওড়িয়া জনগোষ্ঠীও। এইভাবে বাঙালিদেরও পশ্চিমবঙ্গে করে দেওয়া হল সংখ্যালঘু। বাঙালি সমাজে যার প্রতিক্রিয়াও হল তীব্র।
বঙ্গভঙ্গ ঘোষিত হতেই শুরু হল তীব্র গণ-আন্দোলন। প্রথম দিকে সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ও কৃষ্ণকমল মিত্রের মতো নরমপন্থী নেতারা এই আন্দোলনের নেতৃত্ব দিলেও, শেষদিকে আন্দোলনের রাশ চলে গেল চরমপন্থীদের হাতে।
বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলনের যথার্থ সূচনা হল ১৯০৫ সালের ৭ অগস্ট কলকাতার টাউন হলে। এইদিন সেখানে এক বিরাট সমাবেশ হল। বঙ্গভঙ্গ কার্যকর হওয়ার দিন ধার্য হয়েছিল সেই বছরের ১৬ অক্টোবর। সেই দিনটি জাতীয় শোকের দিন ঘোষিত হল। পালিত হল অরন্ধন। মানুষ খালি পায়ে গঙ্গায় গিয়ে স্নান করল। রবীন্দ্রনাথ এই উপলক্ষ্যে লিখলেন তাঁর বিখ্যাত ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি। রাস্তায় রাস্তায় মিছিল বের হল। ‘বন্দেমাতরম্’ ধ্বনিতে মুখরিত হল আকাশ-বাতাস। বাংলা জুড়ে সেদিন রাখিবন্ধনও পালিত হল। হিন্দু ও মুসলমান একে অপরের হাতে বেঁধে দিল সম্প্রীতির প্রতীক রাখি।
তবে ফারাজি, ওয়াহবি ও তাইয়ুনির মতো মুসলিম গোষ্ঠী বঙ্গভঙ্গ-বিরোধীদের বিরুদ্ধে ব্রিটিশদের সমর্থন করেছিলেন। সেই সময় হিন্দুরা শিক্ষাদীক্ষা, ব্যবসাবাণিজ্য সব ক্ষেত্রেই মুসলমানদের থেকে অগ্রসর ছিল। হিন্দুদের অগ্রগতি মুসলমানদের কাছে ভীতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তাই মুসলমান সমাজের একটি অংশ যেন-তেন-প্রকারেণ হিন্দুদের থেকে বিচ্ছিন্ন হতে চাইছিল। অন্যদিকে, পূর্ববঙ্গে জমিদারদের অধিকাংশ হিন্দু হলেও তাঁদের বেশিরভাগ প্রজাই ছিল মুসলমান। মুসলমান কৃষকদের দুর্দশা ও হিন্দু জমিদারদের অত্যাচার সেই অঞ্চলে সাম্প্রদায়িক রঙে রঞ্জিত হয়। সর্বোপরি ১৯০৬ সালে মুসলিম লিগের জন্ম প্রমাণ করে দিল বাঙালি সমাজে সাম্প্রদায়িক বিভাজনের উদ্দেশ্যসাধনে ব্রিটিশরা সে যাত্রা কতখানি সাফল্য পেল।
ক্রমশ…