RSS

ভারতে বিপ্লবী জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ও উনিশশো পাঁচের বঙ্গভঙ্গ :: পর্ব ১

06 ডিসে.

উনিশ শতকের শেষদিকে এবং বিশ শতকের প্রথম বছরগুলিতে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের ভিতরে আবির্ভাব ঘটে এক তরুণ গোষ্ঠীর। এঁরা দলের বৃদ্ধ নেতাদের আদর্শ ও কর্মপদ্ধতিকে এক বিরাট প্রশ্নচিহ্নের মুখে ফেলে দেন। এই তরুণ দলের লক্ষ্য ছিল স্বরাজ। আর সেই লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য কংগ্রেসের চিরাচরিত আবেদন-নিবেদনের রাজনীতির বদলে আত্মশক্তি ও স্বাধীন পদ্ধতির উপরেই তাঁদের আস্থা ছিল বেশি। এই নতুন দলটিকেই বলা হত চরমপন্থী দল।

চরমপন্থী বা বিপ্লবী জাতীয়তাবাদের উন্মেষের কারণ

 

(১) ব্রিটিশ শাসনের স্বরূপ উদ্ঘাটন: উনিশ শতকের জাতীয়তাবাদী নেতারা তাঁদের অনুপূঙ্খ গবেষণা ও লেখালিখির মাধ্যমে ভারতে ব্রিটিশ শাসনের আসল মুখোশটি খুলে দিয়েছিলেন। বিস্তারিত তথ্য ও পরিসংখ্যান দাখিল করে তাঁরা দেখিয়ে দিয়েছিলেন যে, ভারতের অর্থনৈতিক দুরবস্থা ও ক্রমবর্ধমান দারিদ্র্যের জন্য ব্রিটিশ শাসন ছাড়া আর কিছুকেই দায়ী করা চলে না। দাদাভাই নওরোজির লেখা থেকে জানা গিয়েছিল, কীভাবে দেশের সম্পদ শোষণ করে (নওরোজির ভাষায় ‘ড্রেন অফ ওয়েলথ’ বা ‘সম্পদ-পাচার’) ভারতকে ‘রক্তশূন্য’ করে দিচ্ছে ব্রিটিশ সরকার। রমেশচন্দ্র দত্ত ও জি. ভি. যোশী দেখিয়ে দিয়েছিলেন ব্রিটিশ রাজস্বনীতির আসল উদ্দেশ্যটি। সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় সরকারি সংস্থায় কর্মীনিয়োগের ব্যাপারে ভারত সরকারের নীতি ও কার্যপদ্ধতির ফারাকটি তুলে ধরে তার সমালোচনা করেন। এই সব লেখালিখি দেশের যুবসমাজকে সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ করে তোলে।

 

(২) ১৮৯২ সালের কাউন্সিল আইনের বিরুদ্ধে অসন্তোষ: ১৮৯২ থেকে ১৯০৫ সালের মধ্যে ঘটে যাওয়া রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ জাতীয়তাবাদীদের ক্রমান্বয়ে অসন্তুষ্ট করে তুলেছিল। প্রথমত, ১৮৯২ সালের ভারতীয় কাউন্সিল আইন তাঁদের পুরোপুরি হতাশ করে। দ্বিতীয়ত, ১৮৯৮ সালে একটি বিশেষ আইন পাস করে বলা হয়, বিদেশি সরকারে বিরুদ্ধে কোনো রকম বিরুদ্ধ মতামতকে উস্কানি দেওয়াকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হবে। তৃতীয়ত, কলকাতা কর্পোরেশনে ভারতীয় সদস্যের সংখ্যা ৭৫ থেকে কমিয়ে ৫০ করে দেওয়া হয়। যে ২৫ জনকে ছেঁটে ফেলা হয়, তাঁরা ছিলেন কলকাতার জনগণের প্রতিনিধি। আবার এই ছাঁটাইয়ের মাধ্যমে কর্পোরেশনে ইউরোপীয়দের সংখ্যাগুরু করে দেওয়া হয়। চতুর্থত, ১৯০৪ সালে পাস হয় কুখ্যাত সরকারি গোপনীয়তা আইন। এর আগে ১৮৮৯ ও ১৮৯৮ সালের সরকারি গোপনীয়তা আইন প্রযোজ্য হত শুধু সামরিক গোপনীয়তার ক্ষেত্রে। ১৯০৪ সালের আইনের মাধ্যমে সামগ্রিক জনসমাজ ও সংবাদপত্রের সমালোচনার উপরেও এই আইন প্রযোজ্য হয়। সেই সঙ্গে রাজদ্রোহের সংজ্ঞাটিকে প্রসারিত করে রাজদ্রোহিতা মোকাবিলায় সরকারের হাতে নতুন অস্ত্র তুলে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। পঞ্চমত, শিক্ষাক্ষেত্রে অসন্তোষ। ব্রিটিশদের চালু করা প্রাথমিক ও কারিগরি শিক্ষাব্যবস্থা বন্ধ্যা হয়ে পড়েছিল। তদুপরি ১৯০৪ সালের ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয় আইন পাস করে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকে সরকারি নিয়ন্ত্রণকে আরো জোরদার করা ও উচ্চশিক্ষার গতি রোধ করার চেষ্টা করা হয়।

 

(৩) পাশ্চাত্য ভাবান্দোলনের বিরোধিতা: চরমপন্থী নেতৃত্ব পাশ্চাত্য ভাবাদর্শের অনুসরণ পছন্দ করতেন না। ভারতের ইতিহাস ও আধ্যাত্মিক ঐতিহ্য ছিল তাঁদের প্রধান অনুপ্রেরণা। তাঁরা বিভোর ছিলেন প্রাচীন ভারতের লুপ্তগৌরব পুনরুদ্ধারের স্বপ্নে। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, স্বামী বিবেকানন্দ, দয়ানন্দ সরস্বতী প্রমুখের রচনা তাই তাঁদের পাথেয় হয়। বৈদান্তিক বিবেকানন্দ যুবসমাজের মধ্যে আত্মমর্যাদাবোধের বীজ রোপণে সক্ষম হন। দয়ানন্দ পাশ্চাত্যের শ্রেষ্ঠত্ব-গৌরব খর্ব করে দেখিয়ে দেন যে, বৈদিক যুগে ভারত যখন উন্নতির চরম শিখরে ছিল, তখন ইউরোপ ছিল বর্বর পশুপালকদের আবাসস্থল মাত্র।

 

(৪) কংগ্রেসের কাজকর্মে অসন্তোষ: কংগ্রেসের যুব নেতৃত্ব আগেকার নেতৃবর্গের আবেদন-নিবেদনের রাজনীতির প্রতি তিতিবিরক্ত হয়ে ওঠেন। ব্রিটিশদের তথাকথিত ন্যায়বোধ ও ঔদার্যবোধে তাঁদের বিন্দুমাত্র আস্থা ছিল না। ‘শান্তিপূর্ণ ও সাংবিধানিক’ আন্দোলনকে তাঁরা ‘রাজনৈতিক ভিক্ষাবৃত্তি’ বলে ব্যঙ্গ করেন। বরং ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদের মোকাবিলায় ইউরোপীয় ধাঁচের বিপ্লবী পন্থা অবলম্বনের কথা প্রচার করতে থাকেন।

 

(৫) আন্তর্জাতিক ঘটনাবলির প্রভাব: সমসাময়িক আন্তর্জাতিক ঘটনাপ্রবাহ ইউরোপের শক্তিমত্তার ভিতকে অনেকটা খর্ব করে দিয়েছিল। মিশর, পারস্য, তুরস্ক ও রাশিয়ার জাতীয়তাবাদী আন্দোলন ভারতীয় জাতীয়তাবাদীদের মনেও নতুন আশার সঞ্চার করে। ১৮৬৮ সালে আধুনিক জাপানের উত্থান দেখিয়ে দেয়, এশিয়ার একটা পিছিয়ে পড়া দেশও পাশ্চাত্য নিয়ন্ত্রণ ছাড়াই মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে। দু-টি ঘটনা ভারতের জাতীয়তাবাদীদের বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছিল–১৮৯৬ সালে আবিসিনিয়া থেকে ইতালির সেনা প্রত্যাহার এবং ১৯০৫ সালে জাপানের হাতে রাশিয়ার পরাজয়। এই দুই ঘটনাই দেখিয়ে দেয়, ইউরোপীয় শক্তি আদৌ অপরাজেয় নয়। এবং প্রাচ্যের শক্তিও তাকে প্রতিহত করতে সক্ষম।

 

(৬) বিপ্লবী জাতীয়তাবাদ ও হিন্দুধর্মের নবজাগরণ: বাংলায় রাজনারায়ণ বসু ও অশ্বিনীকুমার দত্ত এবং মহারাষ্ট্রে বিষ্ণু শাস্ত্রী চিপলুঙ্করের হাত ধরে দেশে বিপ্লবী জাতীয়তাবাদের সূত্রপাত ঘটে। বিপ্লববাদের একজন প্রথম সারির নেতা ছিলেন বালগঙ্গাধর তিলক (১৮৫৭-১৯২০), পরবর্তীকালে যিনি পরিচিত হন ‘লোকমান্য তিলক’ নামে। বোম্বাই বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক তিলক ১৮৮০-এর দশকে একটি নব্য ইংরেজি বিদ্যালয় (পরবর্তীকালে যার নাম হয় ফার্গুসন কলেজ), মারাঠা নামে একটি ইংরেজি ও কেশরী নামে একটি মারাঠি সংবাদপত্র চালু করেন। ১৮৯৩ সালে মহারাষ্ট্রের গণেশ উৎসবে তিনি যোগ করেন স্বাদেশিকতার চেতনা। ১৮৯৫ সালে জনগণের মনে জাতীয়তাবাদের বীজ রোপণের জন্য চালু করেন শিবাজী উৎসব। ১৮৯৬-৯৭ সালে তিনি মহারাষ্ট্রে করদান-বিরোধী আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন। ফসল না হলে কৃষকদের কর না দেওয়ার পরামর্শ দেন। ১৮৯৭ সালে রাজদ্রোহিতার অভিযোগে সরকার তাঁকে কারারুদ্ধ করে। তিনি হয়ে ওঠেন আত্মত্যাগ ও নব্য জাতীয়তাবাদী চেতনার মূর্ত প্রতীক।

 

(৭) শিক্ষা ও আত্মমর্যাদাবোধের উন্মেষ: চরমপন্থী নেতৃত্ববর্গ ভারতীয় ভাবাদর্শে অনুপ্রাণিত হলেও, পাশ্চাত্যের প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক চেতনার আদর্শ গ্রহণে তাঁদের কোনো আপত্তি ছিল না। পাশাপাশি তিলক ও বিপিনচন্দ্র পালের মতো নেতারা ভারতীয় জনগণকে আত্মশক্তিতে আস্থা রাখার আহ্বান জানান। চরমপন্থী বিপ্লবী আদর্শ মানুষের সমর্থন পেতে থাকে। ব্রিটিশ শাসনের শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে তাঁদের প্রতিবাদও জোরদার হয়।

 

(৮) দুর্ভিক্ষ ও মহামারী: ১৮৯৬-৯৭ সালে একটি বড়ো দুর্ভিক্ষ হয়। এই দুর্ভিক্ষের কবলে পড়েন প্রায় দু কোটি মানুষ। পাশাপাশি পুনে ও কলকাতায় প্লেগও মহামারীর আকার নেয়। এই দুই ক্ষেত্রেই সাধারণ মানুষের প্রতি ইংরেজ সরকারের উদাসীনতা মানুষকে চরম ক্ষুব্ধ করে তোলে।

 

ক্রমশ…

 

 

 

ট্যাগ সমুহঃ

মন্তব্য করুন

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  পরিবর্তন )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  পরিবর্তন )

Connecting to %s

 
%d bloggers like this: