টিনটিন আমার বাল্যবন্ধু। আক্ষরিক অর্থেই। সবাই জানে, আমি হ্যারি পটার সিরিজের ‘ডাইহার্ড ফ্যান’। কিন্তু সে কতদিন? হ্যারির সঙ্গে আমার মোলাকাত কৈশোরের উপান্তবেলায়, গুরুজনেদের ভাষায় যাকে বলে দামড়া বয়স। টিনটিন আমার জীবনে এসেছিল ‘জীবনের প্রথম দোলায়’।
সেই টিনটিনকে নিয়ে অনেকদিন ধরেই সিনেমা হবে শুনছিলাম। স্পিলবার্গ মশাই ১৯৮৩ সালে হার্জের (একালের বইয়ে ছাপা হয় অ্যার্জে, আমার সংগ্রহের প্রাচীন সংস্করণের সবেতেই হার্জে, তাই হার্জেই লিখলাম) মৃত্যুর পর তাঁর পত্নীর কাছ থেকে ফিল্মরাইট কেনেন। কিন্তু নানা ঝঞ্ঝাটে গত দশকের আগে ছবির কাজ শুরু করতে পারেননি। অবশেষে প্রচুর পরিশ্রমের পর তৈরি করলেন ‘মোশন ক্যাপচার’ ছবিঅ্যাডভেঞ্চার্স অফ টিনটিন: দ্য সিক্রেট অফ দ্য ইউনিকর্ন। ‘মোশন ক্যাপচার’ কী? সহজ ভাষায় জিনিসটি হল কোনো কিছুর নড়াচড়াকে রেকর্ড করে তা থেকে একটি ডিজিটাল মডেল তৈরি করা। সিনেমার ক্ষেত্রে মোশন ক্যাপচার বা মোক্যাপ বলতে বোঝায়, অভিনেতা-অভিনেত্রীদের নড়াচড়া ক্যামেরাবন্দী করে, তাকে টুডি বা থ্রিডি কম্পিউটার অ্যানিমেশনে ডিজিট্যালাইড করা। সাধারণ অ্যানিমেশনে আঁকার ভূমিকাটি হয় প্রাথমিক ও মুখ্য। কিন্তু এক্ষেত্রে বিশেষ স্টেজে বিশেষ পোষাকে অভিনেতা-অভিনেত্রীদের অভিনয় করতে হয়, সেটার উপর অ্যানিমেটরের খোদকারির ফলে তৈরি হয় মোক্যাপ অ্যানিমেশন। বাঙালি বিশেষজ্ঞেরা যাকে প্রায়শই ‘কম্পিউটারের খেলা’, ‘স্পেশাল এফেক্টের খেলা’, ‘পুতুল-পুতুল অ্যানিমেশন’ ইত্যাদি বিশেষণে ভূষিত করে থাকেন!
শুনেছি, স্পিলবার্গ মশাই প্রথমে শুধু কুট্টুসকেই (আন্টিনিকেতনী পাঠক ক্ষমা করবেন, আমি বাংলা নামগুলিতেই বেশি স্বচ্ছন্দ) মোক্যাপে ধরতে চেয়েছিলেন। কিন্তু পরে প্রযোজক পিটার জ্যাকসন পরামর্শ দেন গোটা ছবিটাকেই মোক্যাপে ধরতে। পিটার জ্যাকসন মোক্যাপে সিদ্ধহস্ত। তাঁর পরিচালনায় লর্ড অফ দ্য রিংস সিরিজের গলাম চরিত্রে তিনি মোক্যাপকে তিনি নিছক অ্যানিমেশন জাদু থেকে শিল্পের রূপ দিয়েছিলেন। তাই পরামর্শটা স্পিলবার্গ মশাইয়ের মনে ধরল। গলাম চরিত্রের অভিনেতা অ্যান্ডি সারকিস এলেন ক্যাপ্টেন হ্যাডকের চরিত্রে। ন্যানি ম্যাকফি ছবির মিষ্টি চেহারার নজরকাড়া ছোকরা টমাস স্যাংস্টারের টিনটিন হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ছবি দেরিতে শুরু হওয়ায় সে বাদ পড়ল। এল জ্যাকসন পরিচালিত কিং কং ছবির সেই ছিঁচকে চোর-মাল্লা জিমির চরিত্রে অভিনয় করা জেমি বেল। আর খলনায়ক আইভান আইভানোভিচ সাখারিনের ভূমিকায় ‘জেমস বন্ড’ ড্যানিয়েল ক্রেগ। প্রত্যেকেই স্ব স্ব ভূমিকায় চুটিয়ে অভিনয় করেছেন। সুতরাং এখানেই বোঝা যাচ্ছে, মোক্যাপের মহিমা। লাইভ-অ্যাকশন ছবি হলে শত মেকআপেও এঁরা হার্জে ঘরানার সঙ্গে নিজেদের চেহারা খাপ খাওয়াতে পারতেন না। মামুলি টুডি বা থ্রিডি অ্যানিমেশনের কথা বাদ দিলাম, ওসব প্রাগৈতিহাসিক ব্যাপারস্যাপার!
এবার আসি গল্পের কথায়। অ্যাডভেঞ্চার্স অফ টিনটিন: দ্য সিক্রেট অফ দ্য ইউনিকর্ন তৈরি হয়েছে টিনটিনের তিনটি বই জুড়ে–কাঁকড়া রহস্য, বোম্বেটে জাহাজ ও লাল বোম্বেটের গুপ্তধন। গল্পের বৃত্ত শেষ দুটি বই নিয়ে। কাঁকড়া রহস্য-এর পটভূমিটা গল্পের প্রয়োজনে একটু কপিপেস্ট করা হয়েছে মাত্র। ছবিটা দেখার আগে এর সার্থকতা আমার মনে একটু সন্দেহ ছিল। ক্যাপ্টেন হ্যাডকের সঙ্গে টিনটিনের প্রথম আলাপ সেই গল্পে। এবং সে আলাপও যথেষ্ট নাটকীয়। সেই নাটকীয়তাটা তুলে আনার জন্যই বোধহয় ওই কপিপেস্টটার প্রয়োজন হয়েছিল। তবে কাঁকড়া রহস্য থেকে নেওয়া যে দৃশ্যটি মনে গেঁথে থাকল, সেটা হল মরক্কোর মরুভূমিতে মদের অভাবে ক্যাপ্টেনের হ্যালুসিনেশন। বাড়িয়াড়ির চূড়া ডিঙিয়ে সমুদ্রের স্রোত ভেঙে কল্প-ইউনিকর্নের এগিয়ে আসার ওই দৃশ্যটাই সিনেমায় কাঁকড়া রহস্য-এর আঁচল-টানাটাকে অকারণ হতে দেয়নি। এটা বাদ দিলে মূল গল্পদুটোতেও অনেক পরিবর্তন এনেছেন স্পিলবার্গ মশাই। আদত বইয়ের খলনায়ক-যুগল ম্যাক্স ভ্রাতৃদ্বয় এখানে অনুপস্থিত, বরং সাদাসিধা শিল্পসংগ্রাহক আইভান আইভানোভিচ সাখারিনকেই দেখানো হয়েছে টিনটিনের দুর্ধর্ষ দুশমন হিসেবে। যদিও সাখারিনের চরিত্রায়ণে পরবর্তীকালের কমিকসের রাস্তাপপুলসের ছায়া স্পষ্ট। মনে করুন, লোহিত সাগরের হাঙর-এ গর্গনজোলার ছদ্মবেশধারী রাস্তাপপুলসের জাহাজে বিয়াঙ্কা কাস্তাফিয়োরার উপস্থিতি। তুলনা করুন, ওমর বেন সালাদের (এই লোকটি কাঁকড়া রহস্য-এ গাধায় চড়ে ঘুরে বেড়ানো কুখ্যাত চোরাচালানকারী, কিন্তু ছবিতে বেচারা-বেচারা চেহারার নিরীহ আমির) প্রাসাদে বিয়াঙ্কা কাস্তাফিয়োরার ‘কনসর্ট’-রূপে সাখারিনের উপস্থিতি। কাস্তাফিয়োরাকে যখন আনলেনই স্পিলবার্গ সাহেব, শিল্পসংগ্রাহক সাখারিনকে ছাড়ান দিয়ে রাস্তাপপুলসকে আনতে কী ক্ষতি ছিল?
টিনটিনের চরিত্রটির নানা অভিব্যক্তি খুব সুন্দর করে ধরা হয়েছে ছবিতে। এই চরিত্রটি প্রায় নিখুঁত হয়েছে বলতে হবে। তবে ক্যাপ্টেন হ্যাডকের চরিত্রটা কিছুটা জৌলুস হারিয়েছে ছবিতে। অ্যান্ডি সারকিস অনবদ্য। তবুও। তার একটাই কারণ, ক্যাপ্টেনের মুখে গালাগালির অভাব। ক্যাপ্টেনকে ওভাবে দাঁত মুখ খিঁচিয়ে ‘নো বডি টেকস মাই শিপ’ বলতে আগে কখনও শুনিনি। তাঁর বুলি ছিল আলাদা। সে বুলির জন্যই ক্যাপ্টেন হ্যাডক হল ক্যাপ্টেন হ্যাডক। তবে তাঁর মদ্যপ্রিয়তার দিকটা যথাযথভাবে ফুটিয়েছেন স্পিলবার্গ।
মানিকজোড় জনসন রনসনের উপস্থিতি বড়ো প্রক্ষিপ্ত মনে হয়েছে। অ্যারিস্টাইডিস সিল্ক চরিত্রটাও। সিল্কের পকেটমারা দেখাতে গিয়ে স্পিলবার্গ মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন। কিন্তু শেষপর্যন্ত সেটা গল্পের সার্থক সাবপ্লট হতে পারল না। শুধু কিছুটা হাস্যরস সৃষ্টি করল, এটুকুই যা পাওনা। অথচ বোম্বেটে জাহাজ-এ এই চরিত্রদুটোকে সেরকম লাগেনি। সিল্কের পকেটমারার ব্যাপারটা সেখানে গল্পের বিশেষ প্রয়োজনে লেগেছে। জনসন রনসনকে নিয়ে স্ল্যাপস্টিক হিউমার সৃষ্টি করার ব্যাপারটা কিছুটা চার্লি চ্যাপলিনীয় হয়ে গেছে, একটু বাড়াবাড়িই মনে হয়েছে! বরং ছোট্ট উপস্থিতিতে দারুণ লেগেছে নেস্টরকে। কাস্তাফিয়োরার চরিত্রটির প্রয়োগ এক কথায় বলব, আশ্চর্য!
গল্পে কিছু অদ্ভুত সুন্দর ডিটেলিং ব্যাবহার করেছেন স্পিলবার্গ। তার মধ্যে একটি, মানিকজোড়ের তাড়া খেয়ে সিল্কের পলায়ন-প্রচেষ্টার পরের সেই দৃশ্যটি। যেখানে মানিকজোড়-সিল্ক কথোপকথনের পশ্চাদপটে এক উগ্রমেজাজি বৃদ্ধাকে নিয়ে ঘটে যাচ্ছে এক মজার কাণ্ড। অথবা, শত্রুজাহাজের মাল্লায় মাথায় বোতলের আঘাত করতে যাওয়ার সময় টিনটিনের হাত থেকে সেই বোতলটি কেড়ে ক্যাপ্টেনের মদ খাওয়া। দু-টি ‘চেজিং’ দৃশ্য আছে। একটি, অপহৃত টিনটিনকে ধাওয়া করে কুট্টুসের কারাবুজান জাহাজে পৌঁছানো আর অন্যটি টিনটিন ও ক্যাপ্টেনের চিরকুট ধাওয়া করা। এদুটি দৃশ্য হার্জীয় নয়, বিশুদ্ধ স্পিলবার্গীয়। কিন্তু শ্বাসরুদ্ধকর ও মজার। একে মুক্তমনেই নম্বর দেওয়া যায়।
লাল বোম্বেটের গুপ্তধন এখানে প্রান্তিক। স্পিলবার্গ-জ্যাকসন জুটি এর সিকোয়েল বানাতে চাইছেন বোধহয়। যদি হয়, তাহলে সিকোয়েলটিই বলবে শেষ বইয়ের এই অতিসংক্ষিপ্ত প্রয়োগ কতটা সার্থক হয়েছে। কারণ, এখনও এর একটা অপূর্ণতা রয়ে গেছে, যার নাম কাথবার্ট ক্যালকুলাস।
সাজেদুল ওয়াহিদ নিটোল
নভেম্বর 20, 2011 at 7:18 অপরাহ্ন
ভালো লাগল।
অর্ণব দত্ত
নভেম্বর 20, 2011 at 8:25 অপরাহ্ন
ধন্যবাদ, ভাই নিটোল। 😀
Indranil Modak
নভেম্বর 27, 2011 at 9:36 অপরাহ্ন
Good and hard working explanation & criticism.
I don’t have opportunity to get movies unless we downloaded this movie today.
Lets see.
Take care.
Indranil Modak
Rep. Of Benin
Cotonou