বাগবাজার সর্বজনীন দুর্গোৎসব ও মেলা কলকাতার দুর্গাপুজোর একটি অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। উত্তর কলকাতার বাগবাজার অঞ্চলে গিরিশ পার্কের কাছে একটি বিশাল মাঠে এই পূজা ও মেলার আয়োজন করা হয়।
বাগবাজার সর্বজনীনের পুজো কলকাতার সবচেয়ে পুরনো সর্বজনীন দুর্গাপুজোগুলির মধ্যে একটি। ১৯১৯ সালে বাগবাজারের বাসিন্দারা প্রথম এই পুজোর আয়োজন করেছিলেন। প্রথম বার পুজো হয়েছিল নেবুবাগান লেন ও বাগবাজার স্ট্রিটের সংযোগস্থলে সরকার হাউসে। সেই সময় এই পুজোর নাম ছিল “নেবুবাগান বারোয়ারি দুর্গাপূজা”। তারপর তিন বছর সরকার হাউসেই অনুষ্ঠিত হয়েছিল পুজো। ১৯২৪ সালে পুজো সরে আসে বাগবাজার স্ট্রিট ও পশুপতি বসু লেনের সংযোগস্থলে। তার পরের বছর পুজো হয় কাঁটাপুকুরে। ১৯২৬ সালে সমাজকর্মী নগেন্দ্রনাথ ঘোষাল ও আরও কয়েক জন বিশিষ্ট ব্যক্তি ভার নেন এই পুজোর। তাঁদের প্রচেষ্টায় সুষ্ঠভাবে পুজো করার জন্য গড়ে ওঠে একটি সংগঠন। ১৯২৭ সালে পুজো হয় বাগবাজার কালীমন্দিরে। ১৯২৯ সালে প্রথম এই পুজো উপলক্ষ্যে মেলা বসে।
১৯৩০ সালে কলকাতা পৌরসংস্থার অল্ডারম্যান দুর্গাচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় সংগঠনের সভাপতি নির্বাচিত হন। এই সময় থেকেই পুজোর সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়ে স্বদেশী আন্দোলনের ধ্যানধারণা। পুজোর নাম বদলে হয় “বাগবাজার সর্বজনীন দুর্গোৎসব ও মেলা”। যে দুর্গানগর মাঠে এখন মেলা বসে, সেটি আসলে ছিল কলকাতা পুরসভার রাস্তা-সারাই বিভাগের মেটাল-ইয়ার্ড। দুর্গাচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় কলকাতার তৎকালীন মেয়র সুভাষচন্দ্র বসুকে (যিনি পরে পরিচিত হয়েছিলেন নেতাজি সুভাষ নামে) অনুরোধ করেন এখানে মেলা আয়োজনের অনুমতি দেওয়ার জন্য। সুভাষচন্দ্র অনুমতি দেন। সেই সঙ্গে দেন পাঁচশো টাকা চাঁদাও। সেই থেকে এইখানেই চলে আসছে বাগবাজার সর্বজনীনের পুজো। ১৯৩৮ ও ১৯৩৯ সালে সুভাষচন্দ্র প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত ছিলেন বাগবাজার সর্বজনীনের পুজোর সঙ্গে। এই দুই বছর তিনিই ছিলেন পুজোকমিটির সভাপতি। সুভাষচন্দ্র ছাড়াও সন্তোষ কুমার বসু, আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়, হরিশঙ্কর পাল প্রমুখ ব্যক্তিবর্গও এই পুজোর সঙ্গে জড়িত ছিলেন এককালে।
আশ্বিন শুক্লা পঞ্চমীর দিন হয় পুজোর উদ্বোধন। লক্ষ্মীপুজোর দিন হয় সমাপ্তি। মহাষ্টমীর সকালে বীরাষ্টমী উৎসব ও বিজয়াদশমীর সকালে সিঁদুর খেলা এই পুজোর অন্যতম বৈশিষ্ট্য। অনুশীলন সমিতির সদস্য বিপ্লবী পুলিন দাস এই পুজোর বীরষ্টমী উৎসবের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন।
বাগবাজার সর্বজনীনের বৈশিষ্ট্য হল দুর্গাপুজোর সাবেকিয়ানা ধরে রাখা। এখানে থিমপুজো হয় না। এমনকি বিগত কয়েক দশক ধরে প্রতিমাও তৈরি হচ্ছে একই ধাঁচে। একচালা আকর্ণনয়না দেবীমূর্তি। শোলার সাজসজ্জা নয়নাভিরাম। মণ্ডপসজ্জাও এখানকার দেখার মতো হয়। থিমের হুজুগে মাথা না গলিয়েও শুধুমাত্র ঐতিহ্য আর সাবেকিয়ানাকে সম্বল করেই যে বছরের পর বছর কলকাতার এক নম্বর পুজোর তালিকায় সগৌরবে বিরাজ করা যায়, সেটাই জানান দিয়ে যায় বাগবাজার সর্বজনীন।