RSS

উমা

12 সেপ্টে.

মূল রচনা: ডব্লিউ. জে. উইলকিনস (হিন্দু মিথোলজি: বৈদিক অ্যান্ড পৌরাণিক থেকে)

অনুবাদ: অর্ণব দত্ত

  উমা শব্দের অর্থ ‘জ্ঞান’ এবং দেবীরূপে উমা হলেন ‘দিব্য জ্ঞান’।

উমা হল সেই নাম, যে নামে শিবের পত্নী সর্বপ্রথম পরিচিত। পবিত্র ধর্মগ্রন্থগুলিতে তাঁকে দেখা যায় নানা রূপে, জানা যায় নানা নামে; কিন্তু যেহেতু অধিক পরিচিত রূপ ও নামগুলির সঙ্গে কতকগুলি নির্দিষ্ট কিংবদন্তি জড়িত, তাই সেগুলিই যথাসম্ভব কালানুক্রমিকভাবে দেওয়ার চেষ্টা করা হল।

কথিত আছে, দেবী উমা ছিলেন ব্রহ্মার পুত্র দক্ষের কন্যা। ভিক্ষোপজীবীর ঘরে মেয়ের বিয়ে দিতে ভারি আপত্তি ছিল দক্ষের। কিন্তু ব্রহ্মাই তাঁকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে রাজি করান। শিব হলেন মহাদেব; সেই সূত্রে তাই উমাও হলেন মহাদেবী। দেবী উমার অপর নাম সতী। এই নামের পিছনে একটি গল্প আছে। দক্ষ একবার শিবকে অপমান করার জন্য জামাইকে আমন্ত্রণ না জানিয়েই এক মহাযজ্ঞের আয়োজন করলেন। তখন স্বামীর অপমানে অপমানিতা হয়ে উমা স্বয়ং যজ্ঞাগারে প্রবেশ করে দেবতা-ব্রাহ্মণের সামনেই যজ্ঞের আগুনের ঝাঁপ দিয়ে আত্মাহুতি দিলেন। সেই থেকেই তিনি হলেন সতী। অন্য মতে, তিনি আপন মহিমাবলে সতী হয়েছিলেন। সতী শব্দটির অর্থ ‘সত্যবতী বা পবিত্র নারী’। সেকালে যে সমস্ত বিধবারা স্বামীর চিতায় স্বেচ্ছায় আত্মাহুতি দিতেন, তাঁদেরও সতী বলা হত। একটি প্রাচীন ধর্মগ্রন্থে উমার অপর নাম অম্বিকা। উক্ত গ্রন্থমতে তিনি রুদ্রের বোন। যদিও অন্য একটি ধর্মগ্রন্থের মতে, তিনি রুদ্রের স্ত্রী।

“আমি যতদূর জানি, যে প্রাচীনতম গ্রন্থে উমা নামটি পাওয়া যায়, সেটি হল তলবকার বা কেন উপনিষদ। উক্ত গ্রন্থের তৃতীয় পর্বে রয়েছে, একদা ব্রহ্মের শক্তিতে যুদ্ধজয়ী দেবগণ ব্রহ্মকে অবগত না হয়ে জয়ের কৃতিত্ব নিজেরা নিতে উদ্যত হয়েছিলেন। তখন ব্রহ্ম তাঁদের ভ্রান্তিনিরসনের জন্য উপস্থিত হলেন দেবতাদের সকাশে। দেবতারা তাঁকে চিনতেন না। তাই তাঁরা অগ্নি ও বায়ুকে পাঠালেন সেই আগন্তুক কে তা জেনে আসতে। ব্রহ্মের কাছে এলেন দুই দেবতা। তাঁদের একজনের ছিল সবকিছু দগ্ধ করার এবং অন্য জনের ছিল সব কিছু উড়িয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা। ব্রহ্ম তাঁদের সামনে একমুঠো ঘাস রেখে বললেন তা পোড়াতে বা উড়িয়ে দিতে। কিন্তু এই সামান্য কাজে তাঁরা হলেন অসমর্থ। ফিরে এলেন বিফলকাম হয়ে। ইন্দ্রকে বলা হল আগন্তুকের পরিচয় জেনে আসার জন্য। ইন্দ্র বললেন, ‘তাই হোক।’ তিনি গেলেন আগন্তুকের কাছে। কিন্তু কাছে যেতে না যেতেই আগন্তুক অদৃশ্য হয়ে গেলেন। আকাশে দেখা দিলেন এক পরমারূপবতী নারী। তিনিই উমা হৈমবতী। ইন্দ্র তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘ওই আগন্তুক কে ছিলেন?’ উমা বললেন, ‘তিনি ব্রহ্ম। তোমরা তাঁরই বিজয়ে আনন্দোৎসব করছ।’ এইভাবে ইন্দ্র জানলেন ব্রহ্মকে। এই কাহিনির টীকাকার লিখেছেন, উমা শব্দের অর্থ ‘জ্ঞান’ এবং দেবীরূপে উমা হলেন ‘দিব্য জ্ঞান’।” (ম্যুর, ও.এস.টি., চার।৪২০।)

অধ্যাপক ওয়েবার (ম্যুর, ও.এস.টি., চার।৪২৫।) বলেছেন: “শিবের মধ্যে যেমন অগ্নি ও রুদ্রের সম্মিলিত রূপটি দেখা যায়, তেমনি শিবের স্ত্রীও হলেন একাধিক দেবীসত্ত্বার সম্মিলিত রূপ। প্রমাণ তাঁর বিশেষণগুলি। উমা, অম্বিকা, পার্বতী ও হৈমবতী নামগুলি রুদ্রের স্ত্রীর প্রসঙ্গক্রমে আসে। অন্যদিকে কালী ইত্যাদি নামগুলি অগ্নির স্ত্রীর দিকে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। গৌরী ও অন্যান্য নামগুলি সম্ভবত সকল অমঙ্গলের দেবী নিঋতির প্রতি প্রযুক্ত ছিল।” তিনি আরও বলেছেন: “এর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য একটি উদাহরণ পাই মহাভারতে। সেখানে যুধিষ্ঠির দুর্গার স্তব করতে গিয়ে তাঁকে বলেছেন যশোদাকৃষ্ণা, ‘নন্দ গোয়ালার গৃহে জাতা’, ‘বাসুদেবের ভগিনী’, ‘কংসের শত্রু’, ‘সঙ্কর্ষণের বৈশিষ্ট্যযুক্তা’। কালীকে যখন আমরা উমা অর্থাৎ ‘দিব্যজ্ঞানে’র প্রতিমূর্তি রূপে দেখি, তখন এই জাতীয় ব্যাখ্যা জরুরি হয়ে পড়ে।”

রামায়ণে (ম্যুর, ও.এস.টি., চার।৪৩০।) উল্লিখিত নিম্নলিখিত গল্পটিতে উমাকে হিমালয় (হিমবৎ) ও মেনকার (মেনা) কন্যা রূপে বর্ণনা করা হয়েছে; সম্ভবত এই গল্পের লেখকের মনে উমা ও পার্বতী নামদুটি একসূত্রে বাঁধা পড়েছিল: “হিমালয় গিরিরাজ ও ধাতুর এক মহাখনি। তাঁর দুই কন্যা জন্মে – নদীশ্রেষ্ঠা গঙ্গা ও দেবীশ্রেষ্ঠা উমা। দুই কন্যাই ছিলেন সমান রূপবতী। মেরুকন্যা ক্ষীণকটি মেনকা ছিলেন হিমালয়ের স্ত্রী ও সেই দুই কন্যার মা। তাঁদের জ্যেষ্ঠা কন্যা ছিলেন গঙ্গা। দ্বিতীয়া কন্যা উমা। তিনি কঠোর তপস্যা করেছিলেন এবং তপস্বিনীর জীবন যাপন করতেন। এই যোগীপূজিতা বিশ্ববন্দিতা কন্যাটিকে হিমালয় সমর্পণ করেন অদ্বিতীয় দেবতা রুদ্রের হাতে।”

হরিবংশে  (ম্যুর, ও.এস.টি., চার।৪৩২।) হিমালয় ও মেনকার তিন কন্যার উল্লেখ রয়েছে, কিন্তু তাঁদের নামের তালিকায় গঙ্গা নেই। “তাঁদের (পিতৃগণ) মানসকন্যা ছিলেন গিরিরাজ হিমবতের সুযোগ্যা পত্নী মেনকা। গিরিরাজের ঔরসে মেনকার গর্ভে তিন কন্যার জন্ম হয় – অপর্ণা, একপর্ণা ও একপাটলা। এই তিন কন্যা এমন এক ভয়ানক তপস্যা করলেন, যে তপস্যা করতে দেবদানব কেউই সাহস পেত না। তাঁদের তপস্যা সকল বিশ্বকে শঙ্কিত করে তুলল। একপর্ণা একটি মাত্র পাতা খেয়ে ও একপাটলা একটিমাত্র পাটল অর্থাৎ নাগকেশর ফুল খেয়ে তপস্যা করতেন। অপর্ণা কিছুই খেতেন না। তাঁর মা মেয়ের স্বাস্থ্যের কথা ভেবে তাঁকে বারণ করতে গিয়ে বলেন, ‘উ মা’ (ওহো, না)। দেবী আপন জননী কর্তৃক এই নামে সম্বোধিতা হয়ে জগতে পরিচিতা হন উমা নামে। তিন কন্যা কঠোর তপস্যা বলে পবিত্র হয়ে দিব্যজ্ঞান লাভ করেন। উমা ছিলেন তিন জনের মধ্যে জ্যেষ্ঠা ও শ্রেষ্ঠা। তাঁর তপস্যাফলে তিনি মহাদেবকে [পতিরূপে] লাভ করেছিলেন।”

আজকে যেসব নামে উমাকে পূজা করা হয়, হিন্দুদের প্রাচীন ধর্মগ্রন্থে তার অনেকগুলিই পাওয়া যায়। তবে সেগুলি কিন্তু সেই সময়ে শিবের স্ত্রীর নাম হিসেবে বর্ণিত হয়নি। আমরা দেখেছি, উমা শব্দের অর্থ ছিল ‘জ্ঞান’; অম্বিকা ছিলেন রুদ্রের বোন; দুর্গা “তৈত্তিরীয় আরণ্যকের একটি স্তোত্রে উল্লিখিত যজ্ঞশিখার অপর নাম এবং কালী মাণ্ডুক্য উপনিষদের বর্ণনা অনুযায়ী অগ্নির সাতটি জিহ্বার একটি।” (গোল্ডস্টিকার, চেম্বার’স সাইক্লোপিডিয়া, “উমা”)

কথিত আছে, উমা কার্তিকেয়ের জননী, এবং এক অর্থে গণেশেরও। তবে একথা স্পষ্ট নয় যে, উমা, নাকি তাঁর পরবর্তী জন্মের রূপ পার্বতী এই দুই পুত্রের জননী।

“কুর্মপুরাণ”-এ উমার জন্মের একটি গল্প আছে। এই গল্পটি আমাদের নিয়ে যায় দক্ষকন্যা হিসেবে তাঁর জন্মেরও আগের সময়ে। “ব্রহ্মার পুত্রগণ মানবসমাজে বংশবৃদ্ধি না ঘটিয়ে তপস্বীর জীবনযাপন করছেন দেখে ব্রহ্মা ক্রুদ্ধ হলেন। তাঁর ক্রোধ থেকে এক অর্ধ্ব-নারী অর্ধ্ব-পুরুষ মূর্তির জন্ম হল। ব্রহ্মা তাঁকে বললেন, ‘নিজেকে দ্বিখণ্ডিত কর।’ এই বলে তিনি অদৃশ্য হয়ে গেলেন। পুরুষার্ধ্বটি হলেন রুদ্র এবং নারী-অর্ধ্বটি সতী নামে দক্ষকন্যা রূপে পরিচিতা হলেন। তাঁর সঙ্গে বিবাহ হল রুদ্রের বিবাহ। কিন্তু পিতা কর্তৃক অপমানিতা হয়ে তিনি দেহত্যাগ করলেন। পরে হিমালয় ও মেনকার কন্যারূপে নিলেন জন্ম তখন তাঁর নাম হল পার্বতী।”

লক্ষ্যণীয় বিষয় এই যে, যদিও উমাকে শিবের স্ত্রী বলা হয়, কিন্তু আসলে তিনি শিবের শক্তি বা সক্রিয়া সত্ত্বাটিরই প্রতীক। শিবের সঙ্গে যথাযথরূপে মিলনের জন্যই উমা দেহধারণ করেন। ঠিক যেমন বিষ্ণুর শক্তি লক্ষ্মী, সীতা ইত্যাদি রূপে প্রকাশিতা হন।

(আলোকচিত্র: অর্ণব দত্ত)

 

ট্যাগ সমুহঃ

মন্তব্য করুন

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  পরিবর্তন )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  পরিবর্তন )

Connecting to %s

 
%d bloggers like this: