“তাঁর (রবীন্দ্রনাথ) আরো একটি আশ্চর্য ক্ষমতা ছিল। … সংলাপের আসরে ব’সে অনুরুদ্ধ হলে রবীন্দ্রনাথ মুখে মুখে নূতন গল্প ও উপন্যাসের প্লট তৈরি করে দিতে পারতেন।” – যাঁদের দেখেছি, দ্বিতীয় পর্ব, হেমেন্দ্রকুমার রায়।
আধুনিক লেখকদের ঢাউস ‘রচনাসংগ্রহে’র তুলনায় রবীন্দ্রনাথের কথাসাহিত্যকে ক্ষীণকায়ই বলতে হয়। তাঁর গল্পসংখ্যা মেরেকেটে শ’খানেক, উপন্যাস ১৩টি মোটে। গান বা কবিতার মতো অকাতরে গল্প-উপন্যাস লেখেননি তিনি। কিন্তু গল্পের প্লট রচনায় তিনি যে মোটেও কাতর ছিলেন না, তা জানা যায় তাঁর সমসাময়িকদের লেখা স্মৃতিচারণ ও অন্যান্য রচনা থেকে। বিস্মিত হতে হয় এই দেখে যে কত প্রথম সারির সাহিত্যিক কবির থেকে প্লট সংগ্রহ করেছেন তাঁদের গল্পের জন্য। এই সব প্লট থেকে জন্ম নিয়েছে বাংলা সাহিত্যের কালজয়ী সব কীর্তি। কিন্তু আড়ালে থেকে গেছেন এই সব জনকের জন্মদাতা পিতা। এমনকি অনেক সময় এটুকুও জানা যায়নি, কবি ঠিক কাকে কোন প্লটটি দিয়েছেন বা কে কবির লেখা প্লটটি দিয়ে ঠিক কোন গল্পটি লিখেছেন।
প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের ‘দেবী’ গল্পটি বহুপঠিত এবং সত্যজিৎ রায়ের চলচ্চিত্রের কল্যাণে বহু-আলোচিত। নব-কথা গল্পসংকলন-ভুক্ত এই গল্পটির প্লটও রবীন্দ্রনাথের রচনা। নব-কথা-র দ্বিতীয় সংস্করণে প্রভাতকুমার নিজেই সেকথা উল্লেখ করেন।
অক্ষয়চন্দ্র চৌধুরী ও তাঁর স্ত্রী শরৎকুমারী চৌধুরাণী ঠাকুরবাড়ির বিশেষ ঘনিষ্ঠ ছিলেন। শরৎকুমারীর সাহিত্যরচনার অনুরাগী ছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথও। এই শরৎকুমারীকে রবীন্দ্রনাথ একটি প্লট দিয়ে গল্প রচনা করতে অনুরোধ করেছিলেন। পাঁচ-সাত দিনের মধ্যেই শরৎকুমারী সেই প্লট অবলম্বনে লিখে ফেলেন তাঁর ‘যৌতুক’ গল্পটি। সম্ভবত রবীন্দ্রনাথ সেকথা জানতেন না। একই প্লট তিনি চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়কেও দেন। চারুচন্দ্র সেই প্লট অবলম্বনে লেখেন ‘চাঁদির জুতো’ গল্পটি, যেটি স্থান পায় তাঁর বরণডালা গল্পসংকলনে।
চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় অবশ্য ওই একটি গল্পই রবীন্দ্র-রচিত প্লট অবলম্বনে লেখেননি। রবীন্দ্রনাথ চারুচন্দ্রকে বলেছিলেন, “তোমরা সব বড়ো পরে জন্মেছ। বছর কুড়ি আগে যদি জন্মাতে তা হলে তোমাদের আমি দেদার প্লট দিতে পারতাম। তখন আমার মনে হ’ত আমি দু’হাতে প্লট বিলিয়ে হরির লুট দিতে পারি।” হেমেন্দ্রকুমার রায়ের লেখা থেকে জানা যায়, “বন্ধুবর চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় ঐভাবে রবীন্দ্রনাথের মুখে মুখে সৃষ্ট কয়েকটি আখ্যানবস্তুর সদ্ব্যবহার করতে পেরেছিলেন।” চারুচন্দ্রের চারটি উপন্যাসের প্লট রবীন্দ্রনাথের থেকে পাওয়া – স্রোতের ফুল, দুই তার, হেরফের ও ধোঁকার টাটি।
আরেক বিখ্যাত সাহিত্যিক রবীন্দ্রনাথের থেকে একটি প্লট পেয়েছিলেন। তিনি হলেন বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায় ওরফে বনফুল। নির্মোক-এর অমর নামক চরিত্রটি বনফুল সৃষ্টি করেছিলেন পত্রযোগে প্রাপ্ত রবীন্দ্রনাথের এই প্লটটি অনুসরণে।
আরো অসংখ্য নে-লেখা প্লট আর গল্পের খবর ছড়িয়ে আছে তাঁর চিঠিপত্রে এবং নিকটজনের স্মৃতিচারণায়। শান্তিনিকেতনের প্রাক্তন অধ্যাপক মনোরঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়কে একটি চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন – “আমি পণ্ডিতমহাশয় ও সতীশকে গুটিকতক গল্পের প্লট দিয়া গল্প লিখাইয়াছি।” রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘পুত্রযজ্ঞ’ গল্পটির প্লট দিয়েছিলেন সমরেন্দ্রনাথ ঠাকুরকে। গল্পটি সমরেন্দ্রনাথের নামেই প্রকাশিত হয় ভারতী পত্রিকায়। কিন্তু কবির সৃষ্টি বলেই সম্ভবত রবীন্দ্রনাথ গল্পটি গল্পগুচ্ছ-এ অন্তর্ভুক্তির নির্দেশ দিয়েছিলেন।
সূত্র: গল্পগুচ্ছ, চতুর্থ খণ্ড, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিশ্বভারতী গ্রন্থনবিভাগ
Indranil Modak
নভেম্বর 27, 2011 at 9:25 অপরাহ্ন
Thanks for sharing knowledge. Nice “nibondho” eta.
Indranil
Rep. Of Benin, Ctonou