RSS

দ্যৌ ও ধরিত্রী

06 আগস্ট

পৃথু ধরিত্রীকে তাড়া করেছেন, ভাগবত পুরাণের পুথিচিত্রণ, পাহাড়ি চিত্রকলা, ১৭০০-১৭৬০ খ্রিস্টাব্দ

মূল রচনা: ডব্লিউ. জে. উইলকিনস (হিন্দু মিথোলজি: বৈদিক অ্যান্ড পৌরাণিক থেকে)

অনুবাদ: অর্ণব দত্ত

সাধারণত দ্যৌ (স্বর্গ) ও ধরিত্রীকে (পৃথিবী) প্রাচীনতম আর্য দেবতা মনে করা হয়। ঋগ্বেদের স্তোত্রগুলিতে তাঁদের অন্যান্য দেবতার বাবা ও মা বলে উল্লেখ করা হয়েছে। (ম্যুর, ও.এস.টি., পাঁচ।২৩) তাঁরা বর্ণিত হয়েছেন “মহৎ, জ্ঞানী ও তেজোময়” বলে। বলা হয়েছে, তাঁরা “ধার্মিকতা প্রচারক করেন এবং পূজককে দামি উপহার দিয়ে থাকেন।” অন্য একটি জায়গায় বলা হয়েছে, তাঁরা “সকল জীবের স্রষ্টা” এবং তাঁদের অনুগ্রহেই “তাঁদের সন্তানসন্ততি অমরত্ব প্রাপ্ত হয়েছেন।” তাঁরা শুধু সকল জীবের সৃষ্টিকর্তাই নন, সবার রক্ষাকর্তাও বটে। তাঁরা সকলের হিতকারী এবং সকলের প্রতি দয়াশীল। আবার অন্য একটি রচনায় বলা হয়েছে, স্বর্গ ও পৃথিবীর স্রষ্টা ইন্দ্র। ইন্দ্রই তাঁদের মহত্ব দান করেন এবং “রথ যেমন করে ঘোড়াকে অনুসরণ করে”, তেমনি করেই তাঁরা ইন্দ্রকে অনুসরণ করেন। এই বর্ণনা অনুযায়ী, ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে তাঁরা ইন্দ্রের সামনে মাথা নত করেন। কারণ তাঁরা ইন্দ্রেরই অধীনস্থ প্রজা। আবার অন্য মতে, তাঁদের স্রষ্টা হলেন সোম। অন্যান্য স্তোত্রে আবার অন্য অন্য দেবতাদের তাঁদের স্রষ্টা বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এই ধরণের মতানৈক্য থেকে স্বাভাবিকভাবেই তাঁদের উৎস সম্পর্কে প্রশ্ন ওঠে। একটি স্তোত্রে তো সেই প্রশ্ন করাও হয়েছে, “তাঁদের সৃষ্টি কিভাবে হল, কোন ঋষি তা জানেন?”

মনে করা হয়, হিন্দুরা ভারতে বসতি স্থাপন করার পরই পূজার ক্ষেত্রে ইন্দ্র দ্যৌ-এর স্থান গ্রহণ করেন। এই ধারণার পিছনে যথেষ্ট কারণ রয়েছে। নতুন দেবতাদের স্তব গাওয়া হতে শুরু করলে পুরনো দেবতাদের লোকে ভুলে যায়। বেদে দ্যৌ ও ইন্দ্র উভয়কেই স্বর্গের দেবতা বলা হয়েছে। দ্যৌ আজ সম্পূর্ণ অপরিচিত এক দেবতা, কিন্তু ইন্দ্র এখনও পূজিত হন। প্রোফেসর বেনফে (ম্যুর, ও.এস.টি., পাঁচ।১৮) এর একটি সাধারণ ব্যাখ্যা দিয়েছেন, “স্পষ্টতই, ইন্দ্র স্বর্গের দেবতার স্থান অধিকার করেছিলেন। এই দেবতাটিকে বেদে দ্যৌপিতা (স্বর্গপিতা) বলে সম্বোধন করা হয়েছে। এতে প্রমাণিত হয়, এই শব্দটির মধ্যে লাতিন জ্যুপিটার ও গ্রিক জিউ-পিটার শব্দটির ধ্বনি একটি মাত্র ধর্মের আকারে শোনা যায়। অন্যান্য শব্দের মতো ভাষাবিচ্ছেদের আগে এগুলি একই ভাষার শব্দ ছিল। সংস্কৃতভাষী জাতিগোষ্ঠী অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীগুলির সঙ্গে একটি সাধারণ দেশে বাস করত। সেখানকার আবহাওয়া থেকে তাঁরা সুন্দর স্বর্গের ধারণাটি গ্রহণ করেন। সেই স্বর্গকে তাঁরা মনে করতেন পবিত্রতম। সেখান থেকে তাঁরা আসেন গ্রীষ্মপ্রধান ভারতে। স্বর্গের দ্যুতি ভারতে ধ্বংসাত্মক প্রতিপন্ন হয়। কেবলমাত্র বৃষ্টিই স্বস্তি আনে। দেবতার এই রূপটি অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠে। তাই প্লবস অভিধাটি দ্যৌপিতরের অন্য সব বৈশিষ্ট্যকে ঢেকে দেয়। এটি ইন-দ্র নামের মধ্যে প্রকাশিত হয়। এই নামে আমরা দ্বিধাহীনভাবে একটি শব্দ চিহ্নিত করতে পারি (শব্দটি কিছু স্থানীয় উপভাষায় ওঠে, পূজা প্রসারিত হওয়ার পর তার মধ্যে মিশে যায়)। শব্দটি হল সিন্দ-র; যেটি আবার স্যন্দ শব্দ থেকে এসেছে, যার অর্থ ‘ফোঁটায় ফোঁটায় ঝরা’। দ্যৌ-এর সঙ্গে যুক্ত ধারণাগুলি তখন ইন্দ্রের উপর আরোপ করা হয়।” ইন্দ্র যে দ্যৌ-এর স্থান দখল করেছিলেন, সেকথা আজ মোটামুটি সবাই মানেন এবং তার ব্যাখ্যাও স্বাভাবিকভাবেই গৃহীত হয়।

এবার ধরিত্রীর কথা শুনি। “বিষ্ণু পুরাণ”-এ তাঁর জন্ম-সংক্রান্ত একটি গল্প রয়েছে: বেণা নামে এক কুখ্যাত, দুষ্ট ও ধর্মদ্রোহী রাজা ছিলেন। তাঁর অনাচার সইতে না পেরে সেযুগের ঋষিরা তাঁকে হত্যা করেন। কিন্তু তার ফল হয় আরও খারাপ। রাজ্য অরাজক হয়ে ওঠে। ঋষিরা তখন ভাবেন, নেই-রাজার থেকে দুষ্টু-রাজাও ভাল। এই কথা ভেবে তাঁরা বেণার উরু মর্দন করেন। তা থেকে নিগ্রোর মতো দেখতে এক কালো বামনের আবির্ভাব হয়। জন্মের পরই বামন জিজ্ঞাসা করেন, “আমাকে কী করতে হবে?” তাঁকে বলা হয়, “নিষীদ (বোসো)।” সেই থেকে আজ পর্যন্ত তাঁর বংশধরেরা নিষাদ বলে পরিচিত। সব পাপ সেই কালো দৈত্যের বেশে বেরিয়ে যাওয়ায় মৃতদেহটি তখন শুদ্ধ হয়। তখন বেণার ডান বাহু মর্দন করা হলে এক সুদর্শন উজ্জ্বল রাজপুত্রের জন্ম হয়। তার নাম পৃথু। তিনি তাঁর পিতার স্থলে রাজ্যশাসন শুরু করেন। তাঁর রাজত্বে একবার ভয়ানক দুর্ভিক্ষ হয়। শস্য উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়। লোকে অনাহারে থাকতে শুরু করে। পৃথু বলেন, “আমি ধরিত্রীকে হত্যা করে শস্য উৎপাদন করাব।” এতে ভীত হয়ে ধরিত্রী একটি গোরুর রূপ ধারণ করলেন। পৃথু তাঁকে ধাওয়া করে ব্রহ্মলোকে পর্যন্ত চলে যান। শেষে, ছুটতে ছুটতে ক্লান্ত হয়ে ধরিত্রী তাঁর দিকে ফিরে জিজ্ঞাসা করলেন, “আমাকে হত্যা করতে চাইছো; জানো না, নারীহত্যা পাপ?” রাজা উত্তর দিলেন, “যখন একটি দুষ্ট ব্যক্তিতে হত্যা করে বহুজনের হিত সাধন করা হয়, তখন সেই হত্যা পুণ্যকর্ম।” ধরিত্রী বললেন, “কিন্তু যদি তোমার প্রজাদের সুখের জন্য তুমি আমাকেই ধ্বংস করে ফেলো, তবে হে রাজশ্রেষ্ঠ, তোমার প্রজারা খাবে কী?” অবশেষে ধরিত্রী ঘোষণা করলেন, সব উদ্ভিজ্জ খাদ্য পুরনো হয়ে গেছে, তাই তিনি সেগুলি ধ্বংস করে দিয়েছেন। কিন্তু রাজার আদেশে তিনি আবার সেগুলি “তাঁর দুধ থেকে উৎপন্ন করলেন।” “এই জন্য তুমি আমাকে মানবজাতির কল্যাণে সেই গাভীটি দেবে যা থেকে আমি দুগ্ধ দোহন করতে পারব। সব ভূমি সমতল করবে, যাতে আমার দুধ সর্বত্র পড়ে ফসল ফলাতে পারে।”

পৃথু এই উপদেশমতো কাজ করলেন। “তাঁর আমলের আগে হলকর্ষণ ছিল না, পশুচারণ ছিল না, কৃষিকাজ ছিল না, বণিকদের যাতায়াতের সড়কপথও ছিল না; এই সব জিনিস (বা সকল সভ্যতা) শুরু হয় পৃথুর আমল থেকে। যেখানে জমি সমতল করা হয়েছিল, সেখানে তিনি প্রজা বসত করালেন। স্বয়ম্ভু মনুকে বাছুর করে তিনি ধরিত্রীকে দোহন করালেন। মানবজাতির কল্যাণে দুধ নিলেন নিজের হাতে। তারপর সকল প্রকার ফসল ও শাকসবজির জন্ম হল, যা খেয়ে মানুষ বাঁচে। ধরিত্রীকে জীবন দান করে পৃথু হলেন তাঁর পিতা। সেই থেকেই ‘পৃথিবী’ নামে চিহ্নিত হলেন ধরিত্রী।”

একটি টীকায় প্রোফেসর উইলসন যোগ করেছেন, (“বিষ্ণুপুরাণ”, পৃ. ১০৪) ভাষ্যকারের মতে “‘বাছুর’ বা বাছুরের বেশে মনু এখানে সন্তান উৎপাদকের প্রতীক। কোনো কোনো পুরাণে বর্ণিত সৃষ্টিকাহিনি মনুকে মানবজাতির আদি পিতা রূপে দেখা যায়। এই গল্পটি নানা পাঠান্তরে প্রায় সব পুরাণেই পাওয়া যায়। কোথাও সোম, কোথাও ইন্দ্র, কোথাও আবার যম এখানে বাছুরের বেশ গ্রহণ করেন; আর মনুর স্থানটি গ্রহণ করেন ঋষিগণ অথবা মিত্র প্রভৃতিরা। একই টীকায় প্রোফেসর উইলসন বলেছেন, “এই সব গল্পই সম্ভবত আদি মৌলিক রূপক কাহিনিটির পরবর্তীকালে রচিত পাঠান্তর। এই গল্পের মূল বক্তব্য, পৃথিবী গোরুর রূপ ধারণ করেন এবং সব শ্রেণির জীবেদের দুধ অর্থাৎ তাদের আকাঙ্ক্ষিত বস্তু দান করেন।”

উল্লেখ্য, “বিষ্ণুপুরাণে”ই পরে বলা হয়েছে যে, পৃথিবী বিষ্ণুর পা থেকে উৎপন্ন।

 
2 টি মন্তব্য

Posted by চালু করুন অগাষ্ট 6, 2011 in পুরনো লেখা

 

ট্যাগ সমুহঃ

2 responses to “দ্যৌ ও ধরিত্রী

  1. anindya01

    অগাষ্ট 6, 2011 at 4:59 অপরাহ্ন

    অসম্ভব রকমের ভালো লেগেছে !

    অনেক অজানা কিছু বিষয় জানলাম !জেনে ভালো লাগলো !

     
  2. অর্ণব দত্ত

    অগাষ্ট 6, 2011 at 6:52 অপরাহ্ন

    ধন্যবাদটা যদিও উইলকিনস সাহেবের প্রাপ্য। তবুও, অনুবাদক হিসেবে আপনার ভাল লাগায় আমারও খুব ভাল লাগছে।

     

মন্তব্য করুন

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  পরিবর্তন )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  পরিবর্তন )

Connecting to %s

 
%d bloggers like this: