RSS

বৈদিক দেবতাদের সাধারণ পরিচিতি

25 জুলাই

মূল রচনা: ডব্লিউ. জে. উইলকিনস (হিন্দু মিথোলজি: বৈদিক অ্যান্ড পৌরাণিক থেকে)

অনুবাদ: অর্ণব দত্ত

যাস্ক (সম্ভবত বেদের প্রাচীনতম ভাষ্যকার) বৈদিক দেবতাদের নিম্নলিখিত শ্রেণীগুলিতে ভাগ করেছেন। “বেদ-ব্যাখ্যাকারীদের মতে তিন জন দেবতা রয়েছেন: অগ্নি, যাঁর স্থান মাটিতে; বায়ু, যাঁর স্থান বাতাসে; এবং সূর্য, যাঁর স্থান আকাশে। এঁদের মহত্ব ও কাজের বৈচিত্র্য অনুযায়ী নানা অভিধায় ভূষিত করা হয়ে থাকে।” (ম্যুর, ও.এস.টি. খণ্ড ৮) খোদ ঋগ্বেদেই দেবতাদের এই সংখ্যাটি বেড়ে হয়েছে তেত্রিশ। এঁদের মধ্যে এগারোজন বাস করেন স্বর্গে, এগারোজন পৃথিবীতে এবং এগারোজন মধ্য-আকাশে বাস করেন। “সর্বজ্ঞ দেবতা অগ্নি, পূজকের কথা শোনেন। তিনি রক্তিম ঘোড়ার আরোহী এবং স্তব শুনতে ভালবাসেন। তিনিই তেত্রিশ জনকে এখানে নিয়ে আসেন।” এই সংখ্যাটাই সাধারণভাবে উল্লেখ করা হয়। তবে এ থেকে বোঝা যায় না যে কোন তেত্রিশ জনের কথা বলা হয়েছে। কারণ, অন্যান্য সূত্র থেকে প্রাপ্ত তালিকাগুলি পরস্পরবিরোধী তথ্যে ভরা। অন্য একটি স্তোত্র থেকে জানা যায়, “তিনশো, তিন হাজার, উনচল্লিশজন দেবতা অগ্নির পূজা করে।”

এই দেবতাদের অমর বলা হলেও স্বয়ম্ভু [নিজে থেকেই উৎপন্ন] বলা হয়নি। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাদের পিতামাতার পরিচয় দেওয়া হয়েছে। তবে তাঁদের উৎস-সংক্রান্ত কাহিনিগুলিও পরস্পরবিরোধী। অগ্নি ও সবিতৃ অন্য দেবতাদের অমরত্ব প্রদান করেছিলেন। অপর গল্প অনুযায়ী, ইন্দ্র যজ্ঞ করে অমর হওয়ার বর পেয়েছিলেন। দেবতারা কীভাবে অমর হয়ে নিজেদের অসুরদের তুলনায় শ্রেষ্ঠ প্রতিপন্ন করলেন, তা নিয়ে শতপথ ব্রাহ্মণে একটি সুন্দর গল্প রয়েছে। দেবতা ও অসুরেরা উভয়েই সৃষ্টিকর্তা প্রজাপতির সন্তান ছিলেন। তাঁদের সকলের ক্ষমতা সমান ছিল এবং সকলেই ছিলেন মরণশীল। অমর হওয়ার বাসনা নিয়ে দেবতারা যজ্ঞ আয়োজন করলেন এবং কঠোরতম তপস্যা করলেন। তখন প্রজাপতি তাঁদের সেই বিশেষ যজ্ঞটি শিখিয়ে দিলেন, যেটি করলে অমর হওয়া যায়। দেবতারা তাঁর উপদেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করলেন  এবং সফলও হলেন। অসুরদের থেকে শ্রেষ্ঠ হওয়ার জন্য তাঁরা সত্যবাদী হলেন। আগে দেবতা ও অসুর উভয়েই জায়গা বুঝে সত্যি বা মিথ্যে বলতেন। কিন্তু ধীরে ধীরে দেবতারা মিথ্যে বলা বন্ধ করে দিলে অসুরদের মিথ্যে বলা উত্তরোত্তর বাড়তে লাগল। যার ফলস্রুতি, এক দীর্ঘ যুদ্ধের পর জয়ী হলেন দেবতারাই। আদিতে সব দেবতাই ক্ষমতায় সমান ছিলেন। সকলেই সমপরিমাণ ভাল ছিলেন। কিন্তু তিন জন দেবতা সকলের চেয়ে শ্রেষ্ঠ হতে চাইলেন। এঁরা ছিলেন অগ্নি, ইন্দ্র ও সূর্য। এই উদ্দেশ্যে তাঁরা যজ্ঞ করতে লাগলেন এবং সফল না হওয়া পর্যন্ত যজ্ঞ চালিয়ে গেলেন। আদিতে অগ্নির আজকের মতো শিখা ছিল না। তিনি ইচ্ছা করলেন, “এই শিখা আমার হোক।” এবং এই বর পাওয়ার জন্য যথোপযুক্ত যজ্ঞ অনুষ্ঠান করলেন। সফলও হলেন। একইভাবে ইন্দ্র তাঁর শক্তি এবং সূর্য তাঁর ঔজ্জ্বল্য বৃদ্ধি করলেন। এই তিন দেবতাকে বলা হয় বৈদিক ত্রিদেব। পরবর্তীকালে অন্য তিন দেবতা তাঁদের স্থান অধিকার করেছিল। যদিও কেউ কেউ সেই অন্য তিন দেবতাদের বৈদিক ত্রিদেবের সমকক্ষ দেখানোর চেষ্টাও করেছিলেন।

পরে দেখা যাবে যে, প্রত্যেক দেবতার পূজকেরা তাঁদের পূজ্য দেবতাকেই অন্য দেবতার তুলনায় শ্রেষ্ঠতর মনে করছেন। বেদসমূহেও এই শ্রেষ্ঠত্ববাচক শব্দগুলি ঘুরেফিরে ব্যবহার করা হয়েছে। বিনা বাছবিচারেই একাধিক দেবতাকে ভূষিত করা হয়েছে একই প্রকার অভিধায়। প্রোফেসর ম্যাক্সমুলার বলেছেন, “যখন এই দেবতাদের কাউকে এককভাবে আবাহন জানানো হত, তখন তাঁদের তুলনায় উচ্চ বা নিম্ন স্তরের অন্য দেবতাদের ক্ষমতার দ্বারা সীমাবদ্ধ কল্পনা করা হত না। যজ্ঞকর্তার দৃষ্টিতে প্রত্যেক দেবতাই ছিলেন অন্যান্য দেবতার সমকক্ষ। সেই সময় তাঁকেই প্রকৃত দৈবসত্ত্বা, সর্বোচ্চ ও পরম দেবতা মনে করা হত। আমাদের চোখে তাঁদের সীমাবদ্ধগুলি ধরা পড়েও সর্বদেবতার গুণাবলি এক দেবতায় আরোপিত হত। কবির দৃষ্টি থেকে মুহুর্তের জন্য অন্যান্য দেবতারা অন্তর্হিত হতেন। মনোবাসনা-পূর্ণকারী দেবতাই কেবল পূজকের দৃষ্টিপথ সম্পূর্ণ রুদ্ধ করে দাঁড়াতেন। … ঋগ্বেদের অনেক স্তোত্রেই দেখা যায়, প্রত্যেক দেবতাকেই সর্বোচ্চ ও পরম দেবতা বলে উল্লেখ করা হয়েছে।”

এই দেবতাদের ইচ্ছা সার্বভৌম। কোনো মরণশীল ব্যক্তি তাঁদের উদ্দেশ্য ব্যর্থ করতে পারে না। তাঁরা সব জীবের উপরই কর্তৃত্ব করেন। মরণশীলদের জীবন থাকে তাঁদের হাতেই। তাঁরা মানুষের মনের কথা ও বাসনা জানতে পারেন, পূজককে পুরস্কৃত করেন এবং যারা তাঁদের অবহেলা করে তাদের শাস্তি দেন। যখন পৌরাণিক দেবতাদের নিয়ে আলোচনা করব, তখন দেখবেন, পৌরাণিক যুগে দেবদেবীদের রূপকল্পনার ব্যাপারটি পূর্বতন যুগের তুলনায় অনেক বেশি সুস্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল। যদিও বলা হয়েছে যে, বৈদিক দেবদেবীরা মানুষের রূপ ধারণ করে মানুষের মতো কাজ করেন, তা সত্ত্বেও তাঁদের রূপকল্পনার বিষয়টি অনেক বেশি অস্পষ্টই থেকে গেছে। কিন্তু এই অস্পষ্টতা সময়ে দূরীভূত হয়। পূজ্য দেবতারা আর অস্পষ্ট ছায়াবৃত থাকেন না। বরং এত অনুপুঙ্খভাবে তাঁদের রূপকল্পনা করা হয় যে, তাঁদের ছবি আঁকা খুবই সহজ হয়ে পড়ে। এবং সেই সঙ্গে যেহেতু তাঁদের চেহারাগত বৈশিষ্ট্যগুলি আর কল্পনার বিষয় থাকে না, সে হেতু তাদের মানসিক ও নৈতিক চরিত্রও অনুরূপভাবে বর্ণিত হয়। বর্ণনাকারীরা তাঁদের নিজেদের চরিত্রবৈশিষ্ট্যগুলিই বর্ণিত দেবতাদের উপর আরোপ করেন, কেবল দেবতাদের অনেক বেশি শক্তিধর রূপে দর্শান।

প্রোফেসর উইলিয়ামস বলেছেন, (“ইন্ডিয়ান উইশডম”, পৃ. ১৫) “বৈদিক স্তোত্রাবলিতে যেসব দেবতাদের সম্ভাষণ করা হয়েছে, বৈদিক যুগে সম্ভবত তাঁদের সম্ভবত ছবি বা মূর্তি তৈরি হত না। যদিও নিঃসন্দেহে বলা যায়, প্রথমদিকের পূজকেরা নিজ নিজ শক্তি অনুযায়ী তাঁদের আরাধ্য দেবতাকে মানুষের রূপে কল্পনা করতেন।” প্রোফেসর মুলার (“চিপস ফ্রম আ জার্মান ওয়ার্কশপ”, এক।৩৮) আরও দৃঢ়ভাবে বলেছেন, “বৈদিক যুগের ধর্মে মূর্তির স্থান ছিল না। ভারতে মূর্তিপূজা এসেছে পরবর্তীকালে। এটি আরও প্রাচীন [প্রাক-বৈদিক] যুগের দেবতাদের পূজার এক উত্তরকালীন অবক্ষয়িত রূপ।” প্রোফেসর উইলিয়ামসের সংযত বাক্যচয়নই সম্ভবত এই বিষয়ে যথোপযুক্ত। কারণ ড. বোলেনসেন (ম্যুর, ও.এস.টি. পাঁচ। ৪৫৩) অন্যদিকটির প্রতি জোরালো এক বক্তব্য রেখেছেন। তিনি লিখেছেন, “দেবতাদের সাধারণ অভিধা দিব্যনর, ‘আকাশের মানুষ’, বা সহজ কথায় নর, বা মানুষ এবং অপর অভিধা নৃপেস, ‘নররূপী’ থেকে আমরা অনুমান করতে পারি যে ভারতীয়রা শুধুমাত্র তাদের দেবতাদের নররূপ কল্পনাই করত না, বরং তাদের একটি বাস্তবসম্মত রূপে উপস্থাপনাও করত। যেমন রুদ্রের একটি চিত্রিত বর্ণনায় (ঋগ্বেদ ২।৩৩।৯) পাওয়া যায়, ‘তিনি বলিষ্ঠ অঙ্গপ্রত্যঙ্গের অধিকারী, বহুরূপী, ভয়ংকর, কপিশ (বাদামি) বর্ণবিশিষ্ট। উজ্জ্বল রঙে তাঁর ছবি আঁকা হয়।” “চিত্ররূপে দেবতাদের কল্পনা যদিও স্পষ্ট। ‘আমি ইহাদের (মরুৎগণ) দেবতাদের কাছে প্রার্থনা করি। মনে হয়, মরুৎগণ অন্যান্য দেবতা অর্থাৎ তাঁদের চিত্রের তুলনায় ভিন্নতর ছিলেন।” “প্রাচীনতম ভাষায় সন্দ্রি বলে একটা কথা আছে, যার অর্থ সম্ভবত ‘দেবতার ছবি’।

এরপর আমরা বেদে উল্লিখিত দেবতাদের বিস্তারিত বর্ণনায় যাব।

 

ট্যাগ সমুহঃ

মন্তব্য করুন

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  পরিবর্তন )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  পরিবর্তন )

Connecting to %s

 
%d bloggers like this: