মাথা নেই তার মাথাব্যথা
(মাচ অ্যাডু অ্যাবাউট নাথিং)
উইলিয়াম শেকসপিয়র
অনুবাদ: অর্ণব দত্ত
পাত্রপাত্রী
ডন পেড্রো – অ্যারাগনের রাজকুমার
ডন জন – তাঁর বেজন্মা ভাই
ক্লডিও – ফ্লোরেন্সের জনৈক তরুণ লর্ড
লিওন্যাটো – মেসিনার গভর্নর
অ্যান্টোনিও – লিওন্যাটোর বৃদ্ধ দাদা
বালথাজার – ডন পেড্রোর পরিচারক
বোরাশিও ও কনরাড – ডন পেড্রোর দুই অনুগামী
ফ্রেয়ার ফ্রান্সিস – পাদ্রি
ডগবেরি – জনৈক কনস্টেবল
ভার্জেস – জনৈক পুরপ্রধান
জনৈক সেক্সটন (গির্জার ঘণ্টাবাদক)
জনৈক বালক
হিরো – লিওন্যাটোর মেয়ে
বিয়াত্রিস – লিওন্যাটোর ভাইঝি
মার্গারেট ও আরসুলা – হিরোর সহচরী
দূতগণ, প্রহরী, লর্ডগণ, পরিচারকগণ ও গাইয়ে-বাজিয়েরা ইত্যাদি।
দৃশ্য – মেসিনা
প্রথম অঙ্ক
প্রথম দৃশ্য
লিওন্যাটো, মেসিনার গভর্নর; তাঁর মেয়ে হিরো ও ভাইঝি বিয়াত্রিস; এক দূতের সঙ্গে প্রবেশ করলেন।
লিওন্যাটো (চিঠি হাতে)। এই চিঠির সারমর্ম হল – অ্যারাগনের রাজকুমার ডন পেড্রো তাঁর বাহিনী নিয়ে আজ রাতে মেসিনায় আসছেন।
দূত। এতক্ষণে তাঁরা হয়ত কাছাকাছি চলেও এসেছেন। আমি যখন ওঁদের ছেড়ে আসি, তখন ওঁরা এখান থেকে নয় মাইলের কম দূরত্বে অবস্থান করছিলেন।
লিওন্যাটো। আচ্ছা, এই যুদ্ধে কত জন রাজপুরুষ নিহত হয়েছেন?
দূত। হাতে গোনা কয়েকজন। তাঁরাও অবশ্য উল্লেখযোগ্য কেউ নন।
লিওন্যাটো। ঘরের ছেলেরা সবাই নিরাপদে ঘরে ফিরলে বিজয়ের আনন্দ দ্বিগুণ হয়। এই চিঠিতে লেখা রয়েছে, ডন পেড্রো নাকি ক্লডিও নামে ফ্লোরেন্সের এক যুবককে প্রভূত সম্মান প্রদান করেছেন।
দূত। তিনি সম্মান পাওয়ারই যোগ্য। ওইটুকু ছেলে হয়ে তিনি যে কী করেছেন, তা না দেখলে বিশ্বাস হবে না। হরিণের মতো কোমল তাঁর চেহারা, কিন্তু যুদ্ধ করেন তিনি সিংহের মতো। তাঁর বীরত্বের বর্ণনা দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। ডন পেড্রো তাঁর যোগ্য সম্মানই তাঁকে দিয়েছেন।
লিওন্যাটো। মেসিনায় তাঁর নাকি এক কাকা আছেন। উনি খবর পেলে খুব খুশি হবেন।
দূত। তাঁকেও চিঠি দিয়েছি। মনে হল, উনি খুবই খুশি হয়েছেন। শুনে তো উনি প্রচণ্ড আবেগতাড়িত হয়ে পড়লেন।
লিওন্যাটো। কাঁদছিলেন নিশ্চয়ই?
দূত। হ্যাঁ, খুব।
লিওন্যাটো। খুব স্নেহ করেন কিনা ভাইপোকে। আনন্দাশ্রুর চেয়ে আন্তরিক জিনিস আর কী আছে বলো?
বিয়াত্রিস। আচ্ছা, বলতে পারেন, সিনিওর বেড়া-বিধ্বংসী যুদ্ধ থেকে বেঁচে ফিরেছেন না ফেরেননি?
দূত। আমি তো ওই নামে কাউকে চিনি না। আমাদের বাহিনীতেও ওই নামের কেউ নেই।
লিওন্যাটো। কার কথা জিজ্ঞাসা করছিস, মা?
হিরো। আমার বোন পাডুয়ার সিনিওর বেনেডিকের কথা জানতে চাইছে।
দূত। ও হ্যাঁ, তিনি ফিরেছেন। আর আগের মতোই খোশমেজাজে আছেন।
বিয়াত্রিস। সেবার মেসিনায় এসে বেনেডিক কিউপিডকে তিরন্দাজি প্রতিযোগিতায় আহ্বান করেছিলেন। কাকামণির ভাঁড়টা কিউপিডের হয়ে প্রতিযোগিতায় নামতে রাজি হয়েছিল। তবে সে খেলনা তীর ব্যবহার করেছিল। সে যাই হোক, বলুন দেখি, উনি যুদ্ধে এবার কত লোক মেরেছেন আর কত লোক খেয়েছেন? আমি ওঁকে কথা দিয়েছিলুম যে, উনি যত লোক মারবেন সবাইকে আমি একাই ভক্ষণ করব।
লিওন্যাটো। ঈশ্বরের দোহাই, মা বিয়াত্রিস, তুই সিনিওর বেনেডিক সম্পর্কে বড্ড কড়া কড়া কথা বলছিস। দেখবি, উনি এসে ঠিক এর শোধ তুলবেন।
দূত। এই যুদ্ধে সিনিওর বেনেডিক অসামান্য বীরত্বের পরিচয় দিয়েছেন।
বিয়াত্রিস। বীরত্ব না হাতি! ওঁর বীরত্ব তো শুধু খাওয়ার বেলা! আর ওঁর যা কিছু জোর সব ওঁর পাকস্থলীতে!
দূত। মহাশয়ার কাছে উনি কী একজন ভাল সৈনিকও নন?
বিয়াত্রিস। মহাশয়ার কাছে উনি যাই হোন, মহাশয়ের কাছে উনি কী, সেটাই বলুন।
দূত। মহাশয়ের মতো এক মহাশয়। নরশ্রেষ্ঠ। সকল গুণের আধার।
বিয়াত্রিস। ঠিক বলেছেন, আধার। মানে যাকে বলে, বাটি। খেলনাবাটি। উনি নিতান্তই বালখিল্য।
লিওন্যাটো। দয়া করে, আমার ভাইঝির কথার অন্য মানে করবেন না। আসলে বেনেডিক ও বিয়াত্রিসের মধ্যে এক ধরনের বৌদ্ধিক শত্রুতা বিরাজমান। দেখা হলেও, ওদের মধ্যে বাকযুদ্ধ বেধে যায়।
বিয়াত্রিস। আর সব সময় আমিই জিতি। শেষটাও ওঁর অবস্থায় হয় গর্দভের মতো। আচ্ছা, বলুন দেখি, আজকাল উনি কার সঙ্গে রয়েছেন? উনি তো মাসে মাসে তাঁর প্রিয় বন্ধু পালটে ফেলেন।
দূত। সে আবার সম্ভব নাকি?
বিয়াত্রিস। খুব সম্ভব! উনি যা অস্থিরমতি! ওঁর পছন্দের মানুষ তো হালফ্যাশানের চাইতেও দ্রুত বদলায়।
দূত। মনে হচ্ছে, আপনি ভদ্রলোককে পছন্দ করেন না, তাই না?
বিয়াত্রিস। একটুও না। বলুন না, এখন ওঁর প্রিয় বন্ধু কে? নাকি আজকাল আর রাজ্যের হামবড়া ছোকরা-বদমাশের দল আর ওঁর সঙ্গে হাসিমুখে নরকে যেতে রাজি হচ্ছে না!
দূত। আজকাল ওঁকে প্রায়শই মহান ক্লডিওর সঙ্গে দেখা যায়।
বিয়াত্রিস। ও মা, বলেন কী? বেনেডিক তো ওঁকে অসুস্থ করে তুলবেন। জানেন তো, বেনেডিকের একটা ছোঁয়াচে ব্যারাম আছে। ওঁর ছোঁয়াচ লাগলে বেচারা পাগল হয়ে যাবে। শেষে দেখা যাবে, ছেলেটা রোগ সারাতেই ফতুর হয়ে গেল। ভগবান ওকে রক্ষা করুন।
দূত। মহাশয়া, আমি কিন্তু আপনারই পক্ষ নেবো।
বিয়াত্রিস। তাই নাও, দোস্ত, তাই নাও।
লিওন্যাটো। বেনেডিকের পাল্লায় পড়ে তুই পাগল হয়ে যাবি না তো, মা?
বিয়াত্রিস। আগে জানুয়ারিতে গ্রীষ্ম আসুক, তারপর পাগল হতে পারি, তার আগে নয়।
দূত। ওই যে, ডন পেড্রো আসছেন।
অ্যারাগনের রাজকুমার ডন পেড্রো প্রবেশ করলেন। সঙ্গে ক্লডিও, বেনেডিক, বালথাজার ও ডন জন দ্য বাস্টার্ড।
ডন পেড্রো। সুপ্রিয় সিনিওর লিওন্যাটো, আমার সম্পূর্ণ বাহিনীর বোঝা বহন করতে স্বীকৃত হয়েছেন আপনি। সঙ্গে দু’বাহু বিস্তারিত করে আমাকেও গ্রহণ করেছেন। লোকে বোঝা ঝেড়ে ফেলতে চায় কাঁধ থেকে। আর আপনি স্বেচ্ছায় তা কাঁধে তুলে নিতে চাইছেন?
লিওন্যাটো। মহামান্য কুমার, আপনি আদৌ এ রাজভবনের বোঝা নন। বোঝা কাঁধ থেকে নেমে গেলে মানুষ খুশি হয়। আপনি এই ভবন ছেড়ে গেলে, আমরা বিষাদগ্রস্থ হয়ে পড়ি। আমাদের সব আনন্দ কেড়ে নিয়ে, দুঃখে দ্রবীভূত করে দিয়ে যান আপনি।
ডন পেড্রো। আপনি কতই না আগ্রহভরে আপনার কর্তব্য পালন করতে ভালবাসেন। এইটি নিশ্চয়ই আপনার কন্যা।
লিওন্যাটো। ওর মা আমাকে সেই রকমই বলেছিল।
বেনেডিক। আপনার বুঝি সন্দেহ ছিল, যে ওর মা-কে জিজ্ঞাসা করেছিলেন?
লিওন্যাটো। তা নয়, সিনিওর বেনেডিক। তাছাড়া, ওর জন্মের সময় আপনি ছিলেন নেহাত শিশু। তাই বলতেই পারি, আপনার ঔরসে ওর মা ওকে গর্ভে ধরেননি।
ডন পেড্রো। দেখেছো বেনেডিক, তোমার নারীপ্রীতির খবর লিওন্যাটোর কানেও পৌঁছেছে। তবে বাপ-বেটির চেহারায় যা মিল, তাতে আমার তো ওকে লিওন্যাটোর কন্যা বলেই মনে হচ্ছে। বালিকা, তোমাকে অভিনন্দন জানাই। এই সম্মানীয় ব্যক্তির সঙ্গে আমি তোমার চেহারার মিল খুঁজে পেয়েছি বলে।
লিওন্যাটো ও ডন পেড্রো কথা বলতে বলতে একধারে চলে গেলেন।
বেনেডিক। সিনিওর লিওন্যাটোর মতো বুড়ো বাপের বোঝা কী আর ও বইতে চাইবে?
বিয়াত্রিস। অবাক করলেন, সিনিওর বেনেডিক। কার সঙ্গে বকবক করছেন? আপনার কথা তো কেউই শুনছে না।
বেনেডিক। এই যে অবজ্ঞা দেবী। আপনি এখনও বেঁচে আছেন?
বিয়াত্রিস। আপনি বেঁচে থাকতে অবজ্ঞা মরবেন কোন দুঃখে? আর আপনাকে দেখলে তো সৌজন্য দেবীও অবজ্ঞা দেবীর রূপ ধারণ করেন।
বেনেডিক। সৌজন্য দেবীকে এই জন্যই লোকে বিশ্বাসঘাতিনী বলে। আমাকে সব মেয়েই ভালবাসে। কেবল তুইই অন্যধারা। আমার অবশ্য খারাপ লাগে। আমি এমনই পাষাণ যে কাউকেই ভালবাসতে পারি না।
বিয়াত্রিস। আহা, মেয়েগুলির কী ভাগ্য গো! আপনার মতো জঘন্য এক প্রেমিকের পাল্লায় পড়তে হয় না ওদের। আর কপাল ভাল, আমার মনটাও আপনারই মতো। ওসব প্রেম-ট্রেম আমার নাপসন্দ। পুরুষের প্রেমপ্রতিজ্ঞা! তার চেয়ে কুকুরের ঘেউ ঘেউ শোনা ঢের ভাল।
বেনেডিক। তোমার পক্ষে তাই ভাল। নইলে একটা কুশ্রী প্রেমিক জুটবে তোমার কপালে!
বিয়াত্রিস। কী আর জুটবে? আপনার চেয়ে খারাপ মুখ আর কজনেরই বা আছে বলুন!
বেনেডিক। তুমি তো তোতাপাখির মতো বুলি আউড়ে চলেছো!
বিয়াত্রিস। তাও অন্তত আপনার মতো জান্তব চ্যাঁচামেচি করছি না।
বেনেডিক। আহা! আমার ঘোড়াটা যদি তোমার মুখের মতো ছুটতে পারত। বেশ, তুমিই জিতলে! এবার শান্তি?
বিয়াত্রিস। আপনি এভাবেই রণে ভঙ্গ দেন। আপনাকে আমি চিনি না ভেবেছেন?
সামনে এলেন লিওন্যাটো ও ডন পেড্রো
ডন পেড্রো। তা হলে ওই কথাই রইল, লিওন্যাটো। – ক্লডিও, বেনেডিক – আমাদের প্রিয় বন্ধু লিওন্যাটো আমাদের মেসিনায় আতিথ্য গ্রহণের জন্য আহ্বান জানিয়েছেন। আমি ওঁকে বলেছি, আমরা একমাস এখানে থাকব। উনি অবশ্য চান, আমরা আরও বেশিদিন থাকি। আর আমার ধারণা, কথাটা উনি নিছক ভদ্রতা করে বলছেন না।
লিওন্যাটো। না, প্রভু, আমি অন্তর থেকেই বলছি। (ডন জনের প্রতি) আপনাকেও স্বাগত জানাই। শুনলাম, আপনার দাদার সঙ্গে আপনার মিটমাট হয়ে গেছে। তাই আপনিও আমার কাছ থেকে ডন পেড্রো প্রতি আনুগত্যের সমতুল্য আনুগত্য দাবি করতে পারেন।
ডন জন। আমি বেশি কথার মানুষ নই। আপনাকে শুধুই ধন্যবাদ জানাচ্ছি তাই।
লিওন্যাটো। প্রভু, এবার ভিতরে যেতে আজ্ঞা হোক।
ডন পেড্রো। আমার হাত ধরো, চলো আমরা একসঙ্গে যাই।
বেনেডিক ও ক্লডিও ছাড়া সকলের প্রস্থান
ক্লডিও। বেনেডিক, সিনিওর লিওন্যাটোর মেয়েটিকে লক্ষ্য করলে?
বেনেডিক। দেখলুম। তবে লক্ষ্য করিনি।
ক্লডিও। কেমন মিষ্টি লক্ষ্মী মেয়ে, তাই না?
বেনেডিক। আমার সত্যিকারের মতামত জানতে চাও। নাকি যেমন করে আর পাঁচটা মেয়ের নিন্দে করি, তেমন করেই আমার মুখ থেকে ওর সমালোচনা শুনতে চাও?
ক্লডিও। না না, ঠাট্টা নয়। সত্যি কথা বলো।
বেনেডিক। হুঁ। সত্যি বলতে কী, ও এতই বেঁটে যে ওর জন্য লম্বা প্রশস্তিবাক্য রচনা করা যায় না; এমন কালো যে সাদা ভাষায় ওর স্তুতি করা যায় না; আর এমনই ক্ষুদ্র যে ওর দীর্ঘ প্রশংসা করা যায় না। এটুকুই বলব যে, অন্যরকম দেখতে হলে ওকে কুশ্রী দেখাতো। আর যেহেতু ও অন্যরকম দেখতে নয়, তাই আমারও ওকে পছন্দ নয়।
ক্লডিও। ঠাট্টা করছ? বলো না, ওকে কেমন দেখলে?
বেনেডিক। কেন, কিনতে চাও নাকি ওকে?
ক্লডিও। ও রত্ন কি পয়সা দিয়ে কেনা যায়?
বেনেডিক। খুব যায়। সঙ্গে ও রত্ন রাখার জন্য একটা রত্নপেটিকায় কিনে ফেলা যায়। কিন্তু তোমার মতলবটা আগে খোলসা করো তো। তোমার সুরে সুর মেলাতে হলে, আগে তো আমাকে তোমার সুরটা জানতে হবে।
ক্লডিও। আমার মনে হয়, ও আমার দেখা সেরা সুন্দরী।
বেনেডিক। আমার এখনও চশমা নেওয়ার বয়স হয়নি। এবং সাদা চোখে যেটুকু দেখলুম, তাতে তো সেরকম কিছু মনে হল না। ওর জ্যেঠতুতো দিদিটির, মানে ওই বিয়াত্রিসের, মেজাজটা যদি একটু নরম হতো, তাহলে আমি ওকেই সুন্দরী বলতাম। ওর পাশে হিরো? বসন্তের পাশে শীত। দাঁড়াও, দাঁড়াও। তোমার বিয়ে করার মতলব নাকি হে?
ক্লডিও। আমার চিরকৌমার্যের শপথ আমি ভাসিয়ে দিতে প্রস্তুত আছি, যদি হিরো আমাকে বিয়ে করতে রাজি হয়।
বেনেডিক। হায় রে, কী দিনকালই পড়ল! দুনিয়ায় কী বউয়ের চিন্তা ছাড়া আর কারোর অন্য কোনো চিন্তা নেই? কোনোদিনও কী তিন কুড়ি বয়সের আইবড়ো দেখতে পাব না? আচ্ছা যাও, যদি বিয়ে করে দাসখত লিখে দেওয়ার এতই শখ, তাহলেও কলুর বলদ হও গে যাও। দ্যাখো, ডন পেড্রো আসছেন তোমার খোঁজে।
ডন পেড্রোর প্রবেশ
ডন পেড্রো। কী হে! এখানে কী গোপন শলা-পরামর্শ চলছে তোমাদের?
বেনেডিক। মহামান্য কুমার আমাকে জোর করে কিছু বলতে বাধ্য না করলে আমি কিছুই বলব না।
ডন পেড্রো। আমার প্রতি তোমার আনুগত্যের দোহাই, আমি তোমাকে জোর করে বলতে বাধ্য করছি!
বেনেডিক। দ্যাখো ক্লডিও, তুমি নিশ্চয় জানো, আমি বোবা সেজেও কথা চেপে রাখতে পারি। কিন্তু আনুগত্যের খাতিরে – মানে নেহাতই আনুগত্যের খাতিরে কথাটা আমায় – (ডন পেড্রোর প্রতি) উনি প্রেমে পড়েছেন? কার প্রেমে? আন্দাজ করে নিন। কার আবার? লিওন্যাটোর বাঁটুলিনী কন্যা হিরোর প্রেমে!
ক্লডিও। ওটা তোমার কথা।
বেনেডিক। আহা! কী গল্পই না শোনালে! “সব মিথ্যে কথা! কিন্তু দোহাই ভগবান, এই মিথ্যেটাকেই সত্যি করে দিন!”
ক্লডিও। অস্বীকার করব না। এর মধ্যে মত না বদলালে, এটাই সত্যি কথা।
ডন পেড্রো। এ তো খুব ভাল কথা। মেয়েটাও তোমার স্ত্রী হওয়ার উপযুক্ত।
ক্লডিও। সত্যি বলছেন তো, প্রভু?
ডন পেড্রো। শপথ করে বলতে পারি, এটাই আমার অন্তরের কথা।
ক্লডিও। আমিও শপথ করে বলতে পারি, যা বলছি তা সম্পূর্ণ সত্য।
বেনেডিক। আমিও শপথ করে বলতে পারি, এটা পুরো সর্বনাশা কথা।
ক্লডিও। আমার মনে হয়, আমি ওর প্রেমে পড়েছি।
ডন পেড্রো। আমি জানি, ও তোমার প্রেমের যোগ্য।
বেনেডিক। আমি জানি না, কী করেই বা ওর প্রেমে পড়া যায় আর কী করেই বা ওকে ভালবাসা যায়! আমাকে কাঠে বেঁধে পোড়াও না কেন, আমার কথার একটুও নড়চড় হবে না!
ডন পেড্রো। তুমি তো রূপ দেখে পাগল হও না!
ক্লডিও। যুক্তি-টুক্তিরও ধার ধরো না!
বেনেডিক। দ্যাখো, এক নারী আমাকে গর্ভে ধারণ করেছিলেন। তারপর আমাকে মানুষ করেছিলেন। সেজন্য আমি তাঁকে ধন্যবাদ দিই। কিন্তু মাপ চাইছি, অন্য কোনো মেয়ে আমাকে বোকা বানাতে পারবে না। এমনকি বউ সেজেও প্রতারণা করতে পারবে না। কোনো বিশেষ মহিলাকে সন্দেহ করে আমি তার অপমান করতে চাই না বলেই, আমি সব মেয়েকে এড়িয়ে চলি। তাই আমার সিদ্ধান্ত – বিয়ে করব না। খাবোদাবো, ডুগডুগি বাজাবো!
ডন পেড্রো। মরবার আগে তোমাকে প্রেমরোগে আক্রান্ত হতে দেখতে চাই আমি।
বেনেডিক। রাগে আক্রান্ত হতে পারি। জ্বরে আক্রান্ত হতে পারি। খিদেয় আক্রান্ত হতে পারি। কিন্তু প্রেমরোগে? ছোঃ! যদি কোনোদিন আমার মধ্যে ও রোগের উপসর্গ খুঁজে পাও, আর দ্যাখো, আমার গলায় মদ ঢেলেও রোগ সারানো যাচ্ছে না, তাহলে আমার চোখদু’টো উপড়ে নিয়ে বেশ্যালয়ের দরজার মাথা থেকে কানা কিউপিডের ছবিটা নামিয়ে আমাকে সেইখানে লটকে দিও।
ডন পেড্রো। তোমার এই বুকনি আমার মনে থাকবে। যদি কোনোদিন প্রেমে পড়ো, সেদিন তোমায় মজা দেখিয়ে ছাড়ব।
বেনেডিক। আমার কথার খেলাপ হলে, আমাকে চাঁদমারি করে তির ছোঁড়া অনুশীলন কোরো।
ডন পেড্রো। সে কথা সময়ই বলবে। তবে একটা কথা মনে রেখো, অতিবুনো ষাঁড়ও মাঝেমাঝে পোষ মেনে যায়।
বেনেডিক। সে মানতে পারে। আমি কোনোদিন পোষ মানলে, সেই ষাঁড়ের শিং খুলে নিয়ে আমার মাথায় পরিয়ে দিও। বউ পালিয়ে যাবে। আর আমার গলায় ফলক ঝুলিয়ে তাতে বড়ো বড়ো অক্ষরে লিখে দিও – ‘ঘোড়া বিক্রি আছে’। আর তার নিচে লিখো, ‘এই দ্যাখো, বিবাহিত বেনেডিক’।
ক্লডিও। তাহলে তো তুমি পাগলা হয়ে যাবে হে!
ডন পেড্রো। কিউপিড যদি ভেনিসেই তাঁর তূণ খালি না করে দিয়ে আসেন, তাহলে তোমাকে কাঁপাবার জন্যও নিশ্চয় কিছু পাঠাবেন! দেখো!
বেনেডিক। তাহলে ধরণীও কেঁপে উঠবেন!
ডন পেড্রো। সময়ে তোমারও হবে। তবে এখনই নয়। এখন লিওন্যাটোর কাছে যাও দেখি। তাঁকে আমার নমষ্কার জানিয়ে বলো যে, আমি তাঁর সান্ধ্যভোজে উপস্থিত থাকব। আজ সেখানে দারুণ খাওয়াদাওয়া হবে মনে হচ্ছে।
বেনেডিক। এই কাজটা পারবো। আপনার একান্ত অনুগত–
ক্লডিও। ভৃত্য ও সুহৃদ বেনেডিক।
ডন পেড্রো। মদীয় বাসভবন (যদি থাকে)। ৬ জুলাই। ইতি।
বেনেডিক। উফ! মাঝে মাঝে তোমরা ঠাট্টার নামে ভাঁড়ামি জুড়ে দাও! অন্যকে কিছু বলার আগে একবার আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়িও। যাই হোক, আমি চললুম।
প্রস্থান।
ক্লডিও। প্রভু, আমাকে সাহায্য করবেন কি?
ডন পেড্রো। অবশ্যই করব। শুধু বলো কী করতে হবে! বুক চিরে করতে হলেও করব!
ক্লডিও। প্রভু, লিওন্যাটোর পুত্রসন্তান আছে?
ডন পেড্রো। হিরোই তাঁর একমাত্র সন্তান। তাঁর একমাত্র উত্তরাধিকারিণী। তোমার তাকে পছন্দ হয়?
ক্লডিও। প্রভু, যুদ্ধে যাওয়ার আগে ওকে সৈনিকের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখেছিলাম। তখন ওকে পছন্দ হয়েছিল। কিন্তু মন ছিল সামনের কঠিন পথটির দিকে। পছন্দ তাই ভালবাসার রূপ নেয়নি। এখন আর যুদ্ধের চিন্তা নেই। সেই শূন্যস্থান দখল করেছে নানা মধুর ভাবনা। এখন ধ্যান করছি হিরোর রূপ। মনে হচ্ছে যেন, যুদ্ধে যাওয়ার আগেই ওর প্রেমে পড়েছিলাম আমি।
ডন পেড্রো। আর কিছুদিন পরে তুমিও পাকা প্রেমিক হয়ে বন্ধুবান্ধবদের প্রেমের জয়গান শুনিয়ে শুনিয়ে ব্যতিব্যস্ত করে মারবে দেখছি। হিরোকে চাইলে ওকেই ভালবাসো। আমি মেয়ে আর মেয়ের বাপের সঙ্গে কথা বলব। লিওন্যাটোর সম্মতি আদায় করেই ছাড়ব। কী, এই জন্যই তো এত কথা বললে আমাকে, তাই না?
ক্লডিও। ঠিক ধরেছেন। আমি প্রেমেই পড়েছি। হয়ত সবটা আপনাকে বুঝিয়ে বলতে পারছি না। আমার অনুভূতির কথা আপনাকে বিস্তারিত বলতে ইচ্ছা করি।
ডন পেড্রো। দরকার কী? যেমন নদী, তেমন সেতু। তার বেশি নিয়ে কী হবে? তুমি হিরোকে ভালবাসো কিনা, আমি সেটুকুই জানতে চেয়েছিলাম। আজ রাতে মুখোশ নৃত্য হবে। আমি তোমার ছদ্মবেশে ওকে তোমার মনের কথা শুনিয়ে দেবো। তা শুনেই মেয়ে কাবু হয়ে যাবে। তারপর তার বাপের সঙ্গে কথা বলে তাকে তোমার হাতে সঁপে দেবো। এখন চলো যাই।
সকলের প্রস্থান।