রবি ঠাকুরের মা সারদাসুন্দরী দেবী ছিলেন সেকালের যশোর জেলার দক্ষিণডিহি গ্রামের রামনারায়ণ চৌধুরীর মেয়ে। তাঁর সঠিক জন্মসনটি জানা যায় না। ১৮৩৪ সালের মার্চ মাসে সতেরো বছর বয়সী দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। কন্যা সৌদামিনী দেবীর ‘পিতৃস্মৃতি’ ও পুত্রবধূ জ্ঞানদানন্দিনী দেবীর ‘স্মৃতিকথা’ থেকে জানা যায়, এই সময় সারদাসুন্দরীর বয়স ছিল ছয়। জ্ঞানদানন্দিনী তাঁর শ্বশুর-শাশুড়ির বিবাহের একটি বিবরণও দিয়েছেন:
তাঁর [সারদাসুন্দরী দেবীর] এক কাকা কলকাতায় শুনেছিলেন যে, আমার শ্বশুরমশায়ের জন্য সুন্দরী মেয়ে খোঁজা হচ্ছে। তিনি দেশে এসে আমার শাশুড়িকে (তিনি তখন ছয় বৎসরের মেয়ে) কলকাতায় নিয়ে গিয়ে বিয়ে দিয়ে দিলেন। তখন তাঁর মা বাড়ী ছিলেন না – গঙ্গা নাইতে গিয়েছিলেন। বাড়ী এসে মেয়েকে তাঁর দেওর না বলে-কয়ে নিয়ে গেছে শুনে তিনি উঠোনের এক গাছতলায় গড়াগড়ি দিয়ে কাঁদতে লাগলেন। তারপর সেখানে পড়ে কেঁদে কেঁদে অন্ধ হয়ে মারা গেলেন।
রবীন্দ্র-জীবনীকার প্রশান্তকুমার পাল লিখেছেন, “সারদা দেবীর জীবনে সম্পূর্ণ চিত্রটি আমাদের কাছে খুব স্পষ্ট নয়, সেকালের বাঙালী পরিবারের অন্তঃপুরচারিণী গৃহবধূর বৈচিত্র্যহীন জীবনে সে স্পষ্টতা আশাও করা যায় না।”
তাঁর শ্বশুর দ্বারকানাথ ছিলেন সেকালের ধনীদের মধ্যে অগ্রগণ্য ব্যক্তি। সুতরাং বিয়ে হয়েছিল তাঁর জাঁকজমকেই। জীবনও কেটেছিল ঠাকুরবাড়ির অতুল ঐশ্বর্য্যের মধ্যে। স্বামী ছিলেন পরম রূপবান। কিন্তু তিন পুত্রের জন্ম হওয়ার পরই দেবেন্দ্রনাথের মনে বিষয় বৈরাগ্যের উদয় হল। নির্জনে ঈশ্বরধ্যানের উদ্দেশ্যে ১৮৪৬ সালের বর্ষায় বেরিয়ে পড়লেন পথে। কেঁদে-কেটে স্বামীর সঙ্গে নিলেন সারদাসুন্দরীও। সঙ্গে চললেন তিন শিশুপুত্র দ্বিজেন্দ্রনাথ, সত্যেন্দ্রনাথ ও হেমেন্দ্রনাথ। পথে খবর এল, মারা গেছেন দ্বারকানাথ। যাত্রা অসমাপ্ত রেখে ফিরতে হল কলকাতায়।
সুখের ইতি। দ্বারকানাথের শ্রাদ্ধ অপৌত্তলিক মতে করলেন দেবেন্দ্রনাথ। ফলশ্রুতি, আত্মীয়বিচ্ছেদ। এই বিচ্ছেদ সারদাসুন্দরীর বিশেষ মানসিক যন্ত্রণার কারণ হয়েছিল। সেই সঙ্গে ধর্ম নিয়েও পড়েছিলেন দোলাচলে।
সারদাসুন্দরী দেবীর শাশুড়ি দিগম্বরী দেবী ও দিদিশাশুড়ি অলকা দেবী ছিলেন ধর্মপ্রাণা মহিলা। এঁদের শিক্ষা এবং হিন্দুনারীর সহজাত ধর্মপ্রবৃত্তি, দুইই বলবতী ছিল সারদাসুন্দরীর চরিত্রে। দ্বারকানাথের সময়ে জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে ধুমধাম করে দুর্গা ও জগদ্ধাত্রী পূজা হত। দেবেন্দ্রনাথ জগদ্ধাত্রী পূজা তুলে দিলেন। দুর্গাপূজার সময় দেশভ্রমণে চলে যেতেন। কালক্রমে দুর্গাপূজাও উঠে গেল। দেবেন্দ্রনাথের সেজ ভাই গিরীন্দ্রনাথ অপৌত্তলিক প্রথায় অনুষ্ঠানাদি হতে দেখে গৃহদেবতা লক্ষ্মী-জনার্দন শিলার সেবার ভার গ্রহণ করে পৃথক হয়ে গেলেন। খগেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন, “আমরা প্রাচীনাদের মুখে শুনিয়াছি সারদাদেবী স্বামীর কথায় নূতন ধর্ম্মানুষ্ঠান অনুশীলনে একটু দোদুল্যমান অবস্থায় পড়িয়াছিলেন। তাঁহার চিরদিনের অভ্যস্থ বাহ্যিক পূজা অনুষ্ঠান ৩৫ বৎসর বয়সে স্বামীর মতানুবর্ত্তিনী হইয়া ত্যাগ করিয়াছিলেন। বেদীতে বসিয়া কিন্তু নিজের ইষ্টমন্ত্র ও হরিনাম জপ করিতেন এবং স্বামীর ধর্ম্মব্যাখ্যা শ্রদ্ধার সহিত শ্রবণ করিতেন। আবার চিরদিনের অভ্যাসের ফলে কখন কখন রমানাথ ঠাকুরের বাটীর দুর্গোৎসবের পূজক কেনারাম শিরোমণির হস্তে, স্বামীর অজ্ঞাতে, কালীঘাটে ও তারকেশ্বরে পূজা প্রেরণ করিতেন।”
কন্যা সৌদামিনী দেবী মায়ের স্বামীভক্তির একটি ছবি এঁকেছেন, “মা আমার সতীসাধ্বী পতিপরায়ণা ছিলেন। পিতা সর্বদাই বিদেশে কাটাইতেন এই কারণে সর্বদাই তিনি চিন্তিত হইয়া থাকিতেন। পূজার সময় কোনোমতেই পিতা বাড়িতে থাকিতেন না। এইজন্য পূজার উৎসবে যাত্রা গান আমোদ যত কিছু হইত তাহাতে আর সকলেই মাতিয়া থাকিতেন কিন্তু মা তাহার মধ্যে কিছুতে যোগ দিতে পারিতেন না। তখন নির্জন ঘরে তিনি একলা বসিয়া থাকিতেন। কাকীমারা আসিয়া তাঁকে কত সাধ্য সাধনা করিতেন, তিনি বাহির হইতেন না। গ্রহাচার্যরা স্বস্ত্যয়নাদির দ্বারা পিতার সর্বপ্রকার আপদ দূর করিবার প্রলোভন দেখাইয়া তাঁহার কাছ হইতে সর্বদাই যে কত অর্থ লইয়া যাইত তাহার সীমা নাই।”
সৌদামিনী দেবীর লেখা থেকে আরও একটি ঘটনার কথা জানা যায়। ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহের সময়ে দেবেন্দ্রনাথ ছিলেন সিমলায়। দাঙ্গাহাঙ্গামার হুজ্জুতে অনেককাল বাড়িতে চিঠিপত্র দিতে পারেননি। তাই গুজব রটে গেল, সিপাহিরা তাঁকে হত্যা করেছে। সেই শুনে সারদাসুন্দরী দেবী আহারনিদ্রা ত্যাগ করে কান্নাকাটি শুরু করে দেন। অনুরূপ একটি ঘটনার বর্ণনা রবীন্দ্রনাথও দিয়েছেন, তাঁর ‘জীবনস্মৃতি’ বইতে:
বেশ মনে আছে, আমাদের ছেলেবেলায় কোনো-এক সময়ে ইংরেজ গবর্মেণ্টের চিরন্তন জুজু রাসিয়ান-কর্তৃক ভারত-আক্রমণের আশঙ্কা লোকের মুখে আলোচিত হইতেছিল। কোনো হিতৈষিণী আত্মীয়া আমার মায়ের কাছে সেই আসন্ন বিপ্লবের সম্ভাবনাকে মনের সাধে পল্লবিত করিয়া বলিয়াছিলেন। পিতা তখন পাহাড়ে ছিলেন। তিব্বত ভেদ করিয়া হিমালয়ের কোন্-একটা ছিদ্রপথ দিয়া যে রুসীয়েরা সহসা ধুমকেতুর মতো প্রকাশ পাইবে, তাহা তো বলা যায় না। এইজন্য মার মনে অত্যন্ত উদ্বেগ উপস্থিত হইয়াছিল। বাড়ির লোকেরা নিশ্চয়ই কেহ তাঁহার এই উৎকণ্ঠার সমর্থন করেন নাই। মা সেই কারণে পরিণতবয়স্ক দলের সহায়তালাভের চেষ্টায় হতাশ হইয়া শেষকালে এই বালককে আশ্রয় করিলেন। আমাকে বলিলেন,”রাসিয়ানদের খবর দিয়া কর্তাকে একখানা চিঠি লেখো তো।” মাতার উদ্বেগ বহন করিয়া পিতার কাছে সেই আমার প্রথম চিঠি। কেমন করিয়া পাঠ লিখিতে হয়, কী করিতে হয় কিছুই জানি না। দফতরখানায় মহানন্দ মুনশির শরণাপন্ন হইলাম। পাঠ যথাবিহিত হইয়াছিল সন্দেহ নাই। কিন্তু ভাষাটাতে জমিদারি সেরেস্তার সরস্বতী যে জীর্ণ কাগজের শুষ্ক পদ্মদলে বিহার করেন তাহারই গন্ধ মাখানো ছিল। এই চিঠির উত্তর পাইয়াছিলাম। তাহাতে পিতা লিখিয়াছিলেন-ভয় করিবার কোনো কারণ নাই, রাসিয়ানকে তিনি স্বয়ং তাড়াইয়া দিবেন। এই প্রবল আশ্বাসবাণীতেও মাতার রাসিয়ানভীতি দূর হইল বলিয়া বোধ হইল না- কিন্তু পিতার সম্বন্ধে আমার সাহস খুব বাড়িয়া উঠিল।
এখানে বলে রাখা ভাল, প্রথাগত শিক্ষায় শিক্ষিতা না হলেও, সারদাসুন্দরী নিরক্ষর ছিলেন না। তাঁর অপর কন্যা স্বর্ণকুমারী দেবীর ‘আমাদের গৃহে অন্তঃপুর শিক্ষা ও তাহার সংস্কার’ প্রবন্ধ থেকে জানা যায়, “মাতাঠাকুরাণী ত কাজকর্ম্মের অবসরে সারাদিনই একখানি বই হাতে লইয়া থাকিতেন। চাণক্যশ্লোক তাঁহার বিশেষ প্রিয় পাঠ ছিল, প্রায়ই বইখানি লইয়া শ্লোকগুলি আওড়াইতেন। তাঁহাকে সংস্কৃত রামায়ণ-মহাভারত পড়িয়া শুনাইবার জন্য প্রায়ই কোনো না কোনো দাদার ডাক পড়িত।” উল্লেখ্য, চাণক্যশ্লোক দেবেন্দ্রনাথেরও খুব প্রিয় ছিল। তবে সেকালের যুগধর্ম ও রক্ষণশীলতা থেকে মুক্ত হতে পারেননি সারদাসুন্দরীও। জ্ঞানদানন্দিনী দেবীর পিতামাতা কলকাতায় ভাড়াবাড়িতে থাকতেন, এই জন্য তিনি জ্ঞানদানন্দিনীকে বাপের বাড়ি আসতে বাধা দিয়েছিলেন। অবশেষে দেবেন্দ্রনাথের হস্তক্ষেপে জ্ঞানদানন্দিনী বাপের বাড়ি আসেন। সত্যেন্দ্রনাথ স্ত্রী-স্বাধীনতার পক্ষপাতী ছিলেন বলে তিনি ছেলেকে ধমকাতেন, “তুই মেয়েদের নিয়ে মেমদের মত গড়ের মাঠে ব্যাড়াতে যাবি নাকি?” সত্যেন্দ্রনাথ অবশ্য শুধু গড়ের মাঠ নয়, স্ত্রীকে বিলেত পর্যন্ত পাঠিয়েছিলেন।
সাংসারিক ব্যাপারেও কিছুটা উদাসীন ছিলেন সারদাসুন্দরী। সেকালের ধনী গৃহস্থের গৃহিনী হিসেবে সেটা অবশ্য অস্বাভাবিক ছিল না। জ্ঞানদানন্দিনী দেবীর ভাষায়, “আমার শাশুড়ীর একটু স্থূল শরীর ছিল, তাই বেশি নড়াচড়া করতে পারতেন না।” মহর্ষি বাড়ি থাকলে রান্নাঘরে যেতেন। উপাসনার সময় মহর্ষির কাছে গিয়ে বসতেন। জ্ঞানদানন্দিনীর লেখা থেকে আরও জানা যায়, “আমার মনে পড়ে বাবামশায় [দেবেন্দ্রনাথ] যখন বাড়ী থাকতেন আমার শাশুড়িকে একটু রাত করে ডেকে পাঠাতেন, ছেলেরা সব শুতে গেলে। আর মা একখানি ধোয়া সূতি শাড়ি পরতেন, তারপর একটু আতর মাখতেন; এই ছিল তাঁর রাতের সাজ।”
পনেরো সন্তানের জননী সারদাসুন্দরী যে সন্তানদের প্রতিও যথাযথ মনোযোগ দিতে পারতেন না, সেকথাও ঠাকুরবাড়ির একাধিক সদস্যের স্মৃতিকথা থেকে জানা যায়। তবে কনিষ্ঠ পুত্রটির সঙ্গে তাঁর মায়ের একটু ঘনিষ্ট সম্বন্ধই ছিল। ‘জীবনস্মৃতি’তে রবীন্দ্রনাথ আর এক জায়গায় লিখেছেন:
পৃথিবীসুদ্ধ লোকে কৃত্তিবাসের বাংলা রামায়ণ পড়িয়া জীবন কাটায়, আর আমি পিতার কাছে স্বয়ং মহর্ষি বাল্মীকির স্বরচিত অনুষ্টুভ ছন্দের রামায়ণ পড়িয়া আসিয়াছি, এই খবরটাতে মাকে সকলের চেয়ে বেশি বিচলিত করিতে পারিয়াছিলাম। তিনি অত্যন্ত খুশি হইয়া বলিলেন, “আচ্ছা, বাছা, সেই রামায়ণ আমাদের একটু পড়িয়া শোনা দেখি।”
হায়, একে ঋজুপাঠের সামান্য উদ্ধৃত অংশ, তাহার মধ্যে আবার আমার পড়া অতি অল্পই, তাহাও পড়িতে গিয়া দেখি মাঝে মাঝে অনেকখানি অংশ বিস্মৃতিবশত অস্পষ্ট হইয়া আসিয়াছে। কিন্তু যে-মা পুত্রের বিদ্যাবুদ্ধির অসামান্যতা অনুভব করিয়া আনন্দসম্ভোগ করিবার জন্য উৎসুক হইয়া বসিয়াছেন, তাঁহাকে “ভুলিয়া গেছি” বলিবার মতো শক্তি আমার ছিল না। সুতরাং ঋজুপাঠ হইতে যেটুকু পড়িয়া গেলাম তাহার মধ্যে বাল্মীকির রচনা ও আমার ব্যাখ্যার মধ্যে অনেকটা পরিমাণে অসামঞ্জস্য রহিয়া গেল। স্বর্গ হইতে করুণহৃদয় মহর্ষি বাল্মীকি নিশ্চয়ই জননীর নিকট খ্যাতিপ্রত্যাশী অর্বাচীন বালকের সেই অপরাধ সকৌতুক স্নেহহাস্যে মার্জনা করিয়াছেন, কিন্তু দর্পহারী মধুসূদন আমাকে সম্পূর্ণ নিষ্কৃতি দিলেন না।
মা মনে করিলেন, আমার দ্বারা অসাধ্যসাধন হইয়াছে, তাই আর সকলকে বিস্মিত করিয়া দিবার অভিপ্রায়ে তিনি কহিলেন, “একবার দ্বিজেন্দ্রকে শোনা দেখি।” তখন মনে-মনে সমূহ বিপদ গনিয়া প্রচুর আপত্তি করিলাম। মা কোনোমতেই শুনিলেন না। বড়দাদাকে ডাকিয়া পাঠাইলেন। বড়দাদা আসিতেই কহিলেন, “রবি কেমন বাল্মীকির রামায়ণ পড়িতে শিখিয়াছে একবার শোন্-না।” পড়িতেই হইল। দয়ালু মধুসূদন তাঁহার দর্পহারিত্বের একটু আভাসমাত্র দিয়া আমাকে এ-যাত্রা ছাড়িয়া দিলেন। বড়দাদা বোধ হয় কোনো-একটা রচনায় নিযুক্ত ছিলেন- বাংলা ব্যাখ্যা শুনিবার জন্য তিনি কোনো আগ্রহ প্রকাশ করিলেন না। গুটিকয়েক শ্লোক শুনিয়াই “বেশ হইয়াছে” বলিয়া তিনি চলিয়া গেলেন।
তবে মাতা-পুত্রের সম্পর্কের মধুরতম ছবিটি বোধহয় তিনি এঁকেছিলেন অনেক পরে, ‘অসম্ভব কথা’ গল্পে:
বেশ মনে আছে সেদিন সন্ধ্যাবেলা ঝড়বৃষ্টি হইতেছিল। কলিকাতা শহর একেবারে ভাসিয়া গিয়াছিল। গলির মধ্যে একহাঁটু জল। মনে একান্ত আশা ছিল, আজ আর মাস্টার আসিবে না। কিন্তু তবু তাঁহার আসার নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত ভীতচিত্তে পথের দিকে চাহিয়া বারান্দায় চৌকি লইয়া বসিয়া আছি। যদি বৃষ্টি একটু ধরিয়া আসিবার উপক্রম হয় তবে একাগ্রচিত্তে প্রার্থনা করি, হে দেবতা আর একটুখানি কোনোমতে সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা পার করিয়া দাও। তখন মনে হইত পৃথিবীতে বৃষ্টির আর কোনো আবশ্যক নাই, কেবল একটিমাত্র সন্ধ্যায় নগরপ্রান্তের একটিমাত্র ব্যাকুল বালককে মাস্টারের করাল হস্ত হইতে রক্ষা করা ছাড়া। পুরাকালে কোনো একটি নির্বাসিত যক্ষও তো মনে করিয়াছিল, আষাঢ়ে মেঘের বড়ো একটা কোনো কাজ নাই, অতএব রামগিরিশিখরের একটিমাত্র বিরহীর দুঃখকথা বিশ্ব পার হইয়া অলকার সৌধবাতায়নের কোনো একটি বিরহিণীর কাছে লইয়া যাওয়া তাহার পক্ষে কিছুমাত্র গুরুতর নহে, বিশেষত পথটি যখন এমন সুরম্য এবং তাহার হৃদয়বেদনা এমন দুঃসহ।
বালকের প্রার্থনামতে না হউক, ধূম-জ্যোতিঃ-সলিল-মরুতের বিশেষ কোনো নিয়মানুসারে বৃষ্টি ছাড়িল না। কিন্তু হায় মাস্টারও ছাড়িল না। গলির মোড়ে ঠিক সময়ে একটি পরিচিত ছাতা দেখা দিল, সমস্ত আশাবাষ্প একমুহূর্তে ফাটিয়া বাহির হইয়া আমার বুকটি যেন পঞ্জরের মধ্যে মিলাইয়া গেল। পরপীড়ন পাপের যদি যথোপযুক্ত শাস্তি থাকে তবে নিশ্চয় পরজন্মে আমি মাস্টার হইয়া এবং আমার মাস্টারমহাশয় ছাত্র হইয়া জন্মিবেন। তাহার বিরুদ্ধে কেবল একটি আপত্তি এই যে, আমাকে মাস্টারমহাশয়ের মাস্টার হইতে গেলে অতিশয় অকালে ইহসংসার হইতে বিদায় লইতে হয়, অতএব আমি তাঁহাকে অন্তরের সহিত মার্জনা করিলাম।
ছাতাটি দেখিবামাত্র ছুটিয়া অন্তঃপুরে প্রবেশ করিলাম। মা তখন দিদিমার সহিত মুখোমুখি বসিয়া প্রদীপালোকে বিন্তি খেলিতেছিলেন। ঝুপ করিয়া একপাশে শুইয়া পড়িলাম। মা জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘কী হইয়াছে।’ আমি মুখ হাঁড়ির মতো করিয়া কহিলাম, ‘আমার অসুখ করিয়াছে, আজ আর আমি মাস্টারের কাছে পড়িতে যাইব না।’
আশা করি, অপ্রাপ্তবয়স্ক কেহ আমার এ লেখা পড়িবে না, এবং স্কুলের কোনো সিলেকশন-বহিতে আমার এ লেখা উদ্ধৃত হইবে না। কারণ, আমি যে কাজ করিয়াছিলাম তাহা নীতিবিরুদ্ধ এবং সেজন্য কোনো শাস্তিও পাই নাই। বরঞ্চ আমার অভিপ্রায় সিদ্ধ হইল।
মা চাকরকে বলিয়া দিলেন, ‘আজ তবে থাক্, মাস্টারকে যেতে বলে দে।’
কিন্তু তিনি যেরূপ নিরুদ্বিগ্নভাবে বিন্তি খেলিতে লাগিলেন, তাহাতে বেশ বোঝা গেল যে মা তাঁহার পুত্রের অসুখের উৎকট লক্ষণগুলি মিলাইয়া দেখিয়া মনে মনে হাসিলেন। আমিও মনের সুখে বালিশের মধ্যে মুখ গুঁজিয়া খুব হাসিলাম- আমাদের উভয়ের মন উভয়ের কাছে অগোচর রহিল না।
পুত্রবধূ, পৌত্র-পৌত্রী, দৌহিত্র-দৌহিত্রীদের প্রতি তাঁর স্নেহ ছিল অকৃত্রিম। তাঁর এক পুত্রবধূ প্রফুল্লময়ী দেবীর কথায়, “শাশুড়ীর মতো শাশুড়ী পাইয়াছিলাম।… অত বড় বৃহৎ পরিবারের সমস্ত সংসারের ভার তাঁহারই উপর ছিল, তিনি প্রত্যেককে সমানভাবে আদর যত্নে অতি নিপূণ ভাবে সকলের অভাব, দুঃখ, দূর করিয়া চলিয়া গিয়াছেন। কাহাকেও কোনও বিষয় হইতে বঞ্চিত করিয়া মনে ব্যথা দিবার কখনও চেষ্টা করিতেন না। তাঁহার মনটি শিশুর মতো কোমল ছিল। এত বড় লোকের পুত্রবধূ এবং গৃহিনী হওয়া সত্ত্বেও তাঁর মনে কোনরকম জাঁক, বা বিলাসিতার ছায়া স্পর্শ করিতে পারে নাই। যতদূর সম্ভব সাদাসিধে ধরণের সাজ পোষাক করিতেন, কিন্তু তাহাতেই তাঁহার দেহের সৌন্দর্য্যকে আরও বাড়াইয়া তুলিত।”
দেবেন্দ্রনাথ ‘দ্বারকানাথ ঠাকুর এস্টেট’-এ সারদাসুন্দরী দেবীর নামে ২৪,৭০০ টাকা দিয়ে একটি ডিপোজিট অ্যাকাউন্ট সৃষ্টি করেছিলেন। তার সমস্ত উপস্বত্ব সারদাসুন্দরীই ভোগ করতেন। এর উপরে ব্যক্তিগত মাসোহারা ছাড়াও কন্যা ও জামাতাদের মাসোহারাও ‘সারদাসুন্দরী দেবী’ খাতে প্রদত্ত হত।
১৮৭৫ সালের ১১ মার্চ আনুমানিক মাত্র ৪৯ বছর বয়সে সারদাসুন্দরী দেবীর মৃত্যু হয়। রবীন্দ্রনাথের বয়স তখন তেরো বছর দশ মাস। সেই মৃত্যুর বিবরণও ধরা পড়েছে রবীন্দ্রনাথেরই লেখায়:
মা’ র যখন মৃত্যু হয় আমার তখন বয়স অল্প। অনেকদিন হইতে তিনি রোগে ভুগিতেছিলেন, কখন যে তাঁহার জীবনসংকট উপস্থিত হইয়াছিল তাহা জানিতেও পাই নাই। এতদিন পর্যন্ত যে-ঘরে আমরা শুইতাম সেই ঘরেই স্বতন্ত্র শয্যায় মা শুইতেন। কিন্তু তাঁহার রোগের সময় একবার কিছুদিন তাঁহাকে বোটে করিয়া গঙ্গায় বেড়াইতে লইয়া যাওয়া হয়- তাহার পরে বাড়িতে ফিরিয়া তিনি অন্তঃপুরের তেতালার ঘরে থাকিতেন। যে-রাত্রিতে তাঁহার মৃত্যু হয় আমরা তখন ঘুমাইতেছিলাম, তখন কত রাত্রি জানি না, একজন পুরাতন দাসী আমাদের ঘরে ছুটিয়া আসিয়া চীৎকার করিয়া কাঁদিয়া উঠিল, “ওরে তোদের কী সর্বনাশ হল রে।” তখনই বউঠাকুরানী তাড়াতাড়ি তাহাকে ভর্ৎসনা করিয়া ঘর হইতে টানিয়া বাহির করিয়া লইয়া গেলেন-পাছে গভীর রাত্রে আচমকা আমাদের মনে গুরুতর আঘাত লাগে এই আশঙ্কা তাঁহার ছিল। স্তিমিত প্রদীপে, অস্পষ্ট আলোকে ক্ষণকালের জন্য জাগিয়া উঠিয়া হঠাৎ বুকটা দমিয়া গেল কিন্তু কী হইয়াছে ভালো করিয়া বুঝিতেই পারিলাম না। প্রভাতে উঠিয়া যখন মা’র মৃত্যুসংবাদ শুনিলাম তখনো সে-কথাটার অর্থ সম্পূর্ণ গ্রহণ করিতে পারিলাম না। বাহিরের বারান্দায় আসিয়া দেখিলাম তাঁহার সুসজ্জিত দেহ প্রাঙ্গণে খাটের উপরে শয়ান। কিন্তু মৃত্যু যে ভয়ংকর সে- দেহে তাহার কোনো প্রমাণ ছিল না- সেদিন প্রভাতের আলোকে মৃত্যুর যে-রূপ দেখিলাম তাহা সুখসুপ্তির মতোই প্রশান্ত ও মনোহর। জীবন হইতে জীবনান্তের বিচ্ছেদ স্পষ্ট করিয়া চোখে পড়িল না। কেবল যখন তাঁহার দেহ বহন করিয়া বাড়ির সদর দরজার বাহিরে লইয়া গেল এবং আমরা তাঁহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ শ্মশানে চলিলাম তখনই শোকের সমস্ত ঝড় যেন এক-দমকায় আসিয়া মনের ভিতরটাতে এই একটা হাহাকার তুলিয়া দিল যে, এই বাড়ির এই দরজা দিয়া মা আর একদিনও তাঁহার নিজের এই চিরজীবনের ঘরকন্যার মধ্যে আপনার আসনটিতে আসিয়া বসিবেন না। বেলা হইল, শ্মশান হইতে ফিরিয়া আসিলাম; গলির মোড়ে আসিয়া তেতালায় পিতার ঘরের দিকে চাহিয়া দেখিলাম- তিনি তখনো তাঁহার ঘরের সম্মুখের বারান্দায় স্তব্ধ হইয়া উপাসনায় বসিয়া আছেন।
কৃতজ্ঞতা স্বীকার:
এই নিবন্ধটি রচনা করতে সর্বাধিক সাহায্য নিয়েছি প্রশান্তকুমার পালের ‘রবিজীবনী’ প্রথম খণ্ড থেকে। প্রশান্তবাবুর কাছে ঋণ অপরিশোধেয়। তাঁর নয় খণ্ড ‘রবিজীবনী’ রবীন্দ্রানুরাগী মাত্রেই অবশ্যপাঠ্য। এছাড়া উদ্ধৃতি নিয়েছি রবীন্দ্রনাথের ‘জীবনস্মৃতি’ ও ‘গল্পগুচ্ছ’ প্রথম খণ্ড থেকেও।
chayapoth
মে 8, 2011 at 5:57 পুর্বাহ্ন
খুব সুন্দর একটি লেখা। পড়ে অনেক কিছু জানতে পারলাম। এতদিন শুধু রবিন্দ্রনাথকে জানতাম, তার মা সম্পর্কে প্রায় কিছুই জানতাম না। আজ জেনে নিজেকে গর্বিত মনে হচ্ছে।
অসংখ্য ধন্যবাদ আপনাকে।
অর্ণব দত্ত
মে 8, 2011 at 9:43 পুর্বাহ্ন
আপনার ভাল লেগেছে জেনে শ্রম সার্থক বোধ করছি। ধন্যবাদ আপনাকেও।
Tumpa
নভেম্বর 18, 2011 at 9:59 পুর্বাহ্ন
khub valo laglo…
অর্ণব দত্ত
নভেম্বর 19, 2011 at 5:05 পুর্বাহ্ন
Thanks a lot.
Shankar Mohajan
নভেম্বর 18, 2011 at 4:38 অপরাহ্ন
mone ekti dharona dhire dhire basa bnadhchilo je, bangla hoito amar jibon theke onek dure chole geche. onek din por emon ekti lekha pore abornonio shanti pelam. asha kori emonti cholte thakbe
অর্ণব দত্ত
নভেম্বর 19, 2011 at 5:04 পুর্বাহ্ন
Thanks a lot. 😀
Ruba
নভেম্বর 19, 2011 at 1:11 পুর্বাহ্ন
very interesting. thanks
অর্ণব দত্ত
নভেম্বর 19, 2011 at 5:03 পুর্বাহ্ন
You most welcome. 😀
sejutishipu
নভেম্বর 19, 2011 at 12:34 অপরাহ্ন
anek valo laglo. Robindranath amader govir bishmoy, tar paribarik itihas, tar ma- somporke khub kam janar sujog peyechhi. anek dhonyobad. grateful.
অর্ণব দত্ত
নভেম্বর 19, 2011 at 1:49 অপরাহ্ন
Thats why I chose to write on this topic. Thanks anyway. 🙂
Manabendra Bera
নভেম্বর 19, 2011 at 12:34 অপরাহ্ন
This is nice one in my life.
অর্ণব দত্ত
নভেম্বর 19, 2011 at 1:49 অপরাহ্ন
Thank you very much. 🙂
krishna
নভেম্বর 22, 2011 at 9:36 অপরাহ্ন
ratno garbha mohila.
অমল কান্তি সরকার
ডিসেম্বর 27, 2011 at 9:33 অপরাহ্ন
অজানা আনেক কিছূ জানতে পেরে ভাল লাগলো। আরো কিছু জানতে পারবো আপনার অন্য লেখা থেকে সে আশায় থাকলাম।
অর্ণব দত্ত
ডিসেম্বর 28, 2011 at 9:58 পুর্বাহ্ন
এ নিতে প্রচুর লিখতে ইচ্ছে করে। কিন্তু অত সময় কই? তবু, যতটা পারি লিখি। 🙂
আখতার
অগাষ্ট 15, 2016 at 6:38 অপরাহ্ন
৭নং প্যারার দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। সিপাহী বিদ্রোহ হয় ১৮৫৭ সালে। রবীন্দ্রনাথের জন্ম ১৮৬১তে। মায়ের কাছ থেকে অনুরুদ্ধ হয়ে সিমলায় অবস্থান করা বাবার কাছে চিঠি দিলেন বালক রবীন্দ্রনাথ ???
অর্ণব দত্ত
ডিসেম্বর 28, 2017 at 3:59 পুর্বাহ্ন
আমি দু’টি পৃথক ঘটনার কথা বলেছি। রবীন্দ্রনাথের জন্মের পূর্বে সিপাহি বিদ্রোহের সময় একটি ঘটনা ঘটেছিল। ওই রকম একটি ঘটনা (মহর্ষি নিহত হওয়ার গুজব) রবীন্দ্রনাথ ছেলেবেলায় দেখেছিলেন। প্রথম ঘটনাটি রবীন্দ্রনাথ, স্বাভাবিকভাবেই, দেখেননি। শুধু শুনেছিলেন। দ্বিতীয়টি দেখেছিলেন।