‘সহজপাঠ’ বাদ দিলে গড় বাঙালির প্রথম রবীন্দ্রপরিচিতি তাঁর গানের মধ্যে দিয়ে। আমি আজন্ম বেয়াড়া। আমার বেলায় সে নিয়ম খাটেনি। রবীন্দ্রনাথকে আমি গানের মধ্যে দিয়ে চিনিনি। তাঁকে চিনতে চিনতেই তাঁর গানের মধ্যে এসেছিলাম।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় অতিশৈশবেই। সহজপাঠের পর্ব আর পাঁচটা বাঙালি ছেলের মতো আমার জীবনেও গেছে। কিন্তু তার মধ্যে দিয়ে আমি রবীন্দ্রনাথকে পাইনি। বরং ‘সহজপাঠ’ আমার শৈশবে নিছকই একটা প্রাইমারই রয়ে গেছে। ছেলেবেলায় মা আমার বর্ণমালা শিক্ষার উপর একটু অধিক গুরুত্বারোপ করেছিলেন। তাই ‘বর্ণপরিচয়’ ছাড়াও আরও কয়েকটি বর্ণমালা-শিক্ষার বই পড়েছিলাম। তারই একটিতে রবীন্দ্রনাথের ছবি ছিল। দু’টি ছবি। র-এ ‘রবি ঠাকুর মহান কবি’, ল-এ ‘লেখার সাথে আঁকেন ছবি’। বাকি ছড়াটা ভুলে গেছি। কিন্তু এই দু’টি পংক্তি আদি কবির প্রথম কবিতার মতো মনে গেঁথে আছে। আর আমার প্রথম রবীন্দ্রনাথের ছবি দু’টিও।
এরপর রবীন্দ্রনাথের আরও কয়েকটি ছড়া পড়েছিলাম। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সরকারি শিশুপাঠ্য বাংলা বই ‘কিশলয়’-এ। যে ছড়া তিনটি বিশেষ ভাল লেগেছিল, সেগুলি হল ‘দামোদর শেঠ’, ‘হাতির হাঁচি’ আর ‘ক্ষান্তবুড়ির দিদিশাশুড়ি’। আরও কয়েকটি ছড়া পড়েছিলাম। মোটামুটি দাড়িওয়ালা কবিটিকে মন্দ লাগেনি। তৃতীয় শ্রেণিতে পাঠ্য হল সংকলিতা। এই প্রথম রবীন্দ্রনাথের সিরিয়াস কবিতায় উপনীত হলাম। প্রথম যে কবিতাটি পড়েছিলাম, সেটি ছিল ‘সার্থক জনম’। কবিতাটি মুখস্ত করেছিলাম। কবিতাই। কারণ, এটি যে গান, তা জেনেছি অনেক বছর পরে। ক্লাসে অনেক বার আবৃত্তি করেছি ‘সার্থক জনম’। বেশ ভাল লাগত। তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণিতে সংকলিতা প্রথম ও দ্বিতীয় ভাগ পড়েছি আবৃত্তি শিক্ষার বই হিসেবে। কবিতাগুলি বুঝতে অসুবিধে হত না। সবচেয়ে বড়ো কথা, প্রশ্নোত্তর লিখতে হত না। তাই বেশ লাগত। অবশ্য পরীক্ষায় মুখস্ত বলতে ও লিখতে হত। একবার একটা কবিতার লাইন ভুল করে ভরা ক্লাসের মাঝে চড় খেয়েছিলাম। ছেলেদের স্কুলে চড়-থাপ্পড় খাওয়াটা গৌরবের, এতে বন্ধুসমাজে হিরোর মর্যাদা মিলত। সব দিক থেকে ছাত্রজীবনে ‘সংকলিতা’ আমার সুখস্মৃতিই। আজও ওই বইটার মায়া কাটাতে পারিনি। ছেলেবেলার অনেক স্মৃতি হারিয়ে গেছে, কিন্তু সংকলিতার ওই দুটি ভাগ তাদের খাজা-খাজা হয়ে যাওয়া শীর্ণ শরীরদু’টি নিয়ে আজও আমার বইয়ের তাক থেকে বিছানার নৈশ পাঠশয্যায় ডেলি প্যাসেঞ্জারি করে।
রবীন্দ্রনাথের গদ্যের সঙ্গেও টুকটাক পরিচিতি ঘটছিল। কিন্তু প্রথম আমার হৃদয় হরণ করেছিল ‘পেটে ও পিঠে’। তখন আমি পঞ্চম শ্রেণি। এবং এই রচনাটিরও সৌজন্য ‘কিশলয়’। ‘পেটে ও পিঠে’ মুখস্ত করে ফেলেছিলাম। এমন পরমাগ্রহে রবীন্দ্রনাথের আরও একটি রচনা মুখস্ত করেছিলাম। ‘কাবুলিওয়ালা’ ছোটোগল্পটি। সে অবশ্য আরও একটু বড়ো হয়ে। ‘পেটে ও পিঠে’ পড়ার পর আমার জীবনে রবি অস্তমিত হয়েছিলেন বছর দুয়েকের জন্য। ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে আমাকে গ্রাস করেছিলেন বঙ্কিম। পাঠ্যবইয়ের বাইরে প্রথম সাহিত্যের স্বাদ আমি পেয়েছিলাম বঙ্কিমের রচনা থেকেই। রবীন্দ্রনাথ আমার প্রিয় লেখক। কিন্তু বঙ্কিম আজও আমার প্রথম প্রেম। ওই দুই বছর বঙ্কিমের কয়েকটি উপন্যাস ও প্রবন্ধ পড়েছিলাম। আমার শিক্ষক ছিলেন জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাস প্রণীত দুই খণ্ডের ‘বাঙ্গালা ভাষার অভিধান’। এই সময় আমার পূজ্যপাদ পিতৃদেব বিশ্বসাহিত্যেও দীক্ষিত করেছিলেন আমাকে। পড়েছিলাম ইংরেজি সাহিত্যের কয়েকটি মহত্তম কীর্তির বঙ্গানুবাদ। মোটামুটি সাহিত্য বিষয়ে একটু এঁচড়েপাকা পেকে অবশেষে সপ্তম শ্রেণির শেষভাগে আবার ফিরে এলাম রবীন্দ্রনাথে। পড়লাম ‘রাজর্ষি’।
সমালোচকেরা এই উপন্যাসটির প্রতি কৃপাদৃষ্টি পাত করেন না। প্রথম পাঠে আমার এই উপন্যাসটি খারাপ লাগেনি। বরং বেশ ভাল লেগেছিল। গোটা উপন্যাসটা আরও তিন-চার বার পড়েছিলাম। এরপর পড়েছিলাম ‘বউঠাকুরাণীর হাট’। প্রসঙ্গত, দু’টিই ছিল ঐতিহাসিক উপন্যাস। ঐতিহাসিক উপন্যাসের প্রতি আমার একটা দুর্বলতা সৃষ্টি হয়েছিল বঙ্কিমের সূত্রে। ষষ্ঠ-সপ্তম শ্রেণিতে পড়ার সময় বঙ্কিমের যে উপন্যাসগুলি বেছে বেছে পড়েছিলাম, সেগুলি সবই ছিল ঐতিহাসিক উপন্যাস। ভাল লেগেছিল। রবীন্দ্রনাথও ঐতিহাসিক উপন্যাসের ক্ষেত্রে বঙ্কিমানুসারী লেখক। সুতরাং তাঁর রচনা আমার মন্দ লাগেনি। এই সময়ে আরও একটি উপন্যাস পড়েছিলাম। ‘প্রজাপতির নির্বন্ধ’। সেটি অবশ্য পড়ি ‘চিরকুমার সভা’-র অনুষঙ্গে। গল্পগুচ্ছের প্রথম খণ্ডও তখন শেষ। তাতেও মুগ্ধতা। ফলত, আমার জীবনে গদ্যশিল্পী রবীন্দ্রনাথ জাঁকিয়ে বসেছিলেন।
সেই সঙ্গে এল গান। বারো-তেরো বছর বয়স পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথের একটা গানই জানতাম। ‘জনগণমন-অধিনায়ক জয় হে’। স্কুল শুরুর আগে হাত জোড় করে সম্মেলক গাইতাম। গান শুনেছিলাম আরও। কিন্তু কোনো কারণেই হোক, তাতে মনোনিবেশ করিনি। অবশেষে এক সন্ধ্যায় একটি গানের দু’টি পংক্তি আমাকে টেনে এনেছিল রবীন্দ্রসংগীতের প্রতি – ‘আজ নিখিলের আনন্দধারায় ধুইয়ে দাও, মনের কোণের সব দীনতা মলিনতা ধুইয়ে দাও।’ এই গানটা শোনার কয়েকদিন পরেই উত্তরবঙ্গে বেড়াতে যাওয়ার সুযোগ এসেছিল। সেবার যাচ্ছিলাম বাসে। কৃষ্ণনগর পেরিয়ে রাস্তার দু’পাশে ধানজ্যোৎস্না। মাথার উপর চৈতালি পূর্ণিমার চাঁদ। ওয়াকম্যানে সেদিন শুনেছিলাম ‘দোলে প্রেমের দোলনচাঁপা হৃদয় আকাশে’, ‘এ কী লাবণ্যে পূর্ণ প্রাণ, প্রাণেশ হে’। বহু বছর বাদে বাঁকুড়ার আদিগন্ত প্রসারিত সর্ষে খেতের মধ্যে দিয়ে যেতে যেতে শুনেছি, ‘নীল দিগন্তে ওই ফুলের আগুন লাগল।’ সেবারও অগ্রহায়ণে গিয়েছিলাম জলপাইগুড়িতে। ‘ও মা অঘ্রাণে তোর ভরা খেতে কী দেখেছি মধুর হাসি’! রবীন্দ্রনাথের গানকে শিশুকাল থেকেই বাংলার ধানক্ষেত, আকাশ, নদী, সমুদ্র, অরণ্যের মধ্যে পেয়েছি। তাই রবীন্দ্রসদন-কলামন্দির আমাকে কোনোকালেই টানে না।
এই সময় আমার পরিবারের আর এক সদস্য আমাকে টানলেন রবীন্দ্রনাথের কবিতার দিকে। আমার ঠাকুমা। তাঁর আয়ুতরণি তখন জীবননদীর মোহনার কাছাকাছি। জীবনের শেষ পনেরো বছর বহন করেছিলেন অন্ধত্বের অভিশাপ। অন্ধকার ঘরে বসে তাঁর এই শিশুপৌত্রটিকে একটি কথা মাঝে মাঝেই বলতেন।
‘ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাই— ছোটো সে তরী
আমারি সোনার ধানে গিয়েছে ভরি।
শ্রাবণগগন ঘিরে
ঘন মেঘ ঘুরে ফিরে,
শূন্য নদীর তীরে
রহিনু পড়ি—
যাহা ছিল নিয়ে গেল সোনার তরী।’
কথাটার মধ্যে আক্ষেপ ছিল, দুঃখ ছিল, হাহাকার ছিল। সেটা আজ বুঝি। আজ উনি চলে যাওয়ার এত বছর বাদে, ওঁর জীবনস্মৃতিগুলি মিলিয়ে দেখলে আমার কাছে স্পষ্ট হয়ে যায়, অন্ধ বিধবার সব হারিয়ে জীবন নদীর পাড়ে একা পড়ে থাকার যাতনা মূর্তি পেত এই কবিতায়। ঠাকুমা চলে গেলেন এক শারদপ্রাতে। রেখে গেলেন, তাঁর বহুবার পড়া ও অনেক দিন না পড়া রবীন্দ্র-রচনাবলীর খণ্ডগুলি। রবীন্দ্রনাথের কবিতার অর্থটা অবশ্য আর কোনোদিন খুঁজতে যাইনি তাতে।
Bhaswati Ghosh
মে 4, 2011 at 3:16 পুর্বাহ্ন
মন ছুঁয়ে গেল, লেখাটা পড়ে। রবীন্দ্রনাথ সম্বন্ধে তাত্ত্বিক রচনার চাইতে এই ধরণের গভীর ব্যক্তিগত সম্পর্কের কথা পড়তে আমার অনেক ভালো লাগে। তিনি আমাদের আরও সম্মৃদ্ধ করুন।
অর্ণব দত্ত
মে 4, 2011 at 11:36 পুর্বাহ্ন
তাত্ত্বিক রচনার প্রয়োজনীয়তা আমি অস্বীকার করি না। কিন্তু পাশাপাশি রবীন্দ্রনাথ-পাঠক ব্যক্তিগত সম্পর্কের এই সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম অনুভূতিগুলিও প্রয়োজনীয়তা আছে। কারণ, লেখকের সার্থকতা পাঠকের তৃপ্তিতে।