RSS

তুলসী লাহিড়ী

07 মার্চ

প্রখ্যাত নট, নাট্যকার, পরিচালক ও গীতিকার তুলসী লাহিড়ী (১৮৯৭ – ১৯৫৯) বাংলা নাটক ও অভিনয়ের জগতে একটি বিশিষ্ট ও স্মরণীয় নাম। জন্ম রংপুরের নলডাঙার জমিদার পরিবারে। তাঁর নিজস্ব শিক্ষাদীক্ষা, পারিবারিক সংস্কৃতি, তাঁর আইনজ্ঞান, রংপুরে সেই সময়কার নাট্যসংস্কৃতি, জমিদারের ছেলে হয়েও কৃষিজীবন ও সংস্কৃতি সম্পর্কে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও পঞ্চাশের মন্বন্তরের রূঢ় অভিঘাত এবং সর্বোপরি মূল্যবোধে দৃঢ়বিশ্বাস তাঁর শিল্পী মানসকে প্রভাবিত করেছিল। সংগীতের মাধ্যমে তাঁর নাট্যজগতে প্রবেশ। যেখানেই তিনি বিশেষ কোনো আদর্শের কথা বলেছেন (যেমন ‘ছেঁড়া তার’, ‘বাংলার মাটি’) সেখানেই রবীন্দ্রনাথের গান-কবিতার উদ্ধৃতি যেন তাঁর নাটকের আবশ্যিক অঙ্গ হয়ে গেছে।

১৯২৯ সালে উস্তাদ জমিরুদ্দিন খাঁকে দিয়ে স্বরচিত দু’টি গান গ্রামাফোন কোম্পানি অফ ইন্ডিয়া (হিজ মাস্টার্স ভয়েস) থেকে রেকর্ড করান তুলসীবাবু। এরপর থেকেই শুরু হয় তাঁর সুরকার, গীতিকার, পরিচালক ও অভিনেতার জীবন। নাট্যকার রূপে তিনি প্রগতিশীল নাট্যধারার সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েন। প্রথম সুর সংযোজনা করেন আর্ট থিয়েটারের ‘স্বয়ম্বরা’ (১৯৩১) নাটকে। প্রথম অভিনয় করেন রবীন্দ্র-নাটক ‘চিরকুমার সভা’র চন্দ্রবাবুর চরিত্রে। এছাড়া সুর দেন ‘পোষ্যপুত্র’, ‘মন্দির’ প্রভৃতি নাটকে। ‘যমুনা পুলিনে’ নামে একটি চলচ্চিত্রও পরিচালনা করেন।

১৯৪৬ সালে শ্রীরঙ্গম থিয়েটারে তাঁর প্রথম নাটক ‘দুঃখীর ইমান’ অভিনীত হয়। ১৯৪৭ সালের মে-জুন নাগাদ নাটকটি বই আকারে প্রকাশিত হয়। বিজন ভট্টাচার্যের ‘নবান্ন’ ও তুলসীবাবুর ‘দুঃখীর ইমান’ সমসাময়িক দু’টি রচনা। কিন্তু আদর্শগত কারণে গণনাট্য সংঘ এই নাটকটি মঞ্চস্থ করেনি। এটি মঞ্চস্থ হয়েছিল পেশাদার নাট্যমঞ্চে। তাত্ত্বিক দিক থেকে তুলসীবাবু কমিউনিস্ট ছিলেন না। তিনি মানবতাবাদী একটি বিশেষ আদর্শে বিশ্বাস করতেন। যুগের প্রভাবে কৃষক শ্রেণির দুঃখ-বেদনা-বিশ্বাসের দিকটি তিনি ফুটিয়ে তুলেছিলেন তাঁর নাটকে। সুধী প্রধান লিখেছেন, ‘বিজন মার্ক্সবাদ পড়ে যা করতে পারেনি – তুলসীবাবু না পড়ে তাই করেছেন।’ সেই কারণেই হয়ত শিল্পবাদী এবং রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে শোধনবাদী শম্ভু মিত্রের ‘বহুরূপী’ দলে যোগ দিয়েছিলেন তুলসীবাবু। অবস্থানের দিক থেকে তাই তাঁকে গণনাট্য অপেক্ষা নবনাট্য দলের একজন বলতে হয়। ১৯৪৯ সালের ১৬ অক্টোবর তুলসীবাবুর ‘পথিক’ নাটকের মাধ্যমেই বহুরূপীর যাত্রা শুরু হয়। এই নাটকে কয়লাখনির সাধারণ মজুরদের ধ্বংসের নিচে চাপা পড়ার কাহিনিকে পটভূমি করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার কালোবাজারি ও ডাকাত দলের বিরুদ্ধে এক আদর্শবাদী ভবঘুরেকে জাহির করেছেন তিনি – এই লোকটি কোনো দলের লোক নয়, অথচ সত্যের জন্য প্রাণ দিতে পারে।

১৯৫০ সালের ১৭ ডিসেম্বর নিউ এম্পায়ার থিয়েটারে বহুরূপীর প্রযোজনায় তুলসী লাহিড়ীর ‘ছেঁড়া তার’ নাটকটি অভিনীত হয়। কৃষক জীবনের সাধারণ সমস্যার সঙ্গে মুসলিম সমাজের তালাকের সমস্যা তিনি যেভাবে এই নাটকে উত্থাপন করেছেন, বাংলা সাহিত্যে তার তুলনা নেই। কিন্তু তা সত্ত্বেও বলতে হয়, যে শ্রেণিসংগ্রামের মধ্যে দিয়ে ‘ছেঁড়া তার’ নাটকের সূচনা, সেই শ্রেণিসংগ্রামই নাটকে পরে গৌন হয়ে গেছে। একটি বিশেষ মূল্যবোধ, আদর্শবাদ ও ভাববাদী মনোভাব তুলসীবাবুকে বিশেষভাবে পরিচালিত করেছিল। এই নাটকে তিনি নিজে হাছিমুদ্দি চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন।

১৯৫৩ সালে বহুরূপী ছেড়ে বেরিয়ে আসার পর প্রথমে ‘আনন্দম্’ ও পরে ‘রূপকার’ নামে নিজস্ব নাট্যদল গড়ে তোলেন। ঐ বছরই ৩ অক্টোবর ‘ক্রান্তিশিল্পী সংঘ’র মণ্ডপে তাঁর ‘বাংলার মাটি’ অভিনীত হয়। এই নাটকটি ছিল হিন্দু-মুসলমান সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠার একটি প্রয়াস। নাটকের শেষে ব্যবহৃত হয় বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলনের সময় রবীন্দ্রনাথের লেখা ‘বাংলার মাটি, বাংলার জল’ গানটি দিয়ে। এই নাটকে আবু মিঞা ছিলেন নাট্যকারের মুখপাত্র। দার্শনিক আদর্শে বিশ্বাসী এই চরিত্রটির কণ্ঠে ব্যবহৃত হয়েছিল আর একটি রবীন্দ্রগান – ‘বিধির বাঁধন কাটবে তুমি এমনি শক্তিমান’।

এরপর তুলসীবাবু লেখেন ‘ঝড়ের নিশান’ ও ‘লক্ষ্মীপ্রিয়ার সংসার’। আবু মিঞার মতো লক্ষ্মীপ্রিয়ার সংসার নাটকে সমাজকর্মী এক দুঃস্থ নারীকে বলেছে ‘দুঃখের পোড়-খাওয়া সব দুঃখীর দল তোমার পাশে আছে।’

তুলসী লাহিড়ীর একাঙ্ক নাটক ‘নাট্যকার’ ১৯৫৬ সালে গণনাট্য সংঘ কর্তৃক অভিনীত হয়েছিল। এই নাটকে তুলসীবাবু নিজে মুখ্য চরিত্র কমলবাবুর চরিত্রে অভিনয় করেন। এখানে আমরা নাট্যকারকে বলতে শুনি, যারা লোভে নানা কুকর্ম করে, তারা মনুষ্যত্বের চরম শত্রু। ১৯৬১ সালে তাঁর ‘নাট্যকারের ধর্ম’ প্রবন্ধটি গণনাট্য সংঘের রাজ্যোৎসব উপলক্ষ্যে প্রকাশিত স্মরণিকায় প্রকাশিত হয়।

গণনাট্য সংঘের নাট্যরচনা ও প্রযোজনার নিয়মনীতি তুলসী লাহিড়ী কিছুটা অনুসরণ করলেও ভাববাদ থেকে নিজেকে সম্পূর্ণ মুক্ত করতে পারেননি। ‘ছেঁড়া তার’ নাটকে ছেকিমুদ্দিনের সাজা হয়ত শোষক পক্ষের পরাজয়ের প্রত্যক্ষ প্রমাণ, কিন্তু নাট্যকারের মূল লক্ষ্য ছিল রহিমের ট্রাজেডিটি তুলে ধরা। তাই তুলসী লাহিড়ী নাট্যকার রূপে প্রগতিশীল ভাবধারার অনুসারী হয়েও শেষবিচারে তিনি ভাববাদী, আদর্শবাদী ও শিল্পবাদী। যে ভাববাদী আশা ও আদর্শবাদ তাঁর নাটকের প্রধান সুর – ‘আজও যারা বেঁচে আছে, তারা রাত্রির সাধনা করে প্রভাতকে বরণ করে আনবে, এই আশায় উন্মুখ হয়ে দিগন্তে চেয়ে আছে…’।

 

ট্যাগ সমুহঃ

মন্তব্য করুন

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  পরিবর্তন )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  পরিবর্তন )

Connecting to %s

 
%d bloggers like this: