উনিশ শতকের একেবারে গোড়ার দিকে হুগলির শ্রীরামপুর মিশন ও কলকাতার ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে আধুনিক বাংলা গদ্যের জন্ম। প্রথম যুগের ইংরেজি গদ্যসাহিত্যের মতো বাংলা গদ্যসাহিত্যেরও সূচনা হয়েছিল জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চার মাধ্যমে এবং এই চর্চার একটি প্রধান মাধ্যম ছিল অনুবাদ। দুটি পৃথক ধারায় চলত এই অনুবাদ। একটি ধারায় ভারতীয় ও ইউরোপীয় সাহিত্যের বিখ্যাত গল্প-আখ্যানগুলির অনুবাদ করা হত। যেমন, উইলিয়াম কেরির ‘ইতিহাসমালা’ বা বাইবেল অনুবাদ। পরবর্তীকালে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরও এই ধারায় অনেকগুলি ধ্রুপদি গ্রন্থের বঙ্গানুবাদ করেন। অনুবাদের দ্বিতীয় ধারাটি ছিল, জ্ঞানবিজ্ঞান-সংক্রান্ত প্রবন্ধাবলির বঙ্গানুবাদ। ইংরেজি ভাষায় প্রকাশিত বই বা সংবাদপত্র থেকে পাশ্চাত্য জ্ঞানবিজ্ঞানমূলক নানা রচনা বাংলায় অনূদিত হতে শুরু করে উনিশ শতকের একেবারের সূচনালগ্ন থেকেই। এই সব নিবন্ধ প্রকাশিত হত পত্রপত্রিকায়। শ্রীরামপুর মিশন থেকে প্রকাশিত জন ক্লার্ক সম্পাদিত প্রথম বাংলা সাময়িকপত্র ‘দিগদর্শন’ ছাত্রদের উপযোগী ইতিহাস, ভূগোল, বিজ্ঞান ইত্যাদি বিষয়ে প্রবন্ধ প্রকাশ করত। এই সব প্রবন্ধ লিখতেন একাধিক জ্ঞাতনামা ও অজ্ঞাতনামা বাঙালি সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিত।
১৮১৭ সালে ছাত্রবোধ পাঠ্যপুস্তক রচনার জন্য ষোলোজন ইউরোপীয় ও আটজন ভারতীয়ের উদ্যোগে চালু হয় ক্যালকাটা স্কুল বুক সোসাইটি। সোসাইটির ভারতীয় সদস্যদের মধ্যে ছিলেন মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার, রাধাকান্ত দেব, রামকমল সেন, তারিণীচরণ মিত্র, আবদুল ওয়াজেদ, করিম হোসেন, আবদুল হামিদ ও মহম্মদ রশিদ। ১৮২২ সালে স্কুল বুক সোসাইটি ‘পশ্বাবলী’ নামে একটি মাসিকপত্র চালু করেন। প্রথম পর্যায়ে এই পত্রিকার রচনাগুলি সংগ্রহ করতেন পাদরি লসন। সেগুলি বাংলায় অনুবাদ করতেন ডব্লিউ. এইচ. পিয়ার্স। পত্রিকার প্রতিটি সংখ্যায় একটি পশুর কাঠখোদাই ছবি ও তার নিচে পশুটির পরিচয় দেওয়া হত। ১৮৩৩ সাল থেকে দ্বিতীয় পর্যায়ে পত্রিকাটি পরিচালনা শুরু করেন হিন্দু কলেজের শিক্ষক রামচন্দ্র মিত্র। ‘পশ্বাবলী’-ই সম্ভবত বাংলা ভাষার প্রথম বিশ্বকোষীয় রচনা। আধুনিক ‘অ্যানিম্যাল এনসাইক্লোপিডিয়া’ বা ‘প্রাণী বিশ্বকোষ’ জাতীয় বইয়ের সঙ্গে এর সাদৃশ্য লক্ষণীয়।
বাংলা ভাষায় ‘এনসাইক্লোপিডিয়া’ নামধারী বইয়ের আবির্ভাব ঘটে ঠিক তার পরের দশকেই। ডিরোজিয়ান ‘ইয়ংবেঙ্গল’ গোষ্ঠীর অন্যতম নেতা রেভারেন্ড কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮১৩-১৮৮৫) প্রকাশ করেন তেরো খণ্ডে বিভক্ত সুবৃহৎ ইংরেজি-বাংলা দ্বিভাষিক বিশ্বকোষ। বইটির ইংরেজি নাম ছিল ‘এনসাইক্লোপিডিয়া বেঙ্গলিস্’; বাংলা নাম ছিল ‘বিদ্যাকল্পদ্রুম’। প্রকাশকাল ১৮৪৬-১৮৬৭। বইটির উদ্দেশ্য ছিল “বঙ্গভূমির জন্য সাধারণ মতিভ্রম নিবারণার্থে গৌড়ীয় (বাংলা) ভাষাতে ইউরোপীয় পুরাবৃত্ত ও দর্শনাদি শাস্ত্রের বর্ণনা করা।” রেভারেন্ড বন্দ্যোপাধ্যায়ই ছিলেন এই গ্রন্থের প্রধান লেখক ও সম্পাদক। আচার্য অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় এই বইটি সম্পর্কে লিখেছেন, “তাঁর প্রতিভা ও পরিশ্রমের শ্রেষ্ঠ প্রমাণ ‘বিদ্যাকল্পদ্রুম’ (১৮৪৬-৬৭) – যাকে বিশ্বকোষ বলা যেতে পারে। এতে ইতিহাস, ভূগোল, ক্ষেত্রতত্ত্ব, জীবনচরিত, নীতিবোধক ইতিহাস, চিত্তের উৎকর্ষবিধান প্রভৃতি বিবিধ ও বিচিত্র বিষয়ের সংক্ষিপ্ত পরিচয় দেওয়া হয়েছে।” প্রসঙ্গান্তরে যাওয়ার আগে ‘বিদ্যাকল্পদ্রুম’ বইয়ে ব্যবহৃত বাংলা গদ্যের একটু নিদর্শন দেবো:
“আমার অভিপ্রায় এই যে বঙ্গভূমির সমস্ত জাতিকে আমার শ্রোতা করি অতএব যে কেহ পাঠ করিতে পারে সকলের উদ্বোধক কথা ব্যবহার করিব তথাচ রচনার মাধুর্য দর্শাইয়া মনোরঞ্জক শিক্ষা বিস্তার করিতে সাধ্যক্রমে ত্রুটি করি না কিন্তু রূপক অলঙ্কারাদি রচনার শোভা স্পষ্টতর বোধক হইলে তাহার অনুরোধে বাক্যের সারল্য নষ্ট করিব না।” (‘বিদ্যাকল্পদ্রুম’, প্রথম কাণ্ড, ১৮৪৬) (লেখক এখানে যতিচিহ্ন ব্যবহার করেননি।)
উনিশ শতকে বাংলা ভাষায় এনসাইক্লোপিডিয়া রচনার অন্যতম সার্থক প্রচেষ্টা ‘বিশ্বকোষ’। এই গ্রন্থের প্রথম খণ্ড রচনা করেন রঙ্গলাল মুখোপাধ্যায় এবং তা সম্পাদনা করেন তাঁর ভাই ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়। প্রথম খণ্ড প্রকাশিত হয় ১৮৮৬ সালে (বাংলা ১২৯৩ অব্দে)। এরপর রঙ্গলালের কাছ থেকে ‘বিশ্বকোষ’-এর স্বত্ব ও প্রকাশভার কিনে নেন নগেন্দ্রনাথ বসু প্রাচ্যবিদ্যার্ণব (১৮৬৬-১৯৩৮)। বইয়ের দ্বিতীয় থেকে বাইশতম খণ্ড পর্যন্ত নগেন্দ্রনাথই রচনা ও সম্পাদনা করেন। ফলত, এই গ্রন্থের কয়েকটি ছাড়া সকল ভুক্তিই রচনা করেন নগেন্দ্রনাথ। এই মহাগ্রন্থ রচনায় মোট সময় লেগেছিল সাতাশ বছর। হুগলির মাহেশের মানুষ নগেন্দ্রনাথের জন্ম ও নিবাস ছিল কলকাতার বাগবাজারে। তাঁর শ্রেষ্ঠ কীর্তির প্রতি সম্মান জানিয়ে বাগবাজারের একটি রাস্তার নাম রাখা হয়েছে ‘বিশ্বকোষ লেন’।
নগেন্দ্রনাথের বিশ্বকোষের সাফল্যের পর বাংলা ভাষায় প্রকাশিত হয়েছিল একাধিক কোষগ্রন্থ-জাতীয় বই। তেমনই বিষয়ভিত্তিক বিশ্বকোষও রচিত হয়। বিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে ব্রাহ্ম শিক্ষাবিদ শশিভূষণ বিদ্যালঙ্কার (১৮৬১-১৯৪৭) দুই পর্বে প্রথম জীবনীকেন্দ্রিক বাংলা বিশ্বকোষ রচনা করেন। এই কোষগ্রন্থের নাম ছিল ‘জীবনীকোষ’। এর প্রথম পর্বটি দুই খণ্ডে সমাপ্য। এর বিষয়বস্তু ভারতীয় (মূলত হিন্দু) পৌরাণিক চরিত্রগুলির জীবনী। এর প্রকাশকাল ১৯৩৪। দ্বিতীয় পর্বের বিষয়বস্তু ঐতিহাসিক ব্যক্তিবর্গের জীবনী। দ্বিতীয় খণ্ডটি তিনি সম্পূর্ণ করে যেতে পারেননি।
বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ কর্তৃক ‘ভারতকোষ’ প্রকাশিত হয় ষাট-সত্তরের দশকে। এর সম্পাদকেরা ছিলেন আদিত্য ওহদেদার, কালিদাস ভট্টাচার্য, গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্য, চিন্তামণি কর, চিন্তাহরণ চক্রবর্তী, নির্মলকুমার বসু, ফণিভূষণ চক্রবর্তী, বিনয় দত্ত, রমেশচন্দ্র মজুমদার, রামগোপাল চট্টোপাধ্যায়, সত্যেন্দ্রনাথ বসু, সুকুমার সেন, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় ও সুশীলকুমার দে। লেখক তালিকায় ছিলেন সাহিত্য, শিল্প, সংস্কৃতির জগতের প্রথম সারির ব্যক্তিত্বেরা। পাঁচ খণ্ডে প্রকাশিত হয় এই বিশ্বকোষ।
এরপর বাংলা ভাষায় প্রকাশিত হয় একাধিক সাধারণ ও নির্দিষ্ট বিষয়কেন্দ্রিক বিশ্বকোষ। এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য: ‘বাংলাপিডিয়া’ (বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি, ঢাকা), ‘সংসদ বাঙালি চরিতাভিধান’ (সাহিত্য সংসদ, কলকাতা), ‘বাংলা একাডেমী চরিতাভিধান’, ‘বাংলা একাডেমী বিজ্ঞান বিশ্বকোষ’ (বাংলা একাডেমী, ঢাকা), ‘বিজ্ঞানকোষ’ (শিশু-কিশোর আকাদেমি, কলকাতা), ‘বঙ্গসাহিত্যাভিধান’ (হংসনারায়ণ ভট্টাচার্য, ফার্মা কেএলএম, কলকাতা), ‘রবীন্দ্ররচনাভিধান’ (দীপ প্রকাশন, কলকাতা) ইত্যাদি।
তবে নিঃসন্দেহে বাংলা বিশ্বকোষের জগতে বৃহত্তম কীর্তি মুক্ত বিশ্বকোষ ‘উইকিপিডিয়া’ (http://bn.wikipedia.org/)। ‘বিদ্যাকল্পদ্রুম’-এর প্রায় ১৬০ বছর পরে ২০০৪ সালের জানুয়ারি মাসে সম্পূর্ণভাবে স্বেচ্ছাসেবকদের দ্বারা লিখিত এই ইন্টারনেট বিশ্বকোষের আবির্ভাব ঘটে। বর্তমানে বাংলা উইকিপিডিয়ার নিবন্ধ সংখ্যা ২২ হাজারের কিছু বেশি। নিবন্ধিত ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১৮,০০০ এবং বিগত এক মাসে সক্রিয় ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১৭৩। পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশ থেকে মোট নয় জন প্রশাসক বাংলা উইকিপিডিয়ার কাজকর্ম তদারক করেন। এই উইকিপিডিয়া গড়েও উঠছে দুই বাংলার ব্যবহারকারীদের যৌথ উদ্যোগে এবং সম্মিলিত প্রচেষ্টায়।
বই পড়া ফুরায়, নটে গাছটি মুড়ায়। বই চলে যায় বইয়ের তাকে অথবা লাইব্রেরির অন্ধকার আলমারিতে। কিন্তু যে বইয়ের পথ চলা কখনই ফুরায় না, তা হল বিশ্বকোষ। প্রতি নিয়ত চলে তার পরিবর্ধন পরিমার্জন। বাংলা বিশ্বকোষের পথ চলাও তাই ফুরায়নি আজও। প্রতি বছরই নতুন নতুন আঙ্গিকে, নতুন চিন্তাকে সঙ্গী করে কোনো না কোনো বিশ্বকোষ প্রকাশিত হচ্ছে। হবেও। বিশ্বকোষ সভ্যতা ও সমাজের বাতিঘর। তাই প্রকাশনা জগতের এই ধারাটি যত সমৃদ্ধ হবে, ততই পোক্ত হবে আমাদের জাতির বুনিয়াদ।
[নিবন্ধটি বাংলা উইকিপিডিয়ার প্রশাসক শ্রীজয়ন্ত নাথের একান্ত অনুরোধে লিখিত। সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। লেখকের অনুমতি ভিন্ন কোনো ব্লগ, ওয়েবসাইট বা অন্য কোথাও এটি প্রকাশ করা যাবে না।]
© Arnab Dutta
bellayet
ফেব্রুয়ারি 7, 2011 at 1:37 অপরাহ্ন
চমৎকার হয়েছে লেখাটি। আপনি অনুমতি দিলে লেখাটি আমার ব্লগে প্রকাশ করতে চাই, সাথে আপনার একটি ছবিও।
সাড়ার অপেক্ষায় রইলাম।
বেলায়েত
অর্ণব দত্ত
ফেব্রুয়ারি 7, 2011 at 1:57 অপরাহ্ন
ধন্যবাদ। অবশ্যই প্রকাশ করতে পারেন। তবে লেখাটির স্বত্ব উল্লেখ করে করে দেবেন। ইতিপূর্বে আমার লেখা চুরি যাওয়ার ঘটনা ঘটেছে কিনা, তাই আজকাল একটু সতর্ক থাকি। 🙂