RSS

প্রেম প্রসঙ্গে

07 ফেব্রু.

পার্সি বিশ শেলি
ভাবানুবাদ: অর্ণব দত্ত
~
রচনাপ্রসঙ্গে:
শেষ জীবনে লেখা অনেক কবিতা ও কবিতাংশের মতো এই প্রবন্ধটিও শেলি ইতালিতে বসে লেখেন। মাত্র একটি খসড়া পাণ্ডুলিপি পাওয়া গেছে এই রচনাটির। ১৮২৮ সালে কবিপত্নী মেরি শেলি ”কিপসেক ফর ১৮২৯” নামক অ্যানালে এটি প্রথম প্রকাশ করেন। অনতিবিলম্বেই ইংল্যান্ড ও নিউ ইয়র্কে এটি পুনর্মুদ্রিত হয় এবং ফ্রান্সের পত্রপত্রিকাগুলিতে এর অনুবাদ প্রকাশিত হয়।


~*~

প্রেম কী?– জিজ্ঞাসা করো তাঁকে, যিনি প্রত্যক্ষ করেছেন জীবনকে; পূজা করেছেন ঈশ্বরকে।

আমি অন্যের অন্তর দেখিনি। এমনকি, এই যে তোমার সঙ্গে কথা বলছি, তোমার ভিতরটাও আমি দেখিনি। তবে দেখেছি, বাইরের কোনো কোনো বিষয়ে ওদের সঙ্গে আমার মিল রয়েছে। সেই বাইরের মিলটুকুর দ্বারা প্রতারিত হয়ে আমি আমাদের মধ্যে যা কিছু সমরূপী, তা খুঁজতে যাই। তাদের কাছে হালকা করতে যাই আমার অন্তরাত্মার বোঝা। কিন্তু তখনই দেখি দূর বর্বর দেশের ভাষার মতো দুরূহ দুর্বোধ্য হয়ে উঠছে আমার ভাষা। তারা আমাকে যতই অনুভব করার সুযোগ করে দেয়, ততই বড়ো হয়ে দেখা দেয় আমাদের মাঝের ফাঁকটুকু, ততই হারিয়ে যেতে থাকে সহানুভূতিগুলি। আমার আত্মা এই পরীক্ষা সইতে পারে না। দুর্বল কম্পিত আত্মাটাকে বহন করে খুঁজে বেড়িয়েছি সবখানে। বাধা আর হতাশা ছাড়া কিছুই পাইনি।

তুমি জানতে চেয়েছ, প্রেম কী? প্রেম সেই শক্তিশালী আকর্ষণী ক্ষমতা, আমাদের মনে কথাকে অপ্রতুলতার কালগহ্বরে হারিয়ে যেতে দেখলে, যাকে আমরা বাইরে থাকে ধারণ করি, ভয় করি বা আশা করি। যুক্তিবিচার করতে বোধশক্তি পাই। কল্পনা করলে দেখতে পাই আমাদের মস্তিষ্কের আসমানি শিশুটি যেন আরেকজনের মস্তিষ্কে নতুন জন্ম লাভ করছে। অনুভব করতে গেলে বুঝতে পারি, আরেক জনের নাড়ীর স্পন্দন অনুভূত হচ্ছে আমাদের দেহে, তার নয়নের জ্যোতি মুহুর্তের মধ্যে জ্বলে উঠে আমার চোখে এসে মিলেমিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে। অনুভব করি, হৃদয়ের উষ্ণ রক্তে সিঞ্চিত ওষ্ঠাধরের প্রত্যুত্তর মৃতপ্রায় হিমেল ঠোঁটে শোভা পায় না। এই হল প্রেম। এই হল বাঁধন। এই হল সেই সম্মিলনী, যা শুধুমাত্র মানুষকে মানুষের সঙ্গেই আবদ্ধ করে না, বরং যা কিছু অস্তিত্বমান, তাকেই একের বাঁধনে বাঁধে। আমাদের জন্ম এই জগতেই। আমাদের মধ্যে এমন কিছু আছে যা আমাদের জীবনের উপলক্ষ্য। যা আমাদের তৃষ্ণাকে আপনিই নিয়ে চলে পরিতৃপ্তির পথে। হয়ত এই কারণেই শিশু তার মাতৃস্তন্য থেকে দুধ টেনে নেয়। আমাদের প্রকৃতিগত বিকাশের সঙ্গে সঙ্গেই এই প্রবৃত্তিটি আপনি বিকশিত হয়ে ওঠে। অন্তরে আমাদের বৌদ্ধিক সত্ত্বাটির একটি ক্ষুদ্র প্রতিরূপ দেখতে পাই আমরা। মনে করি, এটিই আমাদের পূর্ণাঙ্গ সত্ত্বা। আমাদের অপ্রিয় পরিত্যাজ্য কোনো কিছুই যেন এর মধ্যে নেই। এ যেন আমাদের কল্পনার আয়ত্তে থাকা মানবপ্রকৃতির শ্রেষ্ঠ ও মধুর গুণাবলির এক আদর্শ রূপকল্প। এর মধ্যে শুধু আমাদের বাইরের সত্ত্বার ছবিটাই নেই, বরং আমাদের প্রকৃতির খুঁটিনাটির বর্ণনাও রয়েছে এতে: এ এমন এক আয়না, যা শুধু পবিত্র ও উজ্জ্বল অংশগুলিই প্রতিবিম্বিত করে: আমাদের আত্মার মধ্যে আরেকটি আত্মা এমন এক স্বর্গোদ্যানের ছবি আঁকে, যেখানে দুঃখ, কষ্ট, অমঙ্গল প্রবেশ করার সাহসই পায় না। আমরা আমাদের বাসনা ঢেলে দিই এখানে, যাতে তারা এর সঙ্গে মিলেমিশে যেতে পারে। এর একটি বিপরীত রূপও আছে: এমন এক বোঝাপড়া যা আমাদের সিদ্ধান্তগুলিকে স্পষ্টভাবে পরিমাপ করতে পারে। এমন এক কল্পনাশক্তি যা আমাদের অন্তরে প্রবেশ করে গোপনে লালিত আনন্দঘন সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিরুদ্ধ বৈশিষ্ট্যগুলিকে অধিকার করে নেয়। এমন একটি শরীর যার শিরাগুলি মধুর কোনো কণ্ঠের সঙ্গতে বাদিত দু’খানি বীণার তারের মতো আমাদের অন্তরের কম্পনকে কম্পিত করে তোলে। এবং এই সবের এক সম্মিলিত রূপ যা চাহিদা অনুযায়ী আর একটি সত্ত্বা গঠন করতে পারে। এই রূপটি প্রেমের অদৃশ্য ও অলভ্য রূপ। একটি ক্ষীণ ছায়া আছে, এই ছায়াটিকে ধরতে পারলেই হৃদয়ে শান্তি মেলে। প্রেমের ওই রূপটি লাভ করতে হলে এই ছায়াটিকে ধরার ক্ষমতা মানুষের হৃদয়ে থাকা চাই। তাই নির্জন নির্বান্ধব পুরীতে সহানুভূতিহীন মানবসমাজের দ্বারা পরিবৃত হয়ে আমরা ফুল, ঘাস, জল বা আকাশকে ভালবাসার চেষ্টা করি। বসন্তের নীল আকাশে দোদুল্যমান কচিপাতার চঞ্চলতায় আমাদের মনের সেই গোপন যোগটিকে খুঁজে পাই আমরা। নির্বাক বাতাসেও বাগবৈদগ্ধ আছে, নদীর ধারা আর মর্মরধ্বনির আছে একটা সুস্বন; যা হৃদয়ের সঙ্গে তাদের যোগসূত্রটিকে কাজে লাগিয়ে দেহে মনে এক রুদ্ধশ্বাস উচ্ছ্বাসের নৃত্য জাগিয়ে তোলে। রহস্যময় এক কোমল অনুভূতি চোখে জল এনে দেয়। যেমনটা হয় দেশপ্রেমীর সাফল্য অর্জনের সময় বা নির্জনে প্রিয়কণ্ঠে গান শোনার সময়। স্টার্ন বলেছেন, মরুভূমিকে থাকলে তিনি কয়েকটি সাইপ্রাস বৃক্ষ চাইতেন… যে মুহুর্তে এই আকাঙ্ক্ষা বা এই ক্ষমতাটির মৃত্যু হয়, সেই মুহুর্তে মানুষ তার জ্যান্ত লাশে পরিণত হয়। যা থাকে, তা কেবলমাত্র তার অতীত সত্ত্বার খোলসমাত্র।–

~*~

অনুবাদস্বত্ব অনুবাদক কর্তৃক সংরক্ষিত। এর কোনো অংশ অনুবাদকের অনুমতি ব্যতিরেকে কোনো ব্লগ, ওয়েবসাইট, মুদ্রণমাধ্যম বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা যাবে না।

© Arnab Dutta

 

 

ট্যাগ সমুহঃ ,

মন্তব্য করুন

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  পরিবর্তন )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  পরিবর্তন )

Connecting to %s

 
%d bloggers like this: