RSS

স্বার্থপর দৈত্য

06 ফেব্রু.
রচনা: অস্কার ওয়াইল্ড
ভাষান্তর: অর্ণব দত্ত

রোজ বিকেলে স্কুল থেকে ফেরার পথে ছেলের দল দৈত্যের বাগানে ঢুকে খেলা করে।

বেশ বড়োসড়ো সুন্দর বাগান। নরম সবুজ ঘাসে ভরা। ঘাসের মধ্যে এখানে ওখানে ফুটে রয়েছে তারার মতো সুন্দর সব ফুল। আর রয়েছে বারোটি পিচ গাছ। বসন্তকালে সেই গাছগুলিতে গোলাপি আর মুক্তো-রঙা ফুল দেখা দেয়, শরতে ধরে ফল। পাখিরা বসে সেই সব গাছের ডালে। গান গায়। তাদের গান এতই সুন্দর যে ছেলের দল খেলা থামিয়ে গান শোনে একমনে। নিজেদের মধ্যে বলাবলি করে, ‘আহা! আমরা এখানে কতই না সুখী!’

একদিন দৈত্য ফিরে আসে। সে তার বন্ধু কর্নিশ দানোর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিল। গিয়ে সাত বছর তার কাছেই থেকে যায়। বলার বিশেষ কিছুই ছিল না। তাই যা কিছু কথা সব সাত বছরের মধ্যেই ফুরিয়ে যায়। তখন সে নিজের প্রাসাদে ফিরে আসার কথা ভাবে। আর ফিরে এসে দেখে ছেলের দল তার বাগানে খেলা করছে।

‘কি করছিস তো এখানে?’ ভারি গলায় চিৎকার করে দৈত্য। ছেলের দল পালায়।

‘আমার নিজের বাগান আমার নিজেরই বাগান,’ বলে দৈত্য, ‘এই কথাটা সকলেরই জানা দরকার। আর আমি এখানে নিজেই খেলব, আর কাউকে খেলতে দেবো না।’ তাই সে বাগান ঘিরে একটা উঁচু পাঁচিল তুলল। আর একখানা বিজ্ঞপ্তি ঝোলাল।

বিনা অনুমতিতে প্রবেশকারীরা শাস্তি পাবে

ভারি স্বার্থপর দৈত্য সে।

হতভাগ্য ছেলেগুলোর আর কোনো খেলার জায়গা রইল না। তারা রাস্তায় খেলার চেষ্টা করল। কিন্তু রাস্তাটা ধুলো আর শক্ত নুড়ি-পাথরে ভরা। তাদের পছন্দ হল না। স্কুল ছুটির পর তারা সেই উঁচু পাঁচিলটার চারধারে ঘুরে বেড়াত। আর নিজেদের মধ্যে বলাবলি করত, “আহা! আমরা ওখানে কত সুখীই না ছিলাম!”

তারপর বসন্ত এল। সারা দেশে ছোটো ছোটো ফুল ফুটল। ছোটো ছোটো পাখি ডাকতে লাগল। কেবল সেই স্বার্থপর দৈত্যের বাগানে তখনও শীত। যেখানে ছেলের দল আর খেলে না সেখানে পাখিরাও গান গাইতে চাইল না। গাছগুলো ফুল ফোটাতে ভুলে গেল। একবার একটি সুন্দর ফুল ঘাসের মধ্যে থেকে মাথা তুলেছিল। কিন্তু বিজ্ঞপ্তিটা পড়ে তারও ছেলেদের জন্য মন খারাপ হয়ে গেল। সে আবার মাটির কোলে ফিরে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। একমাত্র বরফ আর তুষারের পোয়া বারো। ‘বসন্ত এই বাগানটাকে ভুলেছে,’ তারা বললে, ‘তাই আমরা এখানে সারা বছরই বসবাস করতে পারব।’ বরফ ঘাসগুলিকে একটা বিরাট সাদা আচ্ছাদনে ঢেকে দিল। তুষার গাছগুলোর গায়ে রুপোলি রঙ লাগিয়ে দিল। তারপর উত্তুরে হাওয়াকে নেমতন্ন করে ডেকে আনল তাদের সঙ্গে বসবাস করার জন্য। পশমের আলখাল্লা পরা উত্তুরে হাওয়া সারা দিন গর্জন করে নেচে বেড়াতে লাগল বাগানে। উপড়ে ফেলল চিমনিগুলো। ‘এ তো ভারি মজার জায়গা,’ বলল সে, ‘আমাদের ঝঞ্ঝাকে ডাকতেই হবে।’ ঝঞ্ঝা এল। রোজ তিন ঘণ্টা করে সে প্রাসাদের ছাদে নৃত্য করতে লাগল। জানলার আরশিগুলো আর গোটা রইল না। তারপর গায়ে যত আছে তত জোর খাটিয়ে সে বাগানে ছুটে বেড়াতে লাগল। তার পোষাক ছিল ধূসর, নিঃশ্বাস হিমেল ঠান্ডা।

‘বুঝতে পারছি না বসন্ত আসতে এত দেরি করছ কেন,’ জানলায় বসে শীতল সাদা বাগানটার দিকে তাকিয়ে বলে দৈত্য। ‘আশা করি, আবহাওয়ায় একটা পরিবর্তন আসবেই।’

কিন্তু বসন্ত আসে না। আসে না গ্রীষ্মও। শরৎ বাগানে বাগানে সোনালি ফল ভরিয়ে দেয়। কিন্তু দৈত্যের বাগানকে সে দেয় না কিছুই। বলে, ‘ও ভারি স্বার্থপর।’ তাই সেই বাগানে সর্বদাই রয়ে যায় শীত। উত্তুরে হাওয়া, ঝঞ্ঝা, তুষার আর বরফ নেচে বেড়ায় তার গাছে গাছে।

তারপর একদিন সকালে একটা ভারি সুন্দর সংগীতের সুর শুনে দৈত্যের ঘুম ভেঙে যায়। তার কানে সুরটা এতই মিষ্টি লাগে যে সে ভাবে বোধহয় রাজার বাদ্যকারের দল পাশের পথ ধরে চলেছে। আসলে একটা ছোট্ট লিনেট পাখি তার জানলার বাইরে বসে গান গাইছিল। দৈত্য অনেক দিন কোনো পাখির গান শোনেনি। তাই সেই সুরটা তার কাছে মনে হল বিশ্বের সবচেয়ে মিষ্টি সুর। তখনই তার মাথার উপর ঝঞ্ঝার নৃত্য বন্ধ হল, উত্তুরে হাওয়া তার গর্জন থামিয়ে দিল, খোলা জানলা দিয়ে ঘরে বয়ে এল এক অপূর্ব সুগন্ধ। ‘মনে হয়, বসন্ত এসেছে অবশেষে,’ দৈত্য লাফিয়ে উঠল শয্যা ছেড়ে। তাকাল বাইরে।

কী দেখল সে?

সে দেখল এক সুন্দরতম দৃশ্য। পাঁচিলের একটি ছোট্ট গর্ত ধরে হামাগুড়ি দিয়ে বাগানে ঢুকছে ছেলের দল। তারা বসে আছে সকল গাছের শাখায় শাখায়। সে দেখল প্রত্যেক গাছে একটি করে ছোটো ছেলে বসে। গাছগুলিও সেই শিশুদের ফিরে পেয়ে এত খুশি হয়েছে যে তারা নিজেদের ভরিয়ে দিয়েছে ফুলে ফুলে। তারা আলতো করে হাত বোলাচ্ছে সেই ছেলেদের মাথায়। পাখি উড়ছে। আনন্দে কিচমিচ করছে। ফুলেরা সবুজ ঘাসের বুকে মাথা তুলে হাসছে। ভারি সুন্দর দৃশ্য। কিন্তু বাগানের এক কোণে তখনও শীত। বাগানের সেই প্রত্যন্ত কোণে একটি ছেলে দাঁড়িয়ে। সে খুব ছোটো। তাই গাছের শাখার নাগাল পাচ্ছে না। গাছটার চারপাশে ঘুরছে আর করুণভাবে কাঁদছে। হতভাগ্য গাছটা তুষারে আর বরফে ঢাকা। মাথার উপর তার গর্জন করছে উত্তুরে হাওয়া। ‘এসো এসো, উঠে এসো, বাছা!’ বলছে গাছটা। সে তার শাখাগুলি যতদূর সম্ভব নামিয়ে দিয়েছে। কিন্তু ছেলেটা খুবই ছোটো।

দেখে দৈত্যের হৃদয় গলে গেল। ‘আমি কতই না স্বার্থপর!’ সে বললে; ‘এখন বুঝতে পারছি, কেন বসন্ত আমার বাগানে আসেনি। আমি ওই হতভাগ্য ছোটো ছেলেটিকে গাছের উপর তুলে দিই, তারপর পাঁচিলটা ভেঙে ফেলব। আর তার পর থেকে আমার বাগান চিরকালের জন্য হয়ে যাবে ছেলেদের খেলার মাঠ।’ সে তার কৃতকর্মের জন্য সত্যিই ভারি অনুতপ্ত হয়ে পড়েছিল।

সে নিচে নেমে এল গুড়ি মেরে। আলতো করে খুলল তার দরজা। কিন্তু ছেলের দল তাকে দেখেই ভয় পেয়ে পালিয়ে গেল। বাগানে আবার ফিরে এল শীত। কিন্তু সেই ছোটো ছেলেটি পালাল না। তার দুই চোখ জলে ভরে গিয়েছিল। তাই সে দেখতেই পায়নি যে দৈত্যটা আসছে। দৈত্যটা তার পিছনে এসে দাঁড়াল। তাকে আলতো করে তুলে নিল নিজের হাতে। বসিয়ে দিল গাছের ডালে। এক মুহুর্তে গাছটা ভরে উঠল ফুলে। পাখিরা ফিরে এল। গান গাইতে লাগল। ছোট্ট ছেলেটি দুই হাত বাড়িয়ে দৈত্যের গলা জড়িয়ে ধরে চুমু খেল তাকে। অন্য ছেলেরা যখন দেখল দৈত্যটা আর দুষ্টু নেই, তখন তারাও ফিরে এল। তাদের সঙ্গে এল বসন্তও। ‘ছোট্ট বাছারা, এখন থেকে এই বাগান তোমাদের,’ বলল দৈত্য। সে একটা বিরাট কুঠার নিয়ে পাঁচিলখানা গুঁড়িয়ে দিল। দুপুর বারোটার সময় হাট-ফেরতা লোকেরা দেখল তাদের দেখা সবচেয়ে সুন্দর এক বাগানে বসে দৈত্যটা ছোটো ছেলেদের সঙ্গে খেলা করছে।

সারা দিন খেলল তারা। সন্ধ্যাবেলা এল দৈত্যের কাছে বিদায় নিতে।

‘কিন্তু তোমাদের সেই ছোট্ট বন্ধুটি কোথায়?’ সে বলল। ‘সেই ছেলেটি যাকে আমি গাছে তুলে দিলাম।’ ছেলেটিকে দৈত্য বড়ো ভালবেসে ফেলেছিল। সে তাকে চুমু খেয়েছিল যে।

‘আমরা তো জানি না,’ ছেলের দল বলল। ‘সে চলে গেছে।’

‘তোমরা কিন্তু মনে করে তাকে কাল আবার আসতে বলো,’ দৈত্য বলল। কিন্তু ছেলের দল বললে যে তারা জানেই না যে সে কোথায় থাকে। আগেও কখনও তাকে দেখেনি। শুনে দৈত্যের মন খারাপ হয়ে গেল।

রোজ বিকেলে স্কুল ছুটির পরে ছেলেরা এসে দৈত্যের সঙ্গে খেলা করে। কিন্তু সেই যে ছেলেটিকে দৈত্য ভালবাসত তাকে আর কখনও দেখতে পায় না সে। দৈত্য সব ছেলের সঙ্গেই মধুর ব্যবহার করে। কিন্তু তার মনে সাধ তার সেই প্রথম ছোট্ট বন্ধুটিকে আবার দেখে। ‘আহা, তার সঙ্গে যদি একবার দেখা হত!’ মাঝে মাঝেই বলে সে।

বছর যায়। দৈত্য বুড়ো আর অথর্ব হয়ে পড়ে। খেলার সামর্থ তার আর থাকে না। সে একটা আরামকেদারায় বসে ছেলেদের খেলা দেখে আর বাগানের তারিফ করে। ‘আমার অনেক সুন্দর ফুল আছে,’ সে বলে। ‘কিন্তু এই ছেলের দলই সবচেয়ে সুন্দর ফুল।’

এক শীতের সকালে পোষাক পরতে পরতে সে বাইরে বাগানটা দেখছিল। এখন সে আর শীতকে ঘৃণা করে না। কারণ সে জানে শীতে বসন্ত ঘুমায়, ফুলেরা বিশ্রাম নেয়।

হঠাৎ পরম বিস্ময়ে সে তার চোখ রগড়াতে থাকে। বারংবার দেখে। কি অপূর্ব দৃশ্য! বাগানের এক কোণে সুন্দর সাদা ফুলে ঢাকা একটি গাছ, শাখাগুলি তার সোনালি, ডালে ডালে ঝুলছে রুপোলি ফল, আর তার নিচে দাঁড়িয়ে আছে সেই ছোটো ছেলেটি যাকে সে ভালবাসত।

মহানন্দে ছুটে নিচে নেমে আসে দৈত্য। বাগানে যায়। ছেলেটির কাছে আসে। কিন্তু কাছে আসতেই রাগে লাল হয়ে ওঠে তার মুখ। সে বলে, ‘কে তোমাকে আঘাত করিয়াছে?’ শিশুর দুই হাতে পেরেকের ক্ষতচিহ্ন, ছোটো ছোটো দুটি পায়েও পেরেকের ক্ষতচিহ্ন।

‘কে তোমাকে আঘাত করিয়াছে?’ দৈত্য চিৎকার করে বলে, ‘আমাকে বল, আমি তাহাকে এই বিরাট তরবারির আঘাতে হত্যা করিব।’

‘না!’ শিশুটি বলে, ‘এ যে প্রেমের ক্ষতচিহ্ন!’

‘কে তুমি?’ দৈত্য বলে। এক ভয় গ্রাস করে তাকে। সে শিশুটির সামনে বসে পড়ে হাঁটু গেড়ে।

শিশুটি দৈত্যের দিকে তাকিয়ে হাসে। বলে, ‘একদিন তুমি আমাকে তোমার বাগানে খেলতে দিয়েছিলে, আজ তুমি আমার সঙ্গে এস আমার বাগানে, যা স্বর্গোদ্যান।’

সেদিন বিকেলে ছেলের দল এসে দেখল গাছতলায় পড়ে আছে দৈত্যের মৃতদেহ, সারা শরীর তার সাদা ফুলে ঢাকা।

 

ট্যাগ সমুহঃ

মন্তব্য করুন

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  পরিবর্তন )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  পরিবর্তন )

Connecting to %s

 
%d bloggers like this: